পূর্ণদাস বাউলের একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল কোনও একটি বাংলা সংবাদপত্রে। তাতে সে তার সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের কথা বর্ণনা করতে-করতে এক জায়গায় বলেছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো শিগগিরই আমেরিকা যাচ্ছেন। লেখাটা পড়তে-পড়তে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমি আমেরিকার যাচ্ছি, অথচ নিজেই তো জানি না? কেউ আসলে কিছুই জানায়নি, কোনও চিঠিও আসেনি।
শান্তিনিকেতনে পূর্ণদাস বাউলের সঙ্গে দেখা হল সপ্তাহখানেক বাদেই। তাকে জিগ্যেস করলাম, পূর্ণ, কী ব্যাপার? আমি আমেরিকা যাচ্ছি, তোমাকে কে বলল?
পূর্ণদাস খুবই বিখ্যাত এবং সম্মাননীয় গায়ক। কিন্তু আমার চেয়ে বয়েসে কিছুটা ছোট বলে তাকে আমি নাম ধরে তুমি বলেই ডাকি।
পূর্ণদাস বলল, হ্যাঁ দাদা, আমি যে অ্যালেন গিনসবার্গের কাছে শুনে এলাম, আপনি ওদেশে যাচ্ছেন। ওখানে কবিতা পাঠ করবেন।
পূর্ণদাস আমেরিকার অনেক গায়কের সঙ্গেই খুব পরিচিত এবং সেই যোগাযোগ প্রথম করিয়ে দিয়েছিল অ্যালেন গিনসবার্গই। পূর্ণদাসের প্রথম বিদেশযাত্রার কাহিনি অনেকটা রূপকথারই মতন।
অ্যালেন গিনসবার্গ তার সঙ্গী পিটার অরলভস্কিকে নিয়ে প্রায় বছরখানেক কাটিয়ে গেছে ভারতে। সেসময়ে বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। তখন পূর্ণদাসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, পূর্ণদাস সেই সময়ে বয়েসে বেশ তরুণ।
অ্যালেন নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পর আমেরিকান গায়কদের এক বিশাল সমাবেশ হয় আপস্টেট নিউ ইয়র্কে। সে জায়গাটার নাম উডস্টক। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অত গায়ক একসঙ্গে আর কোথাও জড়ো হয়নি, আর কোনও হলঘরে নয়। তিন দিন ধরে গানের উৎসব খোলা প্রান্তরে, অনেকটা মুক্তমেলার মতন। শ্রোতারা এসেছিল আমেরিকায় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তারা সারারাত আকাশের নীচে শুয়ে থেকেছে। এখনও অনেকে উডস্টকের সেই মহাসমাবেশের স্মৃতিতে রোমাঞ্চিত হয়।
তখন আমেরিকার তরুণ গায়কদের রাজা ছিলেন বব ডিলান। তাঁর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। সেই বব ডিলানই ছিলেন উডস্টকের প্রধান সংগঠক। তিনি অ্যালেন গিনসবার্গের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি অ্যালেনকে কথায়-কথায় বলেছিলেন, পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে দু-একজন গায়ক আনাতে পারলে বেশ হত।
অ্যালেন তাঁকে জানাল বাউল গানের অভিনবত্বের কথা। সেই গানের খুবই জোরালো ও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী পূর্ণদাস বাউল।
তখন আমেরিকান ভিসার এত কড়াকড়ি ছিল না। এক বেলাতেই ভিসা পাওয়া যেত। পূর্ণদাস এর আগে প্লেনেই চাপেনি, তার পক্ষে কলকাতা থেকে বিভিন্ন প্লেন বদল করে উডস্টকে পৌঁছনো খুবই অসুবিধেজনক হত। তাই বব ডিলান পূর্ণদাসের জন্য তাঁর নিজস্ব জেট বিমান পাঠিয়ে দিলেন দমদমে। ভাবা যায়, একজনমাত্র যাত্রীর জন্য আস্ত একটা অতবড়ো বিমান! অনেক রাজা-মহারাজের ভাগ্যেও এটা ঘটে না। সেই সম্মান পেলেন এক বাউল!
সেই গান-সম্মেলনে পূর্ণদাসের পায়ে ঘুঙুর আর হাতে দোতারা নিয়ে গান, আর ‘ভোলা মন’ বলে দীর্ঘ তান অনেকেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। তারপর থেকে সে আমেরিকায় গেছে অনেকবার। অন্যান্য বাউলদেরও বিদেশযাত্রার পথ খুলে যায়। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে প্রতিদিন গান গায় যে কার্তিক দাস, সে-ও বিলেত-আমেরিকা ঘুরে এসেছে।
আমার সঙ্গে অ্যালেন গিনসবার্গের বন্ধুত্ব অনেকদিনের। প্রথমবার যখন সে আসে ভারতে, তার সঙ্গে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি, ঘুরেছিও অনেক জায়গায়। আমাদের বাড়িতেও এসেছে সে আর পিটার। আমিও প্রথমবার ওদেশে গিয়ে প্রায় মাসখানেক থেকেছি ওদের অ্যাপার্টমেন্ট বা আখড়ায়। অ্যালেন দ্বিতীয়বার একাই এসেছিল বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়। তখনও পূর্ব পাকিস্তানে চলছে অমানুষিক অত্যাচার, প্রায় এক কোটি শরণার্থী চলে এসেছে ভারতে, দুর্বিষহ অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে। দমদম থেকে বনগাঁ পর্যন্ত যশোহর রোডের দুধারে অস্থায়ী চালাঘরে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে, রোগ-ভোগে মরছেও অনেকে পোকামাকড়ের মতন। তার ওপর সেপ্টেম্বর মাসে হল বন্যা, যশোহর রোডের অনেকটা অংশ হয়ে গেল নদী, সেবারে আমি যশোহর রোডের ওপর দিয়ে সত্যি করে নৌকোয় চেপে বনগাঁয় গেছি। অ্যালেনও আমার সঙ্গে যশোহর রোড ধরে নৌকায় করে শরণার্থীদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিল। বব ডিলান এবং অন্যান্য অনেক শিল্পী মিলেই পাঠিয়েছিলেন তাকে। তারপর তাঁরা সংগীত অনুষ্ঠান করে কয়েক কোটি টাকা পাঠিয়েছিলেন রেফিউজিদের সাহায্যের জন্যে।
অ্যালেন তার সেবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিল অবিস্মরণীয় কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোহর রোড’। সেই কবিতার এক জায়গায় সুনীল নামে এক কবির কথাও আছে। কবিতাটিতে অ্যালেন নিজের সুর দিয়ে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে শুনিয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্রোতাকে। সে গানের ক্যাসেটও বেরিয়ে বিক্রি হয়েছে প্রচুর।
অ্যালেন যতই ব্যস্ত থাক, তাকে চিঠি লিখলেই সে উত্তর দেয়। আমারই চিঠি-আলস্য আছে। তাই অনেকদিন যোগাযোগ নেই। ওর সঙ্গে শেষবার হঠাৎ দেখা হয়েছিল যুগোশ্লাভিয়ায়। পূর্ণদাস বাউলের মুখে ওই খবর শুনেও আমি অ্যালেনকে চিঠি লিখিনি
সংকোচবশত। যদি সেটা নিছক কথার কথা বা গুজব হয়, তাহলে আমার দিক থেকে আগ বাড়িয়ে চিঠি লেখা হ্যাংলামির মতন দেখাবে। অ্যালেনের দিক থেকেও কোনও সাড়াশব্দ নেই।
কয়েকদিন পর ভোপালের ভারত ভবনের পক্ষ থেকে অশোক বাজপেয়ী একটা আমন্ত্রণপত্র পাঠাল। তখন ভারত ভবনের খুব রমরমা। প্রায়ই ডাক পাই নানা উপলক্ষে। এবারের উপলক্ষ কবি-সম্মেলন।
পৌঁছে দেখি, সম্মেলনটি খুব বড় আকারের নয়, চোদ্দো-পনেরোজন কবি। সন্ধের পর অশোক বাজপেয়ী আমার হোটেলের ঘরে এসে বলল, তোমার সঙ্গে আলাদা কথা আছে। আগামী মাসে আমেরিকান ভারত উৎসব হবে। তুমি কিছু শুনেছ কি? দেশ থেকে কয়েকটি গানের দুল, নাচের দল, থিয়েটার, ছবির প্রদর্শনী যাবে। আমি কবির দল নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা করেছি। মোট ছজন কবিকে পাঠাতে রাজি হয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু এই ছজনের নাম বাছাই করা কী শক্ত কাজ বলো তো! এত কবি! অবশ্য তোমার নাম আগেই ঠিক হয়ে গেছে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই কবিতাপাঠের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিয়েছেন অ্যালেন গিনসবার্গ। তিনি বলে দিয়েছেন, আর যেই আসুক বা না আসুক, সুনীলকে আনতেই হবে!
আমি প্রথমটা অবাক হলাম। অ্যালেন শুধু আমার নাম বলেছে কেন? শক্তির সঙ্গেও অ্যালেনের খুব বন্ধুত্ব। আমার চেয়েও শক্তি অ্যালেনের সঙ্গে বেশি ঘোরাঘুরি করেছে। আমি তো পুরোপুরি ছন্নছাড়া হতে পারি না, আমাকে অনেক কাজ করতে হয়।
আমি অশোককে বললাম, তুমি বরং আমার বদলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যাও। আমি তো দুবার গেছি ওদেশে, শক্তি কখনও যায়নি। শক্তিও বেড়াতে ভালোবাসে, ওর অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
অশোক বলল, শক্তি সম্পর্কেও গিনসবার্গের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। ওঁর প্রবল আপত্তি আছে। উনি বলেছেন, শক্তিকে কে সামলাবে? শক্তি নেশার ঝোঁকে মাঝে মাঝে অনেকরকম পাগলামি করে। আমেরিকায় মদ্যপানের বাড়াবাড়ি একেবারেই চলে না এখন। কারুকে এরকম দেখলে লোকে হাসে বা বিরক্ত হয়।
আমি অশোককে তবু বললাম, আমি শক্তিকে বোঝাব, যাতে ওদেশে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে। ইচ্ছে করলে ও পারবে।
অশোক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, গিনসবার্গ শক্তির ব্যাপারে একেবারে না বলে দিয়েছে, আমিও ওর দায়িত্ব নিতে পারব না।
শক্তিকে পাঠাবার খুবই ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত যে ছ’জন কবি মনোনীত হলেন, তাঁদের মধ্যে একজন কন্নড় ভাষার কবি আদিগা, বয়েসে বেশ প্রবীণ এবং সদ্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া হিন্দির প্রখ্যাত কবি কেদারনাথ সিং, অশোক বাজপেয়ী নিজে, আর একজন গুজরাতি ও একজন তামিল।
আমার যাওয়ার ব্যাপারে একটা বিপত্তি ঘটল।
দিল্লি থেকে পুরো দলটির একসঙ্গে যাত্রা করার কথা, দিল্লিতে পৌঁছে শুনলাম, কোনও কারণে প্রোগ্রাম বদলে গেছে, সবাই যাবে দুদিন পয়ে, আমাকে ঠিক সময়ে জানানো হয়নি। আমার আর টিকিট বদলাবার উপায় নেই। আমাকে যেতে হবে সেদিনই।
তখনও ই-মেলের যুগ আসেনি। টেলিফোনও এখনকার মতো মসৃণ নয়। আমি যে আগেই যাচ্ছি, সে-খবর আমেরিকান ঠিকঠাক জানানো যাবে কি না তা বলা যায় না। তবু আমাকে যেতেই হবে।
যাকে বলে দুর্গা বলে ঝুলে পড়া, সেইভাবে আমি চেপে বসলাম প্লেনে। একা।
সর্বক্ষণ মনে-মনে চিন্তা রইল, নিউ ইয়র্কে যদি কেউ আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে না আসে, তাহলে আমি যাব কোথায়? কোথায় উঠব তা-ও জানি না।
এর আগে দুবার গেছি আমেরিকান। দুবারই আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। সেখানকার ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো, আগে থেকে আমার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা ছিল। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে কখনও আসিনি, কোনও কবিতা পাঠের জন্যও আগে আমন্ত্রণ পাইনি।
একা-একা নিউইয়র্ক পৌঁছবার পর কী হবে, এই চিন্তাতেই খাদ্যে পানীয়ে কিছু স্বাদ পাচ্ছিলাম না। যদিও গিয়ে একবারে জলে পড়ব না জানি। এয়ারপোর্টে যদি কেউ না আসে, তাহলে কোনও একটা ছোটখাটো হোটেলে উঠতে হবে। নিউ ইয়র্ক শহরের যে অংশটার নাম ম্যানহাটন, সেটা মোটামুটি আমার চেনা। লোয়ার ইস্ট সাইডের দিকে কিছু সস্তার হোটেল আছে। ট্রেনে চলে যাওয়া যেতে পারে।
নিউ ইয়র্ক শহরের কাছাকাছি আমার কয়েকজন চেনা মানুষও আছে। কিন্তু তাদের কারুরই ফোন নাম্বার কিংবা ঠিকানা আনিনি তাড়াহুড়োতে। আমার স্বভাব তেমন গোছালো নয়। অনেকে সঙ্গে একটা ছোট্ট, ব্যক্তিগত ফোনের নোটবুক রাখে। আমার বাড়িতেই তখন টেলিফোন ছিল না। তাই ফোনের খাতাও রাখা হত না।
যাই হোক, পৌঁছলাম তো নিউ ইয়র্ক শহরে। এয়ারপোর্টে কেউ নিতে আসবে না। এটা ভাবলেই মনটা কীরকম দমে যায়। এখন সুটকেস বয়ে-বয়ে হোটেল খুঁজতে হবে।
ইমেগ্রেশান কাস্টমস পার হয়ে বাইরে আসতেই একটা বিরাট চিৎকার শুনতে পেলাম, সুনীলদা! সুনীলদা!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়েও কারুকে দেখতে পাচ্ছি না। আমাকেই কেউ ডাকছে?
আবার শুনলাম, সুনীলদা, এই যে এদিকে, এদিকে!
দেখি যে ওপর দিক থেকে একজন প্রবলবেগে হাত নাড়ছে। সেই চিৎকার শুনে শুধু আমি নয়, আরও বহু লোক তাকিয়ে রইল তার দিকে।
নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে ওরকম বাংলায় চিৎকার করে কথা বলার সাধ্য শুধু একজনেরই আছে। তার নাম ধ্রুবনারায়ণ কুণ্ডু। যে বর্ধমানের ইটাচুনার জমিদার বংশের ছেলে, বহুদিন আমেরিকা-প্রবাসী। যেমনই তার সুঠাম স্বাস্থ্য, তেমনই সে দুঃসাহসী।
ধ্রুব কী করে যেন খবর পেয়ে চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, অ্যালেন গিনসবার্গের ওখানকার এক।
সেক্রেটারি বব রোর্সেনাথাল ও আরও দুজনও আমাকে স্বাগত জানাবার জন্য এসেছে, আমার বুক থেকে বেরিয়ে এল স্বস্তির নিশ্বাস।
দামি পাড়ায় হোটেলের ঘরও ঠিক আছে আমার জন্য। সেখানে পৌঁছে যে বিশ্রাম নেব তার উপায় নেই। দলে দলে নারী-পুরুষ আসছে দেখা করার জন্য। তার মধ্যেই একটা মজার ব্যাপার ঘটল।
তিনজন যুবক এল একসঙ্গে। তিনজনই প্রায় একবয়েসি! সুন্দর চেহারা। নাম জিগ্যেস করতেই তারা হাসতে হাসতে বলল, আমরা তিনজনই গৌতম!
সত্যিই তাই। পরে তাদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। এক গৌতমের একটি পোশাকি নামও আছে, কল্যাণ। সেই কল্যাণ য়ায় নিজেও একজন কবি ও গল্পলেখক, গর এক কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক, সে আমার গরম ভাত গল্পের ইংরেজি নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করেছে, আর আমার অনেক কবিতার অনুবাদ করেছে। তার আর একটি পরিচয়, বর্তমানে তার স্ত্রী আমাদের বিখ্যাত অভিনেত্রী ও পরিচালিকা অপর্ণা সেন। অন্যজন গৌতম দত্ত, সে এখন বাংলা ভাষায় অন্যতম অলোচিত কবি, কৃত্তিবাসের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ, আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের একটি অনুবাদ সংকলনে আমি তার সঙ্গী। এই গৌতমও নাট্যকার ও অভিনেতা, আমার প্রথম আলো’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে আমেরিকার সাত-আটটি শহরে ঘুরে-ঘুরে তা মঞ্চস্থ করে প্রায় একটি ঐতিহাসিক কাণ্ডই করে ফেলেছে বলা যায়। তৃতীয় গৌতম চট্টোপাধ্যায় এখন থাকে অস্ট্রেলিয়ায়, তার সঙ্গে যোগাযোগ কম।
যাই হোক, এবার অনেক পরের ঘটনা। প্রথম যখন দেখা করতে আসে তখন তিনজনই বেশ তরুণ, উৎসাহে টগবগ করছে। আমার কবিতা শুনতে ওরা বস্টন পর্যন্ত চলে এসেছিল।
নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছিলাম বিকেলবেলা, রাত সাড়ে দশটায় আমার হোটেল-ঘরে এল গিনসবার্গ সদলবলে। সেই দলের মধ্যে রয়েছে আর এক প্রখ্যাত কবি গ্রেগরি করলসা
আর পিটার অরলভস্কি। এরা সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। আচ্ছা শেষ হল ভোর পাঁচটায়। এইসব কবিদের কাছে দিন ও রাত্তিরের হিসেব অন্যরকম। গ্রেগরি করসোকে আমি কোনও রাত্রেই ঘুমোতে দেখিনি। অ্যালেনও নিশাচর।
আড়ার ফাঁকেই অ্যালেন জানাল আমাদের সফরসূচি।
আমেরিকার মোট সাতটি শহরে আমাদের কবিতা পাঠের ব্যবস্থা। গোটা উত্তর আমেরিকা ঘুরে-ঘুরে বলা যায়। এ-প্রান্তে যেমন নিউ ইয়র্ক অন্য প্রান্তে লস এঞ্জেলিস। আবার আর একদিকে নিউ মেক্সিকো, কলোরাডো। এত বিস্তৃতভাবে ভারতীয় কবিতা পাঠের ব্যাপার আগে কখনও হয়নি। এর মধ্যে দুটি জায়গা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট, আর বস্টনের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অ্যালেনের খ্যাতি এবং প্রভাবেই এসব জায়গায় অনুষ্ঠানের ব্যস্থা করা সম্ভব হয়েছিল নিশ্চিত। সেসময় অ্যালেন গিনসবার্গ আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত কবি এবং বিচিত্র বর্ণময় তার জীবন। সে সম্পর্কে আমি অন্যত্র লিখেছি বিস্তৃতভাবে। শুধু আমেরিকায় নয়। সারাবিশ্বেই সে প্রখ্যাত, বিশেষ করে স্প্যানিশভাষী কবিদের মধ্যে দেখেছি, কেউ-কেউ অ্যালেনের কবিতা গড়গড় করে মুখস্থ বলে। নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম একাধিকবার প্রস্তাবিত হলেও তা বাতিল হয়েছে, কবিতা নয়, অন্য কারণে।
অ্যালেন হিপি আন্দোলনেরও গুরু। কলকাতায় সে পাজামা-পাঞ্জাবি পয়ে ঘুরে বেড়াত। আমাদের বাড়িতেও কয়েকবার এসেছে। স্বাতীর সঙ্গেও তার পরিচয় আছে। তাই স্বাতী অ্যালেনের জন্য একটা পাজামা ও পাঞ্জাবি পাঠিয়েছিল উপহার হিসেবে। সে-দুটো দিতেই অ্যালেন বেশ বিরক্তভাবে বলে উঠল, এসব আবার এনেছ কেন? না, না, এখন আর আমি হিপি নই, এরকম পোশাক পরি না। এখন আমি সুট পরি, টাই-ও পরি, বয়েস হয়েছে তো।
আমি বললাম, স্বাতী তে সেসব বোঝেনি। পাঠিয়েছে, ফেরত নিয়ে যাব? বাইরে না হয় না-ই পরলে, ঘরের মধ্যে, রাত্তিরে শোওয়ার সময়, স্লিপিং সুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারো!
ভারতীয় কবিদের উৎসব, আগত কবিরা প্রত্যেকেই পড়বেন নিজের নিজের ভাষায়, ইংরেজি অনুবাদ অন্য কেউ পাঠ করে দেবে। আমাদের দেশের মতন, ওদেশে পেশাদার আবৃত্তিকার নেই। কবিদের বিকল্প হিসেবে থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পাঠের দায়িত্ব নেয়। অন্যদের বেলায় সেরকমই ঠিক হল। শুধু আমার কবিতা সম্পর্কে অ্যালেন প্রস্তাব দিল, ও নিজেই পাঠ করবে!
আমার কাছে এ-প্রস্তাব প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কোনও বিখ্যাত কবিই অন্য কারুর কবিতা পাঠ করেন না। বিশেষত জীবিত অন্য কারুর। আমি নিজে থেকে অ্যালেনকে এ-অনুরোধ কিছুতেই জানাতাম না। এমনকি এ-কথাও ওকে বলেছিলাম, তুমি কেন পড়বে, অন্য যে-কেউ পড়ে দিলেই তো পারে!
অ্যালেনের একটা বিখ্যাত নিঃশব্দ হাসি আছে। অনেক সময় কোনও কথার উত্তরে ও শুধু ওই হাসিটা দেয়। সেরকম হেসে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।
এর আগে ‘সিটি লাইট’ পত্রিকায় আমাদের কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কবিতা ছাপা হয়েছিল। অ্যালেনই তার অনুবাদ সংশোধন করে দিয়েছিল। এবারেও আমি যে-কয়েকটি কবিতার অনুবাদ নিয়ে গেছি, অ্যালেন তা কিছু কিছু অদলবদল করে নিল।
প্রথম অনুষ্ঠান মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট-এর চত্বরে। এটি একটি বিশ্ববিখ্যাত স্থান। আধুনিক চিত্রকলার একটি তীর্থস্থানও বলা যেতে পারে। যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দেখি অ্যালেনের গায়ে সুটের বদলে সেই পাঞ্জাবি। একটু-একটু শীত আছে। তবু কোট পরেনি। লাল তোরাকাটা পাঞ্জাবি পরে আছে। আমাদের দেখে লাজুকভাবে বলল, স্বাতী শখ করে পাঠিয়েছে, রংটা ভালো।
আমেরিকান যে-কোনও ফ্যাশান বা হুজুগ ঘন-ঘন বদলায়। হিপি আন্দোলন ঠিক হুজুগ নয়, তার মধ্যে ছিল প্রতিবাদ। সে-আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফল এখনও টের পাওয়া যায়। পোশাকের ব্যাপারে কড়াকড়ি অনেক কমেছে। অনেকেই এখন টাই পরে যায় না। কিন্তু ছেঁড়া জামা কিংবা খালি গা কিংবা খালি পায়ে উদ্ভট কিছুই করে না কেউ। অ্যালেনের গায়ে পাঞ্জাবি, অন্যরকমই দেখাচ্ছিল।
কবিসম্মেলনের বর্ণনা দিতে গেলে অন্যদের কবিতাগুলির উদ্ধৃতি দিতে হয়। কিন্তু সেসব কবিতা তো এখন আমার হাতের কাছে নেই। সেদিন আমার কবিতা যদি বেশি হাততালি পেয়ে থাকে, তার কারণ আমার কবিতার গুণাগুণ নয়, আসল কারণ, ইংরেজি ভাষ্য পাঠ করেছে অ্যালেন গিনসবার্গের মতন কবি! আমেরিকান শ্রোতাদের কাছে এই ব্যাপারটাই তো অভিনব।
এর পরের কাব্যপাঠ হয়েছিল সেন্ট্রাল পার্কের খোলা জায়গায়। যারা নিউ ইয়র্ক গেছে, তারা জানে, ওই শহরের মধ্যে এই সেন্ট্রাল পার্ক আমাদের কলকাতা ময়দানের চতুগুণ তো হবেই। এখানে অনেকেই বেড়াতে আসে। এই অনুষ্ঠানে কারুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবু ভিড় হয়েছিল যথেষ্ট। অবশ্য, আমার চেনা বাঙালিরাও ছিল সবাই। তিন গৌতম, ধ্রুব, আলোলিকা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ, আর প্রীতি সেনগুপ্ত নামে এক গুজরাতি লেখিকা, যে বাঙালিকে বিয়ে করে অতি সত্বর বাংলাভাষা দারুণ শিখে নিয়েছে। এই প্রীতির সঙ্গে পরে আমাদের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তা এখনও রয়েছে।
অশোক বাজপেয়ী আমাকে দুঃখ করে পরে বলেছিল, আমেরিকার সব শহরেই দেখেছি, প্রচুর বাঙালি কবিতা শুনতে আসে। সুন্দর-সুন্দর চেহারার মেয়েরা এসে তোমাকে খাতির করে। আমাদের হিন্দিভাষীরা তেমন আসে না, আমাকে কেউ খাতির করে ডেকে নিয়ে যায় না!
এর পর আমরা যে বিভিন্ন শহরে ঘুরেছি তার বিবরণ দিতে গেলে ভ্রমণকাহিনি হয়ে
প্রথম উদবোধনের দিনে অ্যালেন গিনসবার্গ আমার সম্পর্কে তথা বাংলা কবিতা সম্পর্কে যা বলেছিল, পরবর্তীকালে প্রথম গৌতম অর্থাৎ কল্যাণ রায় ‘সিটি অব মেমোরিজ’ নামে আমার কবিতার যে ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করে, তার ভূমিকায় অ্যালেন প্রায় সেই কথাগুলোই লিখেছিল। তার কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি, তাতেই বোঝ যাবে বাংলা কবিতা সম্পর্কে সে কতটা ওয়াকিবহাল ছিল।
The great poet of the tongue Tagore is sung better than recifed of translated and everyone feels nostalgic for Rabindranath songs…
One poet now dead, killed in 1954 on Rashbehari Avenue run over by a tram car, Jibananda Das, did introduce what for India would be ‘the modern spirit’ –bitterness self doubt, sex, street diction, personal confession, frankness, Calcutta beggars etc.–into Bengali letters .
The Poet Sunil Ganguly (the longer version of his name in formal Brahmin Style-Sunil Gangopadhyay) is an old friend of myself since we met back in Calcutta in 1962 . Sunil Ganguly is an excellent poet in Bengali and a good drinking companion .
(His) poems are interesting in that they do reveal a temper that is XX Century International, i.e., the revolt of the personal . Warsaw, Moscow, San Francisco, Calcutta, the discovery of felling……..
বাংলা কবিতাকে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছিল এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি।