নিয়তি

নিয়তি

শাশুড়ি যখন বললেন, চল বউমা শপিং করে আসি। তখন আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। যে মানুষ ঘরের একটু বাড়তি কাজে এক টাকাও এদিক সেদিক করতে দেন না। তিনি কিনা আমাকে বলছেন শপিং এ যেতে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, মা হাতে তেমন টাকা নেই। যা ছিল ডাক্তারের পিছনে খরচ হয়ে গেছে।

— আমি বলেছি যে তোমার টাকা লাগবে। শুধু বলেছি আমার সাথে শপিং এ চল।

আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রেডি হয়ে রওয়না দিলাম। কিন্তু হিসাব কিছুতেই মিলাতে পারছি না। আমার উপর কি এমন কারণে এত খুশি হয়ে শপিং করাতে চলছেন। আজ অবধি এমন কোনো খুশির সংবাদ দিতে পারিনি আমি। শপিং মলে গিয়ে আমাকে একদম সফট কাপড়ের কয়েকটা ড্রেস কিনে দিলেন। কিন্তু আমার জানা মতে তিনি একটু হাতের কাজ করা শাড়ি ড্রেস পছন্দ করেন যার জন্য আমাকে ঐ রকম কিছু পড়তে হয়। ঠিক তেমনি কয়েকটা একদম নরমাল সুন্দর রঙ দেখে শাড়িও কিনে দিলেন। আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি স্বপ্ন দেখছি না তো ! এরপরে তিনি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনলেন। সাথে বাচ্চাদের ড্রেস, দুধের বোয়াম, প্যাম্পারস পেন্ট, টিস্যু সহ অনেক কিছু হয়ত আমার ননদের জন্য কয়দিন আগে বেবি হয়েছে তার।

এসব কেনাকাটা শেষে তিনি আমাকে বাসায় না নিয়ে গিয়ে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে যাওয়ায় আরো কিছুটা অবাক হলাম। সেখানে বসার পাঁচ মিনিট পর ই একজন লোক এসে আমার কোলে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা দিয়ে গেল। বেশি হলে ১০/১৫ দিন হবে বাচ্চাটার। লোকটা চলে যাওয়ার সাথে সাথে মা বললেন, এই আমার নাতি আজ থেকে। আজ যা কিছু শপিং করলাম সব এর জন্য। আমি জানি মা না হতে পারার কষ্ট কতটুকু। তাই আদিবের সাথে কথা বলে এসব করলাম। এরকম হলে কি স্বামী কে আবার বিয়ের জন্য বলতে হয়।! এর যে অন্য উপায় আছে তা তো বলা যায়। এমন বোকামি কেন কর।

আজ চার বছর আমাদের কোনো সন্তান নেই। অনেক চিকিৎসা অনেক কিছু করেও সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয় নি আমাদের। তাই আদিবকে বলেছিলাম আবার বিয়ে করতে। বেশ কয়দিন ধরে ই এই বিষয়ে আদিব কে জ্বালাচ্ছি আমি। মায়ের কথা গুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আমি।

— জানিস মা, মেয়েরা সবকিছুর ভাগ দিতে পারলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। আর সেই মুখ দিয়ে স্বামীকে বিয়ের কথা বলা কতটা কষ্টকর তা আমি জানি।

মা আমার সব মনের কথাগুলো যেন বলছেন। আমি জানি কতটা কষ্ট চেপে রেখে এই কথা বলার সাহস পেয়েছি আদিবকে বলেছি। ওর এসব নিয়ে এত মাথা ব্যথা না থাকলেও আমি তো শুনতাম আশেপাশের মানুষের কথা ! আমি বুঝি কারণ আমিও একসময় এসবের মধ্যে পার করেছি। বিয়ের দশ বছর পার হওয়ার পরও আমার কোল খালি ছিল। আমিও আদিবের বাবাকে বলেছি বিয়ের কথা। কিন্তু সে মেনে নেয়নি।

সে বলে, আমাদের মধ্যে তো অন্যকিছুর কমতি নেই শুধু সন্তান ছাড়া। আশেপাশে তো অনেক বাচ্চা আছে তাদের থেকে একজন কে না হয় আমাদের সন্তান করে নিব। তার এই কথাতে শক্তি খোঁজে পাই আমি। আরাফ কে এডপ্ট করি। এর ছয় বছর পর আদিব আসে আমার কোলে। জানিস তো, ঐ উপরওয়ালাকে খুশি করাতে পারলে আর কিছু লাগে না। বাকি সব খুশির দায়িত্ব উনি নিয়ে নেন। আজ আমিও সেটাই করলাম। (শাশুড়ি) আমি অঝর ধারায় কাঁদছি। একপাশে আমার সন্তান আর অন্যপাশে মাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক গর্ভধারিনী মা আছেন এমন করে নিজের মেয়েকেও বুঝেন না আর ইনি তো শাশুড়ি। কতটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব বুঝাতে পারছি না। কিছু না বলে চুপ করে শুধু কেঁদে ই যাচ্ছি নিজের সন্তানকে বুকে নিয়ে।

আজ আট বছর,, আমার ২য় সন্তানের জন্মদিন পালন করছি। কিন্তু আমি আমার ১ম সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছি। সে ওপারে চলে গেছে। যদিও আমি ওকে গর্ভে ধারণ করিনি তবুও যে পরিস্থিতে আমি ওকে পেয়েছি তা এর থেকে কিছু অংশে কম নয়। আমার ১ম সন্তান ছিল ও।

আমার নিশ্বাসের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। সারা দিন চোখে চোখে রাখতান কলিজাটা কে। আমার শাশুড়ির মৃত্যু হয় ২ বছর আগে সেই দিন পুকুরে পড়ে ডুবে মারা যায় আমার ৬ বছরের কলিজাটা। আমার মায়ের সাথে তারও অন্তিম বিদায় হয়। যে তাকে আমার কোলে দিয়ে ছিলেন সেই মায়ের সাথে ই তার শেষ যাত্রা । এই কষ্টটা আমি ভুলতে পারি না। মা তো চলে গেলেন যদি আমার সন্তান টা থাকত..! আজও পাগলের মত কাঁদি এই দুজনের জন্য…..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত