এত দেশ ঘুরছি, কিন্তু আফ্রিকায় আর যাওয়া হচ্ছে না কিছুতেই।
আমি কোনও-একটা দেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলে নিজের উদ্যোগে কিংবা জমানো পয়সায় পাশের দু-একটা দেশ দেখে আসি। যেমন চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে গিয়েছিলাম টার্কিতে।
কিন্তু আফ্রিকার কোনও দেশ থেকে কেউ নেমন্তন্ন করে না। ভারত সরকারও আফ্রিকার কোনও দেশে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল পাঠায় না। কেন পাঠায় না কে জানে। অন্তত আমি সেরকম খবর কখনও শুনিনি।
সুতরাং গোটা আফ্রিকা মহাদেশটাই আমার অ-দেখা থেকে যাচ্ছিল। আর সেজন্য একটা অস্বস্তি জমছিল মনের মধ্যে। নিজে পুরো টিকিট কেটে অত দূর দেশে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই। ওসব দেশে হোটেলের খরচও খুব বেশি। খুব বড়-বড় দু-চারটি হোটেল আছে, আর সবই খুব সস্তার, মাঝারি ধরনের হোটেল নেই। খুব সস্তার হোটেল নিরাপদ নয় বলে শুনেছি। টাকা পয়সা তো বটেই, জামা-কাপড়, এমনকি জুতো পর্যন্ত চুরি হয়ে যায়।
হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে একটা সুযোগ এসে গেল।
বম্বে এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গেল তন্ময় দত্তের সঙ্গে। তন্ময় আমার কৃত্তিবাসের গোড়ার দিকের সময়কার বন্ধু। তখন সে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে। যেমন দুর্দান্ত ছাত্র, তেমনই ভালো কবিতা লেখে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার সখ্য বেশি ছিল। ওদের দুজনকে সবসময় একসঙ্গে দেখা যেত, কবি হিসেবেও শক্তি-তন্ময় নাম দুটি একত্রে উচ্চারিত হত।
তারপর কোনও এক কারণে, তন্ময় কবিতা লেখা একেবারে ছেড়ে দেয়। শোনা বায়, তার কবিতার বইয়ের একটি সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেই অভিমানেই তন্ময় বিদায় নেয় কতাির জগৎ থেকে। এই কারণটা সত্যি কি না জানি না। পরবর্তীকালে তন্ময় নিজেও তা অস্বীকার করেছে, যদিও অকস্মাৎ কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেওয়ার কারণ সে জানায়নি। অনেক বছর বাদে, সে ‘তরুণ দত্ত’ ছদ্মনামে ‘দেশ’ পত্রিকায় অনেকগুলি ধারালো, বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ লিখেছিল।
তন্ময়ের কোনও কবিতার বই আর বেরোয়নি। হারিয়ে গেছে সেইসব কবিতা। একেবারে হারায়নি। ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রুফ আমি নিজেই দেখতাম বলে অন্যদের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তন্ময়ের একটা কবিতার নাম ‘শিল্পী’, তার কয়েক লাইন :
কাঁধেতে ফুলের ছাতা, শিল্পী চলে একা একা পথ দিয়ে
মুখ হয়তো দেখা যাবে অবিমৃষ্যকারী ভবিষ্যতে,
ততদিনে মুখ না; আপাতত ফুলের ছাতাই
শিল্পীর অদ্ভুত মুণ্ড…
রমণী লোভায়ও যদি, কৃশ লোভ শিল্প গড়ে গেলে
চরিতার্থ হয় কিছু? নাকি নিম্নে বীজের ভাণ্ডার
প্রকৃতি যা দিয়ে দেহে পাঠিয়েছে সংসারে, দুয়ারে
যাবে না অক্ষয় রাখা?…
কবিতার জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে তন্ময় আবার কলেজীয় পড়াশোনায় মন দেয়, দুর্দান্ত রেজাল্ট করে। তন্ময়ের ছোট্টোখাট্টো চেহারা, কিন্তু সে একটার পর একটা বিশাল চাকরি ধরে আর ছাড়ে। হঠাৎ হঠাৎ এখানে-সেখানে দেখা হয়, তখনই শুনি ও পুরোনো চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরি ধরেছে, কখনও দুর্গাপুরে, কখনও কোরিয়ায়, কখনও হয়তো পুনেয় কিংবা সিঙ্গাপুরে।
বোম্বেতে দেখা হওয়ার পর তন্ময় বলল, ও এখন চাকরি করছে আফ্রিকার কেনিয়ায়।
শুনেই আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে জিগ্যেস করলাম, তোমার ওখানে যদি যাই, আমাকে থাকার জায়গা দেবে?
তন্ময় একগাল হেসে বলল, আমাকে দিয়েছে একখানা আস্ত বাড়ি। তাতে পাঁচখানা বেডরুম। অত ঘর নিয়ে আমি কী করব? তাই বেশ কয়েকটা ঘরের দরজাই খোলা হয় না। তুমি এসে থাকো না, যতদিন খুশি। আমার বাবুর্চি রান্না করে দেয়, খাওয়া-দাওয়ারও অসুবিধে নেই। আমার কোম্পানির গাড়ি দিনে দেব, ইচ্ছেমতন ঘুরে বেড়াবে।
কোন সহজ উপায়ে যাওয়া যায়, তা-ও বাতলে দিল তন্ময়।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট আছে কেনিয়ার নাইরোবি শহরে। ভাড়া বেশি নয়। কেনিয়া যাওয়ার জন্য ভারতীয়দের ভিসা লাগে না। সুতরাং যে-কোনওদিন যাওয়া যেতে পারে।
তন্মর ওর ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লেখা কার্ড দিনে বলল, চলে এসো, শিগগিরি চলে এসো। আমি একা একা থাকি…
সুযোগ যখন আসে, তখন যেন পরপর লাইন দিনে আসে।
কলকাতায় ফিরেই কয়েকদিন বাদে খবর পেলাম, অমল লাহিড়িও এখন থাকে ওই নাইরোবি শহরেই। অমল ও তার স্ত্রী মঞ্জু আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ঠ, দুজনেই বহু আড্ডার সঙ্গী। অমল নিজে লেখে না বটে, কিন্তু এককালে কমলকুমার মজুমদারের চ্যালা ছিল।
অর্থাৎ দুখানা থাকার জায়গা।
তারপর আরও একটা সুযোগ।
ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ। সরকারি দলকে সবসময় এয়ার ইন্ডিয়াতেই যেতে হয়। এই যাত্রায় ফেরার পথে আমার রুটটা কিছু বেঁকিয়ে নাইরোবিতে নেমে পড়তে পারি। তাহলে আমার আর প্লেন ভাড়াও লাগবে না। চমৎকার। এবার তাহলে আফ্রিকাতে যাচ্ছিই।
ফ্রাঙ্কফুর্ট ঘুরে চলে এলাম লন্ডন। যথারীতি ভাস্কর দত্তের বাড়িতে উঠেছি। এখান থেকেই নাইরোবির ফ্লাইট ধরতে হবে। সব ঠিকঠাক। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত!
পরদিন সকালবেলা খবর কাগজ পড়তে-পড়তে দেখি, সেইদিন থেকেই কেনিয়ায় ভারতীয়দেরও ভিসা নিয়ে ঢুকতে হবে, নইলে যাওয়া যাবে না।
ভিসা আনতে হয় দেশ থেকে। আমি আনিনি। সে-প্রশ্নও ছিল না। এককালে জার্মান কিংবা ইংল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা এইসব দেশে ভারতীয়দের ভিসা লাগত না। আমি বিনা ভিসাতেই কয়েকটি দেশে গেছি, এয়ারপোর্টে গিয়ে চাইলেই ভিসা দিয়ে দিত। ক্রমে ক্রমে সব দেশই ভারতীয়দের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করছে।
পরশুদিন আমার যাওয়ার টিকিট কনফার্মড। এর মধ্যে ভিসা পাওয়ার কোনও উপায় নেই। প্লেনের তারিখ বদলালে পরবর্তী সিট কতদিনে পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। সুতরাং যাত্রা বাতিল করতে হবে। খবর দিতে হবে তন্ময় আর অমলকে।
চা খাওয়া শেষ করে ভাস্কর বলল, চল তো একবার কেনিয়ার হাইকমিশন অফিসটা দেখে আসি।
ভাস্করের গাড়িতে অনেক ঠিকানা খুঁজে সেখানে পৌঁছে একেবারে চক্ষুস্থির। সামনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য।
হঠাৎ এই ঘোষণায় অনেক লোকই বিপদে পড়েছে। অনেক সাহেবটাহেবকেও ব্যাবসার কারণে কেনিয়ায় যেতে হয়। সকলেরই যাওয়া আটকে গেছে।
লোকমুখে শোনা গেল, সাত দিনের আগে ভিসা পাওয়ার কোনও আশা নেই।
আমি ভাস্করকে বললাম, চল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আমি সাত দিন লন্ডনে বসে থাকতে পারব না। তারপর প্লেনের টিকিট।
ভাস্কর সহজে নিরাশ হয় না। সে অদম্য আশাবাদী। বলল, আগে তো একটা ভিসা ফর্ম জোগাড় করা যাক, তারপর প্লেনের টিকিটের খোঁজ নেওয়া যাবে।
অনিচ্ছা সত্বেও লাইনে দাঁড়ালাম।
একটি কোকিল রঙের ছিপছিপে তরুণী বসে আছে কাউন্টারে। নাম লিখে-লিখে ফর্ম বিলি করছে। যথাসময়ে আমি তার সামনে পৌঁছে নামটি বলতেই সে থমকে গিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
তারপর বলল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রাইটার?
আমি, যাকে বলে, স্তম্ভিত! নাম শুনে চিনতে পেরেছে? আমার খ্যাতি আফ্রিকাতেও পৌঁছে গেছে? অসম্ভব! নিশ্চয়ই একটা কিছু গোলমাল হচ্ছে!
এবার মেয়েটি বাংলায় এবং বাঙাল ভাষায় বলল, আমি আপনার অনেক লেখা পড়ছি! আপনি ভিতরে আসেন। ভিতরে আসেন।
মেয়েটি বাংলাদেশি। অনেক দূতাবাসেই এরকম বাইরের ছেলেমেয়ে চাকরি করে।
বাংলাদেশের একটি মেয়ে আমার নাম জানতেই পারে। কিন্তু আমার লেখা যে আফ্রিকার পাঠিকাদের কাছে পৌঁছয়নি, সেটাই স্বাভাবিক। তবু চমক লেগেছিল বেশ।
সেই মেয়েটি দু-ঘণ্টার মধ্যে আমার ভিসার ব্যবস্থা করে দিল।
নাইরোবিতে পৌঁছে আমি ভাগাভাগি করে কখনও তন্ময়ের কাছে, কখনও অমল মঞ্জুরও বাড়িতে থেকেছি। অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই ভ্রমণকাহিনি অনেক লম্বা করে লেখা যায়। কিন্তু আমার তো লেখার কথা কবি সম্মেলনের বিবরণ।
কোনও কবি সম্মেলনে তো এখানে আসিনি। এসব জায়গায় কোনও কবি সম্মেলন হয় কি না, তা-ও জানি না।
আমার কেনিয়ায় আসার মূল উদ্দেশ্য মাসাইমারা নামে বিশ্ববিখ্যাত জঙ্গল একবার নিজের চোখে দেখা। গাড়িতে অনেক দূরের পথ, নাইরোবি থেকে ছোট প্লেনে যাওয়া যায়। আমার ইচ্ছে ছিল, তন্ময় কিংবা অমলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তন্ময়ের ছুটি নেওয়ার উপায় নেই, অফিসে খুব কাজ। তা ছাড়া তন্ময়ের বোধহয় বেড়াবার খুব শখও নেই, অফিস থেকে ফিরে হুইস্কির গেলাস হাতে নিয়ে বহুক্ষণ ধরে গান শোনে।
অমল নাইরোবির মধ্যে এবং আশেপাশে আমাকে নিয়ে অনেক ঘুরেছে। আফ্রিকা সম্পর্কে অমলের চেয়েও মঞ্জুর জ্ঞান বেশি। নাইরোবি ছেড়ে দু-তিন দিনের জন্য বাইরে যাওয়া অমলের পক্ষে সম্ভব নয়। একটা কাগজ-কারখানার পুরো দায়িত্ব ওর ওপর। ওদের একটি ছেলে আছে, বেশ ছোট তখন, মঞ্জুকে তার দেখাশোনা করতে হয়।
সুতরাং মাসাইমারা জঙ্গল কিলিমাঞ্জারো পাহাড়, এসব আমি একাই ঘুরতে গিয়েছিলাম। সে-অভিজ্ঞতার কথাও এখানে লিখছি না।
কেনিয়ায় লোকে সিংহ দেখতে যায়। আমি যে কত সিংহ দেখেছি, তার ঠিক নেই। কোথাও সিংহ দেখেছি, মাত্র কুড়ি-পঁচিশ গজ দূরত্বে! নাইরোবি শহরটি উঁচু তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ওখানে বলে, মানুষরা থাকে খাঁচার মধ্যে, আর জন্তু-জানোয়াররা বাইরে।
একবার দুটো সিংহ এসে এয়ারপোর্টের মধ্যে ঢুকে বসে ছিল। তিন দিন সব বিমান চলাচল বন্ধ!
আমি সিংহ দেখেছি প্রথম দিনই। একটা সিংহী একটা হরিণকে তাড়া করে ধরল। মেরে তার পেটের মাংস খেতে লাগল। হরিণটা তখনও ডাকছে…এসব সাজানো ব্যাপার নয় কিন্তু। আফ্রিকায় কিছু সাজানোর দরকার হয় না, রাস্তায় জেব্রা ঘুরে বেড়ায় গাধার পালের মতন। গাড়ি চলতে-চলতে একজায়গায় থেমে যায়, জিরাফের দল রাস্তা পার হচ্ছে। ভারতীয় হাতির চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ের মতন হাতি, আসল চিতা বাঘ, জল থেকে উঠে আসা জলহস্তী, এর আর শেষ নেই।
একদিন গিয়েছিলাম এখানকার টেমপল বারে। হুইস্কির সঙ্গে চাঁট হিসেবে দিয়েছিল জেব্রা আর ওয়াইলড বিস্টের মাংস ভাজা। এই ওয়াইলড বিস্ট সম্পর্কে লিখতে গেলেও কয়েকপাতা হয়ে যাবে। কিন্তু এটা তো ভ্রমণকাহিনি লেখার জায়গা নয়।
হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত একটা কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত হয়েছিলাম ঠিকই।
বিদেশে গেলে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয় না। যদি দৈবাৎ সেখানে কোনও বাঙালি অফিসার থাকে, তাহলে অন্য কথা। বাঙালি কেউ না থাকলে পাত্তাই দেয় না। আমরা নামেই ভারতীয়, কিন্তু বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা পরিচয় এখনও প্রকট। আসল আত্মীয়তা হয় ভাষার মাধ্যমে। অনেক প্রবাসী বাঙালি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে নিযুক্ত। তাঁরা কিন্তু বাংলা ভালো জানেন না, কোনওক্রমে বাংলায় কথা বলতে পারলেও অক্ষরজ্ঞান নেই। বাংলা পড়েন না বলেই আমাকে সেই ধরনের বাঙালিরা তেমন একটা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন না।
বরং ওই ভাষার সূত্রেই বাংলাদেশ দূতাবাসের কেউ-না-কেউ আমার খোঁজ করেন, বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে শুটকি কিংবা ইলিশ মাছ খাওয়ান। মনে আছে, যেবার মালয়েশিয়া যাই, কোনও একটা প্রয়োজনে আমাকে ভারতীয় দূতাবাসে যেতে হয়েছিল, সেখানে আমাকে অকারণে বসিয়ে রাখা হয়েছিল দুঘণ্টা, তারপরেও কাজটা হয়নি। অথচ ওখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের যিনি প্রধান, সেই মাহবুব আলম আমার প্রত্যেকদিন খোঁজখবর নিতেন। এই মাহবুব আলম ছিলেন একসময় কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে খুবই বিদগ্ধ ব্যক্তি, শুধু আমার সঙ্গে নয়, কলকাতার বহু লেখক-শিল্পীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
মালয়েশিয়াতে তিনি আমাকে প্রায়ই নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। একদিন সকালবেলা তাঁর ড্রাইভার আমার হোটেলে এসে একটা বড় প্যাকেট উপহার দিল। সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা, এ-দেশে হুইস্কির খুব দাম। নিজের পয়সায় কিনবেন না।
মালয়েশিয়াতে অবশ্য শেষের দিকে হোটেল ছেড়ে উঠেছিলাম মুস্তাফা কামাল ওয়াহিদের বাড়িতে। সে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি, পরে কানাডার নাগরিক। কামাল অবশ্য বাংলাদেশি কিংবা ক্যানেডিয়ান নয়, সে বিশ্বনাগরিক। আমরা জন্মসূত্রে কিংবা অন্য কারণে যে যে-দেশেরই নাগরিক হই না কেন, বিশ্বনাগরিত্বও তো আমাদের জন্মগত অধিকার! সেকথা অনেকেই মনে রাখি না।
কেনিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের এক অফিসার সুলতান আহমেদ কী করে যেন আমার সন্ধান জেনে গেলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন মনোযোগী পাঠক এবং নিজেও কবিতা লেখেন। তাঁর স্ত্রী নাজনিনও খুব রুচিশীল মহিলা। নিজে যেমন রূপসী, তেমনই তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট অন্ত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার সে বাড়িতে আমার আমন্ত্রণ হল, অনেক রাত পর্যন্ত আচ্ছা।
তার ওপরেও সুলতান আহমেদ বলে রাখলেন, ফর্মালি দাওয়াত দিতে হবে কেন, যে-কোনও সন্ধেবেলা আপনি চলে আসবেন।
ওঁর উদ্যোগেই একটা কবি সম্মেলনের ব্যবস্থা হল।
আফ্রিকার যে-কোনও দেশেই বহু উপজাতি, বহু রকমের ভাষা। সোয়াহিলি ভাষার সূত্রে অনেককে জোড়ার চেষ্টা হয়েছিল, তা খুব একটা সফল হয়নি। তবে সোয়াহিলি ভাষাতেও বেশ কিছু সাহিত্য রচিত হয়, শিক্ষিতরা সবাই অবশ্য লেখেন ইংরেজিতে।
আমরা অবশ্য বেন ওকোরির মতন দু-একজন লেখক ছাড়া অন্যান্য আফ্রিকান লেখকদের হিসেব খবর রাখি না। আমেরিকান কালো মানুষদের কবিতা পড়ি, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কবি ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু আফ্রিকান সাহিত্য আমাদের কাছে অজ্ঞাতই বলা যায়। আফ্রিকায় লেখকরাও কি ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে কিছুমাত্র আগ্রহী? নাকি তারাও শুধু তাকিয়ে থাকে ইউরোপ-আমেরিকার দিকে।
কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল সুলতান আহমেদেরই এক সহকর্মীর বাড়িতে, সেটি পরিসরে অনেক বড়, একটা হলঘরও আছে। আমন্ত্রিত কবির সংখ্যা এগারোজন। তন্ময়কেও দলে টানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে কবিতা থেকে দূরে থাকার সঙ্কল্পে অটুট। বাংলাদেশি কবিও আছেন দুজন, বাকিরা স্থানীয়। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ খ্যাতিমান, ইংরেজিতে তিনখানা কাব্যগ্রন্থ আছে।
প্রথমে ঠিক ছিল, সব কবিরাই যে-যার নিজের ভাষাতে পড়বেন। তাতে বাংলা কবিতাই শুধু বোধগম্য হবে, কারণ, শ্রোতারা অধিকাংশই বাঙালি। অন্য যাঁদের কবিতা ইংরেজিতে লেখা, সেগুলি মোটামুটি আমরা বুঝলেও তাঁরা তো আমাদের লেখা কিছুই বুঝবেন না। সুতরাং ঠিক হল, সকলের কবিতারই ইংরেজি ভাষ্য থাকবে, সেই ইংরেজি পাঠ করে শোনাবেন আর-একজন।
সেদিন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল ঝিরঝিরিয়ে। ভালোই জমেছিল কবিতা পাঠের আসর। নাইরোবির আবহাওয়া বেশ সুন্দর, সারা বছরে কখনও তীব্র গ্রীষ্ম নেই, তীব্র শীতও নেই। সেইজন্যই সাহেবদের বেশ পছন্দ ছিল জায়গাটা। বৃষ্টি পড়লে একটা সোয়েটার গায়ে দিতে হয়। আমি সোয়েটার নিয়ে যাইনি। ঠান্ডাটা বেশ উপভোগই করছিলাম।
এই দূতাবাস সম্পর্কে একটা কথা আগে বলিনি।
সুলতান আহমেদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর অন্য সহকর্মীরাও খুব আন্তরিক ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শুনেছিলাম, শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকারী সেনা অফিসাররা অনেকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বাইরের বিভিন্ন দূতাবাসে ছদ্মনামে আশ্রয় নিয়ে আছে। মেজর ডালিমের সেখানে থাকার খুবই সম্ভাবনা। সত্যি না মিথ্যে জানি না, গুজবও হতে পারে। কিন্তু আমি দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মীর আচরণ চোরা নজরে খুঁটিয়ে লক্ষ করতাম। এদের মধ্যে কেউ অন্যতম নৃশংস খুনি? কারুকেই সেরকম মনে হয়নি কি! সেই কবিতা পাঠের আসরে সবাই উপস্থিত, মন দিনে শুনেছেন কবিতা। খুনিরাও হয়তো সাময়িকভাবে কবিতায় বশ হয়।
অনেকদিন আগেকার কথা, সেসব কবির নাম মনে নেই, কবিতাগুলিও সংগ্রহ করে রাখিনি। মনে আছে, আফ্রিকার এক দেশে বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যায় কবিতার মদির আবহাওয়া আর বিভিন্ন কবির আত্মীয়তা এবং একটি চমক।
আমরা আফ্রিকায় কবিতার ধার ধারি না, কিন্তু ওখানকার একজন কবি নিজের কবিতা পাঠ করার পর বললেন, তোমাদের দেশের একজন কবির কবিতা আমার খুব প্রিয়। সেই কবির একটা কবিতা শোনাতে পারি?
সেই প্রবীণ কবিটি ইংরেজিতে পড়লেন, Where the mind is without fear / And the head is upright…
অর্থাৎ ‘চিত্ত যেখা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির…’
আজও আমাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই একমাত্র আন্তর্জাতিক!