কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে যে সরাসরি বিমানব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে, তা আমার জানা ছিল না। এর আগে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি অঞ্চলে বেড়াতে গেছি ঢাকা থেকে গাড়ি-পথে। খুব সুন্দর রাস্তা। খানিকটা নাকি চিন আর খানিকটা ভারত সরকার বানিয়ে দিয়েছে। ওরকম ভালো রাস্তা তখন পশ্চিমবঙ্গে একটাও ছিল না। এখন কিছু-কিছু হয়েছে অবশ্য।
সেবারে চট্টগ্রামে একটি নতুন সাংস্কৃতিক সংস্থার উদবোধন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ এল। উদ্যোক্তারা পাঠিয়ে দিলেন দুটি টিকিট। বিমানে উঠে বসে বেল্ট বাঁধতে না বাঁধতেই যেন হুস করে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রামে। বেশ মজার অনুভূতি। অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রাম ছিল বেশ সুদুর শহর, সেখান থেকে কলকাতায় আসতে লেগে যেত দু-তিনদিন। চট্টগ্রামের মানুষদেরও মনে হত আধা-বিদেশি, তাদের ভাষা ও কথার টান অনেকটাই ছিল দুর্বোধ্য। শুধু দুর্বোধ্য নয়, কিছু কিছু শব্দ বেশ ভয়াবহ। যেমন মাথার বালিশকে বলে গর্দাইন্যা। গর্দান একটা ফারসি শব্দ, যার অর্থ ঘাড়। যেখানে ঘাড় রাখা হয় সেটা গর্দাইন্যা, ঠিকই আছে। কিন্তু আমরা অন্য ভাষায় গর্দানকে কঠিন শাস্তির অনুষঙ্গেই ব্যবহার করি। কলকাতার এক বাবু নাকি চট্টগ্রামে গিয়ে এক বাড়ির আশ্রয়দাতাকে রাত্তিরবেলা বলেছিলেন, একটা বালিশ দাও তো! আশ্রয়দাতা তাঁর ভৃত্যকে যখন বললেন গর্দাইন্যাটা ফালাইয়া দে তো, তা শুনে বাবু আঁতকে উঠেছিলেন!
আমার মনে-মনে একটা আশঙ্কা ছিল, চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারব তো?
এ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। আজকাল এদিককার বাঁকুড়া শহরের মানুষও যেমন বলে না বাঁকড়ো ভাষা তেমনি চাটগাঁয়ের রাস্তা-ঘাটেও শোনাই যায় না সেই চাটগাঁইয়া ভাষা। শিক্ষিত সাধারণ মানুষ কথা বলে রেডিয়ো-টিভি’র ভাষায়, যা দুই বাংলাতেই প্রায় এক। বাড়ির মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই স্থানীয় ভাষায় কথা চালায়। ছোটবেলায় দেখেছি, আমার কাঠ-বাঙাল মামারা (আমি বাঙাল হলেও ঠিক কাঠ-বাঙাল নই, দুতিন বছর থেকেই আমি কলকাতায় থাকতে শুরু করেছি) বাড়িতে নিজেদের মধ্যে পুরো ফরিদপুরি ভাষায় কথা বললেও হঠাৎ কোনও বাইরের লোক এলেই মুহূর্তের মধ্যে সুর বদলে ফেলে খাঁটি ক্যালকেশিয়ান ভাষায় কথা শুরু করতেন। আমি না-ঘরকা না-ঘাটকা। কলকাতার বন্ধুদের কাছে আমি ছিলাম বাঙাল, আবার ছুটির সময় ফরিদপুরে গেলে সেখানকার ছেলেরা আমাকে বলত ঘটি। আমি আজও বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারি, কিন্তু সুরটা ঠিক হয় না। কিছু-কিছু শব্দও রপ্ত করতে পারিনি। যেমন কোনও পূর্ববঙ্গীয় বন্ধু যখন বলত, একটা গর্ত ফাল দিয়ে পার হয়ে গেল, তখন বুঝতাম না ‘লাফ কী করে ‘ফাল। হয়ে গেল? পুরে বুঝেছি, ‘হ্রদ’ ও উলটে ‘দহ’ হয়ে গেছে, ব্যাকরণে একে অপিনিহিত না কী যেন বলে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় দহ থাকলেও ফাল কথাটা পরিচিত নয় একেবারেই।
চট্টগ্রাম অপূর্ব সুন্দর শহর। নদী, সমুদ্র ও পাহাড় মিলিয়ে গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবাংলায় এরকম কোনও শহর নেই, এখানে সমুদ্র থেকে পাহাড় অনেক দূরে, তবে দক্ষিণের বিশাখাপত্তনম বা ভাইজাগ-এর সঙ্গে এর মিল আছে।
মূল অনুষ্ঠানটি ঠিক কবিসম্মেলন নয়, কিন্তু বাংলাদেশের সব অনুষ্ঠানেই তো কবিতা পাঠ একেবারে অবধারিত। নানাজনের কবিতা পাঠের মধ্যে একজন আবৃত্তিকারের কণ্ঠে শামসুর রাহমানের কবিতা যেন নতুন করে ভালো লাগল :
মানুষের হাটে হেঁটে যেতে যেতে
কবি বললেন, আমাকে বাতলে দিন
কবন্ধ এই কপট সমাজে
শিল্পের কাছে তার কতটুকু ঋণ?
কথামালা তার ঢেউয়ের মতই
পাথুরে দেওয়ালে ভীষণ আছড়ে পড়ে
বেলা অবেলায় খঞ্জের মতো
মাথা নীচু করে কবি ফিরে যান ঘরে।
কিন্তু কোথায় এমন আঁধারে
নান্দনিক সে কবির বাড়ির পথ?…
আমার স্মৃতিশক্তি ভালো নয়। তবু কখনও-কখনও কিছু কিছু পঙক্তি হঠাৎ মুগ্ধতায় মনে গেঁথে যায়। এই কবিতাটি আছে সম্ভবত স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার’ কাব্যগ্রন্থে। সম্ভবত বলছি এই জন্য যে সেই বইটি এখন আমার হাতের কাছে নেই। স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে কিছু ভুল হয়ে গেল না তো? (শামসুর, এই রচনাটি যদি দৈবাৎ তোমার চোখে পড়ে, এবং দ্যাখো যে তোমার কবিতার উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে আমি দু-একটি শব্দ ভুল করে ফেলেছি, তা হলে নিজগুণে মার্জনা করে দিও ভাই!)
ওই সভাতেই হাসান রাজার একটি গানও আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল :
আমিই মূল নাগর রে
আসিয়াছি খেউড় খেলিতে ভব সাগরে রে।
আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিব শংকরী
অধর চাঁদ হই আমি, আমি গৌর হরি।
আমি মূল, আমি কূল, আমি সর্ব ঠাঁই
আমি বিনে এ সংসারে অন্য কিছু নাই…
এই গানের মধ্যে রয়েছে এক স্পর্ধিত আমিত্ব, যা রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী উঠল রাঙা হয়ে।’ কিম্বা ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে’। অবশ্য ‘সো অহং’ বা আমিই সে তত্বও বহু প্রাচীন। ওই গানটি শুনতে-শুনতে হাসান রাজার জীবনী নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আমার মনে জেগে উঠেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হাসান রাজার ব্যক্তিগত পরিচয় কখনও হয়নি বোধহয়। সেরকম কোনও তথ্য নেই। যদিও পরিচয় হতে পারত। হাসান রাজা রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র সাত বছরের বড়, তিনি বেঁচে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। অবশ্য তাঁর পরিচিতি তখনও সীমাবদ্ধ ছিল সিলেটের একটি ছোট গণ্ডির মধ্যে। তাঁর গানের সংগ্রহ হাসান উদাস ছাপা হয়েছিল ১৯১৪ সালে। সে বই যে রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি, তার প্রমাণ আছে।
যতদূর জানা যায়, প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত নামে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের একটি ছাত্র তার কলেজ ম্যাগাজিনে হাসান রাজার গান সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখে। হাসান-ভক্ত এই ছেলেটির সাধ হয়েছিল হাসানের গান রবীন্দ্রনাথের গোচরে আনার। সে উদ্দেশ্যে সে চলে এসেছিল শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গে দেখা করেন এবং তার কথা শুনে হাসানের আটটি গান পড়ে দেখেন। তিনি বলেছিলেন, মাত্র এই কটি গানে ঠিক সিলেটের কবিটির পরিচয় বোঝা যাচ্ছে না, আরও কিছু লেখা চাই। সিলেটে ফিরে এসে প্রভাতচন্দ্র তার সংগ্রহ থেকে ৭৮টি গান পাঠিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। সেসব পড়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন হাসান রাজার জীবন-ভাষ্য। এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি যে ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত হিউবার্ট লেকচারে হাসানের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন যে It is a village poet of East Bengal who preaches in a song the philosphical doctrine that universe has its reality in its relation to the person.’ তারপর থেকেই হাসান রাজা সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজের আগ্রহ জন্মায়।
হাসান রাজা সম্পর্কে আমার সেই পরিকল্পিত জীবনী-উপন্যাস অবশ্য আজও শুরু করতে পারিনি। আমার অক্ষমতা। নিশ্চয়ই অন্য কেউ লিখবে।
চিটাগাঙ থেকে যাওয়া হল কক্সবাজার। বেলাভূমি শহর। আগেও এসেছি। তা শুধু ভ্রমণকারী হিসেবে। এবারে সঙ্গে অনেক বন্ধুমানুষ, বেলাল চৌধুরী, ‘অন্যদিন’ পত্রিকার সম্পাদক মাজহার এবং জুটেছিল বিশ্ববাউণ্ডুলে কামাল। সমুদ্রে স্পিডবোটে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে বেশ দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল। যথেষ্ট বিপদের ঝুঁকি ছিল, পরে বুঝেছি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে মোচার খোলার মতন দুলছিল ছোট্ট স্পিডবোট, যে কোনও মুহূর্তে উলটে যেতে পারত। আমরা তো তবু সাঁতার জানি, স্বাতী তাও জানে না। অথচ ওরই উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
এই অঞ্চলটি ঝড়প্রবণ, কতবার বিধ্বংসী ঝড়ে কত মানুষের প্রাণ গেছে, নষ্ট হয়েছে। বহু বাড়িঘর। সে যাত্রায় দেখেছিলাম, এক-একটা নির্জন দ্বীপে বেমানানভাবে এক-একটি শক্তপোক্ত কয়েক তলার পাকা বাড়ি। শুনলাম, ওগুলি বানিয়ে দিয়েছে বিদেশিরা, ঝড়ের সময় বিপন্ন মানুষদের আশ্রয়ের জন্য। ওই স্টার্ম-শেলটারগুলি দেখে কিশোরপাঠ্য কাকাবাবুর একটি অভিযান-কাহিনি লেখার চিন্তা আমার মাথায় আসে।
কক্সবাজারে আমরা উঠেছিলাম একটা হোটেলে। কী করে যেন সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট খবর পেয়ে গেলেন, আমাদের নিয়ে এলেন সরকারি বাংলোয়। এবং মাত্র একদিনের নোটিশে আয়োজন করে ফেললেন এক কবিসম্মেলনের। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় একজন কবিতাপ্রেমিক। নিজেও লেখেন বোধহয়। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, বিচারপতি, এরকম অনেকেই কবি। শুধু বোধহয় পুঁদে রাজনীতিবিদরাই কবিতার ধার ধারেন না। আহা, ওঁরাও যদি কবিতা লিখতেন, তা হলে দেশের হাওয়া হয়তো কিছুটা নরম হত।
একদিনের নোটিশেই কুড়ি-পঁচিশজন কবি এসে পড়ল কবিতা পড়তে। এমনিতে মনে হয়, এটা পর্যটক আর ব্যাবসাবাণিজ্যের শহর। তবু স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও এত কবি! অনেকেরই ছাপা কবিতার বইও আছে। কে কেমন লিখেছে সেটা বড়ো কথা নয়, যারা কবিতা লিখতে চায়, যারা কাগজ-কলম নিয়ে নিভৃতে কবিতার ধ্যানে বসে, তাদের সবাইকেই আমার আত্মীয় মনে হয়।