‘আপনার কাছে খুব দ-দরকারে এসেছি। আমাকে হে-হেল্প করতেই হবে।’
আমি রাজকুমারের মুখের দিকে তাকালাম। ঘামছে। রুমাল ঘষছে মুখে। বললাম, ‘বসুন আগে। ঠান্ডা হন। শুনছি আপনার কথা।’
আমার চেম্বারে আগে ছিল ফ্যান। এসি বসেছে বছর দেড়েক হয়ে গেল। মক্কেলদের কাছে আমার, মানে শমীক চ্যাটার্জির ওজন বেড়েছে। তাদের বসার জন্য টেবিলের উল্টো দিকে দুটো চেয়ার রাখা থাকে। তারই একটা টেনে বসে পড়ল রাজকুমার। ‘একটু জল পাওয়া যাবে?’
এক কোণে কম্পিউটারের সামনে বসে দলিল টাইপ করছে সঞ্জয়। পরশু দুটো রেজিস্ট্রি আছে। একটা দানপত্র, অন্যটা ফ্ল্যাট। পরের কাজটা চলছে। এরপর প্রিন্ট দেবে। চেম্বারেই জলের বোতল, গেলাস রাখা থাকে। অনেকেই এসে জল চায় মাঝেমধ্যে। সঞ্জয়কে জল দিতে বললাম।
জল খেয়ে, গেলাস নামিয়ে আবার মুখ মুছল রাজকুমার। কিছু একটা হয়েছে। টেনশনে আছে। এমনিতেই কথায় সমস্যা আছে। ব্যাকুল বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লে যে ওর কথা আটকে যায় তা মনে আছে আমার। তবে কত মানুষের শরীরে কত সমস্যা থাকে। তা আঙুল দিয়ে না দেখানোই ভাল। আমরা কেউই তো আর কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো নই। বরং ভাবছিলাম, ওদের সেই ফ্ল্যাট নিয়ে কিছু হলো না কি? নিজেদের জায়গা পেয়ে গিয়েছিল। সেখানেই আছে নিশ্চয়ই।
এখন চেম্বারে কোনও মক্কেল নেই। শনিবার সন্ধের মুখে কিছুটা ফাঁকা থাকে। খানিকটা হালকা চালেই বললাম, ‘অনেক দিন পরে এলেন। আপনি কি সেই যা করছিলেন তা-ই চালিয়ে যাচ্ছেন? আপনার মা কেমন আছেন?’
ছটফটানি কমল না রাজকুমারের। নড়েচড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার যেমন ছিল তেমন, মা ভাল আছে। আপনি শুনবেন কি আমার কথাটা?’
‘আচ্ছা বলুন।’
‘একটা ডি-ডিভোর্স করিয়ে দিতে হবে।’
অবাক হলাম। রাজকুমার আমার কাছে কেস নিয়ে এসেছে! ‘ডিভোর্স? কার? আপনার না কি?’
‘না না, আমার কী করে হবে! আমি তো বিয়েই করিনি। শুনুন না, ই-ইয়ার্কি নয়, সিরিয়াস ব্যাপার।’
‘সে তো নিশ্চয়ই। বিয়ে যেমন সিরিয়াস, ডিভোর্সও তেমনি।’
‘দূর, আপনি শুনছেন না। আমার পরিচিত একটি মেয়ে আছে। আমাদের পাড়াতেই থাকে। তার ডি-ডিভোর্স করিয়ে দিতে হবে।’
আমি চেয়ারে পিঠ ঠেকালাম। ‘ও, এই ব্যপার। আপনি এমন চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, আমি ভাবলাম আপনার নিজেরই – ঠিক আছে, বলুন। ওই যাঁর কথা বলছেন তাঁর বিয়ে হয়েছে কতদিন? তিনি কি হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকেন?’
‘না, থাকে না। বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেকের বেশি। একটা মেয়েও আছে। তার এই তিন বছর হবে বোধহয়। তাকে নিয়ে শ্রেয়সী এখন বাপের বাড়িতে থাকে।’
বুঝলাম রাজকুমারের পরিচিত মেয়েটির নাম শ্রেয়সী এবং রাজকুমার নিজে কিছুটা থিতু হয়েছে। কারণ, আপাতত তার কথা আটকাচ্ছে না। জানতে চাইলাম, ‘বরের থেকে আলাদা আছেন কতদিন?’
‘বছর খানেক তো হয়েই গেল।’
‘ঠিক আছে। অন্তত এক বছর আলাদা না থাকলে ডিভোর্স ফাইল করা যায় না। এখন কি ওঁরা মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইছেন?’
রাজকুমার হাবা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানে?’
‘মানে মেয়েটি আর তাঁর হাজব্যান্ড দু’জনেই রাজি আছেন?’
রাজকুমার মাথা নাড়ল। ‘না, ওর বর রাজি নেই। সে জানেই না কিছু।’
‘ও, তা হলে কি মেয়েটি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করতে চান? মামলা?’
একরকম আঁতকে উঠল রাজকুমার। ‘না না, ওসব কিছুই করা যাবে না। জাস্ট ডি-ডিভোর্সটা করিয়ে দিতে হবে।’
এবার আমার রাগ হয়ে গেল। এই ছেলেটা বরাবরই এরকম। কী যে বলে তার মাথামুণ্ডু নেই। বললাম, ‘হাজব্যান্ডকে জানাব না অথচ তাঁর ওয়াইফের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাবে! এ কি চুপিচুপি ব্যাপার নাকি!’
কথাটা যেন লুফে নিল রাজকুমার। ‘এই তো আসল কথাটা বলেছেন। চু-চুপেচাপেই করতে হবে ব্যাপারটা।’
আমি আর পারলাম না। আরও রাগ সামলাতে সিগারেট ধরাতেই হলো। ধরিয়ে মনে পড়ল রাজকুমারও খায়। প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। অনেকক্ষণ খায়নি হয়তো। ধরানোর পর যেভাবে ধোঁয়া ছাড়ল তাতে মনে হলো আরাম পেয়েছে। টেবিলের ওপর অ্যাশট্রেটা তুলে ওর দিকেই ঠেলে দিয়ে বললাম, ‘কী বলতে চান পরিষ্কার করে বলুন। বুঝতে পারছি না।’
যেন অবাক হয়ে তাকাল রাজকুমার। ‘বললাম তো। ওর বরকে না জানিয়ে ডিভোর্স করানো যায় না?’
‘না, যায় না। মামলার কথা ছেড়েই দিলাম। মিউচুয়াল হলেও দু’জনকেই কোর্টে অ্যাপিয়ার করতে হয়। লুকিয়ে কিছু হয় না। আর তা ছাড়া লুকোনোর কথা উঠছে কেন সেটাই তো মাথায় আসছে না।’
রাজকুমারের মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। লিকলিকে ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে। ঘাম শুকিয়ে গিয়েছে ওর। সিগারেট থেকে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে।
একটু পরে মুখ তুলে বলল, ‘বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই বরের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়েছিল। বাবার একমাত্র মেয়ে। মা নেই। পড়াশোনাটা তেমন মন দিয়ে করতে পারেনি, তবে গ্র্যাজুয়েট। শ্রেয়সীর বাবা খুব বড় সরকারি ক-কন্ট্রাক্টার, বুঝলেন। ছেলেটা ওকে ভুলিয়েভালিয়ে বিয়ে করে। ভেবেছিল বোধহয় রাজকন্যা আর রাজত্ব একসঙ্গে পাবে। বাবা আটকাতে পারেনি। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভাল। শেয়ার মার্কেটে কী যেন করত বলেছিল। পরে দেখা গেল তেমন কোনও রো-রোজগারই নেই। তাই নিয়ে অশান্তি। সংসার চলে না। তারমধ্যেই আবার এক-দেড় বছর পরেই ওর মেয়ে হয়। তখন অ-অশান্তি আরও বাড়ে। তবু কিছু দিন শ্রেয়সী ওখানে ছিল। তারপর আর পা-পারেনি। বিয়ের পর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। এইসব হওয়ায় শেষে বাবার কাছেই এসে ওঠে -’
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে আমি থামালাম ওকে। ‘এই গল্প শুনে আমি কী করব? আসল কথাটা বলুন।’
‘বলছি বলছি।’ রাজকুমারও ফেলে দিল সিগারেট। কথা বলতে গিয়ে টানতে পারেনি তেমন। ‘শ্রেয়সী এখন একটা নার্সারি স্কুলে পড়ায়। ওর বাবাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানেই মেয়েকে ভর্তিও করিয়েছে। চাকরি হওয়ার সময় বলেছিল ওর ডিভোর্সের মামলা চলছে। তবে ওরা হাজব্যান্ডের নাম চেয়েছিল। শ্রেয়সী আ-আসল নামটা না দিয়ে অন্য একটা নাম দিয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল পরে বলে দেবে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাই বলেওছিল। এখন স্কুল ব-বলছে ডিভোর্সের কাগজ জমা দাও।’
‘অন্য কারও নাম দিয়ে দিয়েছিল! এরকম তো জম্মে শুনিনি। মাথায় আছেটা কী! কার নাম দিয়েছিল? আপনার না কি?’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে রাজকুমার বলল, ‘না না, আ-আমার কেন হবে। আমি তো ওর কেউ নই। ওই আজেবাজে একটা কিছু।’
বললাম, ‘অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে। তা ছাড়া এরকম মিথ্যে বললে তো নিজেই ফেঁসে যাবে। গেছেও। ওকে বলুন বরের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাতে ডিভোর্সটা দেয় সেই ব্যাপারে কথা বলুক।’
রাজকুমার বলল, ‘ওর বর ডিভোর্স দেবে না। বলেছে ওকে নাকি জ্বালিয়ে ছাড়বে। আর কথাই বা বলবে কী করে? স্কুলের খাতায় তো ওর বরের নাম নেই। ফ-ফল্স একটা -’
এতক্ষণ ধরে এসব কথা শুনে বিরক্তি লাগতে শুরু করেছিল। বললাম, ‘আমার কাছে এসেছেন কেন? আমার কিছু করার নেই এতে।’
আপনি ডিভোর্সটা করিয়ে দিতে পারেন না?’
সত্যি সত্যি রেগে গেলাম এবার। ‘কী বলছেন যা তা! যে লোকটা আছে তার নাম নেই, যার নাম আছে সে লোক নেই। ডিভোর্স হবে কার সঙ্গে? নামের সঙ্গে?’
‘ওই না-নাম নিয়ে একজন যদি কোর্টে যায়, তা হলে হতে পারে না?’
কোনও বিয়েবাড়িতে কেউ যদি ল্যাংটো হয়ে শুধু একটা টাই পরে চলে যায়, তাহলে তাকে দেখেও হয়তো এতটা অবাক হতাম না যতটা অবাক হয়ে আমি রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এ বলে কী!
সঞ্জয়ও টাইপ করতে করতে থেমে গিয়েছে কথাটা শুনতে পেয়ে। আড়চোখে তাকাল। আমি যেন ট্রাফিক সিগন্যাল। হাসিটা তাই আটকে রেখেছে।
রাজকুমার খানিকটা প্রশ্ন, খানিকটা কাকুতি নিয়ে টেবিলে কনুইদুটো রেখে গলাটা বাড়িয়ে দিল। ‘বলুন না, হয় না?’
কী উত্তর দেব? পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এক প্রোমোটার এই রাজকুমার রায়কে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। অশোকনগর কলোনিতে তাদের দেড় কাঠা জমি আছে। মাকে নিয়ে একটা এক কামরার ঘরে থাকে রাজকুমার। সেখানে প্রোমোটার ফ্ল্যাট তুলবে। গোড়ার দিকে এসব ব্যাপারে যেমন হয় তেমনই। দলিলপত্র দেখে দেওয়া, এগ্রিমেন্টের, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ড্রাফট বানিয়ে দেওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি। তবে তখন জানতে পারি রাজকুমার মায়ের সঙ্গে থাকলেও তার বাবা কিন্তু বেঁচেই আছেন। তিনি অনেক দিন আগে বউ-ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে অন্য সংসার ফেঁদেছেন। যাতে বিরক্ত হতে না হয় তাই রিফিউজি কলোনির জমিটা বউয়ের নামে দানপত্র করে দিয়েছেন।
দু-তিন বার সিটিংয়ের পরে রাজকুমার একা একাই আমার কাছে আসতে শুরু করল। তার খুব সন্দেহ, প্রোমোটার তাদের ঠকাতে পারে। যা যা দেওয়ার কথা বলবে তা পাওয়া যাবে না শেষপর্যন্ত। সে বলতে থাকল, ‘আপনি বাবুলের উকিল নন, আমাদের উকিল। আমাদের ভালমন্দের দায়িত্ব আপনার। আপনি যা বলবেন আমি বি-বিশ্বাস করে তা-ই করব। মা তো জীবনে কিছু পায়নি, দেখবেন শেষবয়েসে যেন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু না চ-চলে যায়।’
ভেবেছিলাম, অতটুকু জমি দিয়ে আর কী হাতিঘোড়া মিলবে। খুব জোর কিছু টাকা আর দু’কামরার ফ্ল্যাট। রাজকুমার আমারই বয়েসি হবে, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। কী করে? না ফোটোগ্রাফার। কোন একটা স্টুডিওয় যাতায়াত আছে। তা ছাড়া খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে ছবি দেয়। ছাপা হয়। ওকে দেখে মনে হত – যেখানে ছবি তুলতে যায় সেখানে ঢুকতে গিয়ে বেগ পেতে হয় বেশ। তড়বড় করে কথা বলতে গিয়ে একে কথা আটকায়। মুখটা মাপে লম্বাটে, কিন্তু দশ বছরের বাচ্চার মতো। সেইজন্যই হয়তো বড় চুল, মোটা জুলপি আর গোঁফ। ফুলহাতা শার্ট দিয়ে ল্যাগব্যাগে হাতগুলো ঢেকে রাখে। তবে তার অন্য কারণও আছে। চিবুকের নীচে, গলার কাছে ছুলি। গায়ের আরও জায়গাতেও থাকতে পারে। জামাটা যতই কায়দা করে ইন করুক না কেন, ঢুকে যাওয়া পেট, সরু কোমর কি তাতে ফাঁপানো যায়!
রাজকুমার নামটা ছোটবেলায় রাখা হয়ে থাকবে। যেমন সকলেরই হয়। যে রেখেছিল সে পরে দেখলে নিজের খরচে এফিডেভিট করে বদলে দিত নিশ্চয়ই।
আমাদের বাড়ির নীচেই একটা ঘরে আমার চেম্বার। একদিন মেয়েকে দেখে রাজকুমার বলল, ‘আপনার মেয়ের ফটোজেনিক ফেস। দারুণ ছবি উঠবে!’
ওর ছবি তোলায় আমার মোটেই বিশ্বাস ছিল না। তবু এসে অনেকক্ষণ ধরে তুলল। যখন সেগুলো হাতে এল তখন মনে হল, এই একটা ব্যাপারে আমি ভুল ভেবেছিলাম। রাজকুমার ওস্তাদ ফটোগ্রাফার।
তবে ওর ব্যাপারে আমি ভুল ভাবলেও প্রোমোটারের ব্যাপারে ও ঠিকই ভেবেছিল। বাবুল নামের সেই ছেলেটা এখন আর আমার কাছে আসে না। কিন্তু তখন সে রাজকুমারদের খুব ভুগিয়েছিল। প্রায় ন’মাস জায়গাটা ফেলে রাখল। তারপর বাড়ি তুলল দেড় বছর ধরে। তারও পরে দেখা গেল রাজকুমারদের ফ্ল্যাটের দেওয়াল জল শুষছে, কল খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কমোডের ফ্লাশ ফেটে যাচ্ছে, ইলেকট্রিক ওয়ারিংয়ে শর্ট সার্কিট হয়ে রাজকুমার শক খেয়েছিল একবার। এমনকি ওরা টাকাও পেয়েছিল কয়েক খেপে।
আমি বাবুলকে বললাম, ‘কেন এরকম করলেন? গোবেচারা দুটো মানুষ!’
সে বলল, ‘আরে ছাড়ুন তো উচ্চিংড়েটার কথা।’
তারপর প্রোমোটার বেপাত্তা। রাজকুমার আমার চেম্বারে এসে দেখা করে যায়। মক্কেল থাকলে বাইরে পায়চারি করে আর সস্তার সিগারেট খায়। আমার জন্য আমার ব্র্যান্ড কিনে বুকপকেটে রাখে। আমি ভাবি মা-ছেলের চলে কিসে? কয়েকটা অনুষ্ঠানবাড়িতে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তবে আমার কাজের ঠেলায় আস্তে আস্তে রাজকুমার সরেও যেতে থাকে। না এলে দেখা হবে কী করে। আজ এতদিন বাদে সে ফুঁড়ে উঠেছে। তাও এই কারণে!
বললাম, ‘আপনি কী বললেন তা জানেন? ওই ফল্স নামের লোক সেজে আপনি কোর্টে গিয়ে মেয়েটিকে ডিভোর্স দেবেন? তা হলে তো আপনার ওই নামই হয়ে থাকবে আর বিয়ে না করেও একটি ডিভোর্স!’
রাজকুমার অবলীলায় বলল, ‘থাকুক না। আসলে তো ওই নামে কেউ নেই।’
বলতে বাধ্য হলাম, ‘আমি যা বলেছি সেটা মজা করে। ওটা হবে না। কোর্টে পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। ভোটার আইডি বা অন্য কিছু। আরও অনেক কাগজ লাগে।’
মাথা ঝাঁকাল রাজকুমার। ‘সে আমি জানি না। আপনি ম্যা-ম্যানেজ করবেন।’
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আরে, পাগল নাকি! আমি কী করে ম্যানেজ করব? আর করতে যাবই বা কেন এরকম একটা কাজ? আপনি কেন এটা চাইছেন বলুন তো? কিসের স্বার্থ আপনার?’
রাজকুমার তেড়েমেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময় এক মক্কেল ঢুকে পড়ায় থেমে গেল। সামনেরটা ছেড়ে দূরের চেয়ারে গিয়ে একটা রোগা পা অন্যটার ওপর পেঁচিয়ে মাথা নামিয়ে গভীরভাবে কী যেন ভাবতে লাগল।
বেশ কিছুটা সময় নিল মক্কেল। জটিল কেস। ঠাকুরপুকুরের কাছে একটা কো-অপারেটিভের মেম্বার হয়ে জমি কিনে ফেলে রেখেছিলেন। এখন খবর পেয়ে গিয়ে দেখছেন পাশের প্লটের লোক এই প্লটটা নিজের বলে দাবি করছেন। একটা খুঁটি পুঁতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন। কো-অপারেটিভও বাধা দেয়নি। মৌজা ম্যাপ ধরে দেখতে গেলে ইনিই ঠিক। কিন্তু কেউ মানছে না। ইনি কো-অপারেটিভ আর ওই লোকটির নামে মামলা ঠুকতে চান।
কাগজপত্র দেখে নিয়ে লোকটিকে ছাড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে আগের চেয়ারটা দখল করল রাজকুমার।
‘দেখুন না, যদি কিছু হয়।’
আমি খুব ধীরেসুস্থে বললাম, ‘যে রাজকুমারীর কথা বলছেন সেই মেয়েটি আপনার কতটা পরিচিত? বিয়ের পর তো অন্য জায়গায় চলে গেছিল। বাবার সঙ্গে যখন যোগাযোগ ছিল না তখন নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গেও ছিল না। আগে কতটা ছিল? ঝেড়ে কাশুন তো।’
রাজকুমার সঞ্জয়ের দিকে তাকাল একবার। প্রিন্ট দিয়েছে সে। প্রায় নিঃশব্দে লেজার প্রিন্টার উগরে দিচ্ছে কাগজ। মুখ ফিরিয়ে রাজকুমার নিচু গলায় বলল, ‘আমি লেখাপড়ায় ভালই ছিলাম, বুঝলেন। তবে ওই হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করা পর্যন্ত। তারপর ভাল থাকতাম কিনা জানি না। ওই সময়েই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল তো। পড়াটা বন্ধ হয়ে গেল। কাজের ধান্দায় ঘু-ঘুরতে থাকলাম। তার আগে শ্রেয়সীর সঙ্গে কথা হতো। মাধ্যমিকের সময় হেল্প করেছি। ওর অনেক টিচার ছিল কিন্তু পড়া সামলাতে পারত না। পরে ওরও আর্টস। নোট্স দিতাম, অ্যানসার লিখে দিতাম। ও আমাদের বাড়ি আসত না, আমিই যেতাম। এই আর কী। পরে যখন এই ঘটনাটা ঘটল, ও ফিরে এল, তখন আবার কথাবার্তা হয়েছে।’
আমি ছাড়ব না। আগের কথাটাই তুললাম। ‘ধরুন ডিভোর্সটা হলো। আপনিই ওর সেই ফিকটিশাস নামের লোক হয়ে কোর্টে গেলেন। আপনার স্বার্থটা কী?’
রাজকুমার হাত ওল্টাল। ‘আমার কী স্বার্থ! একটা চেনা মেয়ে ফেঁসে গেছে, বাচ্চাটাও রয়েছে, চাকরিটা চলে যাবে, মেয়েটাকেও স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে। যদি উদ্ধার পায় -।’
‘ও, সে উদ্ধার পেল আর আপনার বিয়ে হলো না কিন্তু ডিভোর্স হয়ে রইল! নিজেও জালিয়াতি করলেন আর আমাকেও জড়ালেন। বাঃ। আসল কথাটা বলুন তো। ও কি এর পরে আপনাকে বিয়ে করবে? না কি আপনি সেরকম কিছু ভাবছেন? তা হলে কিন্তু সত্যিকারের বরের সঙ্গে ডিভোর্স হতে হবে।’
মুখ থেকে ‘হুঁ’ শব্দের সঙ্গে হাসি ছিটকে বেরোল রাজকুমারের। চেয়ারে হেলান দিতে গিয়ে সে কুঁজো হয়ে গেল। ‘ও আমাকে বিয়ে করবে! বাবা আরেকজনের সঙ্গে অন্য জায়গায় থাকে, আমি যা কাজ করি তাতে নিজেদেরই কোনওমতে চলে, আমার চেহারার এই ছিরি! তার ওপর তোতলা। ওর পাশে আমাকে রাখা যায়? ওদের সঙ্গে আমাদের এ-একটাই মিল – ওরাও রিফিউজি, আমরাও রিফিউজি। কিন্তু তাতে তো আর বিয়ে হয় না!’
আমি আর আড়াল না রাখলেও গলা নামিয়ে বললাম, ‘তাহলে সত্যি করে বলুন তো, কেন করতে চাইছেন ওর জন্য? আপনি ওকে ভালবাসতেন? এখনও ভালবাসেন? ওকে বলুন তা হলে।’
রাজকুমার মাথা নামিয়ে বসে রয়েছে। টেবিলের ওপর রাখা পেপারওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। বুঝতে পারছি পা বদল করল একবার। তারপর মুখ তুলল। ‘ও আমাকে ভালবাসে না। কোনওদিনই বাসেনি। আমিই শুধু শুধু -’
চোখ সরিয়ে নিলাম। র্যাকের মোটা মোটা বইগুলোর দিকে তাকালাম। টেবিলে রাখা কাগজ, দলিল, স্ট্যাম্প পেপারগুলো দেখলাম। তারপর বলতেই হল, ‘আমার কিছু করার নেই। আইনে এটা হয় না।’
উঠে দাঁড়াল রাজকুমার। ‘একেবারেই হয় না, না? আচ্ছা, আসি তাহলে। আপনার সময়টাই নষ্ট করলাম।’
চেম্বারের দরজা খুলে সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আমার মনে হল – আমি আরও একটা ব্যাপারে ভুল ভেবেছিলাম। ওর নামটা যে-ই রেখে থাকুক, ঠিকই রেখেছে। রাজকুমার কথাটা শুনলেই মনে হয় জিতবে। রূপকথা আমাদের তা-ই শিখিয়েছে। তা তো নয়। হেরে গেলেও সে রাজকুমার।