একজন মমতাময়ী

একজন মমতাময়ী

রেড সিগনালে গাড়ি থামতেই ভীষণ বিরক্ত হয়ে জানালার গ্লাসের ভিতর দিয়ে বাইরে তাকালো মিতা। আট বছর পর অস্ট্রেলিয়া থেকে আজই দেশে ফিরেছে সে। তার বড় বোনের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষেই আসা। এয়ারপোর্ট থেকে বড় বোনের বাসায় যেতে বার বার ট্রাফিকজ্যামের মধ্যে পড়তে পড়তে মেজাজটা একেবারেই বিগড়ে আছে তার। তার উপরে আবার ভিক্ষুক আর হকারদের যন্ত্রণা তো আছেই।

বড় আপাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে তাকে বলেছিলো সে আসতে পারবে না বিয়েতে। তাই ওদেরকে রিসিভ করতেও কেউ আসেনি এয়ারপোর্টে। মিতার হাসবেন্ড মেহেদী অবশ্য সত্যিই কাজের জন্য আসতে পারেনি। কিন্তু মিতা আর মৌ কে ঠিকই পাঠিয়েছে। জানালার গ্লাসের ভিতর দিয়ে হঠাৎ করে আট/নয় বছরের ফুটফুটে একটি মেয়েকে ফুল বিক্রি করতে দেখে মিতার বুকের মধ্যে ধ্বক্ করে উঠলো। দ্রুত জানালার গ্লাস নামিয়ে হাত দিয়ে কাছে ডাকলো তাকে।

— ফুল কিনবেন আন্টি? বলে হাসি মুখে এগিয়ে আসলো মেয়েটি।

মেয়েটির হাত থেকে একটা মালা নিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো মিতা। এরপর ব্যাগ থেকে সদ্য ডলার ভাঙানো টাকাগুলো থেকে এক হাজার টাকার পাঁচটা কড়কড়ে নোট নিয়ে ছোট্ট মেয়েটির হাতে দিলো। এরই মধ্যে গ্রীন সিগনাল আসতেই মিতার গাড়ি ছেড়ে দিলো।

একসাথে এতোগুলো টাকা জীবনে চোখে দেখেনি ফুল বিক্রেতা মেয়েটি। আর এই অচেনা-অজানা আন্টি কিনা তাকে খালি খালি এতোগুলো টাকা দিয়ে দিলো! মেয়েটি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো পরীর মতো সুন্দর আন্টির চলন্ত গাড়িটির দিকে আর ভাবতে লাগলো- এটা কি স্বপ্ন ছিলো, নাকি বাস্তব! আর বাস্তব হলে এই আন্টি কি মানুষ ছিলো, নাকি পরী !! এরপর হিসাব করতে লাগলো, এত্তোগুলি টাকা দিয়ে তার কত্তোগুলি স্বপ্ন পূরণ হবে- মায়ের জন্য ওষুধ কেনা, ছোট ভাই-বোনের জন্য নতুন জামা কেনা আরও হাজার হাজার স্বপ্ন তার মাথার মধ্যে ঘূরপাক খেতে লাগলো… হঠাৎ লক্ষ্য করলো, তার চোখের পানিতে তার জামা ভিজে যাচ্ছে এতদিনে সে বুঝতে পারলো মানুষ কেনো অনেক বেশি আনন্দে চোখের পানি ফেলে!

ফুল বিক্রেতা মেয়েটিকে পেছনে ফেলে গাড়িটি কিছুটা সামনে এগিয়ে আসতেই মিতা তার পাশে ঘুম ঘুম চোখে বসে থাকা তার একমাত্র মেয়ে- আট বছরের মৌ কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। আর ভাবতে লাগলো, আট বছর আগে যদি স্বামী পরিত্যক্তা-হতদরিদ্র সালেহা বানুর কাছ থেকে পাঁচ কন্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়েটিকে সে দত্তক না নিতো, তাহলে হয়তো তার ‘সাত রাজার ধন’ এই মৌ সোনামনিকেও আজ এরকম কোন কাজ করে দু’মুঠো অন্ন যোগাতে হতো। কথাটা ভাবতেই মিতার দু’চোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা নেমে এলো। মৌকে আরো শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলো সে। মিতার মনে হলো হাতের বাঁধনটা আলগা হলেই বুঝি অন্য কেউ এসে এক ঝটকায় মৌকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে।

মায়ের এরকম অদ্ভুত আচরণে মোটেই অবাক হয়নি মৌ। কারন, সেই ছোটবেলা থেকেই হঠাৎ-হঠাৎ মায়ের এরকম অদ্ভুত মমতা মাখানো আদর খেতে খেতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই হঠাৎ করে কেনো মা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, সেই ব্যাপারে কোন প্রশ্ন না করে সেও গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলো তার মাকে। আর মনে মনে ধন্যবাদ জানালো সৃষ্টিকর্তাকে– তাকে এতো ভালো আর মমতাময়ী একজন মায়ের মেয়ে করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত