এ যেন পাহাড় নয়, প্রকৃতির ভাস্কর্য

এ যেন পাহাড় নয়, প্রকৃতির ভাস্কর্য

আগে থেকেই ঠিক ছিল, দেখা হবে ভ্যাঙ্কুভারে। ছ’জন বন্ধু। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে দেখা হওয়ার মতনই স্বাভাবিক ব্যাপার যেন, যদিও এই বন্ধুরা উড়ে আসছে তিনটি মহাদেশ থেকে। উদ্দেশ্য? স্রেফ আড্ডা আর ভ্রমণ।

এই ছ’টি চরিত্রের একটু পরিচয় দেওয়া যাক। একটা প্রায় অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি তথ্য হল যে, আড্ডাপ্রিয় আর অ্যাডভেঞ্চার-উৎসুক এই দলটির ছ’জনের মধ্যে চারজনেরই বয়স সত্তরের গণ্ডি পেরিয়েছে। কিন্তু সবারই শরীর ফিটফাট, কেউ কোনও অসুখের কথা উচ্চারণ করে না, আর খাদ্যপানীয়ের ব্যাপারে কিছুমাত্র বাছ-বিচার বা শুচিবাই নেই, বরং কিছু কিছু অনিয়ম করার দিকেই ঝোঁক। পাঁচজনই সিগারেট ফোঁকে, চা-কফি ও আরও কড়া জাতীয় পানীয় চলে সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত।

সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ জন পঁচাত্তরে পা দিয়েছেন, তিনিই সবচেয়ে উৎসাহী ও প্রাণবন্ত। এই মানুষটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। বয়সের কোনও ছাপ পড়েনি শরীরে, আড্ডায় অক্লান্ত, তাঁর নাম কান্তি হোর। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে পাড়ি দিয়েছিলেন ইউরোপে, জার্মানিতে থেকেছেন অনেক বছর, তারপর আবার সমুদ্র ডিঙিয়ে কানাডায়। এখন নামমাত্র বসতি টরন্টো শহরে, আজও কাজের জীবনে সক্রিয়, কাজের জন্য সারা বছরই পশ্চিম গোলার্ধের নানা দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এসবের মধ্যে তেমন বিস্ময়ের কিছু নেই, আসল বিস্ময় হল, প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে দেশের বাইরে থেকেও কান্তি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ আপন করে রেখে দিয়েছেন। কত লোককে তো দেখলাম, দশ-পনেরো বছর বিলেতে বা বিদেশে থেকে সাহেব হয়ে যায়, বাংলা বলতেই চায় না। আর কান্তি অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি বিদেশে, তাঁর চেহারাটা বিদেশিদের মতনই হয়ে গেছে, অনায়াসেই স্প্যানিশ মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর অন্তরটা খাঁটি বাংলা।

বয়সের হিসেবে এর পরেই আমি। এই দলের মধ্যে আমিই কিছুটা কমজোরি হয়ে পড়েছিলাম সেই সময়, আমার হাঁটুতে বেশ ব্যথা ছিল, কিন্তু ইচ্ছাশক্তিতে তো পঙ্গুও গিরি লঙ্ন করতে পারে।

তৃতীয়জন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমার চেয়ে কয়েক মাসের ছোট। ‘অপুর সংসার’-এর এই নায়ককে আমি সিনেমার নায়ক হওয়ার আগে থেকেই চিনি। সৌমিত্র তুখোড় আড্ডাবাজ, আজ্ঞার টানে অনেক জরুরি কাজ ফেলেও চলে আসতে পারে।

এর পর ফরাসি দেশ নিবাসী অসীম রায়। কান্তি হোরের মতন অসীম রায়ও বহুঁকাল প্রবাসী, প্রথমে লন্ডন, তারপর প্যারিস। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ছোটবেলায় দেওয়াল পত্রিকায় লেখার হাতেখড়ি, বিদেশে গিয়ে আর লেখালেখি করেনি, কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে ছাড়েনি, তার বাড়িতে পুরো রবীন্দ্ররচনাবলি থেকে শুরু করে কয়েকজন আধুনিক কবির কবিতার বই পর্যন্ত আছে। মাত্র কয়েক বছর আগে, হঠাৎ কী খেয়ালে সে একটা ছোট গল্প লিখে ফেলেছিল, সে গল্প এমনই মান-উত্তীর্ণ যে অনায়াসে ছাপা হয়ে গেল ‘দেশ’ পত্রিকায়। কিন্তু আর লেখেনি। এখন কলমের চেয়ে ক্যামেরা তার বেশি প্রিয়।

পঞ্চমজন রবীন চ্যাটার্জি, ইনিও যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, দীর্ঘকায়, অতি ভদ্র মানুষ, মৃদুভাষী, ইনি অল্প বয়সে কখনও গল্প-কবিতা লিখেছেন কিনা আমি জানি না। বহু কাল কানাডাবাসী, ওঁর স্ত্রী বিদেশিনী, কিন্তু ওঁর বাংলা ভাষাপ্রীতি খুবই উল্লেখযোগ্য। প্রায় প্রতি বছরই কলকাতায় এসে বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে যান একগাদা বাংলা বই। রবীন স্বেচ্ছায় আমাদের গাড়ি চালাবার ভার নিয়েছেন।

এই দলের ষষ্ঠ এবং একমাত্র মহিলা সদস্যদের নাম স্বাতী, ইনি এখনও সত্তর বছরে পৌঁছবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। অনেক দেরি। এতজন পুরুষের সঙ্গে একজন মহিলা কি মানিয়ে নিতে পারবেন? এ মহিলাটির এমনই ভ্রমণের নেশা যে, কোনও বাধাই মানবেন না, কোনও অসুবিধেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না, শুধু বাথরুমটা ভালো হওয়া চাই। আমাদের দেশে অনেক জায়গায় বাথরুমের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নানা সমস্যা হয়, কিন্তু সাহেবদের দেশে সে প্রশ্নই নেই। পরিচ্ছন্নতাবোধে সাহেবরা আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে, তা স্বীকার করতেই হবে।

সৌমিত্র, আমার ও স্বাতীর ভ্যাঙ্কুভারে আসার একটা উপলক্ষ আছে। আমরা এসেছি বঙ্গ সন্মেলনের আমন্ত্রণে। এখন প্রতি বছরেই উত্তর আমেরিকার (যার মধ্যে কানাডাও আছে) কোনও না কোনও শহরে বঙ্গ সংস্কৃতি সন্মেলন হয়। বাড়তে-বাড়তে তা বিরাট আকার ধারণ করেছে, অংশগ্রহণকারী ও প্রতিনিধিদের সংখ্যা ছ’-সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। সারা ভারতে কোথাও বাঙালিদের এমন সম্মেলন হয় না, যেখানে এত বেশি সংখ্যক মানুষ যোগ দেয়। আমেরিকার মতন এত বেশি ধুতি-পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরা বাঙালিও একসঙ্গে কোথাও দেখা যায় ভারতে।

মূল বার্ষিক সম্মেলন ছাড়াও কয়েক বছর ধরে কয়েকটি ছোট-ছোট বঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোনও কোনও শহরে। যেমন শিকগোয়, কলম্বাস-ওহায়োতে, এই ভ্যাঙ্কুভারে। ছোট বলেই (তাও উপস্থিতি দেড়-দু-হাজার তো হবেই) আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত স্পর্শ পাওয়া যায় অনেকটা।

তিনদিনের সম্মেলন তো শেষ হল ভালোভাবেই, ততদিন বাকি তিনজন এক হোটেলে ঘাপটি মেরে বসেছিল, আমাদের কর্তব্য শেষ হলেই শুরু হবে আজ্ঞা ও ভ্রমণ। সেই টানেই তো এসেছে ওরা।

পৃথিবীতে যে ক’টি অতি সৃদৃশ্য শহর আছে, তার মধ্যে ভ্যাঙ্কুভার অন্যতম। প্রকৃতি এখানে যেমন অকৃপণ, তেমনই তা বিশুদ্ধ সুন্দর করে রেখেছে এখানকার মানুষ। আর ভ্যাঙ্কুভার থেকে বেরোলেই যে শত-শত মাইল পর্বতমালা ও হিমবাহ, তা বিশ্বের বিস্ময়। এর রূপ সমস্ত কল্পনাকেই হার মানায়।

ভ্যাঙ্কুভার আসলে একটা দ্বীপ। এক সময় ছিল বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর লীলাভূমি। তথাকথিত সভ্যতার সংস্পর্শে না এসে তারা নিজস্ব সুখে-শান্তিতেই ছিল। তারপর এল ইউরোপীয় ভাগ্যান্বেষী ও রাজশক্তি। জর্জ ভ্যাঙ্কুভার নামে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর এক অফিসার প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম উপকূল ছুঁড়তে-ছুঁড়তে এখানে এসে পৌঁছল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ‘গোল্ড রাশ’ নামে যে পাগলামি শুরু হয় তার একটা কেন্দ্র ছিল এই দ্বীপ। ততদিনে অবশ্য আদিবাসীদের জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে গেছে।

যাই হোক, আমরা তো চানাচুর, বিস্কুট, চিজ, আরও সব নানা রকম প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করে বেরিয়ে পড়লাম শহর ছেড়ে। একটা বড় গাড়ি ভড়া করা হয়েছে, যাতে ছ’জনে মিলে বেশ হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায়। ছয় সংখ্যাটা একটু গণ্ডগোলের, ছয় রিপুর কথা মনে পড়ে। এখানে কিন্তু আমাদের ছ’জনের মধ্যে একটুও মনের গরমিল নেই। দীর্ঘযাত্রায় সাধারণত একজনকে বেছে নিয়ে নানারকম লেগ পুল (‘পদাকৰ্ষণ’, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর ভাষায়) আর নির্দোষ মজা করতে করতে যাওয়া হয়। এবারে অবশ্য আমাদের মধ্যে তেমন বিশেষ একজন কেউ নেই, সুতরাং এক-এক সময় এক-এক জন। তবে অসীমই নিজগুণে বেশি সুযোগ করে দিচ্ছিল।

এর আগেও প্রতি বছরই আমরা দল বেঁধে কোথাও না কোথাও অভিযানে বেরিয়েছি, কখনও ভারতে কখনও বিদেশে। দলের সদস্যদের মধ্যে দু-একজন অদল বদল হয়েছে, কখনও গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেছে টরন্টোর দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী, নানানরকম খাবার-দাবার জোগাড় করার অদ্ভুত ক্ষমতা তার। এবার সে আসতে পারেনি। অথবা লন্ডনের ভাস্কর দত্ত, স্বাভাবিকভাবেই সে দলের নেতা, অসীমের সঙ্গে তার খুনসুটি ছিল বিশেষ উপভোগ্য। ভাস্কর দত্ত আর কোনওদিন আসবে না। বাদল বসুও থেকেছে কয়েকবার।

এবারে আমরা যে-পথে বেরোলাম, সে-পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্ববিখ্যাত। কানাডিয়ান রকি মাউন্টেনস। টানা চার-পাঁচদিন ধরে পাহাড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা। সে পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যের কথা ক্রমশ প্রকাশ্য। পাহাড় ছাড়াও আরও কিছু।

তবে, এ কথাও ঠিক, প্রকৃতি যতই মনোহর হোক, সব সময় তো আর সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যায় না! দল বেঁধে গেলে মাঝেমাঝেই আড্ডাটা প্রধান হয়ে ওঠে। প্রত্যেক দলে একজন থাকে প্রধান আড্ডাধারী, এই দলে সৌমিত্র। অফুরন্ত তার গল্পের স্টক আর কথায় কথায় সে গান গেয়ে উঠতেও পারে। আর মাঝেমাঝেই বুদ্ধির ঝিলিকে ছোট্ট মন্তব্য করে কান্তি, অসীম প্রায়ই সম্পূর্ণ উলটো কিছু বলে ফেলে।

এই অভিযাত্রীদের গড় বয়স সত্তর হলেও একমাত্র মহিলা সদস্যটি ছাড়া আর সবাই ধূমপায়ী। কিন্তু অসীমের কঠোর নির্দেশ, চলন্ত গাড়িতে সিগারেট ধরানো নিষেধ। একবার ফ্রান্সে তার গাড়িতে এই ব্যাপারে একটা দুর্ঘটনার উপক্রম হয়েছিল। তা ছাড়া, এখানকার চলন্ত গাড়িতে যেহেতু জানলা খোলা যায় না, (দুরন্ত গতির জন্য এমন জোর হু-হুঁ শব্দ হয় যে কথাই বলা যায় না) তাই বন্ধ গাড়িতে ধূমপান দ্বিগুণ অস্বাস্থ্যকর। সুতরাং ঘণ্টাখানেক পরপর কোনও ছুতোয় রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে সিগারেট ব্রেক দিতে হয়।

যদিও দুপাশে পাহাড়, কিন্তু রাস্তা মোটেই পাহাড়ি নয়, অতি মসৃণ যথেষ্ট প্রশস্ত। এসব দেশের রাস্তা দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। কিছুদিন আগেও এইসব দেশের রাস্তা দেখে নিজের দেশের রাস্তার জন্য ভারী হীনম্মন্যতা বোধ হত, কিন্তু এখন ‘সোনালি চতুর্ভজ’-এর সুবাদে এমন সব চমৎকার হাইওয়ে তৈরি হয়েছে, যা সাহেবদের দেশের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে, কোনও কোনও রাস্তা আমাদের দেশেই বেশি ভালো। কলকাতা থেকে আগে গাড়িতে শান্তিনিকেতন যেতে সময় লাগত সাড়ে ছ’ঘণ্টা, এখন তিন ঘণ্টা বড়জোর!

এই প্রসঙ্গে আর একটা রাস্তার কথা মনে পড়ল।

উত্তর আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যেও এরকম পাহাড়ের ট্রেল রয়েছে। বোলডার শহর থেকে আমার এক বাল্যবন্ধু শুভেন্দু দত্ত (এখন ওদেশে বিখ্যাত অধ্যাপক) আমাকে ওই রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল কিছু দূর। সেবারে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জুন মাস, সোয়েটার কোট পরার প্রশ্নই নেই, গায়ে শুধু একটা হাওয়াই শার্ট। এক জায়গায় এসে দেখি, রাস্তার দুধারে দু’তিন ফুট বরফ জমে আছে। অথচ একটুও শীত নেই। প্রথমটা আমি হতবাক। গাড়ি থেকে নেমে বরফের পাশে দাঁড়ালেও একটুও শীতের কাঁপুনি লাগছে না, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা টি-শার্ট পরে বরফ নিয়ে খেলা করছে, এটা কী করে সম্ভব? কয়েকজন ভৌগোলিক ব্যাখ্যা দিয়েছিল, সেটাও আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি। কিন্তু বরফ তো জমে আছে! উত্তাপ শূন্যের নীচে না গেলে বরফ জমে কী করে? বরফ তো গলছেও না। কেউ বলল, হাওয়া নেই বলে শীত লাগে না! যাই হোক, সেটা আমার জীবনে একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে আছে।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি উপন্যাসের নাম ‘স্লেজ অফ কিলিমাঞ্জারো।’ আফ্রিকার কেনিয়ায় গিয়ে আমি কিলিমাঞ্জারো পাহাড় দেখেছি। কত পাহাড়ের চূড়াতেই তো বরফ জমে, তা হলে এই নামকরণের তাৎপর্য কী? এখান থেকে গেছে বিষুব রেখা। সুতরাং গরম হওয়ার কথা, তবু কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় (এমন কিছু উঁচু পাহাড়ও নয়) বরফ জমে আছে, সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার!

আমার এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে একজন বলেছিল, কলোরাডোতে পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাইওয়ে গেছে। আমেরিকানদের যদি মাউন্ট এভারেস্টটা দিয়ে দেওয়া যেত, তা হলে অনেক দিন আগেই ওরা চূড়া পর্যন্ত হাইওয়ে বানিয়ে ফেলতে পারত। তেনজিং আর হিলারি শিখর জয় করত গাড়ি চেপে!

এই কানাডিয়ান রকিজ-এর অনেক পাহাড়েই বরফ নেই, গাছপালাও নেই, শুধুই উলঙ্গ পাথর। সেটাই এই পর্বতমালার বৈশিষ্ট্য। গাছপালা থাকলে সব পাহাড়কেই দূর থেকে একরকম দেখায়। এখানকার প্রতিটি পাহাড়কে মনে হয় যেন আলাদা-আলাদা ভাস্কর্য। নানা রকমের আকার, তা দেখে কত কিছু কল্পনা করে নেওয়া যায়, কত রকমের মূর্তি কিংবা প্রাসাদ। প্রকৃতিই এইসব ভাস্কর্যের স্রষ্টা। কিংবা যারা ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্বে বিশ্বাসী, তারা অবশ্যই ধরে নিতে পারে, এইসব রূপ অপ্রাকৃত।

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, রাত্তিরে গাড়ি চালানো হবে না। প্রতি রাত্রির জন্যই এক এক স্থানে মোটেলে তিনটি করে ঘর বুক করা আছে। এখানে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গলের মধ্যেও হোটেল মোটেল থাকে অনেক পর্যটক আসে অজস্র। ইন্টারনেট দেখে কান্তি হোর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্রথম দিনের গন্তব্য কামলুপস দুরত্ব ৩৬৬ কিলোমিটার। এদেশে এতটা পথ দিব্যি ধীরেসুস্থে সন্ধের আগেই পৌঁছনো যায়।

পাহাড়ের পর পাহাড় এবং কয়েকটি নদীনালা পেরিয়ে এক উপত্যাকায় কামলুপস একটা ছোটখাটো শহরের মতন। টমসন নদীর দুটি ধারার মাঝখানে। এককালে ছিল ‘লাল ভারতীয়’ দের গ্রাম, স্বর্ণসন্ধানীরা হুড়মুড় করে এসে পড়ে এখানে। তারপর আগে পশমলোভী ইউরোপীয়রা। পশম তখন খুবই দামি জিনিস। এইসব অঞ্চলে এক প্রকারের রামছাগল প্রচুর, যাদের বলে ‘মাউন্টেন গোট’, তাদের গায়ে বড় বড় লোম। সেই লোমে তৈরি হয় উত্তম পশম। হরিণের শরীরের মাংসই যেমন তার শত্রু, সেইরকম এই লোমের জন্যই হাজার-হাজার রামছাগল নিহত হয়েছে। তা ছাড়া আছে বৃহৎ আকারের ভাল্লুক, তাদের গায়ের লোেমও মহার্ঘ, সেই ‘গ্রিজলি বেয়ার’ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। আমরা অবশ্য সেই ভাল্লুক দেখিনি, তবে ‘মাউন্টেন গোট’ চোখে পড়েছে প্রায়ই।

কামলুপস নামটা আদিবাসীদের নিজস্ব নামের বিকৃতি, যার অর্থ অনেক জলের মাঝখানে। অন্য মতে, ফরাসিরা এসে এই জায়গার নাম দিয়েছিলেন ‘কাম্প দে লুপস,’ যার অর্থ নেকড়েদের আস্তানা!

মোটেলগুলোতে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, তার জন্য রেস্তোরাঁ খুঁজতে হয়। মালপত্র রেখে কিছুক্ষণ আমরা উষ্ণ পানীয় নিয়ে গা-গরম করে নিই। তারপর বেরিয়ে পড়ি খাদ্যের সন্ধানে। এ ব্যাপারে মূল দায়িত্ব অসীমের। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও অসীম বেশ কয়েক বছর প্যারিস শহরে একটি রেস্তোরাঁর মালিক ছিল। খাবারের গুণাগুণ ও দাম সে-ই ভালো বুঝবে। এরকম ছোট জায়গাতেও চাইনিজ, মেক্সিকান ও নানা রকম রেস্তেরাঁ আছে, ভারতীয়ও থাকতে পারে, কিন্তু আমরা ভুলেও ভারতীয় রেস্তোরাঁ খুঁজি না। সারা জীবন দিশি খাবার খাচ্ছি, বিদেশে এসে বিদেশি খাবার খাব না কেন?

অসীম বেশি-বেশি জানে বলেই তাকে নিয়ে বেশি মুশকিল হয়। সে একটার পর একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে মেনু আর দাম দেখবে, তার পছন্দ হবে না, এদিকে খিদেতে আমাদের পেট চুইচুই করছে! এমনও হয়, আট-দশটা জায়গা দেখার পর প্রথম যেটা দেখা হয়েছিল অসীম সেটাতেই ফিরে আসে। আমি তা নিয়ে কখনও একটু ক্ষোভ প্রকাশ করতে গেলেও অতি ভদ্র কান্তি হোর তা চাপা দিয়ে বলে, না, না, সব ভালো যার শেষ ভালো। অসীম যখন বলছে, এটাই সবচেয়ে ভালো…।

খাবারের অর্ডার দিতেও অনেক সময় যায়। ছ’জনের পাঁচ রকম পছন্দ! দলের কনিষ্ঠা সদস্যটিই তার মতামত জানাবার সুযোগ পায় না। অসীম হঠাৎ একটা ডিশ বেছে নিয়ে বলে, স্বাতী, এটা তুমি আর আমি ভাগ করে খাব, অনেকটা দেবে। স্বাতী বেচারির হয়তো পুরো প্লেটটি খাওয়ার ইচ্ছে, কিংবা অন্য কোনও রান্না বেশি পছন্দ, তা আর বলা হয় না। অসীম পাঁউরুটি খুব ভালোবাসে, যে-কোনও রান্নার সঙ্গে পাঁউরুটি খাবে অনেকটা। কয়েকদিন পরে অবশ্য স্বাতী ক্ষীণ প্রতিবাদ করে নিজের পছন্দ জানাতে শুরু করেছিল।

আমাদের পরের দিনের গন্তব্য ব্যানফ (Banff) নামে এক বিখ্যাত উদ্যান অঞ্চল, দূরত্ব ৪৯২ কিলোমিটার।

প্রস্তুত হয়ে বেরতে বেরতে ন’টা বেজে যায়। গাড়ি চালাচ্ছে রবীন, সে সবচেয়ে আগে তৈরি। রবীন অতিমাত্রায় বাঙালি, কিন্তু ব্যবহারে পাশ্চাত্য দেশীয়দের মতন। একেবারে সাহেবদের মতন চেহারার কান্তি ঘোরের মুখের ভাষা নিখুঁত বাংলা হলেও ব্যবহারে কোনও বাঙালিসুলভ ঢিলেঢালা ব্যাপার নেই। সৌমিত্র চট্টেপাধ্যায়ের অন্য যত দোষই থাকুক, অনেকে স্বীকার করে যে, সে হাতঘড়ি পরে না, কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে সব জায়গায় সময়ের ঠিক রাখে।

সমস্যা দুজনকে নিয়ে। মেয়েদের তৈরি হতে বেশি সময় লাগতেই পারে, ঠিকমতন সাজগোজ না করে তারা বেরতে পারে না। সবাই তাড়া দেওয়ার পর স্বাতী বেরিয়ে এলেও আবার একবার নিজের ঘরে যাবেই। কী যেন সে ফেলে এসেছে। প্রায় প্রত্যেকবারই দেখা যায়, সে টুথব্রাশটা আনতে ভুলে গেছে। আর অসীম অনেক আগেই তৈরি হয়ে কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ছবি তোলা তার নেশা, তাই গাড়িতে ওঠার আগে তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। ডাকাডাকি করে তাকে তো ফিরিয়ে আনা গেল, তখন সে বলবে, আমাকে আর দু’মিনিট সময় দাও। তাকে একবার টয়লেটে যেতে হবেই হবে! অন্তত দশবারো বছর ধরে আমি দেখছি, অসীমের এই লাস্ট মিনিট টয়লেটে যাওয়ার দুর্বলতা। আমি জিগ্যেস করেছি, অসীম, সত্যিই কি তোমাকে সকালে দ্বিতীয়বার টয়লেট যেতে হয়? অসীম আমতা আমতা করে বলে, না, তা নয়, তবে যদি মাঝ রাস্তায় হঠাৎ যদি…।

দ্বিতীয় দিনে পার্বত্য শোভা সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম, চতুর্দিক শান্ত ও নিস্তব্ধ, পাহাড়ের চূড়া যেন দেখছে আমাদের। কখনও মনে হচ্ছে দুর্গ, কখনও মন্দির, গির্জা কিংবা মসজিদ, কখনও কোনও মোষের মাথা, কখনও যেন ভবিষ্যৎ কালের স্থাপত্য। এই দলটির সকলেই অনেক দেশে অনেক পাহাড় দেখেছে, কিন্তু এই পর্বতমালার সৌন্দর্য যে সম্পূর্ণ অন্য রকম, তা মানতেই হয়।

কয়েক ঘণ্টা পর পথের পাশে সাময়িক বিরতি। পাশাপাশি দুটি পর্বতশৃঙ্গের ধারালো চূড়া, যেন আকাশের দিকে উদ্যত অস্ত্র। এ দৃশ্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। ফ্লাস্কে আছে কফি, তাছাড়া বিস্কিট, চিজ, এবং সিগারেট। গাড়ি চালাতে রবীনের ক্লান্তি নেই, সে সৌমিত্রকে বলল, আপনার অভিজ্ঞতার কিছু গল্প বলুন।

কলকাতার সিটি কলেজে সৌমিত্র আর আমি একসঙ্গে পড়েছি। কলেজের বার্ষিক উৎসবে একবার একটা নাটকে সৌমিত্র আর আমি দুজনেই অভিনয় করেছিলাম। একটা বিদেশি নাটকের (খুব সম্ভবত গলসওয়ার্দির) ‘অ্যান ইনসপেক্টর কলস’-এর বাংলা অনুবাদ। সে নাটকে সৌমিত্র আর আমার ভূমিকা ছিল সমান সমান কিন্তু যা হয়, পরবর্তীকালে অভিনেতা হিসেবে

আমার কোনও স্থানই হল না। আর সৌমিত্র উঠে গেল কত ওপরে। তখন কে জানত যে সিটি কলেজের এই ছেলেটিকে সত্যজিৎ রায় পছন্দ করে ডেকে নেবেন ‘অপুর সংসার’ ফিলমের জন্য, পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের অনেক ফিলমে তো বটেই, গোটা বাংলা সিনেমাতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠবে অন্যতম প্রাধন নায়ক!

অন্যতম বললাম এই জন্য যে, বেশ কিছু বছর উত্তমকুমার আর সৌমিত্র ছিল দুই প্রধান নায়ক। অনেক দর্শকই ছিল উত্তমকুমারের বেশি ভক্ত, আবার অনেক দর্শক সৌমিত্রর। যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গানের। যেমন, সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতের। এরকম মনে হতেই পারে যে পাশাপাশি দু’জন সমান মাপের শিল্পীর মধ্যে খানিকটা রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। অন্যদের কথা জানি না, সৌমিত্রের মধ্যে সেরকম মনোভাব আমি কখনও দেখিনি। উত্তমকুমারকে সে মনে করেছে বড় ভাইয়ের মতন, আর উত্তমকুমারও কনিষ্ঠের মতন স্নেহ করতেন সৌমিত্রকে। এটা ভারী চমৎকার ব্যাপার।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর সৌমিত্র শুরু করল নানারকম টুকিটাকি গল্প। তার মধ্যে একটি তরুণকুমার সম্পর্কে। উত্তমকুমারের এই ভাইটিরও বেশ অভিনয়প্রতিভা ছিল, ছায়াছবিতে প্রথম আবির্ভাবের পর তার চেহারাও ছিল ছিপছিপে, সুশ্রী, কিন্তু সে কোনওদিনই নায়কের পর্যায়ে উন্নীত হল না, কারণ দিন দিন সে মোটা হতে লাগল। সৌমিত্র একদিন উত্তমকুমাকে বলল, উত্তমদা, আপনি তরুণকুমারকে (ডাকনাম বুড়ো) বলতে পারেন না, একটু ব্যায়াম করতে, শরীরটা ঠিক রাখতে?

যারা পারফরমিং আর্টিস্ট, তাদের শরীর ঠিক রাখতেই হয়। বাংলায় একটা কথা আছে, কেশো রুগি চোর আর মুখচোরা বেশ্যার কখনও উন্নতি হয় না। সেই রকমই গলা ভাঙা গায়ক, বানান ভুল করা লেখক, চোখের দোষ থাকা ক্রিকেটার, বেশি অহংকারী রাজনীতিবিদ, এদের কোনও উন্নতির আশা নেই।

উত্তমকুমার একদিন সৌমিত্রের বাড়িতে এলেন ভোরবেলা। সৌমিত্র আর উত্তমকুমার দুজনই নিয়মিত ব্যায়াম করেন, ভোরবেলা জগিং করতে যান, দুজনকেই প্রচুর খাটতে হয়। উত্তমকুমার সৌমিত্রকে বললেন, পুলু (ডাকনাম) তুমি তো বলেছিলে বুড়োর ব্যায়াম-ট্যায়ামের কথা! এসো,

আমার সঙ্গে দেখবে এসো। আমি ওকে জোর করে ডেকে জগিং করাতে এনেছি, তার ফল কী হয়েছে।

সৌমিত্র গিয়ে দেখল, লেকে একটা গাড়ির মধ্যে বসে তরুণকুমার ভোঁস-ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে!

এই রকম গল্পের মাঝখানে অসীম রায় হঠাৎ বলে উঠল, সিনেমার সব লোকগুলো বড় দু’নম্বরি হয়!

আমরা স্তম্ভিত। বলে কী অসীম! পাশে বসে আছে বাংলা চলচ্চিত্রের এখনকার প্রধান পুরুষ, তার সামনে এইসব কথা?

রবীন ব্যাপারটা সামলাবার জন্য মুখ ফিরিয়ে বলল, অসীম রায় বোধহয় ওয়েস্টার্ন সিনেমার কথা বলছেন….

কান্তি বললেন, হ্যাঁ, আমরা শুনেছি, ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে সিনেমার কিছু কিছু ব্যাপারে, অনেক রকম…

অসীম সে ইঙ্গিত না নিয়ে আবার বলল, না, না, ওসব বাংলা ইংরেজি একই ব্যাপার। লোকগুলো নানা রকম….

আমি চুপ। আমি তো জানি, অসীম একটু ট্যালা ধরনের, স্থান-কাল পরিস্থিতি খেয়াল রাখে না, হঠাৎ একটা কিছু বলে বসে।

এই ব্যাপারে সবচেয়ে যার আহত হওয়ার কথা, সেই সৌমিত্র হা-হা করে হেসে উঠে বলল, অসীম ঠিকই বলেছে, সিনেমার লোকগুলো এমন ভণ্ড আর পাজি হয়…

তখন অসীমের খেয়াল হল। সে থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, মানে, প্রেজেন্ট কোম্পানি একজেমটেড…আমি সৌমিত্রকে কিছু বলছিনা।

সৌমিত্র আবার হেসে উঠে বলল, না, না, শালা, সিনেমার লোকগুলো…

আমি পুরো ব্যাপারটা থেকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্য বললাম, ওই দ্যাখো, দ্যাখো, সামনে কী হচ্ছে।

রাস্তার ধারে, আমাদের সামনে একটা গাড়ি থেমে আছে। জানলা দিয়ে বায়নোকুলার বার করে কী যেন দেখছে একজন। ওখানে নিশ্চয়ই দ্রষ্টব্য কিছু আছে।

আমরাও নিঃশব্দে গাড়ি থামালাম সেখানে। আমাদের সঙ্গে বায়নোকুলার নেই, খালি চোখেই দেখতে পেলাম, গাছপালার আড়ালে দুটো মুস। অর্থাৎ প্রায় গরুর আকারের প্রাণী, মাথায় মোটা মোটা শিং ধীর গতিতে ঘাস খাচ্ছে। এরাও শিকারিদের প্রিয় প্রাণী।

অসীম নেমে গেল ছবি তোলার জন্য।

২.

অসীম খুব ভালো ফটোগ্রাফার। কয়েকটি সারা দেশীয় প্রদর্শনীতে তার ছবি স্থান পেয়েছে। কিন্তু ভাস্কর বলত, অসীম শুধু শূন্যে ঝোলা মাকড়সা, পুকুরে ব্যাঙের লাফ কিংবা কুকুরের হাই তোলার ছবি তোলে, মানুষের দিকে কক্ষনো ক্যামেরার মুখ ঘোরায় না। আমি একটু সংশোধন করে বলেছি, অসীম পুরুষ মানুষের ছবি তোলে না, কিন্তু ওর বাড়িতে আমি অনেক সুন্দরী মেয়ের ছবি দেখেছি।

সুতরাং একসঙ্গে বেড়াতে বেরলেও অসীমের কাছ থেকে আমরা নিজেদের ছবি কখনও পাই। কখনও খুব কাকুতিমিনতি করলে অসীম ব্যাজার মুখে বলে, ঠিক আছে, সবাই একসঙ্গে দাঁড়াও দেখা যাক কী করা যায়।

ছবি তোলার ব্যাপারে অসীম খুব পরিশ্রমী। পছন্দমতন বিষয়বস্তু পেলে সে জল-কাদা, ঝোঁপ ঝাড় পেরিয়েও চলে যায়। তার এই অধ্যবসায় দেখে আমাদের যাত্রার বিরতি দিতেই হয়। মাঝেমাঝে।

জুলাই মাসের ১১ তারিখ থেকে টানা ছ’দিন আমাদের এই ভ্রমণ। শুধু পাহাড় আর পাহাড়, একসঙ্গে এত পাহাড়ের অভ্যন্তরে এতদিন ধরে ঘোরাফেরা করিনি আগে। সব পাহাড়ের বর্ণনা দেওয়ার কোনও অর্থ হয় না। এর মধ্যে অনেক হ্রদ, অনেক উদ্যান, অনেক গিরিনদীর মধ্যে দুটি জায়গার কথা না বললেই নয়। যদিও লেক লুইসের অভিজ্ঞতাও অবিস্মরণীয়, ব্যানফ, জ্যাসপারের মতন বিখ্যাত স্থানগুলিও বাদ দিতে হচ্ছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য দুটি জায়গার মধ্যে একটি হিমবাহ, অন্যটি উষ্ণ জলের প্রস্রবণ। প্রকৃতির কী বিচিত্র লীলা, এক জায়গায় অনাদিকাল থেকে সঞ্চিত তুষার আর অদূরেই মাটি খুঁড়ে টগবগ করে উঠছে গরম জল।

যেখানেই পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ, সেখনেই ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি। এ তো আর বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ নয় যে যার ইচ্ছে সেই এসে নেমে পড়ছে! এখানে উষ্ণ জলের ধারাকে এক জায়গায় সুইমিং পুলের মতন বেঁধে রাখা হয়েছে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলে তোয়ালে আর পোশাক বদলাবার ব্যবস্থা সব নিখুঁত। দুটি সুইমিং পুলের মধ্যে একটি বেশি গরম, অন্যটি ততটা নয়, যার যেটি পছন্দ। কিংবা ইচ্ছে করলে একবার এখানে, আর একবার ওখানেও নামা যায়।

আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল বলে, আমরা সবাই সুইমিং স্যুট সঙ্গে করে এনেছি। নারী-পুরুষের সহান এদেশে বেশ চালু। কেন জানি না, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাই বেশি মনে হয়। মেয়েদের পোশাকের কত রকম বাহার। কিংবা সঠিক বলতে গেলে, পোশাক না থাকার কত রকম বাহার। একেবারে নিরাবরণ কেউ নয়, তবে অনেকেরই পোশাক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুইমিং স্যুটের ক্ষুদ্র সংস্করণের নাম বারমুডা, আর তার থেকেও ছোট হলে? সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায়, আমার গলার টাই দিয়ে তিনটি মেয়ের জাঙ্গিয়া হয়ে যায়।

একবার টিকিট কেটে ঢুকলে যার যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারে। আরামদায়ক গরম জল আর চতুর্দিকে স্বল্পবসনা সুন্দরীরা। অর্থাৎ সিনেমার মতন বেদিং বিউটির ছড়াছড়ি, এই অবস্থায় উঠে যেতে কার ইচ্ছে করে! কিন্তু আমাদের তো অনেক দূরে যেতে হবে! কে কাকে তাড়া দেবে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, প্রত্যেকেই বলছি, এবার ওঠা উচিত, তবু ওঠার নাম নেই। মাঝেমাঝে সৌমিত্র চলে যাচ্ছে গভীর জলে, কখনও হারিয়ে যাচ্ছে অসীম।

শেষ পর্যন্ত উঠতেই হল খিদের তাড়নায়। এর পর আবার অসীমের রেস্তোরাঁ খোঁজার পালা। হঠাৎ এক জায়গায় নির্দেশ চোখে পড়ল যে মাইলখানেক দূরে গেলেই এই উষ্ণ প্রস্রবণের উৎসটা দেখা যাবে। স্বাতী সেটা দেখতে যাবেই। অন্যরাও রাজি। একমাত্র আমিই অপারগ। সেই সময় আমার হাঁটুতে খুব ব্যথা, পাহাড়ি রাস্তায় দু’মাইল আসা-যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু স্বার্থপরের মতন আমি তো আর অন্যদের নিষেধ করতে পারি না! তাই ঠিক হল, আমি রাস্তার ধারে বসে থেকে অপেক্ষা করব, ওরা ঘুরে আসবে। কান্তি হোর অবশ্য বলল, সে থেকে গিয়ে আমাকে সঙ্গ দিতে পারে, যদি আমার কোনও অসুবিধে হয়! আমি তাকে ধমক দিয়ে বললুম, আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে অসুবিধে হবে? তুমিও ঘুরে এসো।

আমি বসলাম একটা উঁচু পাথরে, অন্য পাঁচজন হাঁটতে-হাঁটতে মিলিয়ে গেল ঢালু রাস্তায়। এবার আমার প্রতীক্ষা, ওরা কতক্ষণে ফিরবে। এইরকম সময়ে প্রতি মিনিটকেই অনেক গুণ বেশি লম্বা মনে হয়, যেন অনন্তকাল কেটে যাচ্ছে। চতুর্দিকে পাহাড় ও জঙ্গল, আকাশ একবারে মেঘমুক্ত নীল, ঝকঝক করছে রোদ, আর কোনও জনমনুষ্যের সাড়াশব্দ নেই, ঝিমঝিম করছে স্তব্ধতা, তার মধ্যে আমি বসে আছি একা। কান্তিকে বলেছিলাম, আমি বাচ্চাছেলে নই, কিন্তু একসময় একটা পরিত্যক্ত শিশুর মতনই আমার বুক অভিমানে ভরে গেল, যেন আমাকে ইচ্ছে করে পথে ফেলে রেখে চলে গেছে আমার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীসাথীরা! এর পর কি আমি কেঁদে ফেলব নাকি?

কতক্ষণ পর কে জানে, সেই ঢেউখেলানো রাস্তায় প্রথম দেখতে পেলাম একজন স্প্যানিশ সাহেবকে, অর্থাৎ আমাদের কান্তি হোর। উৎসস্থলটি নাকি খুবই রমণীয়, আসতে ইচ্ছে করছিল না, কান্তিই সবাইকে তাড়া দিয়ে এনেছে।

যতই সৌন্দর্য উপভোগ করা যাক, এখন সকলেরই খিদেয় পেট জ্বলছে। আজ আর অসীমকে বেশি সুযোগ দেওয়া যায় না, কাছাকাছি প্রথম রেস্তেরাঁতেই ঢুকে পড়া গেল। অসীমেরও তেমন আপত্তি নেই। বেশিক্ষণ স্নান করলে বেশি খিদে লাগে। মূল খাবার আসার আগেই বুভুক্ষুর মতন আমরা টেবিলের ওপর রাখা পাঁউরুটি আর মাখনই খেতে শুরু করলাম। শুধু কান্তিরই খিদেবোধ কম। এরই মধ্যে উঠে গিয়ে সে কাউন্টার থেকে কিনে আনল ছ’খানা রঙিন ছবির পোস্ট কার্ড। অন্যদের বলল, যার যেখানে মন চায়, চিঠি লেখো। আমি পোস্ট করে দেব।

চিঠি লেখা এখন তো প্রায় উঠেই গেছে। একমাত্র অর্ধশতাব্দীরও বেশি প্রবাসী কান্তি এখনও চিঠি লেখার অভ্যেস ধরে রেখেছে। পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্ত থেকে মাঝেমাঝেই তার মুক্তোর মতন হস্তাক্ষরে বাংলা চিঠি আসে। এই যাত্রাতেও সে কয়েকবার আমাদের দিয়ে চিঠি লিখিয়েছে।

আথাবাস্কা গ্লেসিয়ার বিশ্ববিখ্যাত। গোটা উত্তর আমেরিকার মধ্যে এই গ্লেসিয়ার দেখতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আসে। অনেকে বলে, এই হিমবাহের ওপর দাঁড়ালে ঠিক যেন চাঁদের বুকে হাঁটার অভিজ্ঞতা হয়।

ভূগোল বইতেই হিমবাহের কথা পড়েছি। তা যে কখনও দেখব, আর সত্যি সত্যি সেখানে দাঁড়াবার অভিজ্ঞতা হবে, তা কি কখনও কল্পনাতেও ভেবেছি? অবশ্য সেখানে পদার্পণ করাও কম বিপজ্জনক নয়। মৃত্যুভয় আছে। গুপ্ত ক্রিভাস বা তুষারফাঁদ আছে। হুট করে সেখানে হাঁটতে গেলে অতলে তলিয়ে যেতে হয়, বেশ কয়েকজন এভাবে মারাও গেছে।

কত কোটি বছর আগে এই হিমবাহ শুরু হয়েছে, তা কেউ জানে না। একটু-একটু করে নীচে নামছে, প্রতিদিন কয়েক সেন্টিমিটার করে নামে, বছরে দু-তিন মিটার। এখানেও ব্যবসাসায়ীরা বেশ কিছু অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের অবতরণের ব্যবস্থা করেছে। মূল রাস্তা থেকে একটা বাসে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হিমবাহের অনেকটা কাছে। তারপর খাড়া নামতে হয়, তার জন্য আছে অন্য গাড়ি। সে এক অত্যাশ্চর্য স্নো কোচ, তার এক-একটি চাকা একজন মানুষের সমান। সারা পৃথিবীতেই এরকম গাড়ি কয়েকটি মাত্র আছে।

আমার বন্ধুরা আমার প্রতি সদিচ্ছাবশতই উপদেশ দিল, সুনীল, তুমি যেও না, এক জায়গায় বসে থাকো, গাড়িটাই বিপজ্জনক, তা ছাড়া নীচে নামলে টালমাটাল পায়ে হাঁটতে হবে, আছাড় খেয়ে পড়লে তোমার হাঁটুতে চোট লাগবে। অসীম আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, নেমো না। রবীন বলল, না নামাই উচিত হবে। সৌমিত্র বলল, কেন শুধু শুধু রিস্ক নেবে! স্বাতীর দু’চোখে উদ্বেগ, একমাত্র কান্তি নীরব।

আমি হেসে বললাম, তোমরা ভেবেছ কী? বাচ্চা ছেলের মতন আমাকে বারবার রাস্তার ধারে বসিয়ে রাখবে? আমি এবার যাবই, যা হয় হোক!

সেই অতিকায় চাকাওয়ালা কোচে তো চাপা হল। একেবারে খাড়া পাহাড়ের ধার দিয়ে নামতে হবে অনেকটা নীচে। সেদিকে তাকালে অতি বড় সাহসীরও একবার বুক কাঁপবে। কোচটা চালাচ্ছে একটি লাল চুলের যুবতী। একজন গাঁট্টাগোট্টা জোয়ানের হাতে এই গাড়ির স্টিয়ারিং থাকলেই যেন ঠিক মানাত। কিন্তু আজকাল তো মেয়েরা সব পারে।

গাড়িটা সবে মাত্র নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে, তখন সেই যুবতীটি বলে উঠল, তোমরা কিছু মনে কোরো না। এই গাড়িটা অন্যদিন আমার এক সহকর্মী চালায়, কিন্তু আজ সে

অনুপস্থিত, তাই আমি, মানে… এ গাড়ি চালাবার কোনও অভিজ্ঞতা আমার নেই, আজই প্রথম! অনেকেই শিউরে উঠল। বলে কী মেয়েটা, এমন সাংঘাতিক পথে সে এই পেল্লায় গাড়িটা

চালাচ্ছে, অভিজ্ঞতা নেই….। পরমুহূর্তেই কয়েকজন হেসে উঠল। বোঝাই যাচ্ছে, এটা মিছে কথা। এতগুলি মানুষের প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে, ব্যবসায়ী কোম্পানিটি কি একটি অনভিজ্ঞ মেয়েকে সেই গাড়ি চালাবার ভার দিতে পারে? এ দেশে ওসব হয় না। ওটা মেয়েটির রসিকতা। এরা যখন-তখন এরকম রসিকতা করে। সে বেশ মসৃণভাবে, অতি ধীর গতিতে গাড়িটি নীচে নামিয়ে আনল।

ছয় স্কোয়ার কিলোমিটার প্রশস্ত এই হিমবাহে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে না, তারও নির্দেশ আছে। এর রূপ ধপধপে শুভ্র নয়, মানুষের জুতোর দাগে চতুর্দিকে কালো গর্ত হয়ে আছে। ছবিতে দেখা চাঁদের পৃষ্ঠদেশেরই মতন।

বন্ধুরা ছাড়াও আশেপাশে আরও অনেকে, তবু হঠাৎ খুব একা মনে হয়। নিজেকে বলতে ইচ্ছে হয়, কী রে সুনীল, পৃথিবীর অন্য পিঠে একটা হিমবাহের ওপর! এ কি স্বপ্ন না সত্যি না মায়া না যাবজ্জীবনের পুণ্যফল!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত