অনেককাল আগের কথা! এককালে সেখানে বানিজ্য হতো, বিরাট হাট বসতো। দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা আসতো। সপ্তাহের একদিনের সেই হাটে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। দুপুরের পর হাট বসতো আর সাঙ্গ হতো রাত্রি একটা দুইটায়। এখন আর হাট বসেনা সেখানে।
ধান হয় পাট হয় আখ হয়। এখন সেটা হাটখোলার বন বলে পরিচিত। যখন হাট বসতো আশেপাশে কোনো জনবসতি ছিলোনা কমপক্ষে আজ থেকে প্রায় আড়াই তিনশো বছর আগেই সেখানটায় হাট বসা বন্ধ হয়ে গেছে৷ হাট সংলগ্ন বড় খাল ছিলো যেটা বড় এক নদীর সাথে মিশেছিলো। এখন আর সেই খাল নেই, কিছু কিছু জায়গায় খালের সেই রেখা ড্রেনের মতো আছে কিন্তু একটা সময় সেই খাল দিয়ে হাট পর্যন্ত বড় বড় পানসি, জাহাজ, লঞ্চ, স্টীমার আসতো পণ্য আনানেয়া করতো। এখন হাটের চারপাশে বাড়িঘর, জনবসতি, কিন্তু সেইসময় নাকি আশেপাশে কোনো বাড়িঘরই ছিলোনা তেমনি এক হাটবারের কথা। তখন বর্ষাকাল। সপ্তাহের হাটের দিন, তয় বর্ষার কারনে জমজমাট নয় খুব একটা কারণ থেকে থেকে বৃষ্টি। থামে তো আবার পড়া শুরু করে। তখনকার সময়ে মানুষজন নাকি রাতে মাছ নিতো। আমার দাদা, দাদার বাপেরাও ধামাভরে মাছ নিতো রাত বারোটা একটায়।
সেই রাতেই মাছ কেটে কুটে রান্না করতো খেয়ে দেয়ে তারপর তারা ঘুমোতে যেতো। তো সেদিনের সেই হাটের দিনে তত লোকজন হয়নি। বেচাকেনারও সেরকম জাঁকজমকতা নেই। এদিকে রাত হয়ে এলো ঝুপ ঝুপ বৃষ্টিও পড়ছে থেমে থেমে। হাটে যারা পণ্য বিক্রয় করতে আসতো তারা আবার অবিকৃত মালামাল ফেরত নিয়ে যেতো। যারা দূর দূরান্ত থেকে আসতো তারা নৌপথে নিয়ে যেতো আর যারা ছোট ব্যবসায়ী কাছের ব্যবসায়ী তারা মাথায় করে নিয়ে যেতো তাও একেবারে কাছের পথ ছিলোনা! সেরকমই দূর গাঁয়ের এক ছোট ব্যবসায়ী সোলেমান মিয়া ওরফে সোলেমান মাঝি, লোকে তাকে সোলেমান মিয়া বলেই ডাকতো।
বয়স তখন ত্রিশের মতো, সে মাছ বেঁচতো। সেদিন তার সব মাছ বিক্রি হয়নি, তাই সে অনেকরাত পর্যন্ত হাটে বসা ছিলো যদি বিক্রি হয় এই আশায়। নাহলে তো মাছগুলো পঁচে যাবে হাট আসতে আসতে আবার সপ্তাহখানেক পর। এদিকে হাটে আসা মানুষজন কমতে লাগলো রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে। সোলেমান মিয়া একা একা আর কত বসে থাকবে যে কয়জন ব্যাবসায়ী আছে তাদের বাড়ির পথ অন্যদিকে কাজেই সোলেমান মিয়াকে একাই তার বাড়ির পথে এগুতে হবে। সবুরে মেওয়া ফলে, অপেক্ষার পর কিছু মাছ বিক্রি হলো কিন্তু সব নয়! যাক সোলেমান মিয়া তাতেই খুশি। বাকী যা রয়ে গেলো তা পরিমিত, যা সে পরিবারের জন্য রাখলেও ব্যবসায়িক খুব একটা ক্ষতি হবেনা ; পুষে যাবে। এবার সোলেমান মিয়া হাটের পাট চুকিয়ে মাছের ঝাঁকি মাথায় নিয়ে লুঙ্গীতে কাছা দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো রাত তখন একটার কম নয়।। পায়েচলার পথ, বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাও রাত্রি দুইটা বেজে যাবে তারওপর আবার বর্ষাকাল। বর্ষাকালের পথ এতটা সুগম হয়না।
হাট পেরুতেই বৃষ্টি শুরু হলো ; তুমুল বৃষ্টি, সেই বৃষ্টিতে মশাল টিকেনা! এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সোলেমান মিয়া অন্ধকারেই পা টিপে টিপে পথ চলতে লাগলো। অনেকটা পথ আসার পর বাঁশঝাড়ের একটা বাঁশ আচমকা পথের মধ্যে পড়ায় তার চলা থেমে গেলো! কাছে যেতেই তার চোখ ছানাবড়া। এখন, এতরাতে আবার কার জানাজা! খাটিয়া, লাশ, সাদা কাপড়, সাথে দু চারজন অদ্ভুত প্রকৃতির লোক। ওরা সোলেমান মিয়াকে বললো মৃত লোকটির জানাজা পড়ে যেতে। এত রাতে আবার কিসের জানাজা তাও আবার বাঁশঝাড়ের ভিতর সাত পাঁচ ভাবতেই ওদের একজন বলে ওঠলো সন্ধ্যায় মারা গেছে তাই রাতেই জানাজা পড়ে দাফন করতে হবে। সোলেমান মিয়ার শরীরে মাছের আঁশটে গন্ধ, সারাবেলা মাছ বিক্রি করেছে ওরা বললো অসুবিধা নেই।
দ্বিরুক্তি না করে সোলেমান মিয়া তাদের কথায় সায় দিয়ে পাশে মাছের ঝাঁকিটা রেখে কাতারে সামিল হলো। সালাম ফিরিয়ে দেখে কেউ নেই, না লাশ, না খাটিয়া না কেউ। সোলেমান মিয়া একটু ভয় পেলো। সেই মুহূর্তে সে অট্টহাসি শুনতে পেলো, তাকাতেই সে দেখতে পেলো একেকটা মানুষ যেন একেকটা রাক্ষস, ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি। বাশের ডগায় দাড়িয়ে মাছের ঝাঁকা হাতে নিয়ে মাছ খাচ্ছে। এসব দেখে সোলেমান প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে কিন্তু তার পা যেনো নড়ছেনা মনে হচ্ছে একই জায়গায় দৌড়াচ্ছে। পরদিন যখন সোলেমান মিয়ার হুশ হলো চারদিকে প্রচুর লোক তারা নাকি সোলেমান মিয়াকে হাটের মধ্যে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বাড়িতে নিয়ে আসছে।
সোলেমান মিয়া হাটের পথেই দৌড়াচ্ছিলো কিন্তু তার হুশ ছিলোনা। তার শরীরে অদ্ভুত অদ্ভূত আঁচড় ছিলো এগুলো দেখে সে আরও ভয় পেয়ে গেলো। মাঝরাত্তিরে ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠতো প্রায় সময়, উদ্ভট আচরণ করতো। যেনো কেউ তার ওপর ভর করতো, কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতো এবং একটা নয় যখন খেতো বেশ কয়েকটা খেতো। ভয় আর আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে ফেলছিলো, সোলেমান মিয়ার আর কোনোদিন হাটে যাওয়া হয়নি এই ঘটনার পর থেকে। মাঝরাতে সেই বাঁশঝাড়ে গিয়ে বসে থাকতো, একাই হাসতো, কথা বলতো। তার জীবনটা একটা ঘটনার পর থেকে সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেলো, অস্বাভাবিক হয়ে গেলো। এমনি করে বহুদিন ভোগার পর অবশেষ একদিন সোলেমান মিয়া ইহলোক ত্যাগ করলো ।
(সমাপ্ত)