অনেক উদ্যোগ আয়োজন, অনেক জল্পনা-কল্পনার পর শেষে সত্যিই একদিন আমরা বইয়ে পড়া, ছবিতে দেখা কাশ্মীরের দিকে যাত্রা করলাম। আমরা দলে ছিলাম সবশুদ্ধ ১৫ জন, নানা বয়সের আমরা, দলপতি ৪০ বছরের কমলদা থেকে ১২ বছরের বিপুল পর্যন্ত। ১৪ জুন রাত্তিরবেলা হাওড়া স্টেশনে অনেক আত্মীয়স্বজন আমাদের বিদায় দিতে এল–যেন আমরা কোনও বিদেশে যাচ্ছি। এক হিসেবে কাশ্মীর যেতে আমাদের প্রায় বিদেশ যাওয়ার মতোই স্বাদ লাগছিল, কারণ কাশ্মীর যেতে পুলিশের ছাড়পত্র নিয়ে যেতে হয় এবং কাশ্মীর প্রদেশে ঢুকবার আগে সেটা দেখাতে হয়। তা ছাড়া একসঙ্গে এত দুরের পথ এর আগে আমরা কেউ-ই ভ্রমণ করিনি।
কলকাতা থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে পাঠানকোট স্টেশন। সেখানেই আমাদের রেলযাত্রা শেষ। তারপর আবার ২৬৭ মাইল যেতে হবে বাসে চড়ে। সেখানে তাড়াতাড়ি আহার শেষ করে, আমরা বাসে চড়ে বসলুম। পাঠানকোট থেকে একটু দূরে কাশ্মীর-সীমান্ত সেখানে আমরা পুলিশের ছাড়পত্র দেখালুম। তারপরই কাশ্মীর! আমরা কাশ্মীর পৌঁছলুম–কিন্তু যে ‘শ্রীনগর’ শহরে আমরা থাকব–তা এখনও আড়াইশো মাইল দূর। বিহার, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে আমরা যখন এসেছি, তখন অসহ্য গরমে আমাদের একেবারে ঝলসে দিয়েছে। তাই কাশ্মীর সীমান্তে পৌঁছেই আমরা শীতের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লুম। কিন্তু কোথায় শীত। চারপাশে মরুভূমির মতো ধু-ধু করছে মাঠ, মাঝে ছড়ানোভাবে উট, মোষ ঘুরছে, আর চামড়া পুড়িয়ে ফেলছে রোদ। আমাদের হরিদা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে গরমে–অনবরত ওয়াটার বটল থেকে জল নিয়ে মুখে-চোখে রুমালে হাঁটুতে দিচ্ছে। বাস কন্ডাক্টরকে আমরা বললুম যে শীত কখন আসবে। শুনলুম যে, জম্মু শহর পার হওয়ার পর, আরও কিছু দূরে ‘কুদ’ বলে একটি জায়গা থেকে শীত আরম্ভ হবে। ‘কুদ’ নাম শুনেই আমরা চিনতে পারলুম। কারণ খবরের কাগজে প্রায়ই এই নামটি চোখে পড়ে। এখানে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
জন্ম থেকে পাহাড় আরম্ভ হল। পাহাড়ের গা দিয়ে সরু রাস্তা। তার ওপর দিয়ে অসংখ্য বাঁক ঘুরে ঘুরে বাস চলছে। মাঝে সুড়ঙ্গ, এখানে সেখানে ঝরনা ঝরছে। সন্ধের সময় এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেল–আমরা পাহাড়ের অনেক ওপরে চলে এসেছি। একটু পরেই আমরা কুদে পৌঁছে গেলাম। সেখানে ঠান্ডা শীতের হাওয়া। এখানে আমাদের রাত কাটাতে হবে–রাত্রে বসে চলে না। কুদ শহরটা ভারী সুন্দর। মনে হয় পাহাড়ের গায়ে আঠা দিয়ে কে যেন কয়েকটা ঘরবাড়ি আটকে দিয়েছে। একট ঝরনা দিয়ে খুব তোড়ে জল ঝরছে, আর তারই আশেপাশে হোটেল-দোকান। পরদিন ভোরবেলা আবার আমাদের যাত্রা আরম্ভ হল।
কাশ্মীর ভ্রমণের প্রধান আনন্দ হল পাঠানকোট থেকে শ্রীনগরের পথ। এই পথ যেমন সুন্দর, তেমন ভয়ঙ্কর। এরোপ্লেনে গেলে এসব কিছুই দেখা হয় না। ঘুরে ঘুরে বাস ক্রমশ ওপরে উঠছে –তারপর পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছে। নীচের দিকে তাকালে তল কোথায় দেখতে পাওয়া যায় না–মাঝে মাঝে শুধু দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে দাবার ছকের মতো ফসলের খেত। সামনে পাহাড়গুলোর মাথায় সাদা বরফ জমে আছে। আর এখানে-সেখানে অজস্র বুনো ফুল। কখনও কখনও দেখা যাচ্ছে। দুর্দান্ত বন্য পাহাড়ি নদী ভয়ঙ্কর স্রোতে ছুটে চলেছে। একটু পরেই হারিয়ে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। আমাদের জীবন এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বাস ড্রাইভারের হাতে–সে একটু অসতর্ক হলেই একেবারে নিশ্চিত মৃত্যু। বানিহাল বলে একটা জায়গায় এলাম –সেখানে উচ্চতা প্রায় ন’হাজার ফিট। দার্জিলিঙের কাছে ঘুম বলে একটা জায়গা আছে, যেখানকার উচ্চতা আট হাজার ফিট–সেখানে কী শীত, মেঘের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আর আমরা এখন ন’হাজার ফিট দিয়ে বাসে চড়ে যাচ্ছি। বানিহালের কাছে একটা সুড়ঙ্গ কাটা হচ্ছে–এটা শেষ হলে–পথ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
সবচেয়ে আশ্চর্য হলুম শ্রীনগর পৌঁছে। এত ভয়ঙ্কর পাহাড় পেরিয়ে এসে দেখলাম–শ্রীনগর শহর একেবারে সমতল ভূমিতে। কোথাও উঁচু-নীচু নেই। পাহাড়গুলোর মাঝখানে এক বিশাল উপত্যকায় এই শ্রীনগর শহর। শঙ্করাচার্য পাহাড়ের পায়ের কাছে এই শ্রীনগর–এর একদিকে ডাল হ্রদ আর একদিকে ঝিলাম নদী। ডাল হ্রদটা অনেক ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে গলির মতো শহরে ঢুকে পড়েছে। সেসব জায়গায় নৌকো করে বেশ বেড়ানো যায়। ঝিলাম নদীর ওপর সাতটা ব্রিজ আছে।
আমরা যে হাউসবোটে ছিলাম তার নাম গুড লাক। হাউস বোট হচ্ছে জলের ওপর ভাসমান হোটেল। এগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। শুয়ে জানলা দিয়ে দেখা যায় ডাল লেকে জলের খেলা। দূরে বরফের মুকুটপরা পাহাড়। এখানকার নৌকোগুলোকে বলে শিকারা–তাতে চড়ে ফেরিওয়ালারা জিনিস বিক্রি করতে আসে। ফুল আর ফল যে কত রকম কাশ্মীরে পাওয়া যায় তা গুণে শেষ করা যায় না। ফলের মধ্যে আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, আখরোট, আলুবোখরা, বাদাম, পিচ, বেরি খোবানি, স্ট্রবেরি–কত কী!
আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক, দেশভ্রমণ–এবং যেখানে যা কিছু শিক্ষণীয় আছে, সব গ্রহণ করা। বই-এর পাতায় সবকিছু জানাশোনার শেষ নয়। অচেনা অজানা। দেশের মানুষের মধ্যে, প্রবৃত্তির মধ্যে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে। আর আমাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল–কী করে স্বাবলম্বী এবং সময়ানুবর্তী হয়ে সব কাজ করতে হয়–স্কাউটদের তা শিক্ষা দেওয়া। সেইজন্য দলের নেতা কমলদা নিজে কোনও ব্যাপারে হস্তেপেক্ষ না করে–হিসেব, খরচপত্র এবং কাজের প্রোগ্রাম করবার জন্য দুজন স্কাউট কর্মীকেই ম্যানেজার করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘায়িত চেহারার দুই ম্যানেজার মৃত্যুঞ্জয় আর দুর্গাচরণ–একজন বলিষ্ঠ আর হৃষ্টপুষ্ট, অপরজন রোগা আর লম্বা। এরা খুব নিপুণভাবে সবকিছু ব্যবস্থা করেছে। আর সহকারী স্কাউট মাস্টার দ্বারিকদা এদের তত্বাবধান করেছেন মাঝে-মাঝে। অবশ্য সে তত্বাবধানের মধ্যে টিকাটিপ্পনীর ভাগই বেশি ছিল। আর ছিল সময়ানুবর্তিতা। আমরা যখন যে জায়গায় যাব ভেবেছি–সেই সময়ই যাওয়া হয়েছে। এক মিনিটও দেরি হয়নি। সেজন্য আমরা ওই শীতের মধ্যে ভোর চারটের সময় উঠতেও দ্বিধা করিনি। আর এইজন্যই বোধহয় আমরা যেখানে যেটুকু উপভোগ করবার তা পরিপূর্ণভাবে করেছি।
শ্রীনগর থেকে আবার বাসে করে অনেক দূরে দূরে দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যেতে হয়। যেমন, পহলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ, উলার লেক, বারমুডা ইত্যাদি। আমরা শুধু শেষেরটা ছাড়া সবগুলোতেই গিয়েছি। দীর্ঘ বাসজার্নিতে আমরা কোরাস গান করতে করতে যেতাম। এ বিষয়ে সমীর আমাদের নেতা। সমীর আগে শুরু করত–সকলে গলা মেলাত যতীনদা, গোপালদা দ্বারিকদা এবং আর সকলে। বাসের মধ্যেই আমাদের চিরকালের কোয়ার্টার মাস্টার বিশুদা আমাদের খাবার সাপ্লাই দিতেন। আমরা সকলে এমন হইচই করতে করতে যেতুম যে, সকলেই কৌতূহল নিয়ে আলাপ করতে আসত আমাদের সঙ্গে। এমনি করে আলাপ হয়েছিল–কেনিয়া থেকে আসা এক স্কাউটের সঙ্গে এবং ধানবাদের একজন প্রাক্তন স্কাউট আর তাঁর বোন দুজন গার্ল গাইডের সঙ্গে।
কাশ্মীরে দেখার জায়গার শেষ নেই। পথ ঘাট সবকিছুই দর্শনীয়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পহলগাম–পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট জায়গা। মাঝখানে তীব্র স্রোতে বয়ে চলেছে এক পাহাড়ি নদী। বরফ গলে কী করে ঝরনা হচ্ছে, পহলগামে গেলে স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে অনেক ভ্রমণকারী থাকে। তাঁবুর মধ্যে হোটেল। পহলগাম থেকে অমরনাথ তীর্থে যাওয়া যায়। সোনমার্গ থেকে লাক যাওয়ার রাস্তা। সেখানে আমরা ঘোড়ায় করে কয়েকটা ঝরনা পেরিয়ে একেবারে বরফের ওপর গিয়েছিলাম। বরফের ওপর সবচেয়ে মজা লাগে এই যে–আছাড় খেলে লাগে না, জামা ভেজে না। আছাড় খাওয়ার কথায় মনে পড়ল, আছাড় খাওয়ার প্রতিভা আছে আমাদের দলের শরৎদার। কাশ্মীরে যে কতবার তিনি আছাড় খেয়েছেন তার আর কিছু ঠিকঠিকানা নেই। দু-একবার প্রাণসংশয় হয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছেন প্রত্যেকবার।
বরফের ওপর সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছিল খিলানমার্গে। এখানেও ঘোড়ায় করে গুলমার্গ থেকে অনেকটা দূর যেতে হয়। ঘোড়ার পিঠে অনেকটা দূর পথ–স্কাউট নবীন, রবিন আর অসিতের কী উৎসাহ। ওই বিপজ্জনক রাস্তাতেও ওরা ঘোড়ার রেস দিয়েছে। পথে একবার বরফের বৃষ্টি হল–আমরা গা থেকে মজা করে বরফগুলো ঝেড়ে ফেলে দিলুম–জামা-কাপড় ভিজল না। খিলানমার্গে আবার বরফের ওপর স্কেটিং করলাম–যা এতকাল আমরা সিনেমাতেই দেখে এসেছি। ভারী মজা লাগল। বরফের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে কাঠের ওপর বসে গড়িয়ে আসা। যে যতবার আছাড় খাচ্ছে, সে তত আনন্দ পাচ্ছে। শরৎদা, বিশুদা আর অসিত যে কতবার আছাড় খেলো তা আর গুনে শেষ করা যায় না।
শ্রীনগরের আর দেখবার জিনিস মোগল সম্রাটদের তৈরি বাগানগুলো নিসাশ বাগ, শালিমার, শমাসাহী প্রভৃতি। ধাপে ধাপে নেমে আসা ঝরনার সামনে কী অপূর্ব সুন্দর বাগান। ফল আর ফুলের মেলা চারিদিকে। এর মধ্যে চশমা সাহীর একটি বস্তিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মারা যান।
কাশ্মীরের লোকগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয়। যেমন রং, যেমন নাক চোখ–তেমন স্বাস্থ্য। কিন্তু লোকগুলোর মন ভারী সরল আর অতিথিপরায়ণ। এখানে বেশিরভাগ লোক মুসলমান কাশ্মীরী ব্রাহ্মণরা পাণ্ডিত্যের জন্য খুব বিখ্যাত। এখানকার লোকেরা সাধারণত খুব শান্তিপ্রিয়।
কাশ্মীরের কথা লিখে শেষ করা যায় না। আর না দেখলে এর সৌন্দর্যও ঠিক বোঝা যায় না। যাই হোক, শেষে আবার আমাদের ফেরবার সময় হল। ফেরার পথে আবার অমৃতসর, দিল্লি, আগ্রা হয়ে আসতে হবে। একদিন আমরা ফেরার বাসে চেপে বসলুম। আবার আসবেন, আবার আসবেন, বলল আমাদের গাইড রহমান। আবার আসব, আবার আসব, বললাম আমরা সকলে। এই ক’দিনে কাশ্মীরের মানুষজন আচার-ব্যবহার বা দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের যা জ্ঞান হল, কাশ্মীর সম্বন্ধে হাজার বই পড়লেও তা আমরা শিখতে পারতাম না। এইজন্যই ভ্রমণকেই শিক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় বলা হয়ে থাকে।