নিজের স্ত্রীর নোংরা ভিডিওটা দেখা মাত্রই শাহেদ চোখ বন্ধ করে নিলো। অন্য একটা পুরুষকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে আছে নীলা। সেই পুরুষটা নৈপুণ্যের সাথে খেলে যাচ্ছে নীলার শরীরে। সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে নীলা। এটা যে কোনো পুরুষকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আজকে সকালে কুরিয়ারে করে তার অফিসে ভিডিওটা কেউ পাঠিয়েছে। অথচ কাল রাতেও কতো না রোমান্টিক ছিল তারা স্বামী-স্ত্রী। একটা পেনড্রাইভ বাক্সে র্যাপিং করে সুন্দর করে পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে তার সঠিক হদিস নেই। একটা নাম্বার দেয়া ছিল। কিন্তু সেটা বন্ধ।
আচ্ছা শাহেদ কি নীলাকে এখনো ভালোবাসে? খুব কঠিন প্রশ্ন। এক মুহুর্তেই ভালোবাসা শেষ করে দেয়া যায় না। তবে এই মূহুর্তে শাহেদের মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। ফোন করেছিলো নীলা। আছাড় মেরে সেটাও ভেঙ্গে ফেলেছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে। কি হচ্ছে এসব? কেনই বা হচ্ছে? কোনো উত্তর নেই। নীলাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করলো তার। কিন্তু স্মার্ট ফোন তো ভেঙ্গে ফেলেছে। আচ্ছা ল্যান্ড ফোন থেকে কি ট্রাই করবে? কিছুই ভাবতে পারছে না। অফিস থেকে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে গেলো সে।
নীলার সাথে শাহেদের প্রেম ছিলো না। একটা ভালো চেনাজানা ছিলো অনেক আগে থেকেই। সেই চেনাজানাটাই সম্পর্কে রূপ নিয়েছে একবছর আগে। শাহেদের চাকুরিটাও হয়েছে। বিয়েটাও সেরে নিয়েছে। নীলা উচ্চশিক্ষিতা হলেও শাহেদের চাহিদা ছিলো একটা পুরোদস্তুর গৃহিনী বউ, যাকে অফিস থেকে এসে আদর করা যাবে, যার সাথে বসে বাচ্চাদের মতো খেলা যাবে। যার সাথে প্রেমও করা যাবে। শাহেদের আবদারটা নীলা মেনে নিয়েছিলো।
কি দরকার জব করার? ভালো বেতন পাচ্ছে শাহেদ। কয়েকদিন পর গাড়িও নেবে। দুজনের ইনকামের দরকার আছে কি? নীলা ঘরটাই বেছে নিয়েছিলো। একেবারে ছিমছাম সংসার। কোনো অভিযোগ নেই। শুধুই ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার ঘরে আগুন লেগেছে আজকে সকালে। মাথা কিছুটা ঠান্ডা হওয়ার পর শাহেদ ভিডিওটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে। কেউ এডিট করেনি তো? সব রকমভাবে নিশ্চিত হয়ে বুঝলো এটা এডিট করা নয়। নীলার মুখ স্পষ্ট। ভিডিও সাউন্ড কোয়ালিটিও ভালো। নীলার চিৎকার বুঝা যাচ্ছে।
মাথাটা আবার ব্যাথা শুরু করেছে। শরীরটা কেমন জানি গরম হয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে কথা আসছে না ঠিকঠাক। কেন এমন করলো নীলা? শাহেদ কি অক্ষম? নাকি অভাবে রেখেছিল তাকে? কোনোদিন তো অভিযোগ করেনি সে। চোখ ফেটে কান্না বেরুচ্ছে। বোবা কান্না। যে কান্নার কথা কাউকে বলা যায় না। লজ্জা করছে খুব। যে লজ্জা মাটিতে মিশে গেলেও শেষ হয় না। পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে শাহেদ। নিজেকে একা করে ফেলতে চাইছে। এখন বিকেল। সেই সকাল থেকে নীলার সাথে যোগাযোগ করছে না সে। কিভাবে ঘৃনা প্রকাশ করবে সেটা বুঝে ইঠতে পারছে না।
“জীবন সব কিছুই ফিরিয়ে দেয়। একেবারে হিসাব মতো।” পেছন থেকে বলে উঠলো একটা কন্ঠ। পরনে কালো শার্ট , সাদা মোবাইল প্যান্ট , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শাহেদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন পুলক। মুখে হাসি। লোকটা আবার কথা বললো, “কি ভাবছো তুমি? তোমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে?” “কে আপনি?” প্রশ্নবোধক কন্ঠে শাহেদের জিজ্ঞাসা। “আমি পুলক, ভিডিওটা আমিই পাঠিয়েছি।” এক মূহুর্ত চেয়ে থেকে দৌড়ে এসে পুলকের কলার ধরলো শাহেদ। “হারামজাদা, তুই তাহলে এই কাজ করেছিস?” বাঘের মতো চিৎকার করছে সে।
পুলকের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। শাহেদের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এতো ক্ষেপে যাচ্ছো কেন? নিজের চরিত্রে অন্য কাউকে দেখলে খারাপ লাগে তাই না? ভিডিওটা আমিই পাঠিয়েছি। তবে ওই ভিডিওর নায়ক আমি নই। নিজেকে সাধু দাবী করছো কেন? বলো তো আজকে কতো তারিখ? মনে আছে এই দিনটার কথা? আজকে ১৮ তারিখ। এখন সময় বিকেল ৫টা। আমি পুলক, তোমার অতীতটা দেখিয়ে দিতে এলাম। আসো দেখি।” রক্তচক্ষু শাহেদ কিছুই বুঝতে চাইছে না। বলতে শুরু করলেন পুলক।
“থার্ড ইয়ারে থাকতেই তুমি একটা টিউশনি করাতে। বেতন কম ছিলো। কিন্তু এরপরেও তুমি টিউশনিতে যেতে। কেন যেতে বলো দেখি?আসলে তোমার আগ্রহ টিউশনিতে ছিলো না। আগ্রহ ছিলো তোমার ছাত্রীর মায়ের দিকে। একটা সুখী পরিবার নষ্ট করেছো তুমি। সুন্দর করে কথা বলতে পারতে। সেটাকেই কাজে লাগালে। প্রেম করতে শুরু করলে এক মধ্যবিত্ত লোকের স্ত্রীর সাথে। তোমার এই ফ্যান্টাসি একটা পরিবার নষ্ট করে দিয়েছিলো।তোমার ছাত্রীর বাবা টের পেয়ে যায় তার ঘরে একটা কাল সাপ ঢুকেছে। বিষয়টা ইজ্জতের। লোকটা নিজের স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসতো। তাদের বয়সের ব্যাবধান ছিলো বেশি। কিন্তু ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। মাঝ থেকে তোমার কারনে শুরু হলো অশান্তি।লোকটা কিন্তু তোমাকে কিছু বলেনি। একদিন তোমার হলে গিয়ে অনুরোধ করেছিল তার ওয়াইফের সাথে যেন তুমি এমন না করো। তোমাকে টিউশনিতে আসতে বারন করেছিলো।তুমি কি করেছিলে বলো দেখি?” রক্ত সরে গেছে শাহেদের মুখ থেকে। থামলেন না পুলক।
“লোকটাকে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দিলে তুমি। রাজনীতি করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুমি। তোমার গায়ে কেউ হাতটাও দিতে পারেনি।ভেবেছিলে তুমি পার পেয়ে গেছো। অল্প বয়সে যে আনন্দ তুমি পেয়েছো সেটা সহজে ছাড়তে চাইলে না। তোমার ছাত্রীর মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরে যেতে চাইলো তোমার থেকে। তুমি ছাড়লে না। ভিডিও ক্লিপ বের করার ভয় দেখিয়ে জোর করে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকলে। একদিন এসব সইতে না পেরে লোকটা আত্মহত্যা করলো মালিবাগ রেলগেটে। খবরটা তুমি পড়ছিলে আর মুচকি মুচকি হাসছিলে। সেদিন আমিও হেসেছিলাম তোমার সাথে। কারন তোমার পরিনতি আমি জানতাম।আজকে ১৮ তারিখ। লোকটা এই দিনই সুইসাইড করেছিল। নিজের পাপাচারে অনুতপ্ত হয়ে লোকটার স্ত্রীও সুইসাইড করেছিলো বসার সিলিং ফ্যানে ঝুলে।”
শাহেদ বোবা হয়ে গেছে। বলে চলেছেন পুলক। “এইবার তোমার পালা শাহেদ। Lets make it bro! ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে তুমিও সুইসাইড করবে। তোমার কপালে লম্পট স্ত্রী জুটিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমার মৃত্যুর পর সে আরো অনেকের সাথেই একই কাজ করবে এবং তোমার সম্পত্তি ভোগ করবে। এইটাই তোমার শাস্তি।”
কিছু একটা বলার আগেই শাহেদ আবিস্কার করলো মালিবাগ রেলগেটের খুব কাছে বিপজ্জনক ভাবে হেঁটে যাচ্ছে সে। তার হাঁটাচলা সে নিয়ন্ত্রন করছে না। চাইলেও থামতে পারছে না। আস্তে আস্তে রেললাইনে উঠে গেলো সে। একটা ট্রেনের হর্ন শোনা যাচ্ছে। সেই হর্ন ছাপিয়ে একটা কণ্ঠ তার কাছে বেজে চলেছে। কন্ঠটা পুলকের। “Lets make it bro…quick…” বলতে বলতেই আচমকা একটা ট্রেন এসে শাহেদকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেলো। ছিন্নভিন্ন দেহের পাশে একটা পেনড্রাইভ পড়ে আছে।
কালো শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরিহিত এক তরুন সবার অলক্ষ্যে সেটা সরিয়ে নিলো। কেন সরিয়ে নিলো আর কেনই বা এই লোকটা আত্মহত্যা করলো তা কেউ জানতেও পারলো না। একটা এতিমখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পুলক। ফুটফুটে একটা মেয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। বয়স আর কতো হবে, ১৪ কি ১৫। মেয়েটাকে দেখেই এগিয়ে গেলেন পুলক। হাতে তুলে দিলেন পেন ড্রাইভটা। বললেন, “এখানে মীনা কার্টুন আছে মা।” মেয়েটা হাসি মুখে পেন ড্রাইভটা নিয়ে চলে গেলো। আসলেই তাই। পেন ড্রাইভে মীনা কার্টুনই আছে। পাপটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সেই সাথে পাপীটাকেও।