কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে দুদিন ব্যাপী যে বিশাল কবিসম্মেলন হয়েছিল, তার স্মৃতি ধরে রাখার মতন খুব বেশি মানুষ এখন বেঁচে নেই। সিনেট হল নামে সেই অপূর্ব স্থাপত্যটিকেও জলজ্যান্ত অবস্থায় খুন করা হয়েছিল কিছু মূঢ়দের পরিকল্পনায়। সিনেট হলের সেই নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার ধারাবাহিক ফোটোগ্রাফ তুলে রেখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী, তা নিয়ে একটা পাতলা বইও প্রকাশিত হয়েছিল, সেই বইটিও এখন পাওয়া যায় না কিংবা অতি দুর্লভ।
অবশ্য সিনেট হলের কবিসম্মেলনের বর্ণনা কেউ-কেউ লিখে গেছেন আত্মচরিতে, যেখানে মৃত্যুর আগে জীবনান্দ দাশ শেষবার পড়েছিলেন অনেকগুলি কবিতা। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত লিখেছিলেন তার টাটকা বিবরণ।
ভারতবর্ষের মধ্যে আমার দেখা সবচেয়ে বড় এবং স্মরণীয় কবিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের ভোপাল নগরের ভারত ভবনে।
আগে ভারত ভবন বিষয়ে কিছু বলা দরকার।
সংস্কৃতির দিক থেকে মধ্যপ্রদেশের তেমন কিছু খ্যাতি নেই। এই রাজ্যটিতে পাঁচমিশেলি মানুষদের সমাবেশ। একসময় ছিল ছোট ছোট দেশীয় রাজ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের এবং বলাই বাহুল্য, তারা খুবই গরিব, শোষিত এবং অবহেলিত। স্বাধীনতার পর ভারতের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষিত লোকজন মধ্যপ্রদেশে গিয়ে জড়ো হয়েছে। তাদেরই হাতে ক্ষমতা। হিন্দিভাষীদেরই প্রতাপ বেশি, কিন্তু পাঞ্জাব, কেরালা, এমনকি বাংলা মুলুক থেকেও অনেকে গিয়ে সেখানে বসতি গেড়েছে। টাকার খেলা আর ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনিই সেখানে বেশি চলে।
এ-হেন মধ্যপ্রদেশে গড়ে উঠেছিল বিস্ময়কর এক ভারত ভবন, যার তুলনীয় কিছু ভূ ভারতে আর কোথাও নেই। একটি মস্ত বড়ো হ্রদের তীরে অপূর্ব সেই নির্মাণ, ভোপাল শহর থেকে একটু বাইরে, অথচ শহরের সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। এই সংস্কৃতি কেন্দ্রটিতে বলা যয় পূর্ণাঙ্গ শিল্পের সবক’টি শাখারই চর্চা এবং প্রসারের ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকলা, সংগীত, নাটক ইত্যাদির আলাদা বিভাগ। বিভিন্ন বিষয়ে সারাদেশের সেরা বিদগ্ধজন এবং শিল্পীরা সেখানে অনুজদের জন্য শ্রম দিতে আসতেন বিনা পয়সায় নয়, যথেষ্ট ভালো পারিতোষিক পেতেন। তাঁদের থাকারও সুবন্দোবস্ত ছিল।
এই ভারত ভবন স্থাপনের সিংহভাগ কৃতিত্ব পেতে পারেন অশোক বাজপেয়ী। ইনি হিন্দিভাষী কবি এবং একজন রাজপুরুষ, আই . এ . এস., তখন মধ্যপ্রদেশ সরকারের সংস্কৃতি দফতরের সচিব। শোনা যায়, একবার রাজ্যের বাজেট তৈরি করার সময় অশোক বাজপেয়ী মুখ্যমন্ত্রীকে (তখন অর্জুন সিংহ) অনুনয়-বিনয় করে বলেছিল, স্যার, রাজ্যের কালচারের জন্য এক পারসেন্ট দিতে পারেন না? মাত্র এক পারসেন্ট? অর্জুন সিংহ নাকি মাত্র এক পারসেন্ট শুনে অবহেলার সঙ্গে বলেছিলেন, ঠিক হ্যায়, লে লেও!
শুনতে শতকরা একভাগ অতি সামান্য মনে হলেও রাজ্যের বাজেটে তো তা অনেক টাকা! ধরা যাক, রাজ্যের বার্ষিক বাজেট যদি হয় তিন হাজার কোটি টাকা, তার এক পারসেন্ট তো তিরিশ কোটি টাকা! সেই ষাটের দশকে তিরিশ কোটি টাকা দিয়ে প্রায় তাজমহল বানিয়ে ফেলা যেত!
হয়তো এটা গল্পই, ব্যাপারটা অত সহজ নয়, তবু অশোক বাজপেয়ীর কিছু একটা কেরামতি ছিলই এবং টাকার অঙ্কটা অত বেশি নয়।
অশোক আমাদের বন্ধুমানুষ। একসময় ভারত ভবনের পরিচালনা কমিটিতে সে আমাদের কয়েকজনকেও যুক্ত করে নিয়েছিল। তার দুটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করতেই হয়। কোনওকিছু গড়ে তোলার ব্যাপারে তার উদ্দীপনা অসাধারণ, এত বড় কর্মর্যজ্ঞটি সে সামলেছে হাসিমুখে। আর দ্বিতীয় গুণটি হল, হিন্দি ভাষার লেখক হলেও সে খাঁটি অর্থে ভারতীয়, এই ভারত ভবনটিকে সে পুরোপুরি সর্বভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ হিন্দিভাষী রাজ্য, এখানে উগ্র হিন্দিবাদী লোকের অভাব নেই। কিন্তু অশোক সবক’টি স্বীকৃত ভারতীয় ভাষাকে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। সব ভাষার লেখক ও শিল্পীদের সে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেছে ভোপালে, উঁচু ক্লাসের ট্রেন ভাড়া, প্রয়োজনে প্লেন ভাড়াও দিয়েছে, আতিথ্যে কোনও কার্পণ্য করেনি। ভারতের কোন ভাষায় কোন কবি নতুন কিছু লিখছে, তার ঠিকঠাক খোঁজ রাখত অশোক। এই উদারতাই অশোকের কাল হল শেষপর্যন্ত। তাকে বদলি করে দেওয়া হয় দিল্লিতে। একবার মধ্যপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় হিন্দিওয়ালারা ভারত ভবন দখল করে নেয়। এখন সেটি গোল্লায় গেছে শুনেছি।
ভারতের তিন-চারটি ভাষা নিয়ে কবিসম্মেলন হত মাঝে-মাঝে। তারপর বছরে একবার সর্বভারতীয় কবিসম্মেলন। একবার সে ব্যবস্থা করল সর্বএশিয়া কবিসম্মেলনের। সেবারের সম্মেলনের সার্থকতা দেখে অশোকের মনে এল আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এক রাত্তিরে হোটেলের ঘরে আড্ডা দিতে দিতে অশোক বলল, এবারে একটা বিশ্ব কবিসম্মেলন করলে কেমন হয় বলো তো? আমাদের দেশে এরকম কখনও হয়নি!
আমরা বললাম সত্যি-সত্যি বিশ্ব কবিসম্মেলন তো অনেক খরচের ব্যাপার। ইউরোপ আমেরিকা থেকে কবিদের আনাতে পারবে?
অশোক বলল, সেব্যবস্থা হয়ে যাবে। এয়ার ইন্ডিয়াকে বলব কিছু টিকিট স্পনসর করতে, কিছু টাকা আমরা দেব, হোটেলগুলোকেও বলব স্পনসর করতে, সাহেবদের জন্য এ-সুযোগ দিতে অনেকেই রাজি হবে।
সে তক্ষুনি বসে গেল কবিদের নামের তালিকা তৈরি করে ফেলতে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপুল খ্যাতিমান যে-কবির দুর্বলতা আছে ভারত সম্পর্কে, তারই সাহায্য নিতে হবে আগে। অশোক আমাকে বলল, অ্যালেন গিনসবার্গ তো তোমার বন্ধু, তুমি তাকে ফোন করো এখান থেকেই।
কয়েকবারের চেষ্টায় পাওয়া গেল অ্যালেনকে। সে তো পরিকল্পনা শুনে খুব খুশি। সে বলল, সে এবারে এসে মাস দু-এক থাকবে। শুধু কবিতা পড়ে চলে যাবে না।
পৃথিবীর প্রধান ভাষায় বিশিষ্ট কবিদের কাছে সে ব্যক্তিগত অনুরোধের চিঠিও পাঠাবে। আমাদের দেবে সেই চিঠির প্রতিলিপি।
তখনও কম্পিউটার আর ই-মেলের যুগ আসেনি। চিঠিপত্র ডাকেই আসে। অ্যালেনের অনেক চিঠি এসেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত সে নিজে আসতে পারেনি, সেই সময় হঠাৎ তার আলসারের ব্যথা শুরু হয়েছিল।
তবে এসেছিলেন অনেক একনামে চিনে ফেলার মতন কবি। মাথাভরতি সাদা চুল নিয়ে স্টিফেন স্পেন্ডার, সিলভিয়া প্লাথের প্রাক্তন স্বামী এবং পোয়েট লরিয়েট টম হিউজেস। নিকানোর পারা। বিখ্যাতদের মধ্যে আরও কে কে ছিলেন, আমি সব নাম মনে করতে পারছি না। শুধু রাশিয়ার, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাড়াজাগানো কবি ভজনেসেনস্কি আসতে পারেননি, ভিসার কিছু গণ্ডগোলের জন্য, সেজন্য তাঁর আপশোশের শেষ ছিল না, পরে যুগোস্লাভিয়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় তিনি আমার কাছে একথা উল্লেখ করেছিলেন।
নাম বিশ্ব কবিসম্মেলন, পৃথিবীর সব দেশ না হলেও বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন প্রায় ষাটজন কবি। এ ছাড়া, ভারতীয় ভাষার কবিরা তো আছেনই। তিন দিনের সম্মেলন, তবু প্রত্যেক কবিকে সুযোগ দেওয়ার সময় সংকট হয়। অধিকাংশ জায়গায় শেষের দিকে অনুরোধ করা হয়, মাত্র একটি কবিতা পড়ুন! সময় ছিল দু-মিনিট। এরই মধ্যে কেউ রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ সাইজের কবিতা পড়তে শুরু করলে প্রায় কেড়ে নেওয়া হত তার হাত থেকে কবিতা। সবাইকে সুযোগ দিতে-দিতে মধ্যরাত্রি এসে যায়। তখন দর্শকদের মধ্যে থাকে শুধু ঘুমজড়ানো চোখের মহিলা, খুব সম্ভবত বাকি কবিদের স্ত্রী!
অশোকের ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটি নেই। বিদেশ থেকে আগত প্রত্যেক কবির জন্য আছে একজন ভলান্টিয়ার, যাতে সেইসব অতিথিদের আহার-বিহারের কোনও অসুবিধে হয় এবং বিদেশি কবিরা তিন-চারটি করে কবিতা পড়ার সুযোগ পাবেন অন্তত দুদিন। অর্থাৎ শুধু একবার মঞ্চে উঠে কোনওক্রমে একটা বা দুটো কবিতা পড়ে দিলেই সম্পর্ক শেষ না হয়! কিন্তু তাহলে এতগুলি কবিকে সুযোগ দেওয়া হবে কী করে? আট-দশ দিন ধরে তো কবিসম্মেলন চলতে পারে না? (কোনও কোনও দেশে তা-ও চলে, সেকথা পরে)।
অশোক আমাকে প্রস্তুতি কমিটিতে জিগ্যেস করেছিল, কিছু-কিছু ভারতীয় কবিকে বাদ দিতেই হবে। অথচ, যেসব কবিদের বাদ দেওয়া যায়, তারা প্রত্যেকেই চটে যাবেন। এটাই কবিদের ধর্ম। কী করা যায় বলো তো? যেমন ধরো, বাংলা থেকে সুভাষদা, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি, তুমি, এঁদের কারুকেই বাদ দেওয়া যায় না, অথচ বাংলা থেকে চারজনকে নিলে অন্য ভাষার কবিরাও বলবে…
আমি বলেছিলাম, আমাকে বাদ দাও। শক্তিকেও না-পড়তে রাজি করাতে পারি। অন্য ভাষাতেও…
শেষ পর্যন্ত একটা চমৎকার ফরমুলা বার করা গেল।
সব ভারতীয় ভাষারই প্রধান কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। তাঁদের দেওয়া হবে যাতায়াত ভাড়া, থাকবে হোটেলের ব্যবস্থা, বিদেশি অতিথিদের মতনই তাঁদেরই সমান মর্যাদা, কিন্তু তাঁরা মঞ্চে কবিতা পড়বেন না। বিদেশি কবিদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডা দেবেন। যেখানে কবিতা পাঠও হতে পারে। যতদূর মনে পড়ে, এই ব্যবস্থায় কেউই আপত্তি করেননি।
কবিসম্মেলনে কে কীরকম কবিতা পাঠ করেছিলেন, সে বর্ণনা একটু বোরিং হতে বাধ্য। কবিদের আড়াই আসলে এইসব কবিসম্মেলনের প্রধান পাওয়া।
ফিনল্যান্ডের এক কবি আমাকে একটি চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন।
একমাত্র তাঁকেই যাতায়াতের ভাড়া দেওয়া হয়নি। আমন্ত্রণপত্র পেয়েই তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি পৃথিবীর যেখানে খুশি যেতে পারেন, ইচ্ছা প্রকাশ করলেই তাঁর দেশের সরকার বিমানভাড়া দিয়ে দেন।
দীর্ঘকায়, সুপুরুষ সেই কবিটি আমাকে জানিয়েছিলেন, কবিতা লেখেন বলে তাঁকে আর জীবিকার চিন্তা করতে হয় না। তাঁর নিজস্ব বাড়ি আছে, গাড়ি তো থাকবেই, খাওয়া পরার কোনও চিন্তা নেই, ভ্রমণেরও অগাধ সুযোগ।
আমি জিগ্যেস করেছিলাম, তোমাদের কবিদের বুঝি কবিতার বই খুব বিক্রি হয়?
সে বলেছিল, মাথা খারাপ নাকি? কবিতার বই বেরুলে পঞ্চাশ-একশো কপি কাটে কিনা সন্দেহ! কে কবিতা পড়বে? কারুর দায় পড়েনি!
তাহলে তোমার জীবপযাপদের এত খরচ কে দেয়!
সরকার! সব সরকার দেয়!
কেন, সরকার এত কিছু দেয় কেন?
কারণ। কবিরা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এনডেঞ্জারড স্পেসিজ। প্রায় কেউই আর কবিতা লিখতে চান না। কবিতার কথা শুনলে লোকে হাসে। কিন্তু একটা দেশে আর একজনও কবি থাকবে না, এ কি হয়? তাই সরকার আমাদের খুব আদর করে। নেপোলিয়নের কথা শোনোনি? একবার কে যেন নেপোলিয়নকে বলেছিল, ফরাসি দেশে কবির সংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে! তাই শুনে নেপোলিয়ন খুব ব্যস্তবাগীশের মতন বললেন, তাই নাকি? তাই নাকি? তাহলে কিছু কবি তৈরি করো! এরপর খুব হাসিহাসি হল বটে, কিন্তু আমি মনে-মনে ভাবলুম, এই ছেলেটি কলকাতায় গেলেই বুঝতে পারত, বাংলার কবিরা এখনও মোটেই বিলুপ্ত প্রজাতি হিসেবে গণ্য হতে পারে না! বরং উলটোটাই ঠিক!