পরী

পরী

আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মা’কে কোনদিনও ঈদে নতুন শাড়ি পরতে দেখিনি। বাবা ছোটখাটো ব্যাবসা করে। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি ঈদের দশ বারো দিন বাকি থাকতে বাবা আমাকে আর ছোটো বোন মিতু কে একহাজার করে টাকা দিলো জামা কিনতে আর মায়ের হাতে দিলো পাঁচশো টাকা মা সে টাকা কিছুতেই নেবে না করুণ মুখে বাবাকে বললো, আমার শাড়ি লাগবে না আলমারিতে অনেক গুলো শাড়ি আছে না পরে পরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওগুলো পরা শেষ হলে তারপর নতুন শাড়ি কিনবো তুমি বরং ঐ টাকা দিয়ে একটা সার্ট কেনো। বাবা আঁতকে উঠে বললো, আমার যে সার্ট আছে তাই পরে শেষ করতে পারি না,নতুন সার্টের কোন দরকার নেই। বাবা মা’র কথা শুনে আমি আর মিতু ঠোঁট টিপে হাসি , দাদাজানের আমলের একটা পুরনো আলমারি আছে তাতে সর্বসাকুল্যে মার পাঁচ থেকে ছয়খানা শাড়ি আছে আর বাবার আলমারিতে কোন সার্ট নেই তিনটি সার্ট সবসময় পরে।

বাবার জোরাজুরির কাছে হার মেনে মা কে পাঁচশো টাকা নিতে হলো।আমি, মিতু আর মা ঈদের জামা কিনতে বাজারে গেলাম। বাজারে ঢুকেই মা প্রথমে বাবার জন্য একটা সার্টের পিস কিনলো তারপর কুড়ি টাকা দিয়ে একটা সুন্দর রংয়ের লিপস্টিক কিনলো মায়ের লিপস্টিক খুব পছন্দ। বাকি টাকা আমার আর মিতু কে দিয়ে বললো, মা গো জামা একটু কম দামে নিয়ে, একজোড়া নতুন জুতো কেনো। ঈদের দিন বাবা নামাজ পড়ে ফেরার আগেই মা কসকো সাবান দিয়ে গোসল করে পুরনো শাড়ি ইস্ত্রি করে পরে, মুখে হালকা করে পাউডার আর চোখে কাজল দিলো আর ঠোঁটে দিলো নতুন লিপস্টিক।

এই অল্প সাজে মা’কে যে কি সুন্দর লাগছে ! বাবা নামাজ পড়ে ফেরার সাথে সাথে মা টুক করে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে লাজুক হেসে বললো দেখো তো রিতুর বাবা আমাকে কেমন লাগছে? বাবা অবাক হয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে বললো,ও আল্লাহ এতো একদম পরী ও রিতু এই পরী কি ভুল করে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে! মা লজ্জায় গোলাপি হয়ে বললো, মেয়েদের সামনে কি যে বলো!

মায়ের বিয়ের সতেরো বছর পর মা ঈদে নতুন শাড়ি পরে আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি।আমাদের এক আত্মীয় খুব বড়োলোক ঢাকায় থাকেন উনি ঈদে লোক মারফত আমাদের জন্য জামা মা’র জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য সার্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন । শাড়ি হাতে নিয়ে মা’র চোখ খুশিতে চকচক করছে শাড়ি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে মায়ের মুখ কালো হয়ে গেল।আমরা দু বোন কিছুই বুঝলাম না। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে নতুন কাপড়গুলো দেখতে দেখতে বাবার চোখ ছলছল করে উঠলো, আমাকে ডেকে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা আমার হাতে দিয়ে বললো, রিতু তোর মা’কে নিয়ে এক্ষুণি বাজারে যেয়ে একটা নতুন শাড়ি কিনে আনবি। মা হাহাকার করে উঠলো আমার নতুন শাড়ি লাগবে না এতোগুলো টাকা কি জন্য নষ্ট করবা?

বাবা রেগে উঠে বললো একদম চুপ, ঈদে শাড়ি না কিনে নিজের পুরনো শাড়ি পরে খুশি মনে ঈদ করো আমি মেনে নিয়েছি তাই বলে আত্মীয়ের দেওয়া পুরনো শাড়ি পরে ঈদ করবা সেটা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না। আমি আর মিতু অবাক! আত্নীয় মা’কে পুরনো শাড়ি দিয়েছে! আমরা দুই বোন মা’কে সাথে নিয়ে শাড়ির দোকানে যেয়ে সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে হালকা নীল রংয়ের পাড় বান্ধানো টাঙ্গাইল শাড়ি কিনলাম।

ঈদের দিন নীল শাড়িতে মা’কে যে কি সুন্দর লাগছে! বাবা মুগ্ধ গলায় বললো ও রিতু মিতু তোর মা তো দেখি একদম নীল পরী, মনে হচ্ছে এক্ষুণি পিঠে দুটো ডানা গজাবে আর তোর মা আকাশে উড়ে বেড়াবে! এরপর থেকে মা প্রতি ঈদে নীল শাড়িটাই পরবে।আমরা দু বোন বুঝতাম মা’র নতুন শাড়ি খুব প্রিয় কিন্তু আমাদের কথা ভেবে মা নিজের জীবনের সমস্ত শখ আহ্লাদ বাদ দিয়েছে। আমরা দুই বোনই পড়াশোনায় ভালো বাবা অনেক কষ্ট করে পরিশ্রম করে আমাদের পড়াশোনা করিয়েছে।

পড়াশোনা শেষে এখন আমরা দুবোন অনেক ভালো বেতনের চাকরি পেয়েছি। ঈদে মা’র জন্য দশ বারোটা করে নতুন শাড়ি কেনা কোন ব্যাপার না। ছুটিতে আমি আর মিতু বাড়ি এসে দেখি মা সেই নীল শাড়ির কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতে আমি ,বাবা আর মিতু আলোচনা করে ঠিক করলাম এবার ঈদে মা’কে অন্য রকম উপহার দেবো।

ঈদের ছুটিতে দুই বোন বাড়ি এসেছি বাবার সাথে চোখে চোখে কথা হলো বাবা চোখ বন্ধ করে মাথা কাত করে জানালো সব কিছু ঠিক আছে। দুই বোন মা’র গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,মা আমাদের সাথে একজায়গায় চলো। মা অবাক হয়ে বললো, এই মাত্র বাড়ি এসে আবার কোথায় যাবি? বলা যাবে না তুমি চলো, প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছি, খানিক পরে মায়ের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে বললাম, সামনে তাকিয়ে দেখো মা, এইটা তোমার উপহার পছন্দ হয়েছে?

মা অবাক হয়ে দেখছে তার সামনে একটা শাড়ির দোকান আর দোকানের সাইনবোর্ডে তার নিজের নাম লেখা “কল্পনা শাড়ি বিপনি ” মায়ের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কোনরকমে বললো আমার নামে শাড়ির দোকান কিনেছিস? মা শুধু তোমার নামে না এই শাড়ির দোকানটাই তোমার।তোমার যে শাড়িটা পছন্দ হবে সেটাই পরে বাবার সামনে দাঁড়াবে। মা ফিতে কেটে দোকানে প্রবেশ করে খুশিতে বাচ্চা মেয়েদের মতো একটা একটা করে শাড়ি বের করে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে আবার রেখে দিচ্ছে।

মা উপহার পছন্দ হয়েছে? বাবা এখন পরিশ্রম করতে পারে না সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগবে না মাঝে মাঝে দোকানে বসবে।দুই জন কর্মচারী আছে তারাই সব করবে। তুমি ও বাবার সাথে মাঝে মাঝে দোকানে আসবে পছন্দ মতো শাড়ি নেবে।

আমরা সবাই দোকানে বসে আছি, এক দু’জন করে ক্রেতা আসছে টুকটাক বিক্রি হচ্ছে , মা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। অল্প বয়সী শ্যামলা রঙের এক মহিলা চার পাঁচ বছরের মেয়ের হাত ধরে দোকানে ঢুকলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ঘরের বউ। শাড়ি দেখতে দেখতে একটা শাড়ি তার খুব পছন্দ হলো। দামাদামি করে শেষ দাম হলো দুইহাজার টাকা। মহিলা শাড়ি টা সরিয়ে অন্য শাড়ি দেখছে কিন্তু ঘুরে ফিরে ঐ শাড়িটাই ধরছে। শেষে বললো পছন্দ হচ্ছে না বলেই উঠে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ মা বললো একটু দাঁড়াও মেয়ে।ঐ শাড়িটা নিয়ে যাও। কিন্তু আন্টি আমার কাছে অতো টাকা নেই। তোমাকে কোন টাকা দিতে হবে না ঐ শাড়ি টা আমি তোমাকে ঈদে উপহার দিচ্ছি। মহিলা অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার দেওয়া শাড়ি নেবো কেন? মা হালকা হাসি দিয়ে বললো আমার এই দুই মেয়ের মতো তুমি আমার আরেকটা মেয়ে তাই।

বাবা বলে উঠলো, মা গো উনি হচ্ছেন মায়াপরী, মায়াপরী ভালোবেসে যে উপহার দেয় নিতে হয়। মেয়েটি ছলছল চোখে বাবা মা’কে সালাম করে শাড়ির বাক্স নিয়ে চলে গেল। মা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এভাবে শাড়ি দিলাম বলে তুই কি রাগ করেছিস রিতু? মা এইটা তোমার দোকান তোমার যা খুশি করতে পারো, তোমার আনন্দই আমাদের কাছে বড়ো। মা মিষ্টি হেসে বাবাকে বললো,আচ্ছা ঈদের দিন এই মেয়েটা যখন পছন্দের নতুন শাড়ি পরে ওর স্বামীর সামনে দাঁড়াবে তখন ওর স্বামী কি বলবে এইটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে।

শোনো মায়াপরী স্বামী স্ত্রীর ভিতর যদি সত্যি কারের ভালবাসা থাকে তাহলে স্ত্রী যতোই দেখতে কুৎসিত হোক না কেন স্বামীর চোখে সে পরীর মতো সুন্দরী। এই মেয়ের স্বামী যদি সত্যি তার স্ত্রী কে ভালবাসে তাহলে বলবে, ও আল্লাহ তোমাকে তো পরীর মতো সুন্দর লাগছে! আমি অনেক ভাগ্যবান তাই তোমার মতো পরী কে পাশে পেয়েছি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত