পায়ের তলায় সরষে, আমি বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী!
আমার ভ্রমণের শখ নেই। এখন পর্যন্ত ভ্রমণ আমার জীবন যাপনেরই একটা অঙ্গ। কিছুদিন এক জায়গায় থিতু হয়ে থাকলেই আমার মন উচাটন হয়। মাথার মধ্যে একটা ক্যারা নড়াচড়া করে। প্রতিদিন একই মানুষজনের সঙ্গ, খুব ঘনিষ্ঠ হলেও আর উত্তাপ দেয় না; একইরকম সব মুখ, খুব প্রিয় হলেও, দেখতে-দেখতে চোখ খরখরে হয়ে যায়। তখন ইচ্ছে করে, কিছুদিনের জন্য অন্য নদীতে ডুব দিয়ে আসি, অন্য হাওয়ায় আচমন করি।
ছোটবেলায় আমার দিদিমা বলতেন, এ ছেলেটার একেবারে পায়ের তলায় সরষে, একদণ্ড ঘরে মন টেকে না! এ এমন কিছু আহামরি গুণপনা নয়, অনেক ছেলেই এমন হয়, বিশেষত আমার মতন যাদের অল্প বয়েস থেকেই পড়াশুনোয় মন নেই। যে বয়েসটায় সারা গায়ে ইস্কুল ইস্কুল গন্ধ থাকে সেই বয়েসে আমি মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে পালাতুম। আমার ইস্কুল পালানোর উপায় ছিল না, কারণ আমার বাবা ছিলেন স্কুল-শিক্ষক আর সেই স্কুলেরই আমি ছাত্র।
এমনকি খুচরো দুষ্টুমি কিংবা আমার তুলনায় দুর্বল কোনও ছাত্রের সঙ্গে মারামারি করার সুখও আমি পাইনি। কারণ, একটু কিছু শুরু করলেই সবাই বলত, তোর বাবাকে বলে দেব। সেই দুঃখে, ছুটিছাটার দিনে, বাড়ির লোকজনদের খানিকটা দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য আমি পালিয়ে যেতুম দূরে কোথাও। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়, দু-তিন ঘণ্টা মাত্র। তারপর আবার নিজেই নিজেকে খুঁজে পেয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনতুম।
বাল্যকালে আমাদের পরিবারে সারা বছরে দু-তিনবার বাধ্যতামূলক ভ্রমণ ছিল। আমার বাবা কাজ করতেন কলকাতার ইস্কুলে আর আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ফরিদপুরের এক গণ্ডগ্রামে। বছরে দু-বার অন্তত আমরা এই দু’জায়গা যাতায়াত করতুম। দূরত্বের হিসেবে হয়তো মাত্র শ দেড়েক মাইল তবু সে কী লম্বা যাত্রা। প্রথমে নৌকোয় কয়েক ঘণ্টা, তারপর স্টিমারে এক রাত, তারপরে ট্রেনে একবেলা। নদী খাল বিলের দেশ থেকে শান বাঁধানো কলকাতায় এসে মনে হত অন্য গৃহে চলে এসেছি। নদীর চড়ায় দেখেছি পোড়া কাঠের মতন রোদ-পোহানো কুমির, স্টিমারটা কাছে এলেই তারা ঝুপঝুপ করে নেমে পড়ত জলে; রাশি-রাশি সাদা বককে দেখেছি স্বর্গের দিকে উড়ে যেতে। রাত্রিবেলা স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে নদীতে ও আকাশে দু-খানি চাঁদ দেখা, তার ঘোর চোখে লেগে থাকত বেশ কয়েকদিন।
আমাদের স্টিমার ঘাটার নাম ছিল গোয়ালন্দ। সেইখানে প্রথম আমার বাবা আমাকে মিথ্যে কথা বলতে শেখান। তারপর থেকে গুরু-মারা বিদ্যের মতন, বাবার সামনে আমিও যে কত মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলেছি তার ঠিক নেই, বাবা তার অনেকগুলো বিশ্বাসও করে ফেলতেন। ব্যাপারটা হল এই, আমার তখন ন-দশ বছর বয়েস, বাবার হাত ধরে নৌকো থেকে নেমেছি গোয়ালন্দে। তখন সকাল ন’টা, এক ঘণ্টা পরে স্টিমার ছাড়বে। স্টিমারে খাবার পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, পাওয়া গেলেও দাম বেশি। বাবা গোয়ালন্দেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে চান। সেখানে শুধু মুসলমানের হোটেল আর হিন্দুর হোটেল নয়, হিন্দুদের মধ্যেও বামুনের হোটেল, কায়স্থের হোটেল আলাদা আলাদা। বামুনের হোটেলে তখনও চুলো ধরেনি। কায়স্থের হোটেল থেকে গরম-গরম ভাত আর বিউলির ডালের মন হু-হুঁ করা গন্ধ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে বাবা আমায় নিয়ে গটগট করে ঢুকে গেলেন কায়স্থের হোটেলে। ডাল-ভাত আর ইলিশমাছ ভাজা, কাঁচালঙ্কা সহযোগে, অতিশয় পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া হল। বেরিয়ে আসবার পর বাবা চুপিচুপি বললেন, এই কথাটা কারুকে বলবার দরকার নেই। যদি কেউ জিগ্যেস করে তো বলবি যে বামুনের দোকানেই খেয়েছি।
