‘কাল সকালে মরুভূমি দেখতে বাবে?’
ভাবছিলুম কার সঙ্গে যাব। আরিজোনায় এসে ক্যাকটাসের মরুভূমি না দেখার কোনও মানে হয় না। ভুবন বিখ্যাত এই মরুভূমি, এমন আর দেখা যায় না কোথাও। এ মরুভূমি শুধু বালুকাময় নয়। অথচ গাড়ি ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। এমন সময়ে কানের কাছে দৈববাণীর মতো ডুমন্ডের প্রশ্ন।
ড্রুমন্ড হাডলি একজন তরুণ কবি, আমার চেয়ে বছর দু-একের ছোট হবে হয়তো (আমি এই জুলাইতে উনত্রিশ)। পাঁচ বছর আগে বিয়ের পর ভুমন্ড হানিমুন করতে গিয়েছিল কম্বোডিয়া ও ভারতবর্ষে। রথের মেলার সময় পুরীতে গিয়েছিল আসল সমুদ্র নয়, জনসমুদ্র দেখতে।
‘তবে এমন ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিলাম যে, ভ্রমণের অর্ধেক আনন্দই মাটি হয়ে গিয়েছিল’-ও বলল। বললুম, ‘দ্যাখো, আমাদের সরকারি হিসেবে ম্যালেরিয়া ভারতবর্ষ থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে, ওটা বোধহয়
-কম্বোডিয়া থেকে হয়েছিল, আমারও তাই মনে হয়।
-ভাগ্যিস তুমি বললে, তোমরা বললে দোষ নেই। আমি বললেই অন্য দেশের নিন্দে হয়ে যেত। একেই তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভারতবর্ষের বন্ধুত্ব নেই বললেই চলে।
বাড়িতে বাঘ পুষেছে ড্রুমন্ড। সত্যিকারের বাঘের বাচ্চা, মরুভূমি থেকে ধরা। ওর স্ত্রী, ভারী লক্ষ্মী, শ্রীময়ী মেয়েটি, পরীক্ষার জন্য খুব মন দিয়ে পড়াশুনা করছিল, আমি যেতেই শিষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল পাশ থেকে ঘর-ঘর-র-র করে উঠল বাঘের বাচ্চা। ‘ভয় পেয়ো না, আমাদের বেড়ালটা কারুকে কিছু বলে না!’
চারটে কাবুলি বেড়াল সাইজের ওই আট মাসের বাঘের বাচ্চাটা–দেখেই আমার হাড় হিম। একটা বড় ঘরে আলাদা করে রেখেছে ওটাকে–ওরা দুজনে বেড়ালের মতোই ওটার সঙ্গে খেলা করে। ব্যাপারটা গোপন, পুলিশে জানতে পারলে ধরে নিয়ে বাবে। আমি এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে সেই গল্পটা বললুম, সেই যে-কোনও এক ভদ্রলোক বাঘ পুষেছিলেন, তারপর বাঘ সেই লোকটার হাঁটু চাটতে-চাটতে হঠাৎ রক্তের স্বাদ পেয়ে ঘাঁক করে কামড়ে দেয়। ওরা দুজন হেসে বলল, একজন লোকে ফেইল করেছে বলে আমরা পারব না, তার কী মানে আছে। মানুষ অ্যাটমকে পোষ মানাচ্ছে–বাঘ তো দূরের কথা। তুমি কাছে এসে ওর গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখো না, কিছু বলবে না।’
আমি বললুম, ‘না ভাই থাক, দূর থেকেই দেখছি। এমনিতেই আমার শরীরে আঠারো ঘা আছে।’ সকাল ন’টা আন্দাজ ডুমন্ডের ভ্যান নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। অ্যারিজোনার টুসন শহরের একেবারে গা থেকেই মরুভূমি আরম্ভ। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট পাহাড়–তার ওপাশে মেক্সিকোর সীমানা।
-মরুভূমি সম্বন্ধে যা ভাবছ তা নয়, ডুমুণ্ড বলল, ‘অন্যরকম, দেখো, তোমার ভালো লাগবে। কিন্তু একটা কথা, মরুভূমি দেখে কবিত্ব করা চলবে না। বিশেষত এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড আবৃত্তি করা একেবারেই নিষেধ। আমি অনেক শুনেছি।’
‘সুন্দর দৃশ্য দেখলে আমার মনে মোটেই কবিত্ব জাগে না। আমার খিদে পায়।‘
‘কী?’
‘মাইরি বলছি, আমার খিদে পায়। অর্থাৎ আমার হৃদয় কাজ করে না, তার একটু নীচে, পেটে প্রতিক্রিয়া হয় আমার।
ও হেসে বলল, ‘ভয় নেই, আমার বউ কয়েকটা হ্যামবার্গার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।’
বিষম জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। আমি দুপাশের দৃশ্য দেখার বদলে ড্রুমন্ডকে দেখছিলুম। একটা ব্লু জিন আর গেঞ্জি পরেছে, মাথার চুল এলোমেলো। সুঠাম স্বাস্থ্য ও সাহস, বাড়িতে পরমাসুন্দরী স্ত্রী ও বাগান, বাঘ পুষেছে–এই একজন আমেরিকার তরুণ কবি। ভারী চমক্কার খোলামেলা ছেলে ড্রুমন্ড, কিন্তু একটা দোষ : যখন খুব উৎসাহে কথা বলে, তখন খাঁটি ওয়েস্টার্ন অ্যাকসেন্ট বেরিয়ে পড়ে–আমার পক্ষে বোঝা দুষ্কর হয়। ও বলল, ‘এখানে খুব জলের অভাব।’ তারপরই গড়গড় করে কী শুরু করল–আমি কি বুঝতে পারলুম না, তবুও সেনটেন্সের মধ্যে কমা, ফুলস্টপ বসাবার মতো মাঝে-মাঝে ‘হু হ্যাঁ’, ‘ও তাই নাকি’ করে যেতে লাগলুম। হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের দেশে এ সম্বন্ধে কী করো?’ আমি একেবারে গভীর জলে পড়লুম। যদিও বুঝতে পারলুম, ব্যাপারটা জল সম্বন্ধেই। এস্টিমেশন, ড্রিলিং এই সব শব্দ শুনেছি বটে। আমতা-আমতা করে বললুম, ‘আমি ঠিক—‘
‘ঠিক কোন জায়গা খুঁড়লে জল পাওয়া যাবে কী করে বুঝতে পারো?’ বললুম, ‘আমি ঠিক ও বিষয়ে কিছু জানি না। আমি জন্মেছি পূর্ববঙ্গে; সেখানে জল থাকাটাই একটা সমস্যা, না-থাকা নয়। রাজস্থানের দিকে ও সমস্যা আছে বটে কিন্তু ওরা কী করে আমি জানি না।’ একটু থেমে আবার বললুম, ‘একটা কথা বলব? তোমাদের দেশের অনেক কবির সঙ্গে কথা বলে দেখেছি–তাঁরা কবিতা ছাড়াও আরও অনেক বিষয় জানে। স্পেসশিপের কোথায়-কোথায় শূন্য স্টেশন হওয়া দরকার, হায়ারোগ্লি ফিকসের পাঠ্যান্তর, নদীর তলায় সুড়ঙ্গ বানাবার কী কী সমস্যা, বাঁদরের মস্তিষ্ক টেস্ট টিউবে আলাদা বাঁচিয়ে রাখার পর সেই অশরীরী মস্তিষ্কের দুঃখ ও আনন্দ বোধ থাকে কি না, ইন্দোনেশিয়ার প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা–এই সব। আমাদের দেশের কবিরা একটু ন্যালাখ্যাপা টাইপ, জেনারেল নলেজে শূন্য, ধুতি পাঞ্জাবিতে জেবড়ে থাকে, এক চেয়ারে বসলে ঘণ্টাপাঁচেকের কমে উঠতে চায় না, কবিতা ছাড়া আর কোনও বিষয়েই কিছু জানে না–হয়তো সেই জন্যই তোমাদের চেয়ে ভালো কবিতা লেখে।’
আমার শেষ কথা শুনে ও চমকে আমার দিকে তাকাল। তারপরই ঝকঝক করে হেসে উঠল। বলল, ‘কী জানি, হয়তো সত্যি। আমি বেশি পড়িনি–বিশেষ করে তোমাদের ওই হরিবল ট্রানস্লেশন টেগোরের লেখাও আমার মোটেই ভালো লাগেনি। কিন্তু তোমাদের একটা অসুবিধে আছে–যেটা আমাদের নেই। তোমাদের কাঁধের ওপর চেপে আছে তোমাদের ঐতিহ্য, তোমাদের ধর্ম। তোমরা নির্জন হতে পারো না। কিন্তু আমাদের ওসব ঝামেলা নেই-আমরা সবাই গভীর অন্ধকারের মধ্যে হাঁটছি, সুতরাং আমাদের প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে খুঁজতে হচ্ছে–আমরা নির্জন আধুনিক মানুষ সকলেই।‘
‘কিন্তু ঐতিহ্যের প্রতি তোমাদেরও লোভ কম নয়। তোমরা।
দ্যাখো, দ্যাখো, ওই দিকে দ্যাখো। আকাশে একটা বড় সাইজের পাখি দেখতে পেলুম। জিগ্যেস করলুম, ‘ওটা কী?’
গোল্ডেন ঈগল!
বিশাল ডানাওয়ালা সোনালি ইগল এই অঞ্চলে এখনও দেখতে পাওয়া যায় শুনেছিলুম, আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু ‘গোল্ডেন ইগল’ এ নামটা খুব চেনা, কলকাতায় বহু গ্রীষ্মের দুপুরবেলা ও নামে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেছে।
তাড়াতাড়ি একটা জোরালো দূরবিন যার করে ড্রুমন্ড ছুটল ওই পাখিটার পিছনে গাড়ি নিয়ে। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তায় কী দুঃসাহসিক গাড়ি চালানো–এক হাতে স্টিয়ারিং, এক হাতে দূরবিন নিয়ে বাইরে ঝুঁকে–চোখ রাস্তায় নয়, আকাশে। কিন্তু অমন দুঃসাহসীর পাশে বসেছিলাম বলে আমারও ভয় করল না। কী ভয়ংকর গতি ওই ইগলের–ঘুরতে ঘুরতে প্রায় মহাশূন্যে বিন্দুর মতো হয়ে গেল হঠাৎ আবার ঝুপ করে নেমে এল খুব নীচে -শোঁশে: করে আবার পেরিয়ে গেল পাহাড়ের পর পাহাড়, মিলিয়ে গেল দিগন্তে কয়েক মিনিটে। আমরা গাড়ি নিয়েও ওর সঙ্গে পাল্লাও দিতে পারলুম না।
ড্রুমন্ড বলল, ‘ওই ইগল আমেরিকার প্রতীক চিহ্ন।’
গাড়ি উঠে এসেছিল একটা ছোট পাহাড়ের মাথায়। ডানদিকে তাকিয়ে বিশাল মরুভূমি চোখ পড়ল। সত্যিই, আমাদের কল্পনায় যে মরুভূমির ছবি আছে–অর্থাৎ মাইলের পর মাইল হলুদ বালি, গনগনে হাওয়া–এ মরুভূমি সেরকম নয়। এ মরুভূমি জীবন্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সারা ভূমি জুড়ে অসংখ্য সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলো ক্যাকটাস, পশ্চিম অঞ্চলের বিখ্যাত ক্যাকটাস, সরল, দীর্ঘ, প্রত্যেকটা অন্তত দেড়শো-দুশো বছরের পুরোনো। প্রথম শাখা বেরোয় পঁচাত্তর বছরে–ওই শাখা বা ডানা গুনে বয়েস বোঝা যায়। ওগুলোকে বলে সাউয়ারো (স্প্যানিশ নামঃ Saguaro জি উচ্চারণ হল না)-গ্রীষ্মকালে ফুল ফুটতে থাকে-বীভৎসতার বদলে এ মরুভূমিকে মনোরমই দেখায়। মরুভূমি নয়; পুরোটাই যেন এক মরুদ্যান। এ ছাড়া আছে অন্য নানা জাতের ক্যাকটাস, প্রিকলি পিয়ার -বুনো শেয়াল, কাঁকড়া বিছে, ছোট বাঘ, যাটেল স্নেক, (ল্যাজে যেগুলোর খটখট আওয়াজ হয়), হরিণ। জল নেই, ফসল হয় না–কিন্তু মরুভূমির বদলে পোড়ো জমি কথাটাই মনে আসে। কিন্তু ড্রুমন্ড আগেই এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ডের উল্লেখ করতে যারণ করেছে।
এই মরুভূমির দশ্য আমাদের অদেখা নয়। আমেরিকার যাবতীয় ওয়েস্টার্ন ছবিতে দেখেছি, ঘোড়া ছুটোচ্ছে কাউবয়রা, কথায়-কথায় গোলাগুলি খুনোখুনি-এখানকার রেড ইন্ডিয়ানের প্রায় সবাইকে মেরে ফেলে এখন মিউজিয়মে পুয়েছে। অনেক রক্তপাত হয়েছে। এখানে রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে, তারপর স্প্যানিশদের সঙ্গে, তারপর সিভিল ওরারে। মরুভূমি মাত্রই রক্তলোভী, আরবের মরুভূমিও কম রক্ত শোষেনি। ড্রুমন্ড জিগ্যেস করল, ‘কেমন লাগছে?’ বললুম, ‘ভাই ড্রুমন্ড, যদি সত্য কথা বলতে হয়–এসব দৃশ্যই আমি আগে ছবিতে দেখেছি। এ দেখার চেয়ে, ছবিতে বেশি সুন্দর লেগেছিল।‘
–’যাঃ, তা হয় নাকি?’
‘তোমাকে ঠিক যুক্তি দেখাতে পারব না। এ জায়গাটা বড় বেশি বিশাল আমার পক্ষে, আমি ছোট করে, ফ্রেমের মধ্যে না দেখতে পেলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি না।’
-দুঃখের বিষয়, আমি ক্যামেরা আনিনি।
‘আরেকদিন পাহাড়ের ওদিকে গুহা দেখতে যাব, তখন।’ (পরে একদিন সেখানে অসিত রায় ও সুবোধ সেনের সঙ্গে গিয়েছিলাম)।
ছেলেমানুষের মতো ড্রুমন্ড বলল, ‘জানো এখানে হরিণ আছে? হয়তো এই মুহূর্তে দশটা হরিণ দশ দিক থেকে আমাদের দেখছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
আমাদের মোটামুটি গন্তব্য ছিল ডেজার্ট মিউজিয়ম–মরুভূমির ঠিক মধ্যে আসল পরিবেশে মরুভূমিতে যা কিছু পাওয়া যায়–তার প্রদর্শনী। ড্রুমন্ড জিগ্যেস করল, ‘তুমি কিছু মনে করবে, যদি আমরা একটু ঘুরে যাই? ওই ডানদিকের টিলাটা আমার দেখা হয়নি।’
আমি বললুম, ‘না-না, আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে ওটা দেখা হয়নি মানে? তুমি কি মরুভূমির সব জায়গা জানো নাকি?’
‘প্রায়, আমি প্রত্যেক সপ্তাহে এখানে আসি, এবং নানান জায়গা দেখি।’
‘কেন?’
প্রথমে ও কারণটা বলতে চাইল না। লাজুক হেসে আমতা-আমতা করতে লাগল। মুগ্ধ হওয়ার জন্য মরুভূমিতে প্রতি সপ্তাহে আসার মতো এরকম খেলো কবিত্ব ও করবে বলে আমার বিশ্বাস হল না। পরে কারণটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।
ড্রুমন্ড মরুভূমিতে সোনা খুঁজতে আসে। এই খোঁজা নতুন নয়। সোনার লোভেই সাদা চামড়ার লোকেরা আসে পশ্চিমে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত, তারপর একদিন দেখতে পায় প্রশান্ত মহাসাগর। সোনার লোভে কত হত্যাকাণ্ড হয়েছে নিজেদের মধ্যে। ভুলে গেছে মানুষের জীবন সোনার চেয়েও দামি। এতকাল সোনার লোভে একপাল লোক মরেছে সাদা হাড় ও কঙ্কালের স্তূপের মধ্যে ঝিকঝিক করছে দু-একটা সোনার দাঁত। কিন্তু এখনও সোনার লোভে কেউ আসে জানতুম না, শেষে কি একটা পাগলের পাল্লায় পড়লুম! কিন্তু ডুমন্ডের অমন সরল সুন্দর মুখে কোনও স্বর্ণলোভ দেখলুম না। সোনা নয়, সোনা খুঁজছে–এইটাই যেন বড় ব্যাপার।
রাঁবোর কবিতার মতো : যখন আমি ফিরব, আমি সোনা নিয়ে আসব।‘
‘তোমার সত্যিই ধারণা এখানে সোনা পাওয়া যায়?’
‘নিশ্চয়ই! কত লোক ছুটির দিনে আসে সোনা তৈরি করতে। কিন্তু তারা সারাদিনে যতটুকু সোনা পায় বালি হেঁকে-তাতে দিনের মজুরি পোষায় না। আমি খুঁজছি এমন একটা জায়গা–যেখানে অফুরন্ত সোনা। নিশ্চয়ই কোথাও আছে।’
পাকা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি চলল পাহাড়ি পথে। ডুমন্ডের গাড়িটাও ওরই মতো ডাকাবুকো। কড়কড়, মড়মড় শব্দ হতে লাগল, ডানদিকে বাঁ-দিকে বিষম হেলে পড়তে লাগল, তবু চলল ঠিকই। শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় থামল। আর রাস্তা নেই। আমরা নেমে হাঁটতে লাগলুম। ‘সাবধানে হেঁটো সুনীল, র্যাটেল স্নেক আছে খুব! অবশ্য ভয় নেই কামড়ালে মানুষ চট করে মরে না।’ খুব একটা ভরসা পেলাম না যদিও ও কথা শুনে। একটা ছোটো টিলা পেরোতেই দূরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল।
‘এখানে এই বিশ্রী মরুভূমিতে কে বাড়ি করেছে?’
‘জানি না, আমি আগে দেখিনি। তবে ভেব না, কোনও সাধু সন্ন্যাসী, তোমাদের ইন্ডিয়ার মতো নিশ্চয়ই কেউ সোনার লোভে এসেছে!’ বাড়ির সীমানায় বহুদূর থেকে কাঁটাতারের বেড়া। কোথাও কারুর কোনও সাড়া শব্দ নেই। আমরা দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকলুম। হলিউডের সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো–আমি প্রতি মুহূর্তে বন্দুকের গুলি আশা করছিলুম। কাছে এসে অবাক হয়ে গেলুম। বাড়িটা নতুন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত! যেন কোনও অতিকায় দানব এসে মহা ক্রোধে ওটাকে ধ্বংস করেছে। কোনও ঘরের ছাদ নেই, দেওয়ালে বড়-বড় ফুটো (বন্দুকের গুলির কিনা কে জানে!) আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করা। প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে কেউ ভেঙেছে নতুন রেফ্রিজারেটর -কিন্তু হাতুড়ি মেরে ভাঙা হয়েছে বোঝা যায়, গ্যাসস্টোভের শুধু পাইপগুলো ভেঙে বিকল করা হয়েছে নতুন কাঠের চেয়ার অথচ ভাঙা, সোফা কুশন ছুরি দিয়ে ফাঁসানো। আমি ডুমন্ডের মুখের দিকে তাকালুম। ও বলল ‘কী জানি, হয়তো ঝড়ে ভেঙেছে-মাঝে-মাঝে এখানে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। এখানে বাড়ি বানানোই বোকামি!’
আমি বললুম, ‘না, ঝড় অসম্ভব। মানুষের কাজ।’ ‘হতে পারে, একদল গ্যাংস্টার এসে লুটপাট করেছে। কেউ হয়তো এখানে ছুটি কাটাবার জন্য বাড়ি বানিয়েছিল। হয়তো কেউ থাকত না এখানে!’
ডায়নামো বসিয়ে ইলেকট্রিক কানেকশন পর্যন্ত ছিল, তারগুলো দেওয়াল থেকে ছেঁড়া, মেশিনটা তোবড়ানো। দেওয়ালে কুৎসিত ছবি–তাই দেখে প্রাক্তন বাসিন্দাদের রুচির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। সবই ন্যাংটো মেয়েমানুষ, কয়েকটা খড়ি দিয়ে আঁকা, একটি স্ত্রীলোকের শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শ্ল্যাং ভাষায় নাম লেখা, যেন কারুকে শেখান হয়েছে।
‘গুণ্ডারা এসব জিনিসপত্র ভেঙেছে কেন–নিয়ে যেতে তো পারত?’
মরুভূমিতে এসব জিনিসের লোভে কে আসে, সবাই আসে সোনার লোভে।’ ড্রুমন্ড বিষম উৎসাহ পেয়ে গেল ব্যাপারটাতে–শখের গোয়েন্দার মতো খুঁটিনাটি দেখতে লাগল। এক-একটা জিনিস পায়–আর আমাকে ডেকে-ডেকে দেখায়-আধপোড়া পিয়ানো, এক বাক্স ছেঁড়া জামাকাপড় এইসব। মরুভূমি দেখতে এসে কী এক রহস্যময় বাড়িতে এসে হাজির হলুম। হঠাৎ খানিকটা দূর থেকে ড্রুমন্ড আমাকে ডাকল। কাছে গিয়ে দেখলুম, ড্রুমন্ড মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসেছে। ওর সামনে একটা ছোট্ট কবর। একটা কাঠের ব্রুশে ছোট্ট একটা পতাকা–তাতে লেখা, ‘এই ভয়ংকর মরুভূমি আমাদের সাধের খোকনকে খুন করেছে। শ্রীমান ফ্রেডেরিক, (বয়স আট) ঈশ্বর তোমাকে আশ্রয় দেবেন।’ তারিখ খুব টাটকা, মাত্র একুশ দিন আগের। ডুমণ্ড গম্ভীরভাবে বলল, ‘চলো, আমরা এখান থেকে কেটে পড়ি। এখানে কোনও রহস্য আছে–শেষে আমরা পুলিশ কেসে জড়িয়ে পড়ব।’
ওই রহস্যময় বাড়ি পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে আমরা অন্যদিকে নেমে গেলুম। বিশাল ক্যাকটাসগুলো একটু আগেও যেন নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করছিল, আমাদের দেখে থেমে গেল। বিষম গরমে কান ঝাঁঝাঁ করছে। একটা নদীর খাতের মতো জায়গা দেখলুম, মাঝে-মাঝে বাঁধানো ঘাটের মতো, এক বিন্দু জল নেই। প্রাগৈতিহাসিক কালে হয়তো সেখানে নদী ছিল।
আমিই প্রথম সোনা আবিষ্কার করলুম। আমি আস্তে-আস্তে হাঁটছিলুম, মাঝে-মাঝে বসছিলুম ক্যাকটাসের ছায়ায়, কাঁটা বাঁচিয়ে–ড্রুমন্ড ছটপুজোয় মানত-করা মেয়েমানুষের মতো মাঝে-মাঝেই শুয়ে পড়ছিল মাটিতে–কোথাও গন্ধ শুকছে, কোথাও মাটিতে কানপেতে কী শুনছে এবং মাঝে-মাঝে ওর সেই ইমোশনাল ইংরেজিতে (দুর্বোধ্য) কী সব বলছে। এমন সময় আমি বেশ একটা গোল, নধর, পাউডার পাফ (ফরাসিরা বলে শাশুড়ির মাথা) ক্যাকটাসের তলায় দিব্যি একতাল সোনা দেখতে পেলুম। ঠিক একটা ছোটখাটো ফুটবলের সাইজ, রোদের আলো পড়ে ঝলসে দিচ্ছে! সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে হল–ড্রুমন্ড নিশ্চয়ই আমাকে অর্ধেক শেয়ার দেবে, তা হলে, ওটার দাম কত কে জানে দেশে ফিরে অন্তত বছরপাঁচেক আমাকে কোনও চাকরি করতে হবে না! সোনা, আমি সোনা পেয়েছি! আমি চেঁচিয়ে বললুম, ‘ড্রুমন্ড ওই দেখো!’
বিষম চমকে ও মুখ ফেরালে তারপর আমার আঙুল সোজা লক্ষ করে সোনার তালটা দেখতে পেয়ে ও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘ওঃ, তাই বলো! তুমি এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠলে–আমি ভাবলুম, সাপ না বাঘ! আমি আবার বন্দুকটা আনিনি!’
‘ও কী তবে?’
‘সোনা!’
কাছে গিয়ে ডুমণ্ড ওই জিনিসটাকে এক লাথি মেরে বলল, ‘বাস্টার্ড।’ সেই সোনার তালটা অমনি ভেঙে গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে গেল ঝুরঝুরে বালির মতন। অথচ ঠিক সোনার তালের মতনই দেখাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘এ কী!’ ও বলল, ‘এই জিনিসগুলো কম ঝামেলা করে? এর নাম কী জানো,বোকার সোনা, ফুলস গোল্ড। যা কিছু চকচক করে তাই সোনা নয়। বছরদশেক আগেও এ জিনিস আবিষ্কার করে কত লোক নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করেছে।’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আবার সেই সরল হাসি হেসে বলল, ‘ভাগ্যিস তুমি ওটা দেখতে পাওয়ার পরই পেছন থেকে আমাকে ছুরি মারোনি!’
বস্তুত, ব্যাপারটা এমন মেলোড্রামাটিক হল যে তারপর থেকে আমার বিষম বিশ্রী লাগতে লাগল। আর মরুভূমি দেখার সম্পূর্ণ ইচ্ছে চলে গেল আমার। ওটা দেখতে পাওয়ার পর মুহূর্তে আমার বুকের মধ্যে যে দুমদুম শব্দ হওয়া শুরু করেছিল–তা আর থামল না। বিষম ক্লান্ত হয়ে পড়লুম। ড্রুমন্ডকে স্বর্ণলোভী ভেবে মনে-মনে একটু ক্ষীণ অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিলুম-কিন্তু তখন, তারপর থেকে কোথা থেকে এক গভীর নিরাশা আমার বুক ভরে দিলে। যেন কেউ সেই মুহূর্তে কেড়ে নিল আমার পাঁচ বছর চাকরি না করার ছুটি, যেন পাঁচ বছর চাকরি করার পরিশ্রম একসঙ্গে সেই মুহূর্তে আমার কাঁধে চেপে বসল।
আমরা ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। ডুমন্ডের বউ-এর বানিয়ে দেওয়া হ্যামবার্গার আর স্যান্ডউইচ খেলাম। গাড়ির পিছন দিকটা খুলে ড্রুমন্ড কী যেন খেতে লাগল চোঁচেঁ শব্দে -মনে হল যেন পেট্রল খাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলুম ওখানে আলাদা একটা জলের ট্যাংক আছে। ঘন ঘন মরুভূমিতে আসার জন্য পাকা ব্যবস্থা। ‘ডানদিকের ওই অঞ্চলটা একটু দেখেই আমরা যাব মিউজিয়মে। তুমি আসবে আমার সঙ্গে?’
‘না, আমি এখানে বসছি। তুমি ঘুরে এসো।’
‘আমার ঘণ্টাখানেক লাগবে।’
একটু দূরে যাওয়ার পর আমি চেঁচিয়ে বললুম, ‘ড্রুমন্ড, সাবধানে ঘুরো। হারিয়ে যেও না–কিংবা, মরে যেও না। কারণ, আমি পথও চিনি না, গাড়িও চালাতে জানি না।’
একটু পরেই ড্রুমন্ড মিলিয়ে গেল দূরে। আমি একা গাড়ির ছায়ায় বসলুম। চারিদিকে এমন নিঃশব্দ যে ভয় করতে লাগল। হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, একটা শুকনো পাতারও শব্দ নেই। দূরে সেই পোড়ো বাড়িটা। আমি ওটার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে বসলুম। দুমানুষ-তিনমানুষ লম্বা ক্যাকটাসের সারি চলে গেছে মাইলের পর মাইল-সান্টা ক্যাটালিনা পাহাড় পর্যন্ত। নিস্তব্ধতা যেন জীবন্ত হয়ে ঘুরছে সেই মরুভূমিতে। আমার হাতঘড়ি নেই, সময় জানি না। একমাত্র শব্দ শুনছি নিজের হৃৎপিণ্ডের–তখন প্রবলভাবে দুমদুম করছে।
একটু শব্দ হলেই এদিক ওদিক তাকাই। মনে হয় বুঝি কোনও র্যাটেল স্নেক তাড়া করে আসছে। যাটেল স্নেক আগে দেখেছি আমি, লেজের দিকটা শুকনো হাড়, কটকট কট-কট আওয়াজ হয়। দেখলেই কেমন ঘেন্না লাগে। লম্বা-লম্বা ক্যাকটাসগুলো যেন এক দৃষ্টে দেখছে আমাকে। ড্রুমন্ড কোথায় গেল? দুবার ড্রুমন্ড, ড্রুমন্ড বলে চেঁচিয়ে ডাকলুম। কোনও সাড়া নেই। ড্রুমন্ড যদি আর না ফেরে? মরুভূমির মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে থাকার মতন একাকিত্ব বুঝি আর হয় না।
ক্রমশ দুর্বলতা বোধ এনে দিচ্ছে। মরুভূমিতে এতকাল যে সব অসংখ্য মানুষ মরেছে –তাদের সবার জন্য অসম্ভব দুঃখ বোধ করতে লাগলুম। ওপরের দিকে তাকানো যায়, আকাশ এত গরম। অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত মনে হতে লাগল অসম্ভব লম্বা। এর থেকে ঘুমিয়ে পড়া ভালো আমার মনে হল। গাড়ির মধ্যে ঢুকে লম্বা সিটে শুয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম। ঘুমিয়ে আমি একটা জলে ডোবা মানুষের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেদিন।