নদীর ধারে উঁচু ঘাটের ওপর বসে আছে একটি বছর দশেকের বালক। সঠিক বলতে গেলে দশ বছর তিন মাস। আমি তাকে কলকাতার এক দশতলার হর্মের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি এখন সত্তর বছরের এক নাবালক।
বারাণসীর গঙ্গা, দশাশ্বমেধ ঘাট। প্রায় সন্ধ্যা, যদিও কোথাও এখনও বাতি জ্বলেনি। আকাশে কিছুটা আলোর রেশ রয়ে গেছে। এই দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রায় সব সময়েই বহু মানুষের ব্যস্ততা, তবু কোথাও একা বসে থাকারও স্থান পাওয়া যায়।
নদীটি নৌকা-বহুল, ঘাটের কাছে কয়েকটি বড় বড় বজরা বাঁধা। দূরে মণিকর্ণিকার ঘাটে জ্বলছে কয়েকটি চিতা। গাঢ় অন্ধকার না হলে আগুন ঠিক স্বাস্থ্য পায় না। তাই জ্বলন্ত চিতাগুলি কিছুটা ফ্যাকাসে।
ছেলেটি নদীর দিকে চেয়ে কী দেখছে? ওই বয়েসে কি সৌন্দর্যের ভোক্তা হওয়ার মতন তৈরি হয় মন? বালকের একাকিত্বে অনেক সময় অভিমান থাকে। যে-দোষ সে করেনি, তেমন কোনও দোষের জন্য মিথ্যে শাস্তি পেলে সে বিদ্রোহ করতে শেখে। আমি বহু বছরের দূরত্বেও দেখতে পাচ্ছি ছেলেটিকে। কিন্তু কেন সে অন্যদের সঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে একা বসে আছে, তা আমার মনে নেই।
দশাশ্বমেধ ঘাটে যে দৃশ্যটি আমার সবচেয়ে খারাপ লাগত, তা পুরুষ-শরীরের দলাই-মলাই। সারাদিন ধরেই কিছু দামড়া ধরনের লোক ল্যাঙট পরে শুয়ে তেল মাখাত অন্যদের দিয়ে। সেদিকে তাকালেই চোখ ফিরিয়ে নিতাম।
ভালো লাগত রামায়ণ-মহাভারতের কথকতা। সেই সময় কাশী ছিল বাঙালি বিধবাদের ডিপো। বাংলাদেশে অনেক পরিবারেই অল্প বয়েসি বিধবাদের চালান করে দেওয়া হত কাশীতে, কারণ এখানে পরিবারের মধ্যে বিধবারা থাকলে ব্যাভিচারের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তখন গর্ভনাশের ব্যবস্থা আইন-সঙ্গতও ছিল না। সুবিধেজনকও ছিল না। অনেক গর্ভবতী বিধবার পেট খালাস করতে গিয়ে খুনের দায়ে পড়তে হত পরিবারের কর্তাকে। বেনারসে চোখের আড়ালে যা হয় হোক। সেই সব বিধবাদের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল দশ-পনেরো টাকা, প্রতিমাসে সেই মানি অর্ডারও পৌঁছত না। কেউ তাদের খোঁজ খবরও নিত না। যুদ্ধের সময় সব জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বাড়ত না বিধবাদের মাসোহারা। অনেক অসহায় বিধবা বাধ্য হয়েই বেশ্যাবৃত্তি এবং যৌবন ফুরিয়ে গেলে ভিক্ষাবৃত্তি নিত। এরা ছাড়াও অনেক সম্পন্ন বাঙালিদের পুরুষানুক্রমে বসবাস ছিল বেনারসে।
কাছেই বাঙালিটোলা, দশাশ্বমেধ ঘাটে বিকেলের দিকে ছিল অধিকাংশ বাঙালিদের ভিড়, শোনা যেত বাংলা কথা। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য কথকতার বসত আসর, এক একজন কথককে ঘিরে গোল হয়ে এক একটি শ্রোতৃমণ্ডলী। এইসব কথকরা ছিলেন প্রফেশনাল। গল্প বলার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা গান গেয়ে উঠতেন, নেচেও দিতেন কয়েক পাক। বিভূতিভূষণ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’র হরিহরের ছিল এটাই জীবিকা।
সেই কথকতা শুনেই রামায়ণ-মহাভারত সম্পর্কে আমার গভীর আগ্রহ জাগে, ওই বই দুটি আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে যায়। এখনও আমি সময় পেলেই মহাভারতের যে-কোনও পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করি।
ওই কথকরা শুধু মহাগ্রন্থ দুটির গল্পই শোনাতেন না। ব্যাখ্যা করতেন, অনেক সময় নিজস্ব মন্তব্যও জুড়ে দিতেন। একটি মন্তব্য এখনও আমার মনে দাগ কেটে আছে।
রামায়ণের সীতাহরণ, স্বর্ণমৃগের ধান্দায় ছুটে গেছেন রাম, পাহাররত লক্ষ্মণকেও সেদিকে যেতে বাধ্য করলেন সীতা, তারপরই সন্ন্যাসীর বেশে রাবণের আগমন এবং সবলে সীতাকে তুলে নিয়ে শূন্যে উড্ডীন। এ কাহিনি সকলেরই জানা। কথক এখানে মন্তব্য করলেন, এখানে রাবণের সবচেয়ে বড় অপরাধ কী? সীতাহরণ নয়। সুন্দরী রমণীদের তো চিরকালই ক্ষমতাশালী পুরুষরা নিজের ভোগের জন্য নিজের বক্ষে স্থান দেওয়ার বাঞ্ছা করে, তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু রাবণ সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করলেন কেন? অতবড় দুর্ধর্ষ বীর রাজা রাবণ, তিনি আর কোনও ছলে-বলে কৌশলে সীতাকে কুক্ষিগত করতে পারলেন না? সন্ন্যাসীকে দেখেই তো সীতা লক্ষ্মণের গন্ডি অতিক্রম করেছিলেন সরল বিশ্বাসে। হে রাবণ, তুমি যে সন্ন্যাসী সেজে এই অপকর্মটি করলে তার ফলে ভবিষ্যতে সমস্ত সঠিক সন্ন্যাসীদেরও কি মানুষ অবিশ্বাস করবে না? সংসার ত্যাগী স্বার্থজ্ঞানহীন চিরকালের সন্ন্যাসীদের গায়ে তুমি এই অপবাদ দেগে দিলে? ছি ছি ছি…
ওই ব্যাখা শোনার পর আমি নিজে সারা জীবন কোনও সন্ন্যাসীকেই ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে পারিনি।
বেনারসে আমার এক পিসিমা-পিসেমশাই থাকতেন, সেই সূত্রেই আমাদের আসা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমরা কিছুদিন ছিলাম পূর্ব বাংলার এক গ্রামে। সেখানে এক সময় খাদ্যশস্য একেবারেই অকুলান হয়ে গেল, পয়সা থাকলেও কিছু মেলে না। একেবারে অনাহারের সম্মুখীন হওয়ার মতন অবস্থা। কলকাতায় ফিরে গিয়েও থাকার উপায় নেই। কারণ বাবা তখন প্রায় উপার্জনহীন। চাকরি নেই, টুকটাক ব্যাঙ্কের চিঠি অনুবাদ করে দু-পাঁচ টাকা পান। তখন স্থির হল, বেনারস খুব সস্তার জায়গা, কম খরচে বেঁচে থাকা যায়। তাই বাবা আমাদের বেনারসে রেখে গেলেন। পিসেমশাইয়ের সঙ্গে থাকিনি, তিনি তখন জুয়া খেলা কিংবা ওই ধরনের কোনও ঝুঁকিবহুল ব্যাপারে ঢুকে পরে সর্বস্বান্ত, সুতরাং আমাদের আলাদা ঘর ভাড়া নিতে হয়েছিল, আলাদা সংসার। এখানেও মায়ের দশ বছরের ছেলেটিই প্রধান পুরুষ অভিভাবক। মায়ের বয়স তখন বড়জোর সাতাশ। বেনারস শহরেও বহু রাবণের অবতার ঘুরে বেড়ায়।
তখনকার বেনারসে যুদ্ধের কোনও ছায়া নেই। এখানকার আকাশ দিয়ে কোনও বিমানও উড়ে যায় না। এবং জিনিসপত্র সত্যিই সস্তা। বিশেষত মনে আছে একটি জিনিসের কথা, রাবড়ি। বিশ্বনাথের গলিতে মাত্র দু-পয়সায় পাওয়া যেত ছোট এক খুড়ি ভরতি অতি লোভনীয় রাবড়ি। সেই দু-পয়সাও রোজ রোজ ব্যায় করার মতন বিলাসিতা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এক একদিন কিনে, সেই খুড়ির অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা দিতাম আমার ছোট দু-ভাইকে। মাঝে-মাঝে একটাও পয়সা হাতে না থাকলে সেই গলি দিয়ে এমনিই হেঁটে যেতাম। রাবড়ির গন্ধ তো পাওয়া যেত! ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং কথাটা একেবারেই মিথ্যে, সেই গন্ধ পেলে মনের মধ্যে জেগে উঠত ভিখিরিপনা।
আর ছিল অতি উপাদেয়, স্বাস্থ্যবান, মিষ্টি কলা। সেই একটা কলা খেলেই প্রায় পেট ভরে যেত। অনেক পরবর্তীকালে অ্যালেন গিনসবার্গ যখন বেনারসে গিয়ে অনেকদিন ছিল, তখন সে কাশীর এই কলা প্রসঙ্গে আমায় লিখেছিল, খোসা ছাড়িয়ে এই কলায় প্রথম কামড় দিয়েই মনে হল কী অপূর্ব স্বাদ। তখন বলতে ইচ্ছে হল, গড ইজ আ গুড কুক। আরও একটু খাওয়ার পর আমার বলতে ইচ্ছে হল, নো গড ইজ দা বেস্ট কুক।
আমাকে শাসন করার বিশেষ কেউ ছিল না বলে, আমি একা একা দুপুরবেলা বেনারসের গলি-খুঁজিতে ঘুরে বেড়াতাম। নিজের পাড়া ছেড়ে বেপাড়াতেও। তখন কাশীতে বেণীমাধবের ধ্বজা নামে পাশাপাশি দুটি মনুমেন্টের মতন স্তম্ভ ছিল, তার একটার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠাও যেত। সেই স্তম্ভদুটো দেখা যেত বহু দূর থেকে, ওপরে উঠলেই দেখা যেত সমগ্র কাশী ছাড়িয়েও দিগন্ত এবং অনেকখানি গঙ্গা। ওপারের রামনগরের রাজবাড়ি। এখন সেই বেনীমাধবের ধ্বজার চিহ্নমাত্র নেই। কোনও এক সময় ঝড়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বেনারসে থাকতে থাকতে স্থানীয় কিছু ছেলেদের সঙ্গে মিশে আমি ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতেও শিখেছিলাম। ঘুড়ি ওড়াবার নেশা ছিল, রাস্তায় কাটা ঘুড়ি উড়তে দেখলেই ছুটতাম অন্য ছেলেদের সঙ্গে। প্রায় সব সময়ই লম্বা ছেলেরা আগে ধরে নিত। সেই ঘুড়ির পেছনে ছোটা অনেকটা আমার জীবনের প্রতীক হয়ে আছে।
একটা হিন্দি রসিকতা আজও মনে আছে। আপ তো আপহি হ্যায়, কৃপা করকে হঠ যাইয়ে। একটু ব্যাখ্যা দরকার। বারাণসীর সব গলির মধ্যেও এক একটা পেল্লায় চেহারার ষাঁড় শুয়ে থাকত। ষাঁড় শিবের বাহন, বেনারস শিবেরই শহর। সুতরাং ষাঁড়কে মারধোর করা যায় না। ডিঙিয়ে যাওয়াও পাপ। অনেক সময় একটি-দুটি ষাঁড়ের জন্যই হয়ে যেত ট্রাপিক জ্যাম। কিছু প্রতিকারের উপায় ছিল না। একদিন এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক গঙ্গায় স্নান সেরে ফিরতে ফিরতে দেখলেন এক সরু গলির মধ্যে পথ জুড়ে শুয়ে আছে একটি গাধা! ষাঁড় তবু সহ্য করা যায়, তা বলে গাধাও সেই স্থান নেবে। লোকে বলত, কাশীতে কেউ মরলে সরাসরি স্বর্গে যায়, রামনগরে কেউ মরলে পরজন্মে গাধা হয়! ধর্মভীরু সেই ভদ্রলোক কোনও জীবজন্তুকেও মারেন না। গাধাটা এমনভাবে শুয়ে আছে যে পাশ দিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। ডিঙিয়ে যাওয়াও অশালীন ব্যাপার। তাই তিনি হাতজোড় করে বললেন, আপ তো আপহি হ্যায়, কৃপা করকে হঠ যাইয়ে। অর্থাৎ অন্য কেউ এভাবে শুয়ে থাকলে বলতাম, এই গাধা, সরে যা। কিন্তু গাধাকে তো গাধা বলেও গাল দেওয়া যায় না। আমি এখনও কোনও কোনও ব্যক্তির এঁড়ে তর্ক শুনলে অস্ফুট স্বরে বলি। আপ তো আপহি হ্যায়…রসিকতা একাই উপভোগ করি।
ওই বয়েসে শ্মশানের প্রতি কোনও আকর্ষণ থাকার তো কথা নয়। তবু মণিকর্ণিকার ঘাটে যেতাম মাঝে-মাঝে। একদিনের কথা বিশেষভাবে মনে আছে।
একটি চিতায় সদ্য চাপানো হয়েছে এক তরুণীকে। সারা শরীরের ওপর কাঠ চাপানো। শুধু বেরিয়ে আছে তার মুখ আর পা দু-খানি। আলতা মাখিয়ে দেওয়া পা। এক সময় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। কয়েকজন গ্রাম্য পোশাকের নারী পুরুষ জড়াজড়ি করে বসে আছে পাশে, তারা কেউ শোক করছে না, ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ছোঁড়া ছেঁড়া সেই কথা শুনে বোঝা গেল, তরুণীটি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সে কিছুদূরের এক গাঁয়ের বউ, বেঁচে থাকতে সে একবারও বেনারসে আসেনি। গ্রামের বাইরেই কোথাও যায়নি।
কী গভীরও দুঃখে এই বয়েসে নিজের প্রাণ নষ্ট করে দিল এই মেয়েটি? তা জানবার কোনও উপায় নেই। মুখখানা দেখলেই বোঝা যায়, সে কুরূপা ছিল না। মেয়েদের চেহারার ওপরেই যে তাদের জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করে, তা কি সেই বয়েসেই বুঝতে শুরু করেছি একটু একটু?
কেন যেন হঠাৎ বুকটা মুচড়ে উঠে চোখে জল এসে গিয়েছিল। ওই মেয়েটি আমার কেউ না, তবু খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর জন্য। একবার ইচ্ছে হল, ওর পা দুটো ছুঁয়ে প্রণাম করি। পট পট করে শব্দ হচ্ছে আগুনের, পুড়ে যাচ্ছে ওর বুক, পেট। এখনও পায়ের কাছে পৌঁছয়নি।
ইচ্ছে করলেই কি সব কিছু করা যায়? আমি ওর পা ছুঁলে যদি কেউ কিছু বলে? যদি আমার জাত-টাত নিয়ে প্রশ্ন তোলে?
আমি দূরে দাঁড়িয়েই দু-হাত জোড় করে ঠেকালাম আমার কপালে।