ওঃ, সেবার কী বিপদেই পড়েছিলাম। বিদেশবিভূঁইয়ে জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল! পাঠকদের উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখার জন্য সে-ঘটনা পরে বলব। আগে কবিতার আসরের কথা।
গত আশির দশকে বিশ্বের নানান দেশে ভারত-উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। আমেরিকা, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, (তখনও দুই জার্মানির মিলন হয়নি) সুইডেন ইত্যাদি অনেক দেশেই ভারত উৎসব উদযাপিত হয়েছে। গান-বাজনা, নাচ, শিল্পকলার প্রতিনিধি দলকে যেমন পাঠানো হয়েছে তেমন সাহিত্যিকদের প্রতিনিধি দলও সেইসব উৎসবে স্থান পেয়েছে।
এই প্রতিনিধিদলে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কবিরাই বেশি সৌভাগ্যবান। গল্প উপন্যাস লেখকরা কিছুটা বঞ্চিত।
কবিরা পাঁচ-সাত মিনিট মাত্র সময় নিয়ে দু-তিনটে কবিতা পড়ে দিতে পারেন। ঔপন্যাসিকরা তো আর উপন্যাস পড়তে পারবেন না। এমনকি একটা ছোটগল্প পাঠ করতেও অন্তত তিরিশ-চল্লিশ মিনিট তো লাগবেই। কজনকে সে সুযোগ দেওয়া যায়? যতদূর জানি, শুধু জার্মানিতেই একটি গদ্য লেখকের দল পাঠানো হয়েছিল।
আমার সুবিধে এই, আমি কবি কিংবা গদ্য লেখক, যে-কোনও দলেই ভিড়ে যেতে পারি।
সেবারে যাওয়া হল, পাশাপাশি দুটো দেশে। চেকোশ্লোভাকিয়া আর বুলগেরিয়া। এখন চেকোশ্লোভাকিয়া ভেঙে চেক আর শ্লোভাকিয়া নামে দুটো দেশ হয়ে গেছে। আগে দেশটা ভাঙেনি। তবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের লক্ষণ আমাদের চোখে পড়েছে।
প্রথমে আমরা গেলাম বুলগেরিয়ার রাজধাবী সোফিয়া শহরে। বুলগেরিয়া ছোট দেশ, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ কম বলে আমরা ওদেশ সম্পর্কে
বিশেষ কিছু জানি না। সোফিয়া নামটি ভূগোল বইয়ের পৃষ্ঠায় দেখেছি, কেউ সেখানে ভ্রমণেও গেছে বলে শুনিনি।
বুলগেরিয়া একটি গরিব দেশ, মাংসের দোকানের সামনে বিরাট লাইন চোখে পড়ে। অর্থাৎ সপ্তাহে প্রতিদিন সেখানে মাংস পাওয়া যায় না। আর লম্বা লাইনের শেষের দিকে যারা দাঁড়ায়, তাদের নিরাশ হতে হয়।
কিন্তু সোফিয়া শহরটি দৃশ্যত খুব সুন্দর। খুবই সবুজ, মনে হয় যেন গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি শহর।
আমরা দলে ছ’জন, তার মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট মহারাষ্ট্রীয় কবি অরুণ কোলাতকার। ইনি ইংরেজি ও মারাঠি দু-ভাষাতেই লিখতেন, সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। হিন্দি কবি মঙ্গেশ দেবরানও ছিলেন। আর তিনজন গুজরাতি, মালায়ালম ও কন্নড় ভাষার। সবার নাম মনে নেই। সেই সময়কার কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেছি।
আর বুলগেরিয়ার কবিদের নামও হারিয়ে গেছে সেইসব কাগজপত্রের সঙ্গে।
তবে এঁদের মধ্যে যিনি প্রধান কবি, তিনি দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীও বটে। তিনি আমার নাম শুনে প্রথমেই জিগ্যেস করলেন, আপনি ব্রাহ্মণ?
আমি চমকে উঠলাম। গঙ্গোপাধ্যায় উচ্চারণ করতেই বিদেশিদের দাঁত ভেঙে যায়। গাঙ্গুলি বরং সহজ, কিন্তু কোথাও গাঙ্গুলি ব্যবহার করি না। আমরাও তো বিদেশিদের কত শক্ত নাম শিখে নিই।
তাঁকে জিগ্যেস করলাম, আপনি কী করে বুঝলেন?
তিনি বললেন, বাঃ গঙ্গা প্লাস উপাধ্যায়। উপাধ্যায় মানে শিক্ষক। একসময় ভারতের ব্রাহ্মণরাই তো শিক্ষক হতেন, তাই না? আমার নিশ্চয়ই গঙ্গা তীরবর্তী কোনও অঞ্চলে বাস!
ইনি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। সেই তুলনায় আমি বুলগেরিয়া সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
এই দেশটি বেশ কয়েক শতাব্দী তুরস্কের অধীনে ছিল। সেইজন্য অনেক বাড়িঘরে, ভাষা, জীবনযাত্রায় এবং রান্নায় তুরস্কের প্রভাব থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। বেশ কিছু তুরস্কের মানুষ এখনও এদেশে থেকে গেছে।
কিন্তু কথাবার্তায় বোঝা যায় একালের বুলগেরিয়ানরা তুর্কিদের একেবারে পছন্দ করে। এককালে আমাদের যেমন ইংরেজ-বিদ্বেষ ছিল। তবে অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁতেই টার্কিশ রান্নার নানান পদ পাওয়া যায়। আমাদের চোখে সেগুলি খুব সুস্বাদু লাগে। কারণ মোগলাই রান্না কিংবা উত্তর ভারতীয় রান্নার সঙ্গে খানিকটা মিল আছে।
বুলগেরিয়া থেকে আমরা এলাম চেকোশ্লোভাকিয়ায়।
এখানেই বেশিদিনের প্রোগ্রাম। কয়েকটি শহরে যাওয়ার কথা।
আগেই বলেছি, চেক ও শ্লোভাকিয়া তখন একসঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ঠিক যেন সুয়োরানি ও দুয়োরানি। এরই মাঝখানে বোহেমিয়া নামে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। বোহেমিয়ান শব্দটি এখনও টিকে আছে, কিন্তু ওই নামের রাজ্যটি এখন অবলুপ্ত।
দুদিকেই গিয়েই আমরা দুরকম ক্ষোভের কথা শুনেছি।
চেক অংশের বুদ্ধিজীবীরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং রাশিয়ার দাদাগিরি সহ্য করতে পারছে না। এক বছরের মধ্যেই সেখানে সমাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
আর শ্লোভাকিয়ার বিদ্বজ্জনের অভিযোগ, সমস্তরকম সুযোগসুবিধা চেকরা নিয়ে নেয়। শ্লোভাকরা বঞ্চিত, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মতো ব্যাপার। আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অনেক জিনিসই পাওয়া যায় না। একজন বেহালাবাদক আমাকে প্রায় কান্নাভরা গলায় বলেছিল, তোমাদের দেশে গেলে আমাকে আশ্রয় দেবে? আমার আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে ভালো লাগে না।
এর কোনও উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
চেক সাহিত্য খুবই উন্নত। বাংলা ভাষারও চর্চা হয়। কয়েকজন বাংলা সাহিত্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছেন। অনুবাদও করেন প্রচুর। আমায় একটা ছোটগল্পের বইয়ের অনুবাদ সংকলন আগেই বেরিয়েছে এখান থেকে।
প্রাগ শহর (স্থানীয় উচ্চারণ প্রাহা) বেশ অভিজাত ধরনের। কিছু-কিছু বাড়িঘর অত্যন্ত দর্শনীয়। আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ফ্রানৎস কাফকার বাড়ি। অকালমৃত এই তরুণ লেখককে আমরা যৌবন বয়েসে মাথায় তুলে রাখতাম।
কাফকা প্ৰাগের অধিবাসী ছিলেন, কিন্তু চেক ভাষার লেখক ছিলেন না। তাঁর সাহিত্য জার্মান ভাষায় রচিত। প্রথমত ইহুদি, তা ছাড়া এই দেশে থেকেও লেখেন অন্য ভাষায়। তাই তাঁকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।
আন্তর্জাতিকভাবে কাফকাই এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক। তাঁর বাড়ি দেখতে বহু ট্যুরিস্ট যায়। কিন্তু কয়েকজন তরুণ লেখকের মুখে শুনলাম কাফকার রচনা এদেশে নিষিদ্ধ।
প্রকাশকদের এক আলোচনাচক্রে আমি ফস করে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কাফকার বই নিষিদ্ধ করেছেন ঠিক কী কারণে?
ওঁদের সভাপতি বিস্ময়ের ভান করে বললেন, নিষিদ্ধ নয় তো!
আমি আবার বললাম, আমি দোকান থেকে কাফকার বইগুলো কিনতে পারি?
ওঁরা কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে বললেন, এখন কিনতে পারবেন। আউট অফ প্রিন্ট!
আমি নাছোড়বান্দা। পরের প্রশ্ন : কতদিন ধরে আউট অফ প্রিন্ট রয়েছে?
এবারেও উত্তর, বেশ কিছুদিন ধরে। প্রায় কুড়ি বছর।
আমি হেসে ফেললাম।
তখন ওখানে সব প্রকাশনাই সরকার-নিয়ন্ত্রিত। কুড়ি বছর আউট অফ প্রিন্ট রাখা তো নিষিদ্ধ করারই সমান। কেন যে এরকম বোকামি করা হত ওইসব রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করে কি কোনও বইকে আটকানো যায়?
পরে আমি দেখেছি, নদীর ধারে ঘাসের ওপর শুয়ে ছাত্রছাত্রীরা কাফকার বইয়ের জেরক্স কপি পড়ছে অনেকে মিলে, আগ্রহের সঙ্গে। মিলান বুন্দেরার বইও পাওয়া যেত দোকানে। চেকোশ্লোভাকিয়ায় আমাদের কাব্যসভা বাতিল হয়ে গেল। সরকারি প্রতিনিধিদের অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো হয়, একদিন থাকে সাহিত্যের জন্য। নির্দিষ্ট দিনটিতে সকালবেলা হঠাৎ জানিয়ে দেওয়া হল, কবিতা পাঠ আর হবে না, কারণ সেদিন কিছু একটা ছুটির দিন পড়েছে। কেউ আসবে না।
সরকারি ছুটির দিন বলে কেউ সাহিত্যসভায় আসবে না, এরকম আগে শুনিনি।
ওঁদের সকলের মধ্যেই কেমন যেন একটা অস্থির ভাব। আমাদের আতিথ্য দেওয়ার মধ্যেও কেমন যেন একটা দায়সারা ভাব।
তখন বুঝিনি, এর কারণ ছিল, আসন্ন ঝড়ের জন্য অধিকাংশ মানুষের উদবেগ। রাষ্ট্রব্যবস্থা পালটাতে যাঁরা চাইছেন তাঁদের মতে বিপদের আশঙ্কাও রয়েছে।
এবার সেই বিপদের কথা।
আমি আগেও কয়েকবার দেখেছি, সরকারি প্রতিনিধি হয়ে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁরা নির্দিষ্ট কর্মসূচির পরেই দেশে ফিরে আসেন। নিজের উদ্যোগে আর কোথাও যান না।
আমি সবসময়, পাশের দু-একটা দেশ দেখে আসতে চাই। বিমানভাড়া তো অতিরিক্ত লাগে না। অন্য খরচ কোনওক্রমে কুলিয়ে যায়।
এবারেও আমি ঠিক করে এসেছিলাম, সরকারি খরচে তো বুলগেরিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া দেখা হয়ে যাবেই, এই সুযোগে একবার ইস্তানবুল ঘুরে আসতে চাই।
ইস্তানবুল যার আগেকার নাম কনস্টান্টিনোপল, একটি বিস্ময়কর শহর। ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে যেন এক সোনার খনি। পৃথিবীতে এই একমাত্র শহর, যার অর্ধেকটা ইউরোপে, অর্ধেকটা এশিয়ায়। একই শহর দুই মহাদেশে ভাগ করা। এ-শহর যিশুর আমলের চেয়েও প্রাচীন।
ইস্তানবুল ঘোরার জন্য আমি আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলাম। অন্যান্য প্রনিনিধিরা সবাই দিল্লি ফিরে আসবেন, তাঁদের ফ্লাইট দুপুর একটায়, আর আমার প্লেন ভোর ছ’টায়।
সুতরাং অন্যদের কাছ থেকে আমি আগের রাত্রেই বিদায় নিয়ে ভোরবেলা কারুকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একা, একটা ট্যাক্সি করে।
যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমি মালপত্র বুক করে নিলাম। তারপর লাইনে দাঁড়িয়ে পৌঁছোলাম কাস্টমস আর ইমিগ্রেশান কাউন্টারে। সেখানকার অফিসার আমার পাসপোর্টটা উলটেপালটে অনেকক্ষণ ধরে ভুরু কুঁচকিয়ে দেখলেন আর বারবার তাকাতে লাগলেন আমার মুখের দিকে।
তারপর পাসপোর্টে আমার ছবির পাতাটা খুলে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইজ দিস ইয়োর পাসপোর্ট?
জীবনে অত বিস্মিত বোধহয় হইনি আগে। দড়াম করে কেউ যেন আমার বুকে একটা ঘুসি মারল।
পাসপোর্টের ছবিটি আমার নয়! হিন্দি লেখকটির।
অফিসারটি নরম গলায় বললেন, নকল পাসপোর্ট নিয়ে ঘোরা কতটা বেআইনি জানো তো? এক্ষুনি সিকিউরিটির লোক ডেকে তোমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত। তারপর জেল তো হবেই।
আমি চরম উজবুকের মতন হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অফিসারটি আবার বললেন, আমি তোমাকে ছেড়ে দিলেও কোনও লাভ হবে না। তুমি এই ছবি নিয়ে ইস্তানবুলে ঢুকতে পারবে না। এমনকি তুমি নিজের দেশে গেলেও অন্যের পাসপোর্ট সঙ্গে রাখার জন্য তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে। এখানেও প্লেনে ওঠার আগে তোমার এই বিপদ হতে পারে।
আমি তবু চুপ করে রইলাম।
সহৃদয় অফিসারটি বললেন, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বুঝতে পারছি। আমি একটা কাজ করতে পারি। তোমার ফ্লাইটটা ছাড়তে এখনও পঞ্চাশ মিনিট সময় আছে। এর মধ্যে যদি তোমার নিজের পাসপোর্ট জোগাড় করে আনতে পারো, দ্যাখো! তা ছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই!
সেখান থেকে সরে এসে আমি একটুক্ষণ চিন্তা করতে লাগলাম। হোটেল থেকে ট্যাক্সিতে আসতে ফাঁকা রাস্তায় আমার সময় লেগেছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সুতরাং এখান থেকে আবার ট্যাক্সিতে গিয়ে ফিরে আসার সময় নেই।
আমার মালপত্র জমা পড়ে গেছে, তা চলে যাবে ইস্তানবুলে।
এই ফ্লাইটটা মিস করলে আমি আবার কোনও ফ্লাইট পাব কি না জানি না।
চেকোশ্লোভাকিয়ায় আমার ভিসা সেদিনই শেষ। যদি এখানে আরও দু-একদিন থেকে যেতেও হয়, ভিসা ছাড়া থাকব কী করে? সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সেদিন রবিবার। সব সরকারি অফিস বন্ধ। ভারতীয় দূতাবাস থেকেও কোনও সাহায্য পাওয়ার উপায় নেই।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর কাকে বলে?
মরিয়া হয়ে হোটেলে ফোন করলাম। কোনও লাভ হল না। এত সকালে কাউন্টারে একটিমাত্র লোক থাকে। সে একবর্ণ ইংরেজি বোঝে না। আমার উত্তেজিত অভিযোগের সে কোনও গুরুত্বই দিল না। ফোন কেটে দিল।
আমার এরকম ভুল হল কেন? আমি এত দেশে ঘুরে বেড়াই, পাসপোর্ট নিয়ে এমন গণ্ডগোল তো আগে কখনও হয়নি।
আসলে দোষটি হোটেলের এবং আমারও।
সেসময় সোস্যালিস্ট দেশগুলি পাসপোর্ট ছাপ মেরে ভিসা নিত না। অন্য একটি ছবি সমেত কাগজই ছিল ভিসা। দেশ ছাড়ার সময় সেটা নিয়ে নিত। আর সব হোটেলেই পাসপোর্ট জমা রাখতে হত। পশ্চিমি দেশগুলোতে এসব ঝঞ্ঝাট নেই।
এই হোটেলের লোকটা আমার ভিসার কাগজটা অন্য একজনের পাসপোর্টে খুঁজে রেখেছে। এটা ওদের দোষ। আর আমিও ভিসার কাগজে আমার ছবিটা দেখেই তাড়াহুড়োর মধ্যে পাসপোর্টটা নিয়ে এসেছি। পাসপোর্টটা খুলে পরীক্ষা করে আনা হয়নি।
দ্রুত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি, আর কিছু করা সম্ভব নয়। চেকোশ্লোভাকিয়া দেশেই আমাকে কতদিন কাটাতে হবে কে জানে। এদিকে ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য পুজো সংখ্যার উপন্যাসের অর্ধেক রয়েছে আমার লাগেজে।
হঠাৎ অলৌকিক কিছু ঘটার মতন আমার সামনে যেন একটা আলো জ্বলে উঠল। দেখতে পেলাম এক মহিলাকে।
এর নাম ব্লাঙ্কা। কয়েকদিন ধরে এই ব্লাঙ্কা ছিল আমাদের গাইড। কাল সন্ধের পর তার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। আজ সকালে সে এয়ারপোর্টে এসেছ অন্য দেশের ডেলিগেটদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।
সত্যি কথা বলতে কী, এই ব্লাঙ্কাকে নিয়ে এই ক’দিন আমরা আড়ালে অনেক হাসিঠাট্টা করেছি। অরুণ কোলাতকার কপাল চাপড়ে বলেছিল, এই আমাদের গাইড? হায় রে! এ যেন খ্যাংড়া কাঠির ওপর আলুর দম!
মেমদের মধ্যে এরকম অসুন্দর আগে কখনও দেখিনি। এত রোগা যেন বাতাসে উড়ে যাবে। বুক নেই, নারীসুলভ লালিত্য কিছুই নেই। একটুও হাসে না। এই কাজ করতে গিয়ে সে খুব কম মাইনে পায়, তা-ও একবার জানিয়েছিল।
এখন তাকেই আমার মনে হল দেবদূতী। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে হুড়হুড় করে আমার বিপদের কথা জানালাম।
ব্লাঙ্কা সব শুনে বলল, তুমিও দোষ করেছ। হোটেলও দোষ করেছে। এখন আমি সব দোষ হোটেলের ওপরই চাপাচ্ছি। বেআইনি কাজের জন্য ওদের শাস্তির ভয় দেখাতে হবে।
একটা টেলিফোন বুথে গিয়ে ব্লাঙ্কা খুব ধমকের সুরে উচ্চকণ্ঠে কত কী যেন বলল ওদের।
তারপর বেরিয়ে এসে বলল, ওদের বলেছি পাসপোর্টটা পাঠিয়ে দিতে। ওদের নিজস্ব গাড়ির ড্রাইভার এখনও আসেনি। একটা ট্যাক্সিতে পাঠাবে। সে-ভাড়াও ওরাই দেবে। তুমি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করো। আরও চল্লিশ মিনিট সময় আছে, আশা করি পেয়ে যাবে।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে, সে বলল, দাঁড়াও, দ্যাখো আগে ঠিকঠাক পাও কি না। ওদের বলেছি এক মিনিটও দেরি করবে না। কিন্তু সবাই আজকাল কাজে ফাঁকি দেয়। আমার নতুন অতিথিরা এক্ষুনি নামবে। আমি সেখানে যাচ্ছি। তুমি যদি ঠিক সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট না পাও, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি ফিরে এসে দেখব। তখন কী করা যায়।
দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। সে কী অধীর প্রতীক্ষা! কোনও প্রেমিকার অপেক্ষাতেও কখনও এত ব্যাকুল হয়েছি কি?
ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে চিনবে কী করে?
একটার পর একটা ট্যাক্সি আসছে, আমি হাঁ করে দেখছি। ক্রমশ জায়গাটা জ্যাম হয়ে যাচ্ছে।
একসময় দেখি, দূরে একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার জানলা দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে আছে। সেই হাতে একটা পাসপোর্ট। আমি তার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে অন্য পাসপোর্ট আর দশটা ডলার গুঁজে দিলাম তার হাতে।
ব্লাঙ্কা কাছাকাছি কোথাও নেই। আর মাত্র সাত মিনিট বাকি। ব্লাঙ্কাকে আর ধন্যবাদ জানানো হল না। দৌড়োলাম ইমিগ্রেশান কাউন্টারের দিকে।
তারপর ইস্তানবুলে গিয়ে কী হল, সে তো অন্য গল্প!