প্রথম সেই মিথ্যে বলার দীক্ষায় আমি দারুণ রোমাঞ্চিত বোধ করেছিলুম। পরবর্তী কালে আমার পিতার এই শিক্ষা আমার জীবনে খুবই কাজে লেগেছে।
অবশ্য, এর কয়েক বছর পর স্টিমারের মুসলমান খালাসিদের রান্না মুরগির ঝোল আর ভাত আমরা সপরিবারে উপভোগ করেছি। অতি অল্পকালের মধ্যেই আমার বাবা প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিলেন।
গোয়ালন্দ হোটেলের একটা গল্প এখানে শোনানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ঘটনাটা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়। তবু যেন মনে হয় দেখেছি-দেখেছি। কানে শোনাও তো এক রকমের দেখা। রাজারা যেমন কর্ণেন পশ্যতি। গোয়ালন্দের এক হোটেলে তিনরকম খাওয়ার রেট ছিল। ডাল-ভাত আর একটা তরকারি তিন আনা, এর সঙ্গে দু-পিস মাছ নিলে ছ আনা। মাঝখানে একটা চার আনার রেট ছিল, তাতে ঝোল-ভরতি একটা মাছের বাটি সামনে রেখে দেওয়া হতো, মাছের ঝোলটা শুধু ঢেলে নিয়ে মাছ দুটির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে ভাত খাওয়া একে বলা হত মাছের দেখনাই। একজন খদ্দের সেই দেখনাই রেটের খাবার নিয়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর সে কাউন্টারে গিয়ে এক টাকার নোট দিয়েছে, দোকানের মালিক তার থেকে নিল পাঁচ আনা! খদ্দেরটি বলল, এ কী! বেশি নিচ্ছেন কেন, আমি তো মাছ ফেরৎ দিয়েছি। দোকানদারটি একগাল হেসে বলল, তুই যে চষছস (চুষেছিস)!
এই রকম দেখনাই-এর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও অনেকবার ঘটেছে। প্রথমবার যেখানে ঘটেছিল, তা কোনও এলেবেলে জায়গায় নয়, ভারতের গ্রীষ্ম-রাজধানী সিমলা নগরীতে। তখন সবেমাত্র কলেজে উত্তীর্ণ হয়েছি। সিমলার আপার বাজারের এক মহার্ঘ হোটেলের কাঁচের শো কেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর এক বন্ধু। বারবিকিউ করা আস্ত-আস্ত মুরগির দিকে তাকিয়ে আমাদের জিভে জল আসছে, কিন্তু সে হোটেলের ভেতরে ঢোকার কোনও উপায় আমাদের নেই। একটা পয়সাও নেই আমাদের পকেটে। কথাটা একেবারে আক্ষরিক অর্থে সত্যি, একটিও পয়সা নেই আমাদের কাছে।
আমরা উঠেছিলুম সিমলা কালীবাড়ির অতিথিশালায়। অতিথিশালা মানে তো বিনামূল্যে থাকা খাওয়া নয়, চার টাকা করে ঘর ভাড়া, আর খাওয়ার ব্যাপারটা বাইরে। ঘর ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্যও আমাদের নেই, সেখানে আমরা বেয়ারিং হয়ে আছি।
কলকাতা থেকে সুদূর সিমলা যাওয়ার জন্য যারা খরচপত্তর করে তারা কি এত দরিদ্র হয়? আসলে বিনা রেলভাড়ায় সারা ভারত চষে চেড়ানোর এক অপূর্ব সুযোগ তখন আমরা পেয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের এক বন্ধুর বাবা রেলে চাকরি করতেন। তাঁর দুই ছেলের জন্য তিনি বছরে দুবার পেতেন রেলের পাস, কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত। আমি ও আমার আর এক বন্ধু নাম ভাঁড়িয়ে সেই পাস ব্যবহার করতুম। রেলের পাস তিন মাস মেয়াদি হয়। এমনও হয়েছে, সেই এক জোড়া পাস নিয়েই আমাদের বন্ধুদের দল থেকে দুজন দুজন করে একাধিকবার ভ্রমণ করে এসেছি।
বাড়িতে স্বেচ্ছায় রেশান আনা কিংবা বাজার করার ভার নিয়ে, তার থেকে প্রতিদিন কিছু-কিছু পয়সা সরিয়ে পঁচিশ-তিরিশ টাকা জমলেই বেরিয়ে পড়তুম আমরা। সেবারে আমি ও আমার বন্ধু দীপক রেরিয়েছি। প্রথমে আমার টাকা, তারপর দীপকের টাকা খরচ করবার কথা। দিল্লি পার হয়ে সিমলার পথে যাওয়ার সময়ই দীপক ঘোষণা করেছিল যে ওর ম্যানি ব্যাগটা চুরি গেছে! আমি ম্যানি ব্যাগ ব্যবহার করি না কখনও, তাই চুরি যাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। দীপকের সেই বার্তা শুনে আমার তো মাথায় হাত। আমার কাছে তখন আর মোটে পাঁচ টাকা আর কয়েক পয়সা আছে। এই সম্বল নিয়ে আমরা সিমলায় পৌঁছে বাঁচব কী করে?
সিমলার কালীবাড়িতে আশ্রয় নিয়েই দুখানা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম কলকাতায় ও দিল্লিতে বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য চেয়ে। বাড়িতে কিছু জানাবার সাহস ছিল না। আর বাকি পয়সা দিয়ে আমরা তখুনি কয়েকখানা পাঁউরুটি আর কিছু চিনি কিনে নিয়েছিলুম। দিন দুয়েক শুধু সেই চিনি পাঁউরুটি খেয়ে কাটানোর পর মনে হয়েছিল, ফাঁসির আসামিরাও আমাদের তুলনায় অনেক ভালোভাবে থাকে। তারপর আমরা সেই পাঁউরুটি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতুম। ভালো-ভালো হোটেলের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, উত্তম আমিষ-আহার্যের দৃশ্য ও ঘ্রাণ নিয়ে তারপর স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিবোতুম সেই পাঁউরুটি। ঠান্ডার দেশ বলে পাঁউরুটিগুলো পচে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, এই যা সৌভাগ্য।
সেবারের সেই ভ্রমণযাত্রার উপসংহারটিও বলা যায় এতদিন পর নির্ভয়ে। চারদিনের মধ্যে আমাদের কাছে কোনও টাকা এসে পৌঁছয়নি। তখন আমাদের অবস্থা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে আর সিমলায় থাকতে ভরসাও পাচ্ছি না। মনের অবস্থা এমন যে যে-কোনও ছুতোনাতায় দুই প্রাণের বন্ধু তেতোভাবে ঝগড়া করছি। শেষ পর্যন্ত অতিথিশালার ভাড়া না মিটিয়েই এক দুপুরে চুপিচুপি চম্পট দিলুম। ট্রেন ধরার জন্য যতক্ষণ স্টেশানে থাকতে হয়েছিল, বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকলেও সর্বক্ষণ বুক ঢিপঢিপ করেছে, এই বুঝি কালীবাড়ির লোকজনেরা এসে চড়াও হয়!
আর একবার এক ভিখিরি দম্পতিকে খুবই ঈর্ষা করেছিলাম আমি। সেটাও ওইরকম বিনা রেলভাড়ায় ভ্রমণের সময়কার ব্যাপার। আমাদের কাছে যে পাস ছিল, তা নিয়ে আমরা যে কোনও স্টেশনে ব্রেক জার্নি করতে পারতুম। সেবারে যাচ্ছি দক্ষিণের দিকে। এবারেও আমার সঙ্গী দীপক। আগেরবারে দীপকের মানি ব্যাগ হারানোর গল্পটি আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য হয়নি বলে এবারে প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছি, একদিন আমার খরচ, পরের দিন দীপকের খরচ। এই নিয়মে চলবে। পয়সা বাঁচাবার জন্য আমরা আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম, যেসব স্টেশনে আমরা নামব, সে সব জায়গায় আমরা হোটেল ভাড়া দেব না। সারাদিন শহরে ঘোরাঘুরি করে রাত্রে এসে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে শুয়ে থাকা যাবে চমৎকার।
ঘুরতে-ঘুরতে আমরা এসে পৌঁছেছি হায়দ্রাবাদ স্টেশনে। সদ্য শীতকাল বলে আমাদের সঙ্গে মালপত্র একটু বেশি। সোয়েটার, আলোয়ান, কম্বল এসবই আনতে হয়েছে। হায়দ্রবাদ শহরে দিনের বেলা বেশ গরম। তা ছাড়া ঝাড়া হাতপায় ঘুরে বেড়ানো অনেক আরামদায়ক বলে আমরা সব গরম জামা-কাপড় সুটকেস বন্ধ করে জমা দিয়ে গেলুম লেফট-লাগেজে। রাত্রে এসে ছাড়িয়ে নিলেই হল।
হায়দ্রাবাদে দ্রষ্টব্য জায়গা অনেক। এক সালোয়ারজং মিউজিয়াম দেখতেই তো সারাদিন লেগে যাওয়ার কথা। সময় বাঁচাবার জন্য আমরা একই দিনে ওই মিউজিয়াম আর গোলকুণ্ডার দুর্গ দেখার উদ্যোগ নিয়েছিলুম। গোলকুণ্ডা থেকে ফেরবার পথে বাসে কী সব গোলমাল হল, ফিরতে-ফিরতে বেজে গেল রাত সাড়ে দশটা। স্টেশনের বাইরের দোকানে অতি উত্তম গো মাংসের কাবাব ও গরম-গরম রুটি খেয়ে পেট ভরিয়ে ফিরে এসে এক নিদারুণ দুঃসংবাদ পেলুম। লাগেজ অফিস রাত এগারোটায় বন্ধ হয়ে গেছে, কেরানিবাবু চাবি নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন, আমাদের সুটকেস সে রাতে ফেরত পাওয়ার কোনও উপায় নেই।
হায়দ্রাবাদের দিন ও রাত্রির চরিত্রের কোনও মিলই নেই। দিনের বেলা যেখানে পাতলা জামাই যথেষ্ট ছিল এবং তাতেও মাঝে-মাঝে ঘাম হচ্ছিল, সেই শহরেই রাত্তিরের বাতাসে হাড় কেঁপে যাচ্ছে। বিনা শীতবস্ত্রে আমাদের রাতে কাটাতে হবে, এই চিন্তাতেই আমাদের আরও বেশি শীত করেছিল। আমাদের সবই আছে, অথচ কিছুই নেই। তখনও আমরা সিগারেট ধরিনি, হুইস্কি-ব্র্যান্ডি বা গাঁজা-গুলিরও স্বাদ পাইনি, সুতরাং শীত কাটাবার উপায়ান্তরও জানি না।
লাগেজ-রুমের খুব কাছেই একটা কাঠের বেঞ্চে আমরা দুজনে ঠায় বসে রইলুম। মাঝে মাঝে পরস্পরের দিকে আমরা রোষকষায়িত নেত্রে তাকাচ্ছি, অর্থাৎ দেরি করে ফেরার জন্য আমরা পরস্পরকে নীরবে দায়ী করছি। ক্রমশ তিনকেলে বুড়োর মতন আমাদের হাত-পা গুটিয়ে দ-হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা! সত্যিই একেবারে অসহ্য শীত!
একটা কোনও ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অনেকগুলো আলো-টালো নিভে স্টেশনটা একেবারে নিঝুম হয়ে গেল। আমাদের ঘুম আসবার কোনও উপায় নেই। এই সময় একটি ভিখিরি-পরিবার, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও একটি বাচ্চা, হাজির হল আমাদের সামনে। আমাদের অবস্থা দেখে করুণাবশত তারা ভিক্ষে চাইল না, কাছেই মেঝেতে তারা তাদের বিছানা পাততে শুরু করল। স্টেশনের ভিখিরিদেরও কিছু সম্বল থাকে। প্রথমে তারা জায়গাটি পরিষ্কার করল পা দিয়ে, তারপর দুটি মাদুর পাতল। তাদের বালিশও রয়েছে। শুয়ে পড়ার পর তারা তিনজনে মিলে দু খানি শতচ্ছিন্ন কম্বল চাপা দিল গায়ে। এবং একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দ্বেষ-অভিমান ভুলে আমি ও দীপক পরস্পরের দিকে চুম্বক আকৃষ্টের মতন চেয়ে রইলুম। আমাদের দুজনেরই চোখের ভাষা এক। আমাদের চেয়ে এই ভিখিরি পরিবারটি কত সুখী!
এই কাহিনিরও একটা উপসংহার আছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আমরা আবিষ্কার করেছিলুম যে আমরা দুজনে ওই ভিখিরি পরিবারের সঙ্গে জাপটা-জাপটি করে ওদেরই কম্বলের নীচে শুয়ে আছি। মাঝরাত্রে কোনও এক সময় আমরা বেপরোয় হয়ে উঠেছিলুম, ওরাও বিশেষ আপত্তি করেনি।
একটা বয়েস পর্যন্ত ছেলেদের তাদের বাবা-মা কোনও অনাত্মীয়দের সঙ্গে বাইরে যেতে দেন। আমি কিন্তু সেইরকম বয়েস থেকেই পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরতে শুরু করেছি। আস্তে-আস্তে সইয়ে নিতে হয়েছে। প্রথম-প্রথম বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ফিরে আসার পর বকুনি খেতে খেতে রোমহর্ষক সব গল্প বলতুম বানিয়ে। তারপর যেতে শুরু করলুম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। চিলড্রেন্স ফ্রেশ এয়ার অ্যান্ড এক্সকারশান সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান কলকাতার দরিদ্র ছেলেমেয়েরা যাতে কিছুটা অন্তত মুক্ত বায়ু সেবনের সুযোগ পায় সেই জন্য বছরে দুবার করে একদল ছেলেমেয়েকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেত। কিছু সদাশয় ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলেন এবং মিসেস সোম নামে এক সহৃদয়া রমণী ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। রেল কোম্পানি, রেডক্রস ইত্যাদি সংস্থাও অনেক জিনিসপত্র দিয়ে এই উদ্যোগকে সাহায্য করত। যেসব ছেলেমেয়ে নির্বাচিত হত, তাঁদের দিতে হত মাত্র পাঁচ টাকা। স্কুল শিক্ষকের ছেলে হিসেবে আমার নির্বাচনের খুব সহজ যোগ্যতা ছিল। এই রকম পাঁচ টাকা চাঁদা দিয়ে আমি স্কুল-জীবনে অনেকবার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেওঘর মধুপুর রাঁচি ইত্যাদি জায়গা ঘুরে এসেছি। শুধু যে তিন-চার সপ্তাহের জন্য বেড়ানো হত তাই-ই নয়, সেই সঙ্গে টুথপেস্ট-টুথব্রাশ, কম্বল, চিরুনি, হাওয়া দিয়ে ফোলানো বালিশ, গুঁড়ো দুধের প্যাকেট এসব উপহারও পেতুম।
এ ছাড়া আমি ছিলুম বয়েজ স্কাউটের সদস্য। দার্জিলিং-কাশ্মীর সমেত প্রত্যেকটি স্কাউট ক্যাম্পে আমি যোগ দিয়েছি, খরচও যৎসামান্য, পনেরো-কুড়ি টাকার বেশি ছিল না তখন। বয়েস স্কাউট ক্যাম্পগুলি ছিল দারুণ আনন্দের, অনেকরকম নিয়ম কানুনের কড়াকড়িতেও একটু আনন্দ উপভোগ রোধ করতে পারত না। এই সব ক্যাম্প থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছিও বটে। যেমন রান্না। স্কাউটদের রান্নার পরীক্ষা দিতে হয়, তাতে বুকিং ব্যাজ পাওয়া যায়। মুসুরির ডাল ও বেগুনের ভাজা রান্নায় আমি সতীর্থদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলুম।
নিজের বাক্স-বিছানা নিজেই গুছিয়ে এই রকম বাইরে-বাইরে ঘোরার অভ্যেস করে ফেলেছিলুম বলে, স্কুল বয়েসের শেষ দিকে কিংবা কলেজে উঠেই যখন বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে কোথাও যাওয়ার দাবি তুলেছি তখন অভিভাবকরা আর বিশেষ আপত্তি করেননি। সেইসময় থেকেই আমি টিউশানি করা শুরু করি। এবং সেই টাকায় আমার সফরের ব্যায় নির্বাহ হত। অবশ্য এই সময় স্বাবলম্বী হওয়ার আগেই আমার আগ্রা-দিল্লি-কাশ্মীর-বোম্বাই-দার্জিলিং-শিলং ইত্যাদি বিখ্যাত জায়গা প্রায় সবই দেখা হয়ে গেছে।
তখন আমার চোখ পড়ল ছোটখাটো জায়গার দিকে। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা ছোট ছোট টিলার সারি, কিংবা একটা কোনও নগ্ন-নির্জন গিরি-নদী কিংবা কোনও নাম-না-জানা জঙ্গল, অমনিই ইচ্ছে করে সেখানে নেমে যেতে। কোনও অ্যাডভেঞ্চারের নেশা নয়, এমনিই যাওয়া, যেন কেউ হাতছানিতে ডেকেছে। সেই বয়েসে হৃদয় সবসময়েই যে-কোনও বিস্ময়বোধের জন্য উন্মুখ, যা প্রথম দেখি, তাই-ই মনে হয় নতুন, তখনও মনে-মনে ভালো লাগা, মন্দ লাগার কোনও সংজ্ঞা তৈরি হয়নি। মনে আছে, একবার আমার বন্ধু আশুতোষ ঘোষের সঙ্গে বহরমপুরের একটা খুব ছোট হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে কয়েকদিন ছিলুম। প্রথমিক উদ্দেশ্য ছিল মুর্শিদাবাদের নবাব বাড়ি ও খোসবাগ ইত্যাদি দেখা। কিন্তু ওসব দেখার জন্য তো একটা দিনই যথেষ্ট, তবু আরও দিনের পর দিন সেই হোটেলে থেকে যাওয়ার কোনও কারণই ছিল না, শুধুমাত্র একটা অচেনা জায়গায় জীবনযাপন করে আমরা অপূর্ব আনন্দ পেয়েছিলুম।
একবার আমরা চার-পাঁচ বন্ধু ট্রেনে যেতে-যেতে (বিনা টিকিটে অবশ্যই, পরে ধরা পড়ে দণ্ড দিতে হয়েছিল) একটা বেশ ছিমছাম ছোট স্টেশন দেখে পছন্দ করে সেখানেই নেমে পড়েছিলুম। অনেকটা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নামের উপন্যাসের চরিত্রগুলির মতন। অবশ্য আমরা মোটেই ওই উপন্যাসের অনুকরণ করিনি, ওই উপন্যাসটিই বরং আমাদের জীবনের ঘটনা টুকেছে। স্টেশনটির নাম ধলভূমগড়, তখন সেখানে মনুষ্যবসতি বেশ বিরল ছিল, এবং কাছেই ছিল একটি পেঙ্গুইন এডিশান সাইজের জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কোনও হিংস্র জানোয়ার নেই, কিন্তু এমনই আমাদের কেরামতি যে সেই জঙ্গলে রাত কাটাতে গিয়েও আমরা আমাদের জীবন বিপন্ন করেছিলুম। আবার এর বিপরীত ঘটনাও আছে। সুন্দরবনের গহিন জঙ্গল আর বিপজ্জনক নদীতে রাত দুটোর সময় যখন বাঘের পেটে না হলেও ডাকাতের হাতে প্রাণ যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা, তখনও সেখানে আমরা নির্বোধ দেবশিশুর মতন ঘুরে বেরিয়েছি, গায়ে সামান্য একটা আঁচড়ও লাগেনি। সম্ভবত সুন্দরবনের ডাকাতরা দূর থেকে লক্ষ করে আমাদের আরও বড় কোনও ডাকাতের দল ধরে নিয়েছে এবং ভয়ে পালিয়েছে।
একটা বয়েসে যখন-তখন প্রাণের ঝুঁকি নেওয়ার একটা দারুণ নেশা থাকে। রাজনীতি বা আদর্শবাদের জন্য যে-কারণে কিশোর-তরুণরা অবহেলে প্রাণ দেয়। আমি অল্প বয়েসে কিছুদিন বাম ছাত্র-রাজনীতি ও দু-একটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলুম, কিন্তু বেশিদিন লেগে থাকতে পারিনি। মিছিল আমার সহ্য হয় না। আর দশজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একই কথা বলতে আমি কিছুতেই পারি না, বাধো বাধো লাগে। এটা আমার দোষ হোক বা যা-ই হোক। তবে, যে-বয়েসে নকশালপন্থী ছেলেরা আদর্শের জন্য মৃত্যু হাতে নিয়ে খেলেছে, সেই বয়েসে আমরা কয়েক বন্ধুও পাহাড়ে-করে-জঙ্গলে অনেকবার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার তোয়াক্কাই করিনি। অতি তুচ্ছ কারণে আমি ও আর কেউ-কেউ দু-তিনবার অন্তত নির্ঘাত মরে যেতে পারতুম, বেঁচে গেছি অলৌকিকভাবেই বলা যায়। এই ব্যাপারটাতে রোমান্টিক ভাববিলাস মনে হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে যে একটা গূঢ় কিছু খোঁজারও ব্যাপার আছে, তা অনেকেই বুঝবে না, কেউ-কেউ হয়তো বুঝবে।
জীবনের নানা স্তরে বন্ধু-বান্ধবদেরও পালা বদল ঘটে। আমার জীবনে এক সময় দুই চট্টোপাধ্যায় শক্তি ও সন্দীপন, আর সমীর রায়চৌধুরী-পর্ব কেটেছে। সমীরই আমাদের মধ্যে প্রথম চাকরি পায় ও বিবাহ করে। তা হলেও সে ঠিক সংসারী হয়নি, একটা বাউণ্ডুলেপনা তার রক্তে মেশা ছিল এবং বন্ধুদের জন্য তার ছিল সব সময়ের উদাত্ত আহ্বান। চাইবাসা, ডাল্টনগঞ্জ ও সিংভূম সাঁওতাল পরগনার অন্যান্য জায়গায় সে যখনই বদলি হয়ে গেছে, প্রত্যেকবারই আমরা কয়েকজন সেখানে আচম্বিতে উপস্থিত হয়েছি। বিহারের এই সব ছোট শহরের কাছাকাছিই চমৎকার সব জঙ্গলে অধিষ্ঠিত ডাকবাংলো আছে। বড় মোহময় সেই সব অঞ্চল। কোনওরকম পরিকল্পনা নেই। টাকাপয়সার সে-রকম জুত নেই, তবু আনন্দ ছিল স্বতোৎসার। নিরিবিলি জঙ্গলে বসে থাকা বা গড়ানো কিংবা আদিবাসীদের হাটে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া, এরই আকর্ষণ ছিল সাংঘাতিক। একবার একটা শুকনো নদীর খাতে অসংখ্য ফড়িং দেখেছিলুম। অত ফড়িং কেন ছিল সেখানে? একদা সেই নদীটির জলস্রোতের শব্দ শুনেছে সেখানকার জঙ্গল, সেই শব্দ আর নেই, সেই শূন্যতা ভরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি সেই ফড়িংয়ের ঝাঁক সেখানে ডানার গুঞ্জরণ তুলত?
সন্দীপনের ছিল নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী প্রতিভা। আপাতত যা অসম্ভব বলে মনে হয়, সেদিকেও এগিয়ে যেতে সে অপরাজুখ। তবে সন্দীপন পুরোটা যায় না, খানিকটা এগিয়ে, খানিকটা গণ্ডগোল পাকিয়ে তারপর সে অন্যদের সামনে ঠেলে দেয়। সন্দীপনের পরিকল্পনায় আমরা অনেকবার অচেনা রাজ্য আবিষ্কারে গেছি। শক্তি প্রকৃত অর্থেই বেপরোয়া। শক্তি কোনও পরিকল্পনার ধার ধারে না, কোনও একটা জায়গায় গিয়ে পড়তে পারলেই হল, তারপর আর ফেরার নামটি নেই। শক্তি পেছনে ফিরতে চায় না, এই বাংলোর পর আর এক বাংলো আছে, এই জঙ্গলের পর অন্য জঙ্গল। শারীরিক দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়ারও এক অদ্ভুত প্রতিভা আছে শক্তির। কতবার যে ওর মাথা ফেটেছে, হাত-পা ভেঙেছে তার ঠিক নেই। এমনও বেশ কয়েকবার হয়েছে, কোনও অভিযানের মধ্যপথে হাত-ভাঙা বা পা-ভাঙা শক্তিকে নিয়ে আমরা ফিরে এসেছি। কলকাতার হাসপাতালে।
আমাদের দলে সেই সময় আর এক বন্ধু থাকত, তার নাম ভাস্কর দত্ত, যে এখন বিলেতে প্রবাসী। এই ভাস্করের দুঃসাহস ছিল তুলনাহীন, আর যে কোনও অচেনা লোকের কাঁধে হাত দিয়ে নিমেষের মধ্যে তাকে সে অন্তরঙ্গ করে নিতে পারত।
বলাই বাহুল্য, এই দলে আমিই ছিলুম সবচেয়ে সাদামাটা।
ওই সব জায়গায় ঘোরার পর আমাদের জঙ্গলের নেশা ধরে যায়। তারপর ভারতের বহু জঙ্গল আমরা কখনও দল বেঁধে, কখনও আলাদাভাবে ফুঁড়ে ফেলেছি।
বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে ভ্রমণ যেমন মহা আনন্দের, আবার একলা-একলা ঘুরে বেড়ানোরও অন্যরকম মজা আছে। ইদানীং একলা বেড়াতেই আমি বেশি পছন্দ করি। বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেন যাত্রায় কামরার অন্য কোনও লোকের দিকে নজরই পড়ে না, অথচ যখন একা যাই, তখন কামরার সব দৃশ্য ঠিক সিনেমার মতন মনে হয়, স্মৃতিতে জমা হয় অনেকগুলো চরিত্র।
পরিচিত পরিবেশ ছাড়িয়ে দূরে কোথাও নির্জন জায়গায় থাকলে নিজের সঙ্গে দেখা হয়। মাঝে-মাঝে নিজের সাহচর্যও তো দরকার। মনে পড়ে, মধ্যনিশীথে শ্বাপদসংকুল মানস অরণ্যে, মানস নদীর পাশে একা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা। ওপরে পরিষ্কার তারা ভরা আকাশ, মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে হরিণের ডাক। সেইরকম সময়ে মনে হয় সারা পৃথিবীতে আর কোনও মানুষ নেই। কিছুক্ষণ পরে আমি ফিসফিস করে জিগ্যেস করেছিলুম, কেমন আছ, সুনীল? আমায় চিনতে পার? সে রাত্রে সংলাপ বেশ জমেছিল।
একবার হঠাৎ খেয়াল হল আন্দামান যেতে হবে। কিনে ফেললুম একখানা জাহাজের টিকিট। বন্ধুবান্ধবরা জিগ্যেস করল, ওখানে যাচ্ছ কেন? কেউ নেমন্তন্ন করেছে? ওখানে কেউ চেনা আছে? না এবং না। তবে কেন যাচ্ছ? এর উত্তরে আমি এভারেস্ট সম্পর্কে এক বিখ্যাত অভিযাত্রীর মন্তব্যের কায়দায় বলেছিলুম, বিকজ ইট ইজ দেয়ার!
সেই প্রথম আমার সমুদ্রযাত্রা। এর আগে আকাশপথে সমুদ্র ডিঙিয়েছি বেশ কয়েকবার, কিন্তু জাহাজে ভাসিনি। দু-দিন যাওয়ার পর বঙ্গোপসাগরে ঝড় উঠল। প্রবল ঝড়ে জাহাজ থেমে রইল প্রায় গোটা দিন। আমার যে কী তীব্র আনন্দ হয়েছিল। এটা যেন উপরি পাওনা! টিকিটের দামের সঙ্গে তো একখানা এইরকম ঝড় উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল না। শরৎচন্দ্রের লেখায় সেই যে আছে, ‘কর্তা, কাপ্তেন কইছে সাইক্লোন হতি পারে’–সেই সাইক্লোন যে আমি কোনওদিন নিজের চক্ষে দেখব, তা কল্পনাও করিনি! সেই দুর্দান্ত ঝড়ের মধ্যে আমার নাচতে ইচ্ছে করছিল। ভয় পাইনি একটুও, কারণ আজকাল জাহাজডুবির সম্ভাবনা খুবই কম। বঙ্গোপসাগরে যে এত হাঙর আছে আর উড়ুক্কু মাছ, তাও জানতুম না আগে। প্রথম উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক দেখে যেন
নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, মানুষখেকো মাছ পিরানহা কিংবা ইলেকট্রিক মাছ কিংবা উড়ুক্কু মাছ এই ধরনের সব অদ্ভুত জিনিস শুধু দক্ষিণ আমেরিকাতেই আছে। আমাদের কলকাতার এত কাছে উড়ুক্কু মাছ? উড়ুক্কু মাছ শুধু জল থেকে একবার লাফিয়ে উঠেই ডুব মারে না। মুনিয়া পাখির মতন এক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ ফরফর করে যে অনেকক্ষণ উড়ে বেড়াতে পারে, তাও আমার জানা ছিল না। পরে অবশ্য পোর্ট ব্লেয়ারে উড়ুক্কু মাছ ভাজা খেয়েছি। অনেকটা পার্শে মাছের মতন।
আন্দামান পশ্চিমবাংলার প্রতিবেশী। অথচ আন্দামান সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। পোর্ট ব্লেয়ার এমনই এক আধুনিক শহর, যেখানে বাড়িতে বসে টেলিফোনে ট্যাক্সি ডেকে পাঠানো যায়, এ খবর কজন জানে? আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সৌন্দর্য ইটালির ক্যাপ্রি ইত্যাদিকেও হার মানাতে পারে।
একটা দ্বীপে হাঁটতে-হাঁটতে সমুদ্রের ধারে উপনীত হয়ে দেখেছিলুম এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা বিশাল শিংওয়ালা হরিণকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে জলের ধারে। হরিণটার আধখানা দেহ ডুবে গেছে জলে, কিন্তু সে বেঁচে আছে। সমুদ্রে তখন জোয়ার আসছে, ঢেউগুলো যেন লোভী জিভের মতন ছলাৎছলাৎ করে ধাক্কা মারছে তার গায়ে। তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে হরিণটা আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও হরিণটাকে বাঁচাতে পারিনি। ওর কাছাকাছি এগুলেই ও শিং দিয়ে ঝাঁপটা মারার চেষ্টা করছিল। অবিলম্বেই জোয়ারের জল তাকে টেনে নিয়ে গেল।
পরে জেনেছিলুম, ওই দ্বীপে হরিণের সংখ্যা সাংঘাতিক বেড়ে গেছে, হরিণের অত্যাচারে ফসল রক্ষা করা যায় না। হরিণের মাংস খেতে-খেতে অরুচি জন্মে গেছে বলে লোকে ফাঁদ পেতে হরিণ ধরে-ধরে জলে ফেল দেয়। সেই সময় পোর্ট ব্লেয়ারে হরিণের মাংসের কেজি চার টাকা, কোনও কোনও দ্বীপে এক টাকা দুটাকাতেও পাওয়া যেত।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রঙ্গত দ্বীপে যাচ্ছিলুম সার্ভিস লঞ্চে। সপ্তাহে একদিন সেই লঞ্চ যার ফলে সাংঘাতিক ভিড়। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় আমি সকালে টিকিট কাটার লাইন দিতে পারিনি, শেষ মুহূর্তে গিয়ে লঞ্চে উঠেছিলুম, স্থান পেয়েছিলুম ছাদের ওপর খোলা জায়গায়। সারাদিনের যাত্রা। আন্দামানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়। আমি একবার বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছি, আবার রোদ্দুরে গায়ে সব শুকোচ্ছে, এইরকমভাবে দশ-বারো বার। একটু বসবারও জায়গা পাইনি, আগাগোড়া ঠায় দাঁড়িয়ে। সারাদিনেও খাওয়াও জোটেনি। দুপুরে এক জায়গায় লঞ্চ থেমে ছিল, সেখানে নেমেই ছুটতে শুরু করেছিল সব যাত্রীরা। একটি মাত্র হোটেল, তাতে আগে যারা পৌঁছবে, তারাই খাবার পাবে। অন্যদের খাওয়া জুটবে না, কারণ ততক্ষণে লঞ্চ ছেড়ে দেবে। আমি অনভিজ্ঞ তাই আগে পৌঁছতে পারিনি। অভুক্ত অবস্থায় সারাদিন ধরে বৃষ্টি ভেজা ও রোদে পোড়া, এক সময় মনে হয়েছিল, দূর ছাই, এভাবে আর যেখানে সেখানে ছুটব না। ঢের পৃথিবী দেখা হয়েছে, এবারে ক্ষ্যামা দাও।
তবু, আন্দামানের কথা এখন মনে পড়লেই ইচ্ছে করে আবার সেখানে যাই। আবার সেই ঘন নীল সমুদ্রের বুকে লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।
আর একরকম বেড়ানোতে ইদানীং আমার বেশ নেশা ধরে গেছে। সেরকম বেড়ানো নিয়ে কোনও ভ্রমণ কাহিনি লেখা যায় না। কেষ্টপুর, স্বরূপনগর, বাণপুর ইত্যাদি সাধারণ নামের যে হাজার-হাজার গ্রাম রয়েছে, সেরকম কোনও-কোনও গ্রামে গিয়ে মাঝে-মাঝে চুপচাপ কয়েকটি দিন কাটিয়ে আসা। আমি গ্রাম সম্পর্কে তদন্ত করতে যাই না, কারণ লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু দেখি। এইভাবে কয়েকটা গ্রাম এবং সুন্দরবনের সঙ্গেও আমার খানিকটা চেনাশুনো হয়েছে।
আমি বিদেশেও বেশ কিছু ঘোরাঘুরি করেছি। কলকাতার কোনও জায়গায় একটা লোহা পুঁতলে সেটা পৃথিবী ফুঁড়ে উলটোদিকে যেখানে বেরুবে, সেখানেও গেছি, অর্থাৎ অর্ধেক পৃথিবী দেখেছি এমন দাবি করতে পারি। তাতে লাভ হয়েছে এই যে, এই রূপসি বসুন্ধরা যে মানুষের বসবাসের পক্ষে চমক্কার জায়গা সেই উপলব্ধি হয়েছে। কেস্টপুরে যেমন, রিভিয়েরাতেও তেমন মানুষ সমান সুখে বেঁচে থাকতে পারে। এই পৃথিবীকে যারা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, তারা জননীর কুপুত্র।