মে মাসে মালদায় প্রধান দ্রষ্টব্য আম। ফরাক্কা সেতু ছাড়বার খানিক পরেই চোখ টানে দুপাশের সব আমবাগান। এত আম! এ বছর বোধহয় এদিকে তেমন ঝড় বা শিলাবৃষ্টি হয়নি, গাছগুলি একেবারে ফলে ভরতি। সারা পশ্চিমবাংলায় এত আম আর কোথাও হয় না। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর-মজিলপুর থেকে বারুইপুর পর্যন্ত অঞ্চলটার নানরকম ফলের খ্যাতি আছে। এবারে দেখেও এসেছি। কিন্তু তা মালদার তুলনায় কিছু না। মুর্শিদাবাদের আমবাগানও অনেক হার মেনে যায়। মালদার আমবাগানগুলি ঝকঝকে তকতকে, কোনও কোনও গাছের আম ভরতি ডাল এত নীচু যে রাস্তা থেকেও হাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নেওয়া যায়। কেই নিচ্ছে না অবশ্য। এই আমবাগানগুলি নিশ্চয়ই ব্যাবসায়ীদের কাছে জমা দেওয়া। কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তাদের পাহারাদার। এই সময়টায় আম এখানকার অর্থনীতিতে একটা বড় ভূমিকা নেয়। মাঝেমাঝে লিচু বাগানও রয়েছে।
বিদেশে গিয়ে আমরা রাস্তার ধারেধারে আপেল-আঙুর ফলে থাকতে দেখে বিস্মিত হই, এখানকার হাজার হাজার গাছে আম আর লিচুর দৃশ্যও কম সুন্দর নয়। আপেল সম্পর্কে নানান ভুল খ্যাতি এতদিন প্রচলিত ছিল, কিন্তু স্বাদে ও খাদ্যগুণে আম আপেলের চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট। আমি অবশ্য আম বা আপেল কোনওটারই ভক্ত নই, তবু একসঙ্গে এত ফলবান গাছ দেখলে মুগ্ধ হতেই হয়।
মালদার অন্য দ্রষ্টব্য হল গৌড় ও পাড়ুয়া। বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের চিহ্ন প্রায় বিশেষ কিছুই নেই, যা আছে, তার মধ্যে গৌড়, ও পাণ্ডুয়ার পুরাকীর্তি এবং ধ্বংসাবশেষ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অথচ পর্যটন দপ্তর এগুলি সম্পর্কে এত উদাসীন কেন? হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় কোথা দিয়ে ঢুকতে হবে, তার কোনও পথ নির্দেশ নেই, মসজিদ-মিনারগুলির কোনও রক্ষক নেই, ঐতিহাসিক পরিচিতিগুলি এক কালে যা লেখা ছিল, তা অনেক জায়গায় মুছে গেছে। এই অবহেলা দেখে মর্মপীড়া হয়। মনে হয়, এখানে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে
গা ঠেলাঠেলির ব্যাপার আছে। লুকোচুরি দরওয়াজা, চাকনা মসজিদ, লিটন মসজিদ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম সীমান্তে। গৌড়ের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশেও পড়েছে, কিন্তু তা তার দেখবার উপায় নেই। ছোট একটা রাস্তার ওপর আড়াআড়ি একটা ডান্ডা বাসিয়ে লেখা আছে, প্রবেশ নিষেধ। বসে আছে একজন মাত্র তেলতেলে চেহরার রক্ষী, সে একজন কালো চশমা পরা লোকের সঙ্গে কী নিয়ে গল্প করছে কে জানে। কাছাকাছি মাঠ-ঘাট দিয়ে যে কেউ এপারে-ওপারে আসা যাওয়া করতে পারে, সেরকম, ভাবে আসছে যাচ্ছে নিশ্চয়ই অনেকে, শুধু আমরা যারা আইন মেনে চলি, তাদের জন্যই প্রবেশ নিষেধ-এর কাঠোর নির্দেশ।
গৌড়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বারো দুয়ারী বা বড় সোনা মসজিদ-এর রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাস্তায় একজন প্রৌঢ় মুসলমান চাচীকে জিগ্যেস করতে সে খুব সুন্দরভাবে রামকেলী গ্রামের রাস্তা বুঝিয়ে দিয়ে, একটু থেমে, জোর দিয়ে বললেন, ওখানকার মন্দিরটাও দেখে আসবেন। প্রৌঢ়টির এই কথা খুব স্বাভাবিক বলেই গণ্য করা উচিত, কিন্তু পরে পাণ্ডুয়াতে গিয়ে অতি বিখ্যাত আদিনা মসজিদ দেখতে গিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে খানিকটা অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা লক্ষ করেছি। আদিনা মসজিদে বৌদ্ধ ও হিন্দু ভাস্কর্যের ছাপ স্পষ্ট। বুদ্ধমূর্তি এবং হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি ঘষে ঘষে মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও এখনও অনেক চিহ্ন বেশ ভালোভাবেই রয়ে গেছে। এমনকী মেহরাবের পাশে রয়েছে হিন্দু ধর্মীয় মোটিফ। রাজা গনেশের ছেলে যদি এক মুসলমান নবাব নন্দিনীর প্রেমে পড়ার পর ধর্মান্তরিত হয়ে জালালুদ্দিন হন, এরকম এক আধা ইতিহাস মিশ্রিত কিংবদন্তী জড়িয়ে আছে এই মসজিদের সঙ্গে। এটা মিশ্র সংস্কৃতির একটা চমৎকার নিদর্শন। হিন্দু মন্দির ভেঙে মুসলমানের মসজিদ তৈরি হয়েছে শুনলেই অনেক হিন্দুর ইদানিং রক্ত গরম হয়, কিন্তু তারা ভুলে যায় যে আগে বৌদ্ধ মন্দির বা স্কুপও ভেঙে এক সময় জবর দখল করেছে হিন্দুরা। ভাঙা-গড়া নিয়েই তো ইতিহাস। কিন্তু আদিনা মসজিদ গিয়ে কয়েকবার ঘোঁট পাকিয়েছে কোনও এক গোঁড়া হিন্দু সংস্থা। স্থানীয় মুসলমানরা এই জন্যই খানিকটা চিন্তিত। যদি এর পরে এখানে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের মতন কোনও বিবাদ লেগে যায়? এ বিষয়ে কি আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন নেই? আমাদের জাতীয় দোষ এই, আমরা কোনও সমস্যারই আগে থেকে প্রতিকারের চেষ্টা করি না, আগুন জ্বলে উঠলে গেল গেল রব তুলি এবং অন্য কারুর ওপর দোষারোপের চেষ্টা করি।
গৌড় থেকে ফেরার পথে একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হল। আমবাগানগুলো নানা লোকের সম্পত্তি কিন্তু রাস্তার ধারের গাছগুলো সরকারি অর্থাৎ কারুর নয় যে কেউ এইসব গাছের ফল পাড়তে পারে। জায়গাটা আমের পক্ষে এমনই উর্বর যে রাস্তার ধারেই গাছেও প্রচুর ফল। নানা জায়গায় বিভিন্ন বয়েসি নারী পুরুষ মহা উৎসাহে এইসব গাছের ফল পাড়ছে, কেউ কেউ ঝুড়ি বস্তা ভরতি করে ফেলেছে। এগুলো উঁচু জাতের আম, সুস্বাদু আম, এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আমি একজনকে বললাম, ভাই দুটো আম দেবে নাকি? সে সঙ্গে সঙ্গে দুটোর বদলে চারটে দিয়ে দিল। আমি কিন্তু দাম দেওয়ার জন্য পকেটে হাতে দিচ্ছিলাম, আর কয়েকজন এসে বলল, নিন না, আমারা নিচ্ছি, আপনারাও নিন! প্রত্যেকেই দুটো তিনটে করে দিতে লাগল। একজন অন্যদের বলল, দিচ্ছিস যখন, ভালো দেখে দে! আমি যত বলি, আর চাই না, তারা শোনে না, মহাউৎসাহে সবাই দুটো তিনটে করে আম-দান করতে লাগল। পয়সার কোনও প্রশ্ন নেই। পঞ্চাশ বছর আগে এরকম ঘটনা হয়তো স্বাভাবিক ছিল কিন্তু এখনও বিনা পয়সায় মানুষ মানুষকে কিছু দিতে চায়, এটা যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। ভবিষ্যৎ কালের জন্য আমি এই ঘটনাটা উল্লেখ করলাম।
এই ভালো লাগার অনুভূতি অবশ্য মালদা শহরে ঢুকলে মিলিয়ে যায়। নির্বাচনী দেওয়াল লেখা ও পোস্টারে এই শহর একেবারে ছয়লাপ। এত প্রচার উপকরণ পশ্চিম বাংলার আর কোনও শহরে আছে কি না সন্দেহ। লাল, তেরঙা, ও দু-রঙা ঝান্ডা যেন সারা শহরটাকে মুড়ে রেখেছে। যেন যুদ্ধের আয়োজন, ভোটে জেতা যেন এক জীবন-মরণ সমস্যা, শহর ছেড়ে ইংলিশবাজার ও মানিকচকের দিকে যেতে গিয়ে দেখি, অল্প ব্যবধানে জমেছে কংগ্রেস প্রচারকদের সাইকেল বাহিনী, পদ্মফুল মার্কাদের মিছিল, আর বামপন্থীদের মিটিং। পথের মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এক পুলিশের গাড়ি, থমথমে অপেক্ষায়। আমাদের সৌভাগ্য এই যে কোনও সংঘর্ষ দেখিনি।
টুরিস্ট লজের কাছাকাছি এক রাজনৈতিক নেতার প্রায় মুখোমুখি পড়ে গেলাম। তিনি আমাকে বোধহয় চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমি না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এখানকার পরিচিত দু’চারজন জিগ্যেস করল আপনি নিশ্চিয়ই এখানে কারুর কারুর সঙ্গে কথা বলবেন? আমি কোনও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেই দেখা করতে চাই না শুনে তারা বিস্মিত। কেন আমি দেখা করব? প্রেমে ও রণে মিথ্যে কথা বলা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ইদানীং সবচেয়ে বেশি মিথ্যে কথা বলা হয় নির্বাচনের সময়। আমি নির্বাচনকে যুদ্ধ বলেও মানতে রাজি নই।
অনেক কংগ্রেসি আমাকে মনে করে বাম-ঘেঁষা। আবার বামপন্থীরা আমাকে মনে করে, আমি পুরোপুরি বিরুদ্ধ পক্ষে। আমি এই অবস্থাটা বেশ উপভোগ করি। কট্টর হিন্দু এবং কট্টর মুসলমান, এই দুই দলই নাস্তিকদের ঘৃণা করে। সব রাজনৈতিকদলের কট্টর সমর্থকরাই নিরপেক্ষতা সহ্য করে না। সবাই মনে করে নিরপেক্ষরা আসলে বিপক্ষে, কেউ-কেউ মনে করে, নিরপেক্ষ মানেই শত্রু। এই মনোভাব বদলের সময় এসেছে। দলীয় আনুগত্য এক ধরনের অন্ধত্ব এনে দেয়, যুক্তি তুচ্ছ হয়ে যায়। দলকে শক্তিশালী করার জন্য অনেক মিথ্যেকেও সত্য বলে জোর গলায় প্রচার করা হয়। কোনও রাজনৈতিক দল বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে যে কিছু কিছু মিথ্যের কাছে তাদের আদর্শ বিসর্জন দিতে হয় না? দেশের সমস্ত মানুষকে কোনও না কোনও দলীয় রাজনীতির দিকে ঠেলে দিলে সামাজিক পরিবেশে যে অনেক রোগ দেখা দেয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। সেই জন্যই সমাজের কিছু লোকের নিরপেক্ষ থাকা দরকার। যারা কোনও দলের কাছ থেকেই কোনও সুযোগ বা কৃপা গ্রহণ করবে না। শাসক দলের যে কোনও সুকৃতিকে সমর্থন জানাবে, ভুল নীতি বা স্পর্ধার সমালোচনা করবে। মুক্ত সমালোচনার সুযোগ না থাকলেই সমাজে হিটলার, স্টালিন, এমাজেন্সি আমলের ইন্দিরা গান্ধি, চাউসেস্কু এরশাদের মতন স্বৈরাচারীরা আধিপত্য করার সুযোগ পায়।
প্রতিবেশী বাংলাদেশে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়েছে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে। সেখানকার সাম্প্রতিক নির্বাচনের মতন মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচন যে এই উপ মহাদেশে আগে কখনও হয়নি, তা সমস্ত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাই স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের নিরপেক্ষরা জোরালো কণ্ঠে দাবি তুলে ছিল, নিজের ভোট নিজে দেব। যাকে ইচ্ছে ভোট দেব।
আমাদের এই নির্বাচনে জোর জবরদস্তি আর টাকার খেলায় ভোট কেনার সম্ভাবনা যে যথেষ্ট রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। একে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের প্রকৃত চরিত্রকে বাঁচাতে হলে এখানকার নিরপেক্ষদেরও এই ধ্বনি তোলা দরকার।
নিজের ভোট নিজে দেব
যাকে ইচ্ছে ভোট দেব!