ব্যবহারই বংশের পরিচয়

ব্যবহারই বংশের পরিচয়

‘তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেনো রুবেল? কি হয়েছে তোমার? বেশ কিছুদিন যাবত দেখছি তুমি কথা বলছো না।’ ভাবির মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। ঠিক কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। ভাবি আমার পাশে চেয়ার টেনে বসলো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল….

–কি হয়েছে তোমার রুবেল?

আমি ভাবির থেকে একটু সরে বসলাম। আমতা আমতা করে বললাম….

-কি..কি..কিছুনা ভাবি।

–তাহলে এমন করছো কেনো?

-ক..কই কি করছি?

–কয়েকদিন থেকেই দেখছি তুমি বেশ দূরে দূরে থাকছো, আগের মতন ঠিক ভাবে কথা বলোনা।

-কিছু হয়নি, এমনিই।

–আমি জানি কিছু একটা হয়েছে তোমার, বলো?

-উহু কিছুনা ভাবি।

বলেই আমি চেয়ার থেকে উঠে বাইরে আসা শুরু করলাম। ভাবি আরো বার কয়েক ডাক দিলো। আমি আমলে নিলামনা, ঠিক নিজেকে শামুকের মতন গুটিয়ে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। নিজের ভিতরে কেমন জানি অপরাধবোধ কাজ করছে।

“ছোট বেলায় মা-বাবা মারা যায়। ঠিক মতন মায়ের আদর যত্ন পাইনি। যতটুকু করেছে তার সবকিছু বড় ভাইয়া করেছে। আমাকে আগলে রাখা, খাওয়াদাওয়া, গোসল থেকে শুরু করে সবই। ভাইয়া আমাকে অনেক ভালোবাসতো। নিজে স্কুলে নিয়ে যেত, আবার নিজে নিয়ে আসতো। কখনো কোনকিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। কখনো মায়ের অভাবের কমতি রাখেনি। আমার হাসি মুখটাই যেন ভাইয়ার সব ছিলো। ভাইয়া তখন একটা দোকানে থাকতো। দিনবদলের পালায় ভাইয়াও একসময় নিজে দোকান দেয়। অনেক ব্যস্ত হয়ে পরে। আমি তখন সদ্য ক্লাস ১০ এ পড়ি। একদিন ভাইয়া আমার কাছে আসলো, বলল….

–রুবেল তোর জন্য একটা ভাবি নিয়ে আসবো, কি বলিস?

ভাইয়ার কথা শুনে সেদিন অনেক লজ্জা পেয়েছিলাম। মাথা নিচু করে বসেছিলাম। এমনিতেই বেশ লাজুক ছিলাম আমি। ভাইয়া আমার এমন কাণ্ড দেখে হাসতে থাকলো। মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল….

–কয়দিন আর একা থাকব বল? আলাদা সংসারওতো হবে। আর তাছাড়া তুইওতো বাসায় একা থাকিস। তুইও তখন আড্ডা দিতে পারবি। আমিতো ব্যবসায়ী কাজেই ব্যস্ত হয়ে পরেছি।

আমি মাথা নিচু করেই মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পরই চাচাদের বলে ভাইয়া বিয়ে করে। বিয়েটা ঘরুয়া ভাবেই হয়। আর আমার জন্য হয় ভাবি। ভাইয়া ভাবিকে একটা কথাই বলেছিলো, ‘আমার এই ভাইটাকে একটু দেখো, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দিওনা। পাগলটা একা খুব।’ ভাবি শুধু মাথা নাড়িয়েছিলো সেদিন। কয়েকদিন লজ্জায় ভাবির সামনেই যায়নি। বেশ লজ্জা লাগতো আমার। কিন্তু ভাবি টের পেয়ে একদিন আমায় বলে….

–ঐ আমি তোমার ভাবি এত লজ্জার কি আছে?

-উহু….. (মাথা ঝাঁকিয়ে)

–বাব্বাহ আমার ভাইটার দেখি লজ্জাও আছে হিহি…আসো ভাত খেয়ে যাও।

আমি মাথা নিচু করেই ঘরে গিয়েছিলাম। ভাবি সেদিন প্রথম আমায় নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হয়েছিলো আমার মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মা মারা যাবার পর সেই প্রথম আমি আবার কান্না করেছিলাম। ভাবি আমার কান্না দেখে নিজেও অবাক হয়েছিলো, চোখের জল মুছে দিয়ে বলেছিলো….

‘এরপর আর কখনো যেন চোখে পানি না দেখি। দেখলে খবর আছে হু… আর আজকের পর থেকে এত দূরে দূরে থাকবানা বুঝছো। পাগল ছেলে একটা।’

সেদিন যে কতটা ভালো লাগা কাজ করেছিলো নিজেও জানিনা। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো। দিনদিন ভাবির সাথে আমার খুনসুটি বেরেই চলছিলো। মায়ের মতন শাষণ করতো, পড়া না পারলে বুঝিয়ে দিত, আবার পড়া শেষে নিজে পড়া ধরত। আমি যখন ঘুমিয়ে যেতাম তখন ভাবি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। গায়ে কাঁথা দিয়ে দিত। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় টিফিন বক্সে ভাত দিয়ে দিত।

কিন্তু এই বিষয়টাই একসময় কেমন জানি লজ্জা জনক লাগে। তার কারণ বহিরাগত। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে যখন মাঠে খেলতে যেতাম অনেকেই কটু কথা বলতো। যেমনঃ

*কিরে রুবেল তোর ভাবিতো দেখতে অনেক সুন্দর। জোস কিন্তু…!
*আরে বুঝিসনা, এইজন্যই দিনদিন রুবেলও সুন্দর হচ্ছে।
*আরে দেখিস না, এখন রাত করে আমাদের সাথে আড্ডা দেয়না।
*কিযে বলিস তোরা? এমন সুন্দরী ভাবি দেখলে কেউ বাইরে আড্ডা দিবে বল? ভাবির সাথেইতো আড্ডা দিবে।
*হাহা আচ্ছা রুবেল সারাদিন তো সাখাওয়াত (বড় ভাইয়া) ভাই দোকানেই থাকে, চান্সতো ভালোই পাস। কাজে লাগাবি শালা।

এই সবকথা গুলো বেশি বলতো আমাদের পাশের বাসার রনি। ছোট বেলা থেকেই ওর প্রতি আমার অনিহা। তারকারণ ও বেশ উগ্র টাইপের। একদিন ভাবির সাথে পাশাপাশি ছবি দেখে রনি বলল….

–যাই বলস, তোর ভাবি কড়া মাল। শালা কপাল গুনে এমন ভাবি পেয়েছিস।

মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে সজোরে ঘুষি মেরেছিলাম রনির মাথায়। প্রচণ্ড ঝগড়া লাগে আমাদের। ভাবি ঝগড়ার কারণ জানতে চাইলে আমি বলিনা, ভাবিও আর জোর করেনা। তবে রনি দিনদিন আরো বেশিই বলে যাচ্ছিলো। ভাবিকে নিয়ে সবজায়গায় উল্টাপাল্টা কথা বলতো। আমার সহ্য হতোনা।”

ভাবির থেকে তখন-ই বেশ দূরে থাকি। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। রাতে খাওয়ার সময় চুপচাপ খেয়ে আসি। কথা বলিনা তেমন। ঘুমানোর আগেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেই যাতে রাতে ভাবি আসতে না পারে। পরদিন রাতে খাওয়াদাওয়া করে চেয়ারে যখন উদাস হয়ে বসে থাকি তখনই ভাবি উপরোক্ত কথাগুলো বলে… ‘তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেনো রুবেল? কি হয়েছে তোমার? বলো আমায়? বেশ কিছুদিন যাবত দেখছি তুমি কথা বলছো না।’

রাতে দরজা বন্ধ করে রুমে বসে আছি। তখন-ই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। আমি দরজা খুলতেই ভাবি আমার রুমে ঢুকলো। আমাকে বিছানায় বসিয়ে বলল….

–আমি কি কিছু করেছি রুবেল বলো? ভাবির কি দোষ পেলে বলো? এভাবে দূরে থেকোনা। কয়দিন যাবত দেখছি মনমরা হয়ে বসে থাকো, কি হয়েছে এমন করছো কেন?

-কিছুনা, এমনিই।

–বড্ড বড় হয়ে গেছো না? ভাবিকেও বলবানা! আমি পর কেউ? নিজের ভাইয়ের মতন দেখি তোমায়। সবমসময় নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করি তোমাকে খুশি করার জন্য।

আর তুমিই কিনা দূরে থাকো। ভাবি কষ্ট পায় বোঝনা? কতদিন ধরে ঠিকমতো কথা বলোনা খেয়াল করো? আমার কলিজায় আঘাত লাগে বোঝো? বলো কি ভুল করেছি, ক্ষমা করো তবুও ভাবির উপর অভিমান করে থেকোনা….

আর কিছু বলতে পারেনা ভাবি। উনার গলা ধরে আসে। খেয়াল করে দেখলাম ভাবি কাঁদছে। আমার খারাপ লাগছে ভয়াবহ রকমের খারাপ। মনের অজান্তেই মায়ের সমতুল্য ভাবিকে নীরবে না কতই কষ্ট দিয়েছি। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে।

আমি চোখের জল মুছলাম। ভাবিকে সবকিছু খুলে বললাম। ভাবি বলল…’সবার কথায় কান দিতে নেই, সবাই তোমাকে উল্টাপাল্টা বললেও নিজের বিশ্বাসে অটুট থাকো। আর পারলে খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করো পাগল ছেলে।’ আমি অসহায় দৃষ্টিতে ভাবির দিকে তাকিয়ে বললাম….

–সরি ভাবি।

-কেনো?

–কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমি আর কখনো এমন করবনা।

ভাবি কিছু বলেনা। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে। আমি তাকিয়ে থাকি নির্বিকার। ভাবি উঠে দাঁড়ায়। মুখের হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে….

–পড়তে বসো, আমি এসে পড়া ধরব। না পারলে তোমাদের দুই ভাইকে পিটাবো।

-ভাইয়াকে কেনো?

–দু’টোই খুব বড়লোক হয়েছো তাই।

বলেই ভাবি চলে যায়। মনে হচ্ছে অনেকদিনের জমানোর কষ্ট গুলো আর নেই, সত্যিই নেই। এমন ভাই, ভাবি পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।

এক সপ্তাহ পর একদিন খুব ভোরে চিৎকার চেঁচামিচিতে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। বিষয়টা বোঝার জন্য বাইরে গিয়ে শুনি, রনি নাকি ওর ভাবির সাথে অশ্লীলতা করার চেষ্টা করেছিলো। আর যার ফলে রনির বড় ভাই ওকে মেরেছে। ওর চরিত্র যে বেশ নিচে নেমেছে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে আসলাম। পাপের শাস্তি সবাই পায়। রনিও পেয়েছে। আসুন মন মানষিকতা বদলাই, বড়দের সম্মান করতে শিখি। যারযার প্রাপ্ত সম্মান দিতে শিখি। কথায় আছে…’ব্যবহারই বংশের পরিচয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত