একসময় যুগোশ্লাভিয়া নাকে একটি দেশ ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির পতনের সময় এ দেশটা কয়েক টুকরো হরে যায়।
ম্যাসিডোনিয়া নাম শুনলেই আমাদের আলেকজান্দার-এর কথা মনে পড়ে। সেই ম্যাসিডোনিয়ার একটি অংশ তখন যুগোশ্লাভিয়ার মধ্যে। প্রায় আমাদেরই মতন গরিব দেশ, কোনও কোনও ব্যাপারে বেশ গরিব, আবার কোনও কোনও ব্যাপারে নিয়মশৃঙ্খলা অনেক ভালো। গরিব সাহেব দেখতে হলে তখন এইরকম কয়েকটি দেশে যেতে হত, যেখানে তাদের মাংস জোটে না, দুধ ছাড়া শুধু বরফের গুঁড়োর ওপর সিরাপ ছড়িয়ে আইসক্রিম হিসেবে চুষে চুষে খায়।
এইসব গরিব দেশের মানুষগুলো কিন্তু কবিতা ভালোবাসে খুব। রুমানিয়ায় আমি নতুন কবিতার বই লোকদের লাইন দিয়ে কিনতে দেখেছি। প্রকাশের প্রথম দিনেই।
ম্যাসিডোনিয়ার সেই অংশে প্রতি দু-বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত বিশ্ব কবিসম্মেলন। আমাদের হলদিয়া কিংবা ঢাকার বিশ্ব কবিসম্মেলনের মতো নয়, সত্যি-সত্যি পৃথিবীর বহু দেশ থেকে প্রধান কবিরা তাতে যোগ দিতেন। আমি যে বছর যাই, সেবারে দুজন অন্তত বিশ্ববিখ্যাত কবি, আমেরিকা ও রাশিয়া থেকে অ্যালেন গিনসবার্গ এবং আন্দ্রেই ভজনেসনস্কি এসেছিলেন।
জাগ্রেব নামে একটা ছোট্ট শহরে সেই কবিসম্মেলনের কেন্দ্র। শতাধিক কবি এসেছেন, থাকার ব্যবস্থা একটা ব্যারাকের মতন মস্ত বাড়িতে। ব্যবস্থা খারাপ নয়, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর, শৌখিনতা কিছু নেই, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা আছে। খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য খুবই খারাপ। কুপন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা দেখিয়ে একটা ক্যান্টিনে বাঁধাধরা খাবার খেতে হয়, অধিকাংশ খাবারই বিস্বাদ, মুখে দেওয়া যায় না। কিন্তু নিজে আলাদা পয়সা দিলে অন্য খাবার আসে। এই তুলনায় হলদিয়া সারা ভারত কবিতা উৎসবের খাদ্য অনবদ্য।
ভারত থেকে আমি একলা হলেও বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন দুজন কবি। তাঁদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলা যায়। অ্যালেন গিনসবার্গ আমার পুরোনো বন্ধু, তখন নানান জায়গায় দাবি তোলা হয়েছে, তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক। শোনা যাচ্ছিল যে বারবার পুরস্কার কমিটিতে তার নাম প্রস্তাবিত হলেও তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে একটি কারণে, অ্যালেন গিনসবার্গ প্রকাশ্যভাবে সমকামী। নোবেল কমিটি নাকি এসব নৈতিক বিচারও করে।
অ্যালেন আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল ভজনেসেনস্কির। তিনজনেই আড্ডা দিতাম বেশিরভাগ সময়। ইয়েফতুশেংকো আর ভজনেসেনস্কি, এই একজোড়া কিশোর কবি ষাটের দশকে রাশিয়ায় হঠাৎ খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। পরে ইয়েফতুশেংকো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, ভজনেসেনস্কি একজন প্রধান কবি হিসেবে গণ্য। ভজনেসেনস্কি আমাকে বলল, তার খুব ভারতে আসার ইচ্ছে। কিন্তু কেউ নেমন্তন্ন করে না।
বিদেশের এই ধরনের কবিসম্মেলনে আড়াটাই তো প্রধান। সেই টানেই যাওয়া। এবং পারিপার্শ্বিক কিছু ঘুরেটুরে দেখা। দিনেরবেলা ওগরিদ নামে একটা হ্রদে নৌকোবিলাস হল। সেই হ্রদেরই মাঝখানে ভাসমান বল দিয়ে দিয়ে অন্য দেশের সীমারেখা টানা। ওপাশের দেশটি আলবেনিয়া। তখন সে দেশ ছিল অতি উগ্রপন্থী কমিউনিস্ট, এখন ধর্মীয় মৌলবাদী! মানুষ কী বিচিত্র!
এই ম্যাসিডোনিয়ার কবিসম্মেলনের মঞ্চটি একেবারে অভিনব। এরকম আর কোনও দেশে দেখিনি।
শহরের প্রায় মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি খরস্রোতা নদী। বেশি চওড়া নয়। ধরা যাক আমাদের রেড রোডের থেকেও একটু ছোট। জল খুব স্বচ্ছ। দিনেরবেলা একটা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দেখেছি, ঝাঁকে-ঝাঁকে মাছ ছুটে যাচ্ছে। এখনকার বাংলাদেশ যখন পূর্ববঙ্গে ছিল, তখন সেখানকার নদীগুলি মাছের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সেখানেও আমি কখনও কোনও নদীতে এরকম হাজার-হাজার মাছের ছুটে যাওয়ার দৃশ্য দেখিনি। মাঝে মাঝে এরকম দেখা যায় বটে ডিসকভারি চ্যানেলে, তাও সমুদ্রে।
সেই সেতুটিই কবিতা পাঠের মঞ্চ।
পরপর কয়েকদিনই কবিসম্মেলন শুরু হয় রাত সাড়ে আটটার পর। সারাদিন ভ্রমণ ও সেমিনার ইত্যাদি। ওদের ওখানে নাকি রাত্তির ছাড়া কবিতা পাঠ জমে না।
সেতুটাকে নানারকম রঙিন কাপড়ে মুড়ে বানানো হয়েছে মঞ্চ। জ্বালানো হয়েছে বড় বড় বাতি। দর্শক বা শ্রোতাদের বসবার জায়গার কোনও ব্যবস্থা নেই। নদীর দু’পারে চমৎকার কার্পেটের মতন ঘাস। সবাই এসে বসেছে সেই ঘাসের ওপর। সঙ্গে বিয়ারের বোতল কিম্বা লাল-সাদা ওয়াইনের (ওসব দেশে হুইস্কি অতি দুর্লভ ও দুমূল্য) এবং সসেজ ও আলুভাজা। কেউ বলেছে তার সঙ্গিনীর কোলে মাথা রেখে, কেউ অন্যের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে।
যখন কোনও কবির কবিতা পাঠ করার কথা, তখন সেই মঞ্চে আর কেউ থাকবে না। ঘোষণাটোষণা সব আড়াল থেকে। একটা সেতু তো স্টেজ হিসেবে বেশ বড়ই। তার ঠিক মাঝখানে একজন মাত্র মানুষ। তিনি কবি, তিনি অনন্য।
আমি আমার পাঠের সময়ে দেখি, সামনে কোনও মানুষ নেই, শুধু চলমান নদী, তার জল চিকচিক করছে। দুই তীরের শ্রোতাদের স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট রেখাচিত্রের মতো। কেউ কোনও কথাবার্তা বলা বা শব্দ করছে না।
সুতরাং মনে হল, আমি যেন আকাশের নীচে একা দাঁড়িয়ে শুধু এই নদীকেই কবিতা শোনাচ্ছি। কেমন যেন মদির অনুভব।
শেষ হবার পর হাততালির শব্দে সেই ঘোর ভেঙে যায়।