কলকাতা থেকে পাখিওড়া দূরত্বে একশো মাইলও হবে না বোধ হয়। মোটর গাড়ির দূরত্বে দুশো কুড়ি-পঁচিশ মাইল। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। অথচ মনে হয় যেন কত দূরে। ভারতীয় সংবাদপত্রে, বেতারে, দূরদর্শনে বাংলাদেশের সংবাদ থাকে কৃচিৎ-কদাচিৎ, সেই খবরও ঝড়ে লঞ্চ ডুবির বা রাজনৈতিক ওলটপালটের। বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমগুলিতেও ওই একই রকম। ভারতীয় সংবাদ অতি নগণ্য, যা থাকে, তাও দাঙ্গা বা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির। এর নাম ঐতিহাসিক নিয়তি।
কিন্তু মানুষ যেমন শুধু খাদ্য খেয়ে বাঁচে না, সেই রকম কোনও দেশই শুধু রাজনীতি নিয়ে বেঁচে থাকে না। রাজনীতি-নিরপেক্ষ এক জীবন প্রবলভাবে প্রবাহিত হয়ে চলে ঠিকই।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে, উভয় দেশের কোনও রকম সরকারি সংস্পর্শে না গিয়ে। যারা বেড়াতে ভালোবাসে, তারা পৃথিবীর যে কোনও দেশেই কিছু না কিছু দর্শনীয় বস্তু পেতে পারে, কিন্তু একটা মুশকিল হয় এই যে অন্য দেশে গিয়ে অনবরত বিমাতৃভাষা বলতে-বলতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়। সেই হিসেবে আমাদের পক্ষে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশে প্রতি প্রকৃষ্ট স্থান, সেখানে প্রকৃতি অতি ঐশ্বর্যময়ী এবং সাংস্কৃতিক আবহাওয়া আমাদের কাছে সাবলীল লাগে। বাংলাদেশের নাবিকরাও বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে একবার অন্তত কলকাতায় ঘুরে যেতে চান, সম্ভবত ওই একই কারণে। আমি বাংলাদেশে বারবার যাই, এবার সাগরময় ঘোষও গিয়েছিলেন সস্ত্রীক।
সংবাদের অভাব অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। নকশালপন্থী আন্দোলনের সময় দিল্লি ও বোম্বাইয়ের সংবাদপত্রে শুধু কলকাতার খুনের খবর ছাপা হত। তাতে ওইসব জায়গার লোকেরা মনে করত, কলকাতার মানুষ বুঝি ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না। সন্ধ্যের পর রাস্তাঘাট সব শুনশান। আসলে, এত বড় নগরীতে যে চার-পাঁচটি রাজনৈতিক খুনের কোনও প্রভাবই জনজীবনে পড়ে না, তা দূর থেকে বোঝা যায় না। তারই মধ্যে সভা-সমিতি, সিনেমা-থিয়েটার, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, মধ্যরাত পর্যন্ত পথের জনস্রোত এবং পাড়ায় পাড়ায় আচ্ছা ঠিক একইভাবে চলে। সেই রকমই, বাংলাদেশের শুধু রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সংবাদই এখানে ছাপা হয় বলে অনেকের ধারণা, ওখানে বুঝি শুধু ডামাডোলই চলছে। স্বাভাবিক জনজীবন নেই। প্রতিবেশীদের সম্পর্কে আমরা এ রকম পারস্পরিক ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছি। কে যেন বলেছিল আধুনিক বিজ্ঞান পৃথিবীটাকে অনেক ছোট করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে দূরত্বও যে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে সে কথা বলেনি কেন?
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটি অতি জীবন্ত ও স্পন্দমান শহর। কলকাতার ছড়ানো বিশালত্ব সহসা চোখে পড়ে না। সেই তুলনায় ঢাকা শহর আয়তনে ছোট হলেও এর নতুন সৌন্দর্য প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাস্তাগুলি চওড়া-চওড়া এবং পরিষ্কার, খানাখন্দ নেই, এবং সন্ধ্যের পর ঢাকা শহর যতখানি আলোয় ঝলমল, ততখানি আলো এখন নেই কলকাতায়। পশ্চিমবাংলার অনেকেরই ঢাকা শহর মুখস্থ, অনেকেরই বাল্য-কৈশোর কেটেছে ঢাকা কিংবা আশেপাশের এলাকায়। তাঁরা কিন্তু এতদিন পর ঢাকা শহর দেখলে সহসা চিনতেই পারবেন না। বুদ্ধদেব বসুর রচনায় বর্ণিত ঢাকা শহরও এখন খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। সম্পূর্ণভাবে রূপ পালটেছে এই শহর, পুরোনো ঢাকার গুলিযুঁজি এখনও কিছু-কিছু টিকে থাকলেও খাল ও জলাভূমি ভরাট করে বিস্তৃত হচ্ছে নতুন শহর। শুনেছি যে জংলা জায়গাটির নাম ছিল মতিঝিল এখন সেখানেই গড়ে উঠেছে ঢাকার কনট সার্কাস কিংবা চৌরঙ্গি। বাড়িগুলিতে আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন, ঢাকার নতুন রেল স্টেশন এমনই চমকপ্রদ চোখ-ধাঁধানো যে তার তুলনায় হাওড়া-শিয়ালদা অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে। কলকাতার অনেক কিছুই গড়ে উঠছে বটে, কিন্তু স্থাপত্যকলা নিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমি কখনও ঢাকা শহরে যাইনি। সুতরাং এই শহর আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। সাগরময় ঘোষেরও জন্ম চাঁদপুরে। কিন্তু কখনও তিনি ঢাকা শহর দেখেননি। শুধু তাই নয়, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনি পূর্ব বাংলায় যাননি, তিনিও নতুন শহর হিসেবেই ঢাকাকে দেখেছেন। এবং প্রথম নজরে ঢাকা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতন।
পশ্চিমবাংলার অধিবাসী আমাদের অনেকেরই জন্ম ওদিকে। কারুর ফরিদপুরে, কারুর কুমিল্লা, কারুর টাঙ্গাইলে। কথায়-কথায় সেইসব প্রসঙ্গ ওঠে। তখন জানতে পারা যায় যে ঢাকানিবাসী অনেকেও জন্মেছিলেন এদিকে। কেউ কলকাতায় পার্ক সাকাসে, কেউ বারাসতে, কেউ বর্ধমানে। অমনি যেন আত্মীয়তা স্থাপিত হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে দেখাশুনো হয়েছে অধিকাংশই লেখক শিল্পীদের সঙ্গে এবং বারবার মনে হয়েছে, সাংস্কৃতিক সম্পর্কে দুই বাংলা এখনও নিবিড়ভাবে আপন। দুই বাংলা কথাটা উচ্চারণ করতে এখন কিছুটা খটকা লাগে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বাংলা। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় আমরা নিজেদের বাঙালি বললেও কার্যত আমরা ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা, আমরাও টাকা কথাটা ব্যবহার করি, কিন্তু ভারতীয় মুদ্রার নাম রূপিয়া। ঢাকায় যে ভারতীয় হাইকমিশন আছে, তারা অবশ্যই দেখবে ভারতীয় স্বার্থ, আলাদা করে পশ্চিমবাংলার জন্য তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যে একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্ক থাকতে বাধ্য, তা নিয়ে ভারত সরকার কিংবা পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকার কখনও চিন্তা করেছেন কি না জানি না।
বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যের আসর জমজমাট। সাহিত্যের মাধ্যমে মানসিক মুক্তির যেন একটা জোয়ার এসেছে। সবচেয়ে যেটা প্রথমেই নজরে আসে এবং যেটা বাংলাদেশের অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর দিক, সেটা হল শিল্প-সাহিত্যের বিকাশের মাধ্যমগুলিতে তরুণদের প্রবল উপস্থিতি। রেডিও টেলিভিশনের অনেক শাখা পরিচালনা করে বেশ তরুণ বয়স্করা। সংবাদপত্রে কাজ করছে অনেক সদ্য যুবক। থিয়েটার ও চলচ্চিত্র-আন্দোলনের অগ্রণী হয়েছে তারাই।
কলকাতার তুলনায় ঢাকায় সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। কলকাতা ছাড়া পশ্চিমবাংলার আর কোনও জায়গা থেকে খবরের কাগজ বিশেষ বেরোয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় শহর থেকেও দৈনিক কাগজ বেরোয়। আমাদের দৈনিক সংবাদপত্রে সাহিত্যের জন্য আলাদা পৃষ্ঠা যেমন প্রায় লোপ পেতে বসেছে, সেই তুলনায় ওঁদের সংবাদপত্রে সাহিত্যের জন্য সিংহভাগ বরাদ্দ থাকে। ওঁদের কোনও-কোনও লেখকের সাক্ষাৎকার ফলাওভাবে ছাপা হয়। কারণ, একজন লেখক ওদের কাছে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আমাদের দেশে তা নয়। কবি শামসুর রহমানের পঞ্চাশবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি সংবাদপত্র যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সেই সংবাদ প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় প্রধান সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনটি। সরকারি সংবাদপত্র দৈনিক বাংলার সঙ্গে যুক্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক ও সাপ্তাহিক দুটিরই সম্পাদক শামসুর রহমান। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেকাফ, তাঁদের সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম ‘রোববার’। এর সম্পাদক আবদুল হাফিজ, এবং রাহাত খান ও রফিক আজাদের মতন লেখকরা এর সঙ্গে যুক্ত। সংবাদপত্র নিরপেক্ষ আর একটি সাপ্তাহিকের নাম সচিত্র সন্ধানী। এর সম্পাদক গাজি সাহাবুদ্দিন এবং বেলাল চৌধুরী, শফিক রেহমান এবং অন্যান্য লেখকরা এই পত্রিকা পরিচালনায় সাহায্য করেন। মূলত সাহিত্যধর্মী, সেই সঙ্গে সামাজিক সমস্যার আলোচনা এবং চলচ্চিত্রের কথাও থাকে এই সব পত্রিকায়। এ ছাড়া কয়েকটি ট্যাবলয়েড সিনেমা পত্রিকাও আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূর্বাণী। এবং আমার কাছে আরও উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে ‘কিশোর বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা, এমন রঙিন ছবি দিয়ে সাজানো সর্বাঙ্গীন কিশোরদের পত্রিকা পশ্চিমবাংলায় নেই।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ছোটদের জন্য সরকারি উদ্যোগও অনেক কিছু করা হচ্ছে বাংলাদেশে। ঢাকায় আছে শিশুদের জন্য আলাদা উদ্যান, সেখানকার বিশাল মেরি গো রাউন্ডটি বহু দূর থেকে চোখে পড়ে। সেটি দেখলে বড়দেরও চাপবার লোভ হবে। এ ছাড়া আছে ‘শিশু একাডেমি’, সেখান থেকে ছোটদের জন্য চমৎকার চমৎকার রঙিন বই প্রকাশিত হচ্ছে কম দামে। আমাদের দিল্লিতেও আছে চিলড্রেন্স বুক ট্রাস্ট, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, কিন্তু তার ছিটেফোঁটা কতটা পশ্চিমবাংলায় এসে পৌঁছয়, কে জানে। ঢাকায় শিশু একাডেমির সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন লেখক, বিপ্রদাস বড়ুয়া।
আরও দুটি প্রধান একাডেমি আছে ঢাকায়। তার মধ্যে শিল্পকলা একাডেমির কথা সম্ভবত পশ্চিমবাংলার অনেকের কাছে অজানা। বিশালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই একাডেমি, বাংলাদেশের শিল্পসামগ্রী সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছেন এঁরা। একটি বিশাল প্রেক্ষাগৃহ সেখানে নির্মিত হচ্ছে দেখে এলাম। এই একাডেমি নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এঁদের আছে আলাদা পত্রিকা। আমাদের পরিচিত কবি আল মাহমুদ এই শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত। বিখ্যাত শিল্পী জয়নাল আবেদিনের একটি চমৎকার অ্যালবাম এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় আছে আর্ট কলেজ, প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান এবং কাইয়ুম চৌধুরী এর সঙ্গে যুক্ত।
বাংলা একাডেমির নামের সঙ্গে আমরা অনেকেই আগে থেকে পরিচিত। সরকারি উদ্যোগে সাহিত্য-সৃষ্টি হয় না ঠিকই, সৃজনমূলক সাহিত্য সরকার থেকে যত দূর সরে থাকে ততই ভালো। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে গবেষণার কাজ এবং সার্থক সাহিত্য সুলভে প্রচারের ভার সরকারের নেওয়া উচিত। সুবৃহৎ আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান ছাড়াও আরও প্রায় তিনশো সাড়ে তিনশো গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন এই বাংলা একাডেমি এবং আরও বিপুলভাবে কাজ চলছে। শুনলাম, এই উদ্যোগের জন্য সরকারি অনুদান এ বছর এগারো কোটি টাকা। শুনলে আমাদের শিস দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয় না? দিল্লির সরকার বাংলা সাহিত্যের জন্য কতটা কী করেছে বা করবে? পশ্চিমবাংলার সরকার অতিকষ্টে রবীন্দ্র রচনাবলি দ্বিতীয়বার মুদ্রণের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু এখনও বেশি দামে শরৎচন্দ্র, নজরুল বা বিভূতিভূষণের রচনাবলি কেনবার জন্য প্রকাশকদের দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে। ঢাকার বাংলা একাডেমি অল্প দামে ক্লাসিক বইগুলি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়। উত্তরাধিকার নামে একটি সুসম্পাদিত পত্রিকাও প্রকাশিত হয় এখান থেকে। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর পর তাঁর উদ্দেশ্যে এই পত্রিকার একটি সম্পূর্ণ সংখ্যা নিবেদিত হয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলির মৃত্যুর পর এই পত্রিকা কেন এখনও সেই দায়িত্ব পালন করেনি, সে সম্পর্কে আমার খটকা রয়ে গেল।
বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক আশরফ সিদ্দিকী স্বয়ং একজন কবি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ঢাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেই রয়েছেন একজন কবি বা লেখক। ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানকার উপাচার্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রখ্যাত কবি, সম্প্রতি তিনি শেকসপিয়রের সনেটগুলি অনুবাদে নিমগ্ন। টাকা ভাঙাতে গিয়েছিলাম মতিঝিলের এক বিরাট ব্যাংকে। সেখানকার হোমরা-চোমরা একজনের সঙ্গে পরিচয় হল, তিনিও একজন কবি, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ। রসীজুদ্দিন আহমেদ নামে এক ভদ্রলোক জাহাজের ব্যাবসা করেন, তিনিও ছোট গল্প লেখেন। ওখানকার পেট্রোল কোম্পানির একজন চাঁই হলেন প্রধান ঔপন্যাসিক রশিদ করীম। এ রকম আর কতজনের নাম করব। তা হলে তো গোটা লেখাটাই নামাবলি হয়ে যাবে। বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ পদে আরও কয়েকজন কবি ও গদ্য লেখককে দেখলাম। অর্থাৎ অনেক লেককের জীবিকার সংস্থানও করেছেন বাংলা একাডেমি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বেশ দুর্বল। এ কথা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করেন। অনেক দামি-দামি আধুনিকতম সরঞ্জাম আছে ঢাকায়। সেই তুলনায় ছবির মান তেমন কিছু না। তবু এরই মধ্যে আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ ছবিটির বিশেষ প্রদর্শনী দেখলাম। একটু সংক্ষিপ্ত করলে ছবিটি বেশ ভালো বলা যায়। ট্রেনে যেসব মেয়েরা চোরাচালান করে তাদের নিয়ে গল্প। বেশ একটি সুস্থ বক্তব্য আছে। অন্য চালু ছবিগুলি দেখতে অনেকেই নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি চমৎকৃত হলাম বাংলাদেশে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের খানিকটা পরিচয় পেয়ে। ঢাকার একটি টিনচালের ঘরে মুহম্মদ খসরু নামে এক অতি উৎসাহী যুবক তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে শুরু করেছিল এই আন্দোলন। বিদেশের শ্রেষ্ঠ দেখা বা না-দেখা চলচ্চিত্রগুলির সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এদের উদ্দেশ্য ছিল। এখন চলচ্চিত্র আন্দোলনের অনেকগুলি সংস্থা হয়েছে এবং জেলায়-জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই ফিল্ম সোসাইটির ছেলেরাই নতুন ছবি বানাবার স্বপ্ন দেখে। একদিন এদের কারুর হাত থেকেই বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশের সার্থক চলচ্চিত্র। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ থেকে ধ্রুপদী নামে একটি পত্রিকাও বেরোয়, যার সম্পাদক ওই মুহম্মদ খসরু। পত্রিকাটির রুচি, অঙ্গ-সজ্জা ও রচনাগুলির মান যথেষ্ট উঁচু।
নাটক অভিনয়ের ব্যাপারেও এখন মেতে উঠেছে ঢাকা শহর। অভিনয়ের উপযোগী হলের অভাব, যে হলটি আছে, সেটার মধ্যেও দারুণ গরম। তবু সেখানেও নিয়মিত দর্শকরা এসে অটুট ধৈর্য নিয়ে নাটক উপভোগ করছেন। ঢাকায় এখন অনেকগুলি নাটকের দল। তার মধ্যে তিনটিই প্রধান, এমন শুনেছি। এই দল তিনটির নাম থিয়েটার, নাগরিক এবং ঢাকা থিয়েটার। থিয়েটার দল এখন অভিনয় করছেন, রামেন্দু মজুমদারের পরিচালনায় আবদুল্লা আল মামুন রচিত সেনাপতি, একটি ব্যঙ্গধর্মী নাটক। সংলাপ বেশ তীক্ষ্ণ এবং অভিনয়ের মান বেশ উন্নত। এঁরা রবীন্দ্রনাথের দুই বোনও অভিনয় করেন মাঝে-মাঝে।
ঢাকা থিয়েটার করছেন এখন শকুন্তলা। সেলিম আল দিন নামে এক তরুণ কালিদাসের তোয়াক্কা না করে শুধু শকুন্তলা উপাখ্যানটি নিয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন এই নাটক। খুবই নতুন ধরনের প্রচেষ্টা। নাটকটির পরিচালক নাসিরুদ্দিন ইউসুফ। বিশেষভাবে মনে থাকে এই নাটকের সেট, যেটি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন নামে এক তরুণ শিল্পী, যিনি একজন ভালো অভিনেতাও বটেন। এই দলের সবাই তরুণ এবং বুক ভরতি টগবগে উৎসাহ।
নাগরিক দল এখন ডি এল রায়ের সাজাহান নাটকটি খানিকটা বদলে অভিনয় করছেন। সেটি দেখার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠেনি। তবে এই দলের কর্ণধার আলি যাকের-এর বাড়িতে আমরা কাটিয়ে এলাম এক সন্ধ্যা। আলি যাকের ওখানে বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’-এর নির্দেশক এবং সাজাহানের প্রধান অভিনেতা। সেই দলের আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর এবং তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নাটক বিষয়ে অনেক কথা হল। ঢাকায় নাট্যকর্মীরা কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সম্পর্কে অনেক খবরাখবর রাখেন। সেই তুলনায় কলকাতার দর্শকরা ঢাকার নাটক বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ঢাকার কোনও-কোনও নাটক দলকে কলকাতায় নিমন্ত্রণ করে এনে তাঁদের অভিনয় এখানে দেখাবার ব্যবস্থা করা যায় না? কারা যেন এ সব ব্যবস্থা-ট্যবস্থা করতে পারে।
ঢাকার প্রধান অভিনেত্রী ফিরদৌসী মজুমদারকে দেখলে কেন যেন বারবার তৃপ্তি মিত্রের কথা মনে পড়ে। শুধু অভিনয়ের গুণের জন্যই নয়, ব্যক্তিত্বেও যেন কোথায় দুজনের মিল আছে। ‘থিয়েটার’ দল ‘থিয়েটার’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। তাতে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নাট্য আন্দোলনের খবর। এর সম্পাদক এবং নির্বাহী সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার এবং মুহম্মদ জাহাঙ্গির।
শুধু ঢাকাতেই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম বা আরও অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করব। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠল না। ঢাকাতেই আচ্ছা, হইহল্লা আর নেমন্তন্ন খেতে-খেতে দিন ফুরিয়ে গেল। মাঝখানে একদিন শুধু গিয়েছিলাম টাঙ্গাইল। সেখানে কবি তারাপদ রায় তখন ছিলেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। তারাপদ রায়ের বাড়ির বারান্দাতেও অবিরাম চলেছিল টাঙ্গাইলের কবিদের আড্ডা। আমরা আর যেখানেই বেড়াতে যাই, যত কিছুই দেখি না কেন, বাঙালিতে-বাঙালিতে যেমন আড্ডা হয়, সেটা কি আর কোথাও সম্ভব? ঢাকার লেখক শিল্পীরা বাঙালি আড়ার ঐতিহ্যটি সার্থকভাবে বহন করে চলেছে। এক একদিন চলত এক এক জায়গায় আড্ডা। আড্ডাধারীদের মধ্যে ছিলেন রশীদ করীম, লায়লা সামাদ, মাহমদুল হকের মতন প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিকরা, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল সাহাবুদ্দিন, রফিক আজাদের মতন প্রসিদ্ধ কবিরা এবং অগণিত তরুণ-তরুণী লেখক-লেখিকা। কত রকম প্রসঙ্গ। ওখানকার অনেকেই এদিককার সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। ইফতেখারুল ইসলাম নামে এক নবীন লেখকের কথাবার্তা শুনে আমি চমকে-চমকে উঠছিলাম। সে সমগ্র বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে এত বেশি জানে যে ওই বয়েসি কৃচিৎ দু-একজনের মধ্যেই এ রকম জানার পরিধি সম্ভব।
ঢাকার মানুষদের আতিথেয়তারও কোনও তুলনা নেই। প্রতি সন্ধেবেলাতেই দাওয়াত এবং নেমন্তন্ন এবং নেমন্তন্ন মানেই বিশাল আয়োজন, অন্তত দশ রকম পদ। শুধু চাখতে-চাখতে উদরপূর্তি হয়ে যায়, এবং কয়েকদিন পর খাদ্য সম্পর্কে ভীতি জন্মে যায়। ঢাকার লোকের কলকাতা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা আছে। তারা ভাবে, কলকাতায় বুঝি মাছ একেবারেই পাওয়া যায় না। আসলে কলকাতায়ও অত্যন্ত ভালো-ভালো মাছ পাওয়া যায়। দাম বেশি বলে আমরা কম খাই। তা বলে ঢাকায় দিন দশেকের জন্য বেড়াতে গিয়ে তো আর দশ বছরের উপযোগ্য মাছ খেয়ে আসা সম্ভব নয়।
ঢাকায় আমরা কোনও হোটেল ঠিক করে যাইনি। প্রথমে উঠেছিলাম এক পরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে, ভেবেছিলাম, পরে কোনও হোটেল বেছে নিয়ে চলে যাব। কিন্তু সে বাড়ির সকলের আন্তরিক ব্যবহারে এবং আপ্যায়নে আমরা বাঁধা পড়ে গেলুম। তাঁরাই জোর করে যেতে দেননি কিংবা আমরাই আর যাওয়ার গরজ দেখাইনি–এর মধ্যে কোনটা বেশি সঠিক তা বলা শক্ত। বোধহয় দ্বিতীয়টিই বেশি সত্যি। সে বাড়ির গৃহিণী বীথি সাহাবুদ্দিন যেমন রূপসি তেমনি মধুর স্বভাবের, এবং রন্ধন শিল্পেরীতিমতন প্রতিভাময়ী। পশ্চিমবাংলায় এমন মহিলা দুর্লভ।
ঢাকায় কি শিল্প-সংস্কৃতির দিক ছাড়া আর কিছুই নেই? খারাপ কিছু বা সমালোচনা করার মতন কিছুই নেই? আছে নিশ্চয়ই, কারণ ঢাকা শহর তো স্বর্গ নয়, কিংবা স্বর্গে গেলেও নিশ্চয়ই অনেক দোষ ধরা যাবে। কিন্তু আমি সেসব লিখতে চাই না। অথবা, এমনও হতে পারে, সব সময় ভালো লোকজনদের সংসর্গে আমরা ছিলুম বলে মন্দ কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। স্বেচ্ছায় মন্দ কিছু আমি দেখতেও চাইনা।