আচমকা এক টুকরো

আচমকা এক টুকরো

আচমকা এক টুকরো ১

মিহির বিশ্বাস ও তার স্ত্রী ভারতী, বাবলু সিরাজী ও তার স্ত্রী রুমা আমাকে ট্রেনে তুলে দিল। স্টেশনে পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল, প্রায় শেষ মুহূর্তে ছুটতে ছুটতে এসে উঠে পড়লুম কামরায়। ওই দম্পতির কাছে ভালো করে বিদায় নেওয়া হল না।

শুরু হল আমার স্টকলম থেকে অসলো যাত্রা।

ধুমপায়ীদের জন্য আলাদা ছোট ছোট কিউবিকল থাকে, আমার টিকিট সেইরকম একটি খোপে। আমি ছাড়া আর পাঁচজন যাত্রী ও যাত্রীণী। ট্রেন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকে, কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না। আমি আমার সহযাত্রীদের ভালো করে লক্ষ করলুম। এদের মধ্যে আমিই যে একমাত্র বিদেশি, তা আমার গায়ের রঙেই স্পষ্ট। সুইডিসরা বর্ণ-বিদ্বেষী না মোটেই, বিদেশিদের তারা অপছন্দ করে না। কিন্তু তারা স্বভাব-গম্ভীর, অন্যদের সঙ্গে সহজে কথা বলতে চায় না, বিশেষত দিনের বেলা।

দু-জোড়া নারী পুরুষ ও দুজন আলাদা পুরুষ। আমার বাঁ পাশে যে লোকটি বসে আছে, তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হাতে একগুচ্ছ বই, দেখলেই কেমন যেন অধ্যাপক-অধ্যাপক মনে হয়। তার উলটোদিকে গোলাপি স্কার্ট পরা যে যুবতীটি বসে আছে, তার মুখখানা হাসি মাখানো। এক একজনকে দেখলেই ভালো লাগে, এই মহিলাটি সে রকম। চশমা পরা পুরুষটি এবং এই মহিলা পূর্ব পরিচিত, উঠেই তারা একটা থলি থেকে দুটো আপেল নিয়ে খেতে লাগল, কিন্তু কেন যেন মনে হল এরা স্বামী-স্ত্রী নয়, হয়তো একই কলেজে পড়ায়, কিংবা প্রতিবেশী। আমার এ রকম মনে হওয়ার কোনও যুক্তি নেই, তবে ট্রেনের কামরায় সময় কাটাবার জন্য আমি অচেনা নারী পুরুষদের চরিত্র, জীবিকা ও পাশাপাশি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে কতকগুলো ধারণা তৈরি করে নিই, অনেকসময় তা মেলে, তার চেয়েও বেশিরভাগ সময় আমার ধারণা মেলে না। তবু মনে মনে এই রকম অনুমানের খেলা খেলতে দোষ তো কিছু নেই।

এবারে এই ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা আমার কাছে বিশেষ স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

আমার ডানপাশে যে যুবকটি বসে আছে, তাকে দেখে মনে হয় কোনও কারখানার শ্রমিক, মাথার চুল রুক্ষ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জিনসের ওপর হলুদ গেঞ্জি পরা, ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই সে একটা মোটা চুরুট ধরিয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে রইল বাইরে।

আমি ধাঁধায় পড়লুম আমার সামনের একজোড়া নারী পুরুষকে নিয়ে। এদের পেশা কিংবা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক আন্দাজ করা শক্ত। পুরুষটির মতন এমন রূপবান মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ছ-ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা মনে হয়, নিখুঁত স্বাস্থ্য, মাথার চুল সোনালি, চোখের মণি দুটি নীল। তার খয়েরি পোষাকটিও বেশ মুল্যবান। সুইডিসরা সকলেই প্রায় স্বাস্থ্যবান ও সুন্দর হয়, তবু তাদের মধ্যেও এমন সুন্দর পুরুষ দুর্লভ। এর বয়েস পঁয়তাল্লিশের বেশি হতেই পারে না।

তার পাশের মহিলাটি প্রায় বুড়ি, মুখে ভাঁজ পড়ে গেছে, চোখের নীচে ক্লান্তির ছাপ, কোনও রকম প্রসাধন নেই, নস্যি রঙের চুল, একটা দোমড়ানো মোচড়ানো হলদে গাউন পরা। সে ওই রূপবান পুরুষটির মাসি-পিসি বা বড়জোর বউদি হতে পারে, কিন্তু সে প্রেমিকার ভঙ্গিতে পুরুষটির কাঁধে মাথা হেলিয়ে বসেছে।

ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেক পরেই রূপবান পুরুষটি, ধরা যাক তার নাম ইংগমার, এই সুইডিস নামটি আমাদের কাছে পরিচিত, সে তার ঝোলা থেকে একটি ওয়াইনের বোতল ও কয়েকটি কাগজের গ্লাস বার করল। কর্ক ক্রু দিয়ে ছিপিটি খুলে, গেলাসে ঢালতে-ঢালতে আমার দিকে চেয়ে পরিষ্কার ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, তুমি একটু নেবে কি?

আশ্চর্য, কামরায় অন্য কারুকে জিগ্যেস করল না, শুধু আমাকেই সাধল কেন? আমি বিদেশি বলে? কিংবা আমি তার মুখোমুখি বসে আছি, সেইজন্য চক্ষুলজ্জায়?

আমি বোতলের লেবেলটা দেখে নিয়েছি, ফরাসি বোর্দে ওয়াইন, সাদা রঙের। এই সুরা আমার বিশেষ প্রিয়, কিন্তু ওই লোকটি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করেছে, আমার পক্ষেও ভদ্রতা হবে প্রত্যাখ্যান করা। ওদের দুজনের পক্ষে একটি বোতল এমন কিছু বেশি নয়, তাতে ভাগ বসানো উচিত নয়।

আমি সবিনয়ে বললুম, ধন্যবাদ। আমি খাব না।

সে তবু জিগ্যেস করল, তুমি বুঝি অ্যালকোহল স্পর্শ করো না।

আমি বললুম, অন্য সময়ে পান করি, এখন ইচ্ছে করছে না।

সুইডিসরা কেউ কেউ চমৎকার ইংরিজি বলে, কেউ কেউ কিছুই জানে না প্রায়। ইংগমারের পাশের প্রৌঢ়াটি সুইডিস ভাষায় আমার সম্পর্কে কিছু জিগ্যেস করলেন। ইংগমার আমার কোনও পরিচয় জিগ্যেস না করেই তার সঙ্গিনীকে বলল, এই বিদেশিটি ভারতীয়। ওরা অনেকেই মদ্য বা মাংস খায় না।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ইংগমার বলল, আমি দুবার বোম্বাই শহরে গেছি, জাহাজে। ভারতীয়দের দেখলেই চিনতে পারি। অথবা তুমি কি পাকিস্তানি?

আমি সহাস্যে বললুম, না তুমি ঠিকই ধরেছ, আমি ভারতীয়। তুমি জাহাজে করে বোম্বাই গিয়েছিল, তুমি কি নাবিক?

সে বলল, না। তখন শখ হয়েছিল, সে প্রায় দশ বারো বছর আগের কথা।

প্রঢ়াটি তৃষ্ণার্তের মতন তার গেলাসটি এক চুমুকে শেষ করে আবার সেটি ভরতি করার জন্য বাড়িয়ে দিল। ইংগমার তাকে দ্বিতীয়বার গেলাস দেওয়ার আগে তার ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন দিল একটি।

এই সময় অন্যদিকে তাকাতে হয়। আমি বাঁ-পাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলুম। চশমা পরা লোকটি এবং গোলাপি স্কার্ট পরা সুন্দরী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে চলেছে, কিন্তু একটুও শব্দ হচ্ছে না। ওদের দুজনের হাতের আঙুলগুলো নানা রকম খেলা করছে। বোবারা এ রকম আঙুলের চিহ্ন দিয়ে কথা বলে। এরা দুজনই বোবা? চশমা পরা তরুণটি যদি বোবা হয়, তা হলে তো সে অধ্যাপক হতে পারে না। আর ওই হাস্যমুখী সুন্দরীটি, যাকে দেখলে মনে হয় জীবন সম্পর্কে তার কোনও অভিযোগই নেই, সে কি বাক্যহীনা হতে পারে? সে একবার শব্দ করে হাসল। যার হাসির আওয়াজ এত মিষ্টি, সে কথা বলতে পারে না?

আমার ডানপাশের চুরুট-ফোঁকা যুবকটি বাইরের দিকেই তাকিয়ে আছে, অন্য কারুর সম্পর্কে তাঁর কোনও আগ্রহই নেই।

আমি সিগারেট ধরালুম। ইংগমার আমার প্যাকেটটা চেয়ে নিয়ে দেখল। তারপর বলল, ভারতীয় সিগারেট।

তার সঙ্গিনীটি তাকে কিছু বলল। তখন ইংগমার আমার দিকে তাকিয়ে জানাল যে তার বান্ধবী এই বিদেশি সিগারেট একটু চেখে দেখতে চাইছে, সে কি একটি নিতে পারে?

আমি ধন্য হয়ে বললুম, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমার কাছে আরও অনেক আছে। তোমরা পুরো প্যাকেটটাই নিতে পারো।

ইংগমার জানাল যে সে ধূমপান করে না। সে একটিই সিগারেট নিয়ে তার বান্ধবীকে দিয়ে প্যাকেটটা আমাকে ফেরত দিল।

ইংগমার ধূমপান করে না। অথচ এই কামরায় উঠেছে, শুধু তার বান্ধবীর জন্য। কী না ওই বান্ধবীর ছিরি। এমন রূপবান পুরুষ এদেশে অসংখ্য তরুণী বান্ধবী পেতে পারে। সে ওই বিচ্ছিরি বুড়িটাকে এত আদর যত্ন করছে কেন, বুড়িটার কি অনেক টাকা আছে?

ইংগমার বলল, সে নাবিক নয়। তা হলে তার-জীবিকা কী? চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, সে বেশ সচ্ছল। সিনেমায় নামলে সে অনেক নামকরা নায়কদের ভাত মেরে দিতে পারত। এমন সুপুরুষ হলিউডের নায়কদের মধ্যেও কম আছে।

ওদের ওয়াইনের বোতল এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, আর একটি খোলা হয়েছে। কিন্তু প্রৌঢ়াটি এর মধ্যেই বেশ বেচাল। এক বোতল সাদা ওয়াইনের এমন কিছু নেশা হওয়ার কথা নয় এত তাড়াতাড়ি। নিশ্চয়ই ওই প্রৌঢ়াটি ট্রেনে ওঠার আগে খেয়ে এসেছে অনেকটা। এখন দুপুর তিনটে বাজে, এর মধ্যেই মাতাল।

সুইডেনে মদ খাওয়ার চল বেশি। শুক্রবার-শনিবার সন্ধের পর অনেক রাস্তায় মাতালদের ঢলাঢলি দেখা যায়। স্বভাব-গম্ভীর সুইডিসরা মদ খাওয়ার পর বেশ খোলামেলা হয়ে যায়। অচেনা লোকের গলা জড়িয়ে ধরে কথা বলে, স্টকহলমের রাস্তায় এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কিন্তু দিনের বেলায় এই কাণ্ড?

বোধহয় যাত্রাপথে নিয়ম নাস্তি।

চশমা পরা লোকটি ও গোলাপি স্কার্ট পরা তরুণী অনবরত হাত নেড়ে চলেছে, মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। এমন নিঃশব্দ আচ্ছা আমি আগে কখনও দেখিনি। তারা আমাদের সম্পর্কেই আলোচনা করছে কি না, তা বোঝবার উপায় নেই। তরুণীটি শুধু হেসে উঠছে এক একবার।

ইংগমারের প্রৌঢ়া বান্ধবীটি হঠাৎ আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে জোরেজোরে কী যেন বলল। বেশ রাগ রাগ ভাব। কী ব্যাপার, এ কি বিদেশিদের পছন্দ করে না? আমার সিগারেটটা ভালো লাগেনি? পুরোটাই তা শেষ করল, এখন আমাকে ধমকাচ্ছে। ইংগমার আমাকে বলল, আমার বান্ধবী বলছে, তুমি ওকে সিগারেট দিয়েছ। তুমি আমাদের ওয়াইন একটু খাবে না কেন?

ওদের দ্বিতীয় বোতলটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শুধু এক ঢোঁক ওয়াইন খেয়ে আমার কী হবে? অমি বিনীতভাবে বললাম, না, থাক।

প্রৌঢ়াটি আমার প্রত্যাখ্যান বুঝতে পেরে খুঁসে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে আমার কাছে এসে গেলাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, খা খা।

এদেশে কেউ এঁটোকাটা মানে না। সুরা ও নারীর ওষ্ঠ কখনও এঁটো হয় না। অপরের গেলাসে চুমুক দিতে আমি অন্য সময়ে আপত্তি করি না। কিন্তু এই মাতাল মহিলাটির ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা, এর আগে দু-একবার থুতু ফেলেছে মাটিতে। সব মিলিয়ে একটা নোংরা নোংরা ভাব, আমার ঘেন্না করল। আমি বললুম, প্লিজ প্লিজ আমি খাব না।

আমাকে জোর করে খাওয়াবার জন্যে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার গায়ে। তার পাতলা পোষাকের আড়ালে বিশাল দুটি স্তন বেশ শিথিল, আমার মনে হল দুটো নরম বালিশ কেউ চেপে ধরেছে আমার গায়ে। আমি মুখ সরিয়ে নিলেও খানিকটা ওয়াইন ছলকে পড়ল আমার গায়ে। খুবই বিরক্তি বোধ হলেও তা প্রকাশ করার নিয়ম নেই এদেশে, আমি রুমাল দিয়ে গা মুছতে লাগলুম।

ইংগমার টেনে সরিয়ে নিল তার বান্ধবীকে, তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। ফিসফিস করে বলতে লাগল কত কী প্রেমের কথা।

একটু পরেই সেই প্রৌঢ়া বমি করে ভাসিয়ে দিল ইংগমারের পোষাক।

ইংগমার একটুও রাগ করল না, সে পেপার ন্যাপকিন দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল নিজেকে। কামরায় কেউ একটা কথা বলল না। ইউরোপীয়দের এই এক চমৎকার স্বভাব, অন্যের ব্যাপারে কিছুতেই নাক গলায় না, অকারণে কোনও মন্তব্যও করে না। সুইডিসরা আরও বেশি নিস্পৃহ ধরনের।

বমি করার পরেও প্রৌঢ়াটি হাত বাড়িয়ে বোতলটি নিয়ে বাকি ওয়াইনটুকু শেষ করতে যাচ্ছিল, ইংগমার জোর করে সেটি কেড়ে নিল। রমণীটি শুরু করে দিল চিৎকার।

তখুনি ট্রেন এসে থামল একটা স্টেশনে। ইংগমাররা সেখানে নামছে। তার বান্ধবী কিছুতেই নামতে চায় না। সে সমানে হাত-পা ছুড়ছে ও ওয়াইন চাইছে। ইংগমার এবার সাহায্য চাইল আমার ডান পাশের চুরুট-ফোঁকা ছোঁকরাটির। সে উঠে প্রৌঢ়াটির দু-হাত চেপে ধরল। দুজনে মিলে প্রায় চ্যাংদোলা করে মাতালিনীকে নামিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মে।

নীরব বাক্যালাপকারী দুই নারী-পুরুষও নেমে গেল এই স্টেশনে। আমাদের সঙ্গে তারা কোনও কথা বলেনি। কিন্তু যাওয়ার সময় তারা ছুঁড়ে দিয়ে গেল খানিকটা হাসি।

আবার ট্রেন চলার পর আমার একমাত্র সহযাত্রীটি এতক্ষণ বাদে মুখ খুলল। নম্রভাবে জিগ্যেস করল, তুমি ভারতের কোন শহরে থাকো?

আমি কলকাতার নাম বলতেই সে জানালো যে সে কলকাতায় তিনবার গেছে বিশেষ গবেষণার কাজে। সে একটু একটু বাংলাও জানে। মাছের বংশ বিবর্তন নিয়ে তার গবেষণা। সে সুন্দরবন অঞ্চলে কয়েকটা মাছের ভেড়িতেও কাজ করেছে।

হা কপাল, আমি যাকে শ্রমিক ভাবছিলুম, সে একজন উচ্চাঙ্গের গবেষক।

এই কলকাতা-ফেরত যুবকটির সঙ্গে আগে পরিচয় হলে আমি অনেক গল্প করতে পারতুম।

আমি তাকে জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, ওই যে ওই পাশের দুজন এতক্ষণ হাত নেড়ে আঙুলের ভাষায় কথা বলছিল, ওরা কি ইয়ে…. মানে… বোবা?

ছেলেটি বলল, না, না। ওরা তো প্ল্যাটফর্মে নেমেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে লাগল। ওই চশমা পরা পুরুষটি একজন সেলসম্যান। সে আমাকে এখানকার একটা হাসপাতালের কথা জিগ্যেস করল।

তা হলে ওরা এখানে শুধু হাত নেড়ে কথা বলছিল কেন?

বোবা না হলেও আজকাল অনেকে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শিখে নেয়। তাতে সুবিধে কত বলো। ট্রেনের কামরায় সবাই মিলে কথা বললে গোলমাল হয়, ওদের কথা বলার কোনও শব্দ নেই। ওরা অনেক গোপন কথা আলোচনা করতে পারে। আমিও ওই ল্যাঙ্গোয়েজ একটু একটু জানি। ওদের কথা কিছু কিছু বুঝতে পারছিলুম। ওরা তোমাকে নিয়েও আলোচনা করছিল।

তাই নাকি, কী বলছিল?

তোমার গায়ে যখন বয়স্কা মহিলাটি ওয়াইন ঢেলে দিল, তখন ওরা বলল ভারতীয়রা খুব ভদ্র হয়, তাই কিছু বলল না। ওই বুড়িটার উচিত ছিল ভারতীয়টির কাছে ক্ষমা চাওয়া। ছি ছি, কী লজ্জার কথা।

না, না, তাতে কী হয়েছে। ভদ্রমহিলার বেশি নেশা হয়ে গিয়েছিল।

ওরা মাদাম টুনিলকে চিনতে পারেনি। তুমি তোমার সামনের ব্যক্তিটিকে চিনতে পেরেছিলে? কাগজে ছবি দেখোনি?

আমি তোমাদের দেশে মাত্র কয়েকদিন আগে এসেছি, কারুকেই চিনি না। ওই সুদর্শন পুরুষটি খুব বিখ্যাত ব্যক্তি বুঝি?

মোটামুটি বিখ্যাত। ওর নাম ওলাফ গোল্ডবার্ন। স্টকহলম থিয়েটারে বেশ নাম করা অভিনেতা। দু-একটি ফিল্মেও নেমেছে। আর ওর সঙ্গের মহিলা–

ওই বয়স্কা মহিলা ওর বান্ধবী?

ওই মহিলার নাম মাদাম টুনিল। উনি এককালে আরও বেশি বিখ্যাত ছিলেন। মঞ্চে বহু নাটকের নায়িকা হতেন। সিনেমায় ইচ্ছে করে নামেননি কখনও। গানও গাইতেন চমৎকার। একবার অসুস্থ হয়ে দুবছর আর মঞ্চে নামতে পারেননি। সেই অসুখে গলা নষ্ট হয়ে যায়। তারপর পরপর দুটো নাটক একবার জমেনি, দর্শকরা ওঁকে আর চায় না। এখন স্টেজ থেকে একেবারে বাদ পড়ে গেছেন। কেউ চান্স দেন না। মদ খেয়ে, অত্যাচার করে উনি নিজেকে নষ্ট করে ফেলেছেন, দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। ওর আর কোনও বন্ধু নেই। ওলাফ ওকে এখানে একটা হাসপাতালে ভরতি করে দিতে এনেছে। আমি মাদাম টুনিলের ভক্ত ছিলাম একসময়, খুব বড় অভিনেত্রী ছিলেন, এখন কী অবস্থা হয়েছে! দেখে কষ্ট হচ্ছিল।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম।

আমার একটিমাত্র অনুমান কাছাকাছি গেছে। ওলাফ অর্থাৎ মনে মনে আমি যার নাম দিয়েছিলুম ইংগমার, তাকে দেখে আমার সিনেমার অভিনেতাদের কথা একবার মনে হয়েছিল,

সে সত্যিই একজন অভিনেতা।

ওই আধ-বুড়ি, মাতাল, পাগলাটে স্বভাবের প্রাক্তন অভিনেত্রীকে কত যত্ন করে, কত আদরে সে নিয়ে আসছিল, একবারও রাগ করেনি। কোনও নাম করা সুদর্শন অভিনেতা কি কোনও বাতিল, প্রাক্তন, অসুন্দরী বুড়ির জন্য এতটা করে?

কিংবা এটাও ছিল ওই রূপবান পুরুষটির অভিনয়।

আচমকা এক টুকরো ২

আগে থেকে ভেবেচিন্তে, এক-দেড়মাস আগে ট্রেনের টিকিট কেটে, গন্তব্যে পৌঁছবার আগেই থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করে ভ্রমণে বেরুনো আমার ভাগ্যে বিশেষ ঘটে না। উঠল বাই তো কটক যাই এবং কটক যেতে যেতেও চলে গেলুম কাঠমান্ডু, এরকমও হয়েছে বহুবার। ট্রেনে যেতে যেতে একটা বেশ সুন্দর স্টেশন দেখে পছন্দ হয়ে গেলে সেখানে নেমে পড়তেই বা বাধা কী? সেই রকমভাবেই আমি একবার নেমে পড়েছিলুম ধলভুমগড়ে। তার আগে আমি আমার চেনাশুনো কারওর কাছ থেকে ধলভুমগড়ের নামও শুনিনি। সেই হিসেবে আমার নিজের কাছে অন্তত, ধলভূমগড় জায়গাটি আমারই আবিষ্কার।

আমার মুখে এরকম দু’একটা জায়গার গল্প শুনে দু-একজন প্রশ্ন করেছিল, লোকে তো ট্রেনে চাপে কোনও বিশেষ জায়গায় যাবে বলেই সেখানকার টিকিটি কেটে। তুমি কি অনেক দূরের জায়গার টিকিট কেটে মাঝপথে নেমে পড়ো? এর উত্তর খুব সহজ। টিকিট না কেটেও তো ট্রেনে চাপা যায়! বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ একটা সামাজিক অপরাধ? তা কি আর আমি জানি না! কিন্তু কে বলেছে যে আমি একখানা বিরাট দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সমাজ সেবক? যে-সমাজ লক্ষ-লক্ষ বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি দিতে পারে না, যে-দেশ এখনও লক্ষ-লক্ষ ভূমিহীন কৃষক আর কর্মহীন মজুরকে বছরের অর্ধেক দিন অভুক্ত রাখে, সেখানে বহু লোক তো ট্রেনের ভাড়া ফাঁকি দেবেই। আমার মুখে একটু বেশি বড়-বড় কথা হয়ে গেল? তা, কুঁজোরও তো মাঝে-মাঝে চিত হয়ে শুতে সাধ হয়!

একবার ঠিক ট্রেনে চেপে নয়, গাড়িতে আসতে আসতে একটা বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল!

সেবার আমি ঝিলিমিলি, মুকুটমণিপুর, শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকটা ঘোরাঘুরি করে এসে পৌঁছেছি বাঁকুড়া শহরে। এবার কলকাতায় ফেরার পালা। সন্ধে হয় হয়, বাস ডিপোতে কী কারণে যেন প্রচণ্ড ভিড়, আজ আর ফেরার আশা নেই। বাঁকুড়া শহরে আমার ঠিক রাত্রিবাসের জায়গা নেই, কিন্তু কাছাকাছি বেলেতোড় গ্রামে, শিল্পী যামিনী রায়ের এক নাতির সঙ্গে ক্ষীণ পরিচয়ের সূত্রে থাকার জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কীভাবে বেলেড়ে যাব তাই নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় একটা জিপগাড়ি আমাকে ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে থেমে গেল, আবার ব্যাক করে চলে এল আমার কাছে। পূর্বপরিচিত মুরুব্বি দাদাগোছের একজন মুখ বার করে বলল, কী রে হা করে আকাশের দিকে চেয়ে তারা গুনছিস নাকি?

আমাকে যেমন বিনা দোষে পুলিশে ধরে নিয়ে মেরেছে, একবার আমাকে একজন অন্যলোক ভেবে একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে অপমান করা হয়েছিল, সেই রকমই হঠাৎ হঠাৎ এমন সৌভাগ্যেরও উদয় হয়। আমার সেই দাদাটি তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তির জিপে কলকাতায় ফিরছেন। জিপের আসল মালিকের মতামত না নিয়েই তিনি আমাকে বললেন, উঠে পড়, উঠে পড়! পেছন দিকে সর্বাঙ্গে চাদর মুড়ি দিয়ে একজন লোক বসে ঢুলছিল, আমার স্থান হল তার বিপরীত দিকে। লোকটি একবার আমার দিকে তাকালও না। আমি দুটি ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলুম। কলকাতায় ফেরার জন্য আমার কোনও ভাড়া লাগছে না। ঘণ্টা-পাঁচেকের রাস্তা, মাঝখানে এরা খাবারের জন্য নিশ্চয়ই কোথাও থামবে, তখন আমাকেও খেতে ডাকবে নিশ্চয়ই। সুতরাং আমার সমুখের লোকটির দৃষ্টান্তে অমিও ঘুমিয়ে পড়তে পারি! অন্ধকার রাস্তায় জিপের পিছন দিকে বসলে আর কীই-বা করার থাকতে পারে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ঘুম ভেঙে গেল। জিপটা থেমে আছে একটা ঘুরঘুট্টি জায়গায়। আমার দাদাটি বললেন, এই নেমে আয়, নেমে আয়, গাড়ি ঠেলতে হবে।

তাতে আমার আপত্তি নেই। গাড়ি যারা চাপে, তাদের সকলকেই কোনও না কোনওদিন গাড়ি ঠেলতেই হয়। গাড়ির মালিকরাও বাদ যায় না। এটা হচ্ছে গাড়ির কৌতুক। বেশি কৌতুকপ্রবণ গাড়িগুলো ইচ্ছে করে খুব গণ্ডগোলের জায়গায় খারাপ হয়ে বসে।

বাঁকুড়া থেকে বিষ্ণুপুর আসার পথে খানিকটা ঘন জঙ্গল আছে। সেখানে ডাকাতির বেশ সুখ্যাতি আছে। প্রাইভেট গাড়ি জিপ তো আকছার, এমনকী সেই অকুতোভয় ডাকাতরা যাত্রী ভরতি বাসেও হামলাও করে মাঝেমাঝে। শুনলুম, জিপটা সেই জঙ্গল পেরিয়ে এসেছে। একটু নিরাশই হলুম বলতে গেলে, আমাদের জীবনে রোমাঞ্চের এত অভাব মাঝেমাঝে একটু ডাকাতি ফাঁকাতির অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই তো!

এই জাগয়গাটি নির্জন দুপাশে বড় বড় গাছ রয়েছে, কিন্তু জঙ্গল নয়। অনেক দূরে মিটমিট করছে কোনও গ্রামের আলো।

আসলে জিপটি খারাপ হয়েছে প্রায় আধঘন্টা আগে। জিপের ড্রাইভার এতক্ষণ খোঁচাখুচি করেও ইঞ্জিনটা সচল করতে পারেনি। এখন উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে কোনও লোকালয়ে পৌঁছনো। রাস্তার মাইলপোস্টে কোনও অত্যুৎসাহী বঙ্গ প্রেমিকের দল আলকাতরা লেপে দিয়েছে। আমরা যে ঠিক কোথায় আছি, তা বোঝা যাচ্ছে না। দূরে যে আলোর বিন্দু দেখে গ্রাম মনে হয়েছিল, সেটা অবশ্যই মরীচিকা, কেন না, গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গদলঘর্ম হতে হতে মনে হচ্ছিল, এইভাবেই এক সময় কলকাতায় পৌঁছে যাব।

একটা বাঁক ঘুরতেই অবশ্য একটা জনপদ চোখে পড়ল। খুব ছোটখাটো জায়গাও নয়, সেখানে বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। একটি দুটি দোকানও খোলা রয়েছে। তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে কোনও গাড়ি সারাবার ব্যবস্থা নেই, একজন মেকানিক আছে বটে, কিন্তু রাত্তিরে তাকে দিয়ে কোনও কাজ হবে না।

সেই শহরে একটি ডি ভি সি-র অফিস এবং সংলগ্ন গেস্টহাউসও রয়েছে, রাত্তিরের জন্য জায়গা পাওয়া গেল সেখানে। ডিমের ঝোল এবং গরম ভাতেরও ব্যবস্থা হল, তারপর মশার গান শুনতে-শুনতে ঘুম।

সকালে উঠে, একটুখানি বাইরে এসেই আমি যাকে বলে চমৎকৃত।

ছোট্টখাট্টো, অপূর্ব সুন্দর, ছিমছাম একটি রেল স্টেশন। জায়গাটার নাম সোনামুখী। সেই স্টেশানের প্রাঙ্গণেই বড় বড় সরল, উন্নত শাল গাছ। এমন পরিচ্ছন্ন স্টেশন আমি বহুঁকাল দেখিনি।

সোনামুখী নামটা তো আগে শুনেছি নিশ্চয়ই, কিন্তু জায়গাটা যে কীরকম সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না, কোনওদিন সোনামুখীতে বেড়াতে যাওয়ার উপলক্ষও ঘটেনি বা সেরকম পরিকল্পনাও আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু দিনের আলোয় প্রথম দর্শনেই আমার জায়গাটা ভালো লেগে গেল।

পশ্চিমবাংলায় মফসসল শহর মানেই সরু সরু রাস্তা, গরুর গাড়ি ও সাইকেল রিক্সার যান জট, খোলা ড্রেন নীল ডুমো মাছি, বাতাসে পেঁকো-পেঁকো গন্ধ, ভ্রমণের পক্ষে আকর্ষণীয় কিছুই থাকে না। সোনামুখী যে সেই তুলনায় বিরাট কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তা নয়, কিন্তু এই পুরোনো শহরটির রাস্তাঘাট তেমন নোংরা নয়, গোলমাল কম। প্রাতরাশের জন্য একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে কয়েকটা জিলিপি ও সিঙারা খেয়ে চমকে উঠলুম, খাবারগুলোতে কেমন যেন অচেনা খাঁটি খাঁটি স্বাদ। এরপর দুটো রসগোল্লা খেয়ে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। মাত্র চার আনায় এমন সাইজের এমন সুস্বাদু রসগোল্লা পৃথিবীতে এখনও কোথাও থাকা সম্ভব?

গাড়ি সারাবার নিয়ম হল, একজন মেকানিক খুঁটখাট করবে আর পাঁচজন সেখানে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করবে। আমি গাড়ির কলকবজা বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করব! কিন্তু আমি একটু অন্যদিকে পা বাড়াতে গেলেই আমার সেই দাদাটি ধমকে ওঠেন, অ্যাই, কোথায় যাচ্ছিস। এক্ষুণি গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমরা স্টার্ট করব।

মেকানিকটি যে-পরিমাণ যন্ত্রপাতি খুলে ফেলেছে, সেসব আবার জোড়া লাগাতে যে খুব কম সময় লাগবে না, সেটুকু অন্তত আমি বুঝি। মাঝেমাঝে ওখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এক ঝলক করে সোনামুখী শহরটা দেখে আসি। একবার বাজারের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে একটা মাটির হাঁড়ি-কলসির দোকানে কিছু পুতুল দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়লুম। বাঁকুড়ার লম্বা কানওয়ালা ঘোড়ার খ্যাতি সুবিদিত, সোনামুখীতে দেখলুম রয়েছে মাটির হাতি। তারও বেশ বৈশিষ্ট্য আছে। এই হাতিগুলোও এখানে কোনও একটা পুজোয় লাগে, কিন্তু ঘর সাজাবার পক্ষেও অনবদ্য। বেশ শস্তা দেখে কিনে ফেললুম এক জোড়া। তাই দেখে জিপ গাড়ির দাদারা কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল, আমার ওপর অর্ডার হল আরও গোটা ছয়েক হাতি কিনে আনার। হাতিগুলো নেহাত ছোট নয়, ছ’খানা আমি আনব কী করে?

‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হস্তি লোফেন যখন তখন’-এর স্টাইলে নিয়ে আসব? তার চেয়েও ভালো উপায় আছে, সেই ফাঁকে সোনামুখীর মন্দিরটা দেখে এসে জানালুম, যাঃ, সব হাতি শেষ!

এইরকম ভাবে একটু একটু সোনামুখী দেখতে লাগলুম আর মনেমনে জোর প্রার্থনা চালালুম, হে বাবা, বিশ্বকর্মা, আজ যেন কিছুতেই ওই জিপ গাড়িটা ঠিক না হয়। আরও জখম করে দাও বাবা, আরও একটা দিন সোনামুখীতে থেকে যাই।

তা অবশ্য হল না। সোনামুখীর একমাত্র দক্ষ মেকানিক দুপুরের দিকে সবকিছু জোড়াতালি দিয়ে জিপটাকে এক অদ্ভুত অবস্থায় দাঁড় করাল। জিপটা অতি আস্তে, প্রায় শম্বুক গতিতে ধক ধক শব্দ করে চলতে পারে।

সেই অবস্থায় জিপটাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে গেলে অন্তত দু’তিন দিনের ধাক্কা, তা ছাড়া মাঝপথে আবার সবকিছু খুলে পড়ে যেতে পারে। গিয়ার বক্সে নাকি গুরুতর কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, ইঞ্জিন ডাউন করতে হবে, সে সাধ্য সোনামুখীর মেকানিকের নেই। কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুরে সারাবার ব্যবস্থা হতে পারে। বিষ্ণুপুর মানেই আবার পিছিয়ে যাওয়া। অগত্যা তাই যেতে হল। সেখানেও লেগে গেল দুতিন ঘন্টা। আমি আবার বিষ্ণুপুরের আটচালা ও টেরাকোটার কাজ করা মন্দির দেখে নিলুম। আগের দিন বিকেল-সন্ধের সন্ধিক্ষণে, ছ’টা বেজে পাঁচ মিনিটে বাঁকুড়া শহরের বাস ডিপোর কাছাকাছি বড় রাস্তায় আমি যদি না দাঁড়াতুম, সেই সময় কোথাও চা খেতে যেতুম বা বাসে উঠে পড়তুম, তাহলে আমার সোনামুখী দেখা হত না। আমার জীবনের ম্যাপে সোনামুখী নামটা যুক্ত হয়ে গেল, আবার সেখানে যাওয়া পাওনা রইল।

আচমকা এক টুকরো ৩

ছেলেবেলা থেকেই সবকিছু অবিশ্বাস করতে শিখেছিলাম।

দ্বিজেন জ্যাঠামশাইর বাড়ির বারান্দায় লণ্ঠন জ্বেলে আমরা কয়েকজন গল্প শুনতুম ওঁর কাছে। হঠাৎ বাইরে কীরকম অস্বাভাবিক শব্দ হতে আমরা সবাই ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে জ্যাঠামশাইর সামনে এসে বসতাম। দ্বিজেন জ্যাঠা গম্ভীর হয়ে বলতেন, যা দেখে আয় তো ওটা কীসের শব্দ। কে যাবে আমাদের কারুর সাহস নেই, কিন্তু জ্যাঠামশাই জোর করে একজন না একজনকে পাঠিয়ে দিতেন। হয়তো সেন্টু ফিরে এসে মুখ চুন করে বলত, কিছু তো দেখলুম না। জ্যাঠামশাই চোখ বুজে গড়াগড়া টানতে টানতে বলতেন, সে কী আর এতক্ষণ থাকে।

কে সে? আমরা একেবারে শিউরে উঠতুম! জ্যাঠামশাই হাসতে হাসতে বলতেন, কারণ ছাড়া কার্য হয় না। চোখে দেখতে না পেলেও কীসে কী হচ্ছে বুঝে নিতে হয়। আমাদের বাড়ির চাল থেকে তোদের বাড়ির রান্নাঘরের চালে লাফিয়ে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল মদনমোহন, পারেনি ঠিক মতো, ফসকে গিয়ে অতিকষ্টে রান্নাঘরের চাঁচের দেয়ালটা ধরে ফর ফর করে। নেমেছে আর দেয়ালের গায়ে ঝোলানো ছিল রুটি সেঁকার চাটুটা-সেটা পড়ে গিয়ে ওরকম শব্দ হল।

মদনমোহন জ্যাঠামশাইর আদরের হুলো বেড়ালটার নাম। ঘর থেকে এক পা না বেরিয়ে ওরকম ছবির মতো ঘটনাটা তিনি কী করে বললেন–ভেবে আমরা অবাক হয়ে যেতুম। কিন্তু বিশ্বাস করতুম জ্যাঠামশাইকে। ওইরকম ভাবেই আমরা ভূত প্রেত অবিশ্বাস করতে শিখেছিলুম। সন্ধেবেলা এক-একদিন আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতুম। ফেরার সময় ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আদিগন্ত পাটখেতের পাশ দিয়ে আসতে আসতে দূরের একটা সাদা দিঘি মতন দেখিয়ে জ্যাঠামশাই বলতেন, ওই দ্যাখ পেতনি দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যাঠামশাই যখন বলছেন, তখন নিশ্চয়ই ওটা পেতনি নয়। কারণ জ্যাঠামশাই বলেছেন যে, ভূত-পেতনি বলে কিছু নেই। সুতরাং তাঁর কথার মর্যাদা রাখতেই আমরা তাঁর একথার প্রতিবাদ করতুম। তবে ওটা কী, এখান থেকে বল তো? তিনি জিগ্যেস করতেন। তখন আরম্ভ হত আমাদের অনুমানের খেলা। কেউ বলতো কলাগাছ, কেউ বলত–ওখানে একগোছা পাট শুকিয়ে ইন্দ্রপুজোর জন্য ধ্বজা করে তোলা। আমি বলেছিলুম : ধোপাদের বউ ওখানে দাঁড়িয়ে হারানো গাধাটাকে খুঁজছে। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, আমরটাই ঠিক। আমরা আর কেউ মিলিয়ে দেখতে যায়নি। অন্য গল্প করতে করতে বাড়ি চলে গেছি।

এই ভাবেই যে কোনও কাজের পিছনে যুক্তি খোঁজার বদ অভ্যাস আমার দাঁড়িয়ে গেছে। এখন মনে হয়, সত্যি সত্যিই হয়তো অনেক ভূত-প্রেত অলৌকিক রহস্যকে যুক্তি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু কোনও একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাওয়ার আজকাল খুব ইচ্ছে হয়। আমার দৃষ্টিশক্তি এখনও খুব ভালো। কিন্তু ইচ্ছে হয় অকারণে চশমা-টশমা নিয়ে চোখ দুটো একটু খারাপ করে ফেলি। তবু যদি কখনও কোনও সত্যিকারের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটে। এসব চেনা জিনিস দেখতে দেখতে একঘেয়ে হয়ে গেছে। এখন আমি যুক্তি ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি।

মনে পড়ে, শ্যামপুকুরের বাড়িতে যখন থাকতুম, নীচের তলাটা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা, শুধু একটা ঘরে শুতুম আমি, বাড়ির আর সবাই দোতলায়। ওই বাড়িতে ভূতের ভয় ছিল। শুনেছি। আমাদের আগের ভাড়াটেদের বড় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল ও বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে। কতজন তাকে দেখেছে। ছাদের ওপর চুল এলো করে বসে কাঁদত কেউ দেখতে পেলেই এক মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেত। আমি কতবার চেষ্টা করেছি তার দেখা পাওয়ার।

একদিন মাঝরাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালার ওপর টক-টক আওয়াজ শুনলুম।

ঘুমের ঘোর কাটার আগে শব্দটা কোথা থেকে আসছে কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার পাতলা ঘুম চট করে ভেঙে যায়। বুঝতে পারলুম, শব্দ হচ্ছে আমরা পায়ের কাছের জানালার পাল্লায়। অল্প-অল্প জ্যোৎস্নায় অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি জানলার বাইরেটা-সেখানে কোনও মানুষের মুখ নেই। কিন্তু শব্দটা হাওয়ার নয়, স্পষ্টত মানুষের। একটু থেমে থেমে শব্দ হচ্ছেঠক ঠক ঠক।

আমার বালিশের তলায় বেড স্যুইচ। তা ছাড়া ইঁদুরের উৎপাতের জন্য পাশে একটা মোটা বেতের লাঠি রেখে দিতাম। সুতরাং সশস্ত্র ছিলাম। তবু আলো জ্বালিনি, শুরু করেছি যুক্তির খেলা। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমারই কোনও বন্ধু-বান্ধব ডাকতে এসেছে। দীপকের ফ্ল্যাট বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেলে মাঝেমাঝে রাত্রে এসে ও আমার সঙ্গে শুত। কিন্তু দীপক তো চুপ করে থেকে জানলা নক করার ছেলে নয়। এতক্ষণে ওর কম্বুকণ্ঠে সারা পাড়া নিনাদিত হয়ে উঠত। তবে কি কোনও চোর? আমি জেগে আছি কিনা দেখার জন্য আওয়াজ করছে? আমি খর চোখে তাকিয়ে রইলুম–জানালার পাল্লায় আবার আওয়াজ ঠক ঠক ঠক। কিন্তু কোনও মানুষের হাত বা মুখ দেখা গেল না। অথচ জানালাতেই যে শব্দটা করা হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জানালার কপাট দুটো ঘরের মধ্যে ঢোকানো–সুতরাং কেউ আওয়াজ করলে তার হাত দুটো আমি দেখতে পাবই। এমন মূর্খ আমি, কোনও অদৃশ্য বা অলৌকিক অস্তিত্বের কথা তখন আমার মাথাতেই আসেনি। আমার পক্ষে সবচেয়ে সহজ ছিল–আলো জ্বেলে উঠে গিয়ে দেখা। কিন্তু ওই যে–অনুমান এবং ডিডাকশান করার লোভ। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে নানান যুক্তি ভাবতে লাগলুম। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলুম সমাধান। টিকটিকিতে আরশোলা ধরেছে। আরশোলাটাকে মারার জন্য টিকটিকি অনেকবার ঝাঁপটা মারে। টিকটিকির যা স্বভাব–অসীম ধৈর্য নিয়ে থেমে ঝাঁপটা মারতে মারতে ওকে শেষ করবে। কাঠের জানলায় ওইরকম আওয়াজ হচ্ছে ঝাঁপটা মারার। আমার এই সিদ্ধান্তে আমি এতদূর নিশ্চিন্ত হয়ে গেলুম যে, উঠে গিয়ে মিলিয়ে দেখারও ইচ্ছে হল না। ঘুমিয়ে পড়লুম পাশ ফিরে।

আজ সে জন্য কত অনুতাপ হয়। হয়তো টিকটিকি নয়–সেই আত্মহত্যাকারিনী অষ্টাদশী মেয়েটি আসতে চেয়েছিল আমার ঘরে। দুটো কথা বলতে এসেছিল। আসবার আগে ভদ্রভাবে অনুমতি চেয়েছিল। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আজকাল ভূত আর ভগবান তো একই অবিশ্বাসীর কাছে আসে না একেবারেই। ভয় দেখাতেও আসে না।

কিন্তু আমি যদি কোনও অলৌকিকের দেখা না পেয়ে থাকি তবে এ লেখাটা লিখছি কেন? না, পেয়েছিলাম একবার। একটি অসম্ভব অলৌকিক দৃশ্যের রাত্রি।

চক্রধরপুর থেকে রাঁচি যাওয়ার রাস্তায়, পাহাড়ের ওপর হেশাডি ডাকবাংলোয় একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম কয়েক বন্ধু। চারপাশে জঙ্গল–সন্ধের পর ভাল্লুক আর চিতাবাঘের ভয় আছে। রাস্তার পাশে এই বাংলো–আর চতুর্দিকে ১৫ মাইলের মধ্যে কোনও জনমানব নেই। সন্ধ্যের পরই অন্ধকার এবং স্তব্ধতা একসঙ্গে ছেয়ে আসে। মাঝেমাঝে শুধু দু-একটা ট্রাক তীব্র আলো জ্বেলে ঝড়ের বেগে ছুটে যায়–ডাকাতির ভয়ে কোথাও না থেমে।

কয়েকদিন তাসটাস খেলে হই-হুল্লোড় করে কাটল। তারপর আর সন্ধে কাটতে চায় না। কী বিপুল দীর্ঘ সন্ধেগুলো। সুতরাং একদিন ১৮ মাইল দূরে ওঁরাওদের গ্রামে হাট হবে শুনে আমরা দুপুরবেলাই একটা ট্রাক ধরে চলে গেলাম। চাল, হাস, মুরগি, কাঁচের চুড়ি, আয়না আর হাঁড়িয়া ও জুয়ার আড্ডা নিয়ে ছোট্ট গ্রাম্য হাট। সন্ধের পরই ভেঙে গেল। তখন সমস্যা হল আমাদের ফেরা নিয়ে। কী করে অতখানি রাস্তা ফিরে যাব–কোনও ট্রাক আমাদের নিতে রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত একটা সিমেন্টের ট্রাক আমাদের পৌঁছে দিতে রাজি হল বাদগাঁও পর্যন্ত। সেখান থেকে আমাদের বাংলো ৪ মাইল। হেঁটে ছাড়া যাওয়ার আর কোনও উপায় নেই। জমাট অন্ধকারে পাকা পিচের রাস্তা ধরে চুপচাপ হাঁটছিলুম আমরা খুব সাবধানে। যে-কোনও সময় ছুটন্ত ট্রাক আমাদের চাপা দিয়ে যেতে পারে–এখানে আর কে দেখছে। হাঁটতে একদম ভালো লাগছিল না। শেষে, কে এই হাটে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল সেই নিয়ে খিটিমিটি বেধে গেল। তারপর তুমুল ঝগড়া। আমি ঝগড়ায় এমন উন্মত্ত হয়ে গেলাম যে পাহাড়ের ধার দিয়ে নীচে নেমে যাওয়া একটা পায়ে চলা রাস্তা দেখে বললাম, আমি ওই রাস্তায় যাব–এটাই শর্টকাট। কেউ আমার সঙ্গে যেতে রাজি হল না। দু-একজন আমাকে বারণ করল। আমি তখন নামতে শুরু করেছি।

খানিকটা বাদে বুঝতে পারলুম, কী ভুল করেছি। পায়ে চলা পথ আর দেখা যায় না, মিলিয়ে গেছে জঙ্গলে। আমি নামার ঝোঁকে অনেকখানি নেমে এসে দাঁড়ালুম, বুঝতে পারলুম, ফেরার আর উপায় নেই। খাড়া পাহাড়–অতি কষ্টে ঝোঁক সামলে নীচে নামা যায়। কিন্তু ওপরে ওঠা যায় না, খানিকটা ওঠার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে গেলুম। তাকিয়ে দেখলাম এতদূরে নেমে এসেছি যে ওপরের রাস্তাটা আর দেখা যায় না। পায়ের কাছে অনেকটা সমতল হয়ে এসেছে–শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। কোথাও এক বিন্দু আলোর চিহ্ন নেই। আমার সঙ্গে হাট থেকে কেনা বাঁশের ছড়ি–আর কিছু না, একটা টর্চ পর্যন্ত নেই। আমি জঙ্গলে পথ হারালাম।

মনে আছে সেই রাত্রির কথা। ভাল্লুক আর চিতাবাঘ বেরোয় ওই জঙ্গলে শুনেছিলাম, তার চেয়েও ভয়ংকর পাহাড়ে চিতিবোড়া সাপ, যার একটা আমরা আগের দিন নিজেরাই দেখেছিলাম। বন্ধুদের নাম ধরে ডাকলুম। কোনও সাড়া নেই। ওরা শুনতে পাচ্ছে না বা এগিয়ে গেছে। বেশি ডাকতেও সাহস পেলুম না–শব্দ করতে যেন ভয় করছিল। পাগলের মতো হন্যে হয়ে ছুটতে লাগলুম। তারপর একবার ক্লান্ত হয়ে বসলাম একখণ্ড পাথরের ওপর। ছড়িটা দিয়ে চারপাশ পিটিয়ে দেখে নিলাম সাপ আছে কি না কাছে। বসে থেকে এমন অসহায় লাগতে লাগল। কোনও গাছের ওপর বসে যে রাত কাটাব তারও উপায় দেখলুম না। লম্বা-লম্বা শালগাছগুলো অনেকদূর উঠে গেছে সিধেভাবে–তারপর ডালপালা ছড়িয়েছে। ও গাছে চড়া আমার সাধ্য নয়।

চুপ করেই বসে রইলুম। হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া দিল, কেঁপে উঠল গাছের পাতাগুলো। আমি স্পষ্ট গলায় আওয়াজ শুনতে পেলুম, আহা-হা, লোকটা লোকটা। ফিসফিস করে কেউ বলল আমার মাথার ওপরের গাছটা থেকেই। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। আবার এক ঝলক হাওয়া দিতে সামনের গাছ থেকে ফিসফিস শব্দ হল, আহা-হা, লোকটা লোকটা। আমি ওপরের দিকে তাকালুম। দুটো গাছ যেন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলছে, আহা-হা, লোকটা লোকটা।

তারপর বেশ জোরে হাওয়া দিল একবার–আশেপাশের সবগুলো গাছ বলে উঠল, আহা-হা, লোকটা লোকটা।

মনের ভুল তাতে সন্দেহ কী। কিন্তু এরকম মন বা কানের ভুল হবেই বা কেন? শুনেছি মরুভূমিতে অনেক লোক পাগল হয়ে যায়, আমিও শেষে জঙ্গলে? উঠে হাঁটতে আরম্ভ করলুম। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আবার ফিসফিস সুর…আহা-হা…। লোকটা! নিষ্ঠুর কৌতুকের নয়, করুণ সহানুভুতিময় সেই সুর, যেন শতশত বৃক্ষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে–আমি ছুটতে লাগলুম।

হঠাৎ একবার বাতাস থেমে গেল। তারপর আর এক ঝলক বাতাস বইতেই আমি অন্যরকম কথা শুনতে পেলুম। এইখানেই অলৌকিক দৃশ্যের আরম্ভ। আমি থেমে দাঁড়ালাম। এবার শুনতে পেলুম–ওদিকে নয়, ওদিকে নয়! এই প্রথম শিহরণ হল। গাছের পাতাগুলো দুলে-দুলে সরসর শব্দ করে আমাকে বলছে, ওদিকে নয়, ওদিকে নয়। এক মুহূর্তে দ্বিধা করে আমি পিছন ফিরে হাঁটতে লাগলুম। আবার শুনতে পেলাম, ওদিকে নয়, ওদিকে নয়!

চিৎকার করিনি, কিন্তু মনে মনে জিগ্যেস করলুম, কোন দিকে? বোবা বৃক্ষেরা কথার উত্তর দেয় না, শুধু নিজেরা কথা বলে, ওদিকে নয়, ওদিকে নয়। কীরকম বোবা ওরা কী জানি।

আমি ডানদিকে ঘুরলুম, আর কোনও কথা নেই। হাওয়া থেমে গেছে। এবার সবাই আমাকে দেখছে, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম। ডানদিকেই হাঁটতে লাগলুম। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আবার হাওয়া উঠল। আবার শব্দ উঠল, ওদিকে নয়। থেমে দাঁড়িয়ে আবার ডানদিকে বাঁক নিলুম। তখনও শব্দ ওদিকে নয়, ওদিকে নয়। দাঁড়িয়ে বাঁদিকে বাঁক নিলুম। শব্দ থেমে গেল।

তারপর যতক্ষণ হেঁটেছি ভুলে গিয়েছিলুম বাঘ ভাল্লুক বা সাপের কথা। শুধু উত্তর্ণ হয়ে শুনেছি গাছের পাতার সরসরানি। মাঝেমাঝে থেমে ওদের নির্দেশ মতো চলেছি। একটু পরেই দেখতে পেলুম, দূরে ডাকবাংলোর আলো, শুনতে পেলুম বন্ধুদের গলায় আওয়াজ।

মনের ভুল? কানের ভুল? আর যাচাই করে দেখতে চাই না। এরপর যখনই সেই রাত্তিটার কথা ভাবি, আমার যেন একটা অলৌকিক সুখানুভূতি হয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত