আন্দামান

আন্দামান

মা,
যেদিন তোমার বাঁধন ছিড়ে চলে এলাম অথৈজলে; দুর্গম যাত্রায়-তোমার তৃষালু মুখে তুলে দিতে অমৃতফল।
সে আশা আজ যেন অরণ্যবেষ্টিত বন্দী স্রোত। প্রতিটি ক্ষণ তোমাকে ভেবে ভেবে অশ্রুজলে -বুক ভাসিয়েছি,

সমুদ্রের নোনাজলে মিশিয়ে দিয়েছি ভাষাবোধ। সেদিন অচেতন নিদ্রায় স্বপ্নে দেখি তুমি চিরবিচ্ছেদ ধরণী থেকে।

কেঁদে কেঁদে নিদ্রা ভেঙে গেলো, তোমাকে এক নজর দেখার জন্য প্রাণ পাখিটা- কেমন আনচান করতেছিলো লিখে

বুঝাতে পারবো না। দিশা না পেয়ে গভীর সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ছিলাম। কারা যেনো মরতে দিলো না আমাকে।

টেনে তুললো তরীতে – চেতন হয়ে দেখি আমার হাত পা বাধা।
ওরা আমাকে মায়ের পাগল বলে হাসতো। কেউ মলিন হয়ে বলত এ আবার ঝাপ দিবে সমুদ্রে। বার্মার লোকগুলো খুব ভালো,

মা,
কারণে অকারণে আমাকে যে যার হাতের স্বাদ মিটাতো, তাদের পায়ের অপেয় বিষ দিতো।

সে আঘাতের চিহ্ন আমার দেহের প্রতিটি শিরা – উপশিরায় আকাশের তারকার মত গেঁথে আছে।

রোহিঙ্গা এক মুসলিম মেয়ে তার দরদ মানবতা , আমাকে উঝার করে দিয়ে বাঁচিয়েছে।

এমন করে ৫ দিন পরে। অজানা অচেনা এক দ্বীপে আমাকে আর সেই মেয়েটিকে জোর করে ফেলে দিয়ে গেলো।

আমাদের চিৎকারে কারো মনে দয়ার সন্ধান মেলেনি। চারদিকে নোনাজল আর জনশূন্য বনরাজি।
হেটে হেটে বনের মাঝে চলে গেলাম আমরা -দুজনে পথ খুঁজতে থাকলাম, যে দিকেই যাই বাঁধার সমুদ্রতট রুদ্ধ করে দেয় গতিপথ।

ফের ছুটে আসি বনের মাঝে
নাম না জানা এক অচেনা বৃক্ষের তলে বসে পরি
কয়েকটিমাত্র বিস্কুট আর জল দুজনে খেতে বসলাম। ও অবাক চোখে আমার দিকে -কি করুণ ভাবে চেয়েছিলো,
তোমাকে বুঝাতে পারবোনা “মা” অবশেষ একটি বিস্কুট আর সামান্য জল। আমি ওকে বললামঃ তুমি খেয়ে নাও,
কিন্তু ও খেলো না। ও বলে আমাকে খেতে; আমিও খেলাম না। আমাদের সম্বল ব্যাগের মাঝে রেখে দিলাম -আমাকে

একা রেখে ও একটু দূরে কি যেনো খুঁজতে গেলো।

কিছু লতাপাতা আর দুটো পাথর অনেক কষ্ট করে যোগার করে আমার পাশে নিয়ে এলো। ওর শুকনো দেহ থেকে ঘাম ঝরে পরছিলো।

আমি দুর্বল শক্তিতেই ওকে স্ব জোরে এক ঘা বসিয়ে দিলাম। কারণ ও বুঝতে পেরেছিলো। তাই চুপ করে আর কোন কথা বললো না।

মশ্রিন এক ঝলক হাসি দিয়ে লতাপাতা গুলো পিষতে শুরু করলো।
আমার দেহের ক্ষত জায়গা গুলো ওর ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছে বনজ রস দিয়ে দিয়ে সুস্থ করে তুললো।
এ গহীন দ্বীপে আমরা দুজন দুজনার অভিভাবক। এ দ্বীপে কোন জাহাজ ভেড়ে না। কোন পাখিও না, সমুদ্রের গর্জন আমাদের গান শোনায়।

বনে বনে দুজনে ঘুরে আদিম যুগে পথ চলি।

লতাপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই। তেতো মিঠা কষায় জিহ্বা সয়ে গেছে সব তিক্ততা। প্রতিদিন সকালে বুনো ফুল থেকে
শিশিরের জল পান করি, রাতে কিভাবে চিংড়িমাছ ধরতে হয় তাও শিখেছি ওর কাছ থেকে।

মাঝে মাঝে ভীষণ খারাপ লাগে, মা তোমার হাতের রান্না আর বুঝি এই অভাগার মুখে আসবে না। সাত দিন সাত রাত গাছের তলায় কেটেছে।

আজ প্রথম আমরা পাথর আর ডালপালা দিয়ে
একটি থাকার ঘর বানিয়েছি। জানি, আমাদের বাকি জীবন এই দ্বীপেই সমাপ্ত হবে। হরেক রঙের পাতা দিয়ে বিছানার ব্যাবস্থাও করেছি।

তুমি কাছে থাকলে আরো একটি ঘর বানাতাম। ও বলে এই নির্জন দ্বীপ বার্মার চেয়ে অনেক ভালো। এখানে কেউ রোহিঙ্গা বলে গালী দেয়না।
আগুনের তরবারি নিয়ে কেউ ভয় দেখায় না। জাতিভেদ নেই হিংসা নেই ভোট নেই। অধিকার নিয়ে যুদ্ধ নেই।

আজ পূর্ণিমারাত,
আমরা দুজনে বিয়ে করবো, নতুন সংসার করবো, এক নতুন জাতি উপহার দেবো ধরণীকে। সভ্য জাতি, সভ্য সমাজ অহংকার আর হিংসামুক্ত।

লতায় বুনো ফুল গেথে মালা গাঁথলাম, ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি,
কচু পাতার গিফট বক্সে, আমাদের কর্মগুলো বড় আজব মনে হবে তোমার। বাগদা চিংড়ি আর কিছু বুনো মিষ্টি ফলমূল।

কয়েকটি জোনাকির আলোক সজ্জা।
পূর্নিমার চাঁদ, তারকার মেলা, আজ আমাদের বিয়ে
বোবা বৃক্ষ আর কিছু পোকামাকড় ছাড়া কোন মেহমান নেই। সন্ধ্যায় নোনাজলে আজ প্রথম অজু করলাম মাগো।
আজান দিলাম, বৃক্ষকে, এই দ্বীপকে জানিয়ে দিলাম আল্লাহ্‌ এক, মনে হয়েছিলো বৃক্ষগুলো তার জিকিরে মসগুল।

আয়েশা দু হাত আকাশের দিকে তুলে- শুধু কাঁদতে ছিলো।
আজ অলৌকিক আলোতে । আমাদের ঘর উজ্জ্বল ছিলো।
দুজনে এক সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। মালা বদল করে এক আল্লাহ্‌কে বিশ্বাস করে , বিয়ে করলাম –
এক বছর চলে গেলো কোন পথে — জানা নেই।

মা,
আজ আমাদের ঘরে নতুন মেহমান এসেছে। ও বলে দেখতে আমার মত। আয়নায় মুখ দেখা হয়না সেই কত মাস

হলো ভুলে গেছি আমি, দেখতে কেমন। ওর চোখের মণিকে আয়না ভেবে মাঝে মাঝে, নিজেকে দেখার চেষ্টা করেছি।

এখন শুধু হা করে নবজাতকের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। নিজেকে দেখি ওর মাঝে।

সে যে কি আনন্দ “মা!! আমি বাবা হয়েছি!!! সোনার পালঙ্ক নয়, এলো পাথরের বিছানায়। ও একদিন বড় হবে
ও হবে এই দ্বীপের রাজা। আজ থেকে আমি প্রজা! মাগো আমি প্রজা!!! আমরা দুজনে মিলে ওর নাম রাখলাম
আন্দামান সাগর, বুনো ফুল এনে লতায় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখি আন্দামানের চারপাশে।
আয়েশা আমার ডায়েড়ীর কাগজ ছিঁড়ে ওর জন্য ফুল, পাখি, নৌকা, আরো কত কি বানায়। উই পোকার কাদামাটি দিয়ে

পুতুল বানিয়ে রোদে শুকায়। চার পাশের দ্বীপ গুলো দেখিয়ে বলি। ঐ যে দূরে দ্বীপ, ওটা তোমার দাদু বাড়ি ওটা তোমার নানা বাড়ি।

ঐ দুটো দ্বীপের মাঝে সব সময় আগুন জ্বলে। একটি দ্বীপের নাম বাংলা,
আর একটির নাম বার্মা। কখনো যেও না যেনো —
আন্দামানের জন্য দোয়া করিও মা। মা তোমার ছেলে আজ বাবা হয়েছে! বাবা! বাবা!

পাথর দিয়ে আমার লুঙ্গী কেটে অনেক কষ্ট করে আয়েশা তোমার নাতীর জন্য জামা প্যান্ট বানিয়েছে। খেজুর কাটার সুই আর উলের সুতা।

তার চোখের জলের সীমাহীন স্মৃতি – দীর্ঘশ্বাস মেশানো ঢেউ।

আজ পাঁচ বছর পূর্ণ হলো, আন্দামান এখন একা একাই
এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারে। আমাদের সাথে সাথে ফুল ফল সংগ্রহ করে ও এখন চিনে কোন ফল তেতো আর মিঠা।

আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলে। দ্রুত চোখ বন্ধ করি
ওর ভালোবাসা পাওয়ার আশায়। তেতো ফল আমার মুখে পুড়ে দিয়ে হাতে তালি দেয় ; আর আনন্দে নাচে। সে যে কত মধুর আলিঙ্গন কিভাবে বুঝাবো!
তবুও তুমি বুঝবে তুমি যে আমার মা।

একদিন বিকেলে দেখি আন্দামান বাসায় নেই। খুঁজে পেলাম অবশেষে সমুদ্রের তীরে একটা ডলফিন মাছের সাথে খেলা করছে।

কবে থেকে আন্দামানের বন্ধু হয়েছে আমরা জানিনা। মাছটি আন্দামানকে পিঠে চড়িয়ে
সমুদ্রের কূলে ঘুরে বেড়াতো ।

আমাদের পরিবারের সদস্য
আর একজন বেড়ে গেলো। আজ তিনদিন ধরে আন্দামানের জ্বর। কোথায় ডাক্তার পাবো। বনের কোন ঔষধ উপকারে আসছে না।

সমুদ্র সৈকতে অপেক্ষা করি জাহাজের, কোন জাহাজ আসে না এই দ্বীপে। নিরাশ হয়ে ফিরে যাই। আয়েশা নামাজ পড়ে দু হাত তুলে কাঁদে
হে আল্লাহ্‌ আমার আন্দামানকে ভালো করে দাও। সে কান্না হয়ত বিধাতার কাছে পৌঁছেনি বা পৌঁছেছে।

ডলফিন মাছটি প্রতিদিন ডাঙায় এসে আন্দামানকে খুঁজতে থাকে।
আমি জলে ঠেলে দেই, ঘুরে ফিরে আবার ডাঙায় এসে মিনতি জানায়। ভাষাহীন ভালোবাসা কি তা এই দ্বীপে না এলে বুঝাতাম না মা।

মুমূর্ষু আন্দামানকে ডলফিন মাছটির কাছে নিয়ে এলাম। আন্দামানকে ঠোঁট দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো। তার পরে ডলফিন আবার জলে নেমে গেলো।
আমরা অপেক্ষা করতে ছিলাম নিরাশে কোন জাহাজের; পথ ভুলে যদি এ পথে আসে। কিচ্ছুক্ষণ পরে ডলফিন আবার ফিরে

এলো আন্দামান চোখ ফেরালো ডলফিনের দিকে। অনেক কষ্ট করে তার কচি হাত
ডলফিনের গায়ে বুলিয়ে -বিড়বিড় করে বললো
আমি আজ তোর সাথে খেলতে পারবো না। সাতার কাটতে পারবোনা তোর পিঠে চড়ে তোকে বলেছিলাম ;
বড় হয়ে নানা বাড়ি দাদা বাড়ি যাবো
তোর পিঠে চরে। জন্মের পর আগুন দেখিনি
আগুন দেখবো। ভালো হয়ে ফের তোর সাথে খেলা করবো তুই কাঁদিসনে ভাই।
আমি ভালো হয়ে যাবো।

মা,
আজ সাতদিন হল আকাশে চাঁদ উঠেনা প্রভাতে সূর্যোদয় হয় না, বাতাসে বৃক্ষের সাথে গান গায়না।
শুধু সমুদ্রের কূলভাঙা ঢেউ আছড়ে পরে বুকের মাঝে;
তেতো ফল কুড়িয়ে এনে আমার মুখে দিয়ে- আজ আর আন্দামান আনন্দ পায় না।
আমি উল্লাসে আর সেই সুখের পরশ অনুভব করতে পারিনা। মাকড়শা এখন স্বাধীন, বাঁধাহীন বাসা বেঁধে হেঁটে বেড়ায়।

ফুল থেকে সৌরভ বিলীন হয়ে ভেসে গেছে ” মা”
আয়েশা এখন মানসিক রোগী। সারাদিন কিছু খায়না।
আন্দামান, আন্দামান বলে ডেকে ডেকে বনে বনে ঘুড়ে বেড়ায়। আর মাটির খেলনাগুলো বুকে জড়িয়ে
শ্রাবন ঝরায়। ডলফিন মাছটি মাছ ধরে ডাঙায় তুলে পর্বত করেছে। একটু পরপর ডাঙায় উঠে বনের দিকে তাকিয়ে থাকে
আন্দামানের অপেক্ষায় আন্দামানের সাথে খেলা করবে, সাতার কাটবে।

আমাদের রাজ্যের রাজা নেই “মা”
আমরা দুটি কংকাল প্রজা পড়ে আছি এই দ্বীপে
তাও হয়ত আর বেশিদূর নয়। আমার এই চিঠি কোনো দিন তোমার কাছে যাবে না “মা” তবুও লেখি পাগলের মত।
তুমি ছাড়া তো এই দুনিয়ায় আমার আর কেউ ছিলোনা “মা”
বাতাসকে পড়ে পড়ে শুনাই, আর বলি, হে বাতাস; আমার জনম দুখিনী মাকে বলিস। তোর নারী ছেড়া ধন খুব ভালো আছে, খুব ভালো।

আমার মহাকাল ঘনিয়ে এসেছে “মা” আজ তিনদিন ধরে আমার বুকে ভীষণ ব্যথা। পাথরের উপড়ে ছটফট করছি।
আয়েশা আমার শিয়রে বসে কাঁদছে আর বলছে,
হে মালিক, মরণ দিলে আমাকেও দাও, ওর আগে আমাকে মৃত্যু দাও। তা না হলে আমার স্বামীকে সুস্থ করে দাও। এই দ্বীপে ও ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই।
তুমি এত পাষাণ হইওনা প্রভু।

আমি মরে যাই তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু, আয়েশা কেমন করে এই দ্বীপে একা একা থাকবে। যে মানসী আমার জন্য এত কিছু করলো,

আমি তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

…………………………………………….( সমাপ্ত)…………………………………..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত