দুই তীর এক নদী

দুই তীর এক নদী

আমার বড় ভাসুর হঠাৎ বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন।মেয়েটার বয়স উনিশ কি বিশ হবে।আমার থেকেও ছোট।ভাসুরের নাম সজল।আমি ভাইজান বলে ডাকি।ভাইজান যে আগে বিয়ে করেননি তা কিন্তু না।ভাইজানের আগের একটা বউ ছিল।আমার যখন উৎসের সাথে বিয়ে হয় তখন ভাবি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা।ভাবি অসুস্থ থাকায় বিয়েতে যেতে পারেন নি।শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার পরেই বুঝলাম বাড়ির লোকজন মন্দ নয়।শ্বাশুড়িমা আমাকে ভাইজানদের ঘরে নিয়ে গেলো।ভাবি গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল।

শ্বাশুড়িমা আদুরে কন্ঠে বড় বউমা বলে ডাকায় তার হুস ফিরলো।তারপর আমার সাথে ভাবির পরিচয় করিয়ে দিলেন।পরের দিন সকালে ভাবি আমার ঘরে চা নিয়ে গেলেন।আস্তে আস্তে আলাপ হলো।বাড়ির সবার সাথেই মোটামুটি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।কিন্তু আমি ভাবি আর আমার শ্বাশুড়ি ছিলাম বন্ধুর মতো।তিনজন এক জায়গায় হলেই হাসি-ঠাট্টার শেষ থাকতো না।আস্তে আস্তে ভাবির ডেলিভারির দিন এগোতে থাকলো।ভাবি একদিন আমায় কাছে ডেকে বললো -“বোনরে আমার আয়ু মনে হয় শেষ।আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখিস।”

আমি সেদিন ভাবির মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়েছিলাম।তারপর হু হু করে কাদতে কাদতে ভাবির কোলে লুটিয়ে পরেছিলাম।ভাবি বারবার বলছিল- “পাগলি মেয়ে।কাদিস কেন?আমি চলে গেলে তোকেই এই পুরো সংসারের হাল ধরতে হবে।”আমি সেদিন ভাবিকে ধরে বড্ড কেদেছিলাম।ভাবি ভাবির কথা রেখেছে।মুনিয়াকে জন্ম দিয়ে ভাবি সেই দিনেই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে।মুনিয়ার জন্মের পর থেকে ভাইজান সারাদিন মুনিয়াকে নিয়ে থাকে।মাঝে মাঝে ডুকরে কেদে ওঠে।পুরুষ মানুষের কান্না বড়ই আঘাত করে বুকে।শ্বাশুড়িমা ভাইজানকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।কিন্তু ভাইজান করেন নি।রুদ্ধ কণ্ঠে সবসময় একটা কথাই বলেছেন মুনিয়াই তার সব।তাকে ঘিরে তিনি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন।

কিন্তু সকাল বেলায় আজ ভাইজান বিয়ে করে এনেছেন।শ্বাশুড়িমা রেগে গেলেন।এই দীর্ঘ সংসারের জীবনে তাকে খুব কমই রাগতে দেখেছি।তিনি পরিষ্কারভাবে বলে দিলেন ওই মেয়ের জায়গা হবে না বাড়িতে।আমি লুকিয়ে ভাইজানের নতুন বউকে ঘরে তুললাম।মুনিয়া তখন আমার শাড়ির আচল ধরে লুকিয়ে ছিল।নতুন বউকে ঘরে নিয়ে গেলাম।ভাবির ঘরে আজ থেকে অন্য কেউ থাকবে ভেবেই আমার বুক কেপে উঠলো।তবুও হাসি মুখে নতুন বউকে ভাইজানের ঘরে নিয়ে গেলাম।

মুনিয়াও গুটি গুটি পায়ে আমার আচল ধরে আমার সাথে আসলো।নতুন বউটা হঠাৎ মুনিয়াকে কাছে ডাকলো।মুনিয়া আমার মুখের দিকে তাকালো।আমি অস্ফুট স্বরে বললাম যাও।নতুন বউটা মুনিয়ার সাথে গল্প শুরু করলো।কয়েক মূহুর্তেই মুনিয়াকে আপন করে নিল।আমি বউটাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার নাম কি।বউটা বললো তার নাম জান্নাতুল ফেরদৌস অথৈ।আমি মুনিয়াকে অথৈয়ের কাছে রেখে শ্বাশুড়িমার ঘরে গেলাম।যদিও অথৈ সম্পর্কে আমার বড় ভাবি হয় কিন্তু বয়সে অনেক ছোট।শ্বাশুড়িমায়ের ঘরে গিয়ে দেখলাম আবহাওয়া মোটামুটি ঠান্ডা।

ধীরে ধীরে সময় পার হলো।অথৈ আমাকে বুবু বলে ডাকে।আমি ওকে বোন বলে ডাকি।সংসারটা আপন করে নিয়েছে মেয়েটা। শ্বাশুড়িমা আমি আর অথৈ পুনরায় আগের মতো আনন্দে মেতে উঠি ঠিক যেমন ভাবি বেচে থাকতে হতো।মুনিয়াও অথৈকে এখন মা বলে ডাকে।এতো আনন্দের মাঝে আমি কখনো ভাইজানকে বা অথৈকে তাদের হঠাৎ বিয়ের কারণটা জিজ্ঞেস করি নি।থাক না কিছু কথা গোপন।দরকার কি আনন্দের সময় গুলোকে নষ্ট করার।

আমিও আজ অন্তঃসত্তা। আজ নয় মাস।আর কিছুদিন বাকি ডেলিভারির।অথৈকে কাছে ডেকে বললাম আমি মারা গেলে মুনিয়ার মতো আমার বাচ্চাটাকেও যেন দেখে রাখে।অথৈ ও আমার মতো ডুকরে কেদে উঠলে।ঠিক যেমন আমি ভাবিকে জড়িয়ে কেদেছিলাম।হেসে বললাম-“পাগলি বোন।কাদিস কেন?আমি মরে গেলে তোকেই তো সংসারের হাল ধরতে হবে।” অথৈরের কান্না তাতে আরও বেড়ে গেল।অথচ আমিও মনে প্রাণে চাই এবারের গল্পটা যেন ভিন্ন হয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত