কালো মেয়ের মন

কালো মেয়ের মন

অমিতাভবাবুর দুই সন্তান কল‍্যাণী আর দীপ্তেষ বয়সের পার্থক‍্য মাত্র আড়াই বৎসর।। একমাত্র ছেলে পড়াশোনা আর কেরিয়ার নিয়েই ব‍্যস্ত অন‍্যান‍্য ভবিষ্যৎ সচেতনীদের মতোই।। বাবা নিজের সামান‍্য জমানো টাকার প্রায় অনেকাংশই একমাত্র ছেলের পিছনে ব‍্যয় করে দিতে থাকে জলের মতো, অনেক আশা যে, ছেলে বড়ো হয়ে,মানুষের মতো মানুষ হয়ে তার একমাত্র বোন ও বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতা কে অন্ততঃ দেখবে।। তাই, অমিতাভ বাবু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যতোটুকু জমিয়ে ছিলেন,এমনকি একমাত্র মেয়ের জন‍্য বিবাহের প্রায় সমস্ত টাকাটুকুও ব‍্যাঙ্ক থেকে তুলে ছেলের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি এবং আনুষঙ্গিক যাবতীয় খরচাপাতিতে ব‍্যয় করে দেন।।

আজ সেই গুণধর পুত্র তো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এদিকে একমাত্র বিবাহযোগ‍্যা বোনের জন‍্য জমানো বিবাহের টাকাটা দিতে বলায় ছেলে বলে –“আরে দাঁড়াও,এই সবে মাত্র জব পেয়েছি এখনই অতো টাকা কোথায় পাবো???,,,,ধৈর্য ধরো,ঠিক দিয়ে দেবো।।

এদিকে বোনের গা’য়ের রঙ একটু না ,অনেকটাই কালো বলে,পাত্রপক্ষের তরফ থেকে জোর দরদাম হাঁকছে,,,,এই নিয়ে নয়-দশ জন রিজেক্ট করলো।। কল‍্যাণী বেশীদূর পড়াশোনা করতে পারেনি,বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ততোটাও স্বচ্ছ্বল ছিলো না বলে।। তবুও উচ্চমাধ্যমিকের কোঠা পেরিয়েছে।। অপর দিকে একমাত্র ছেলের উপর ভরসা ছিলো,তিনি জানতেন যে মেয়ে তো একদিন না একদিন’ পরের বাড়ি যাবেই,বরং ছেলের পড়াশোনার প্রতি ব‍্যয় করলে, ও’ নিজের পা’য়ে দাঁড়িয়ে একদিন সবকিছু দায়িত্বই পালন করতে পারবে।।

আরও দেখতে ,দেখতে কয়েকটা বছর পেরিয়ে গেলো, কর্মসূত্রে দীপ্তেষ এখন ব‍্যাঙ্গালোরে শিফ্ট করেছে। ঐ দাদাই নিজের আগে থেকে পছন্দ করা পুরানো বান্ধবীর সাথে নিজের বিয়েটাও সেরে ফেলেছে সেখানে,বাড়িতে কেবল ফোনে সুখবরটি জানিয়েছে।। তারপর থেকে ক্রমশ বাড়িতে নামমাত্র যোগাযোগ রেখেছে ,বলা যায় ওখানেই পাকাপোক্ত ভাবে সেটেল হয়ে গেছে,আর ওয়েল সেটেল হয়ে নিজের ফ‍্যামিলির কথা ভুলে গিয়েছে!! এখন কোনো মাসে টাকা পাঠায়,আবার কোনো মাসে বিভিন্ন অজুহাতের দোহাই দিয়ে পাঠায় না।।,,,,,যেটা একসময়, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আবার বন্ধ হয়ে যায়!!

এদিকে মেয়ে কল‍্যাণীর হয়তো রূপ নেই কিন্তু গুণ ঠিকই ভগবান দিয়েছে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই, বাবা আর কলেজে না ভর্তি করায় ভীষণ মনক্ষুণ্ন হলেও মুখ ফুটে কিছুই বলেনি, অসম্ভব জেদি এই মেয়েটি সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী না, স্কুলে ওঠার পরই বুঝে গিয়েছিলো যে, সে শুধুমাত্র কালো রঙের অধিকারীনী বলে বন্ধুমহলে,এমনকি সমাজেও কতো হেয় হয়েছে,কোনো পুরুষের প্রেমিকাও হতে পারেনি।। তাই নিজের পা’য়ে দাঁড়ানোর জেদ সেই ছোটোবেলা থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো মনের ভিতরে, পড়া ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই সেলাইয়ের কাজ শিখতে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় সম্পূর্ণ ফ্রি কোর্স,একটি টাকাও খরচ হয়নি বরং নিয়মিত ক্লাস করলে স্টাইপেন্ডের ব‍্যবস্থা ছিলো।। যেটা কল‍্যাণী পেয়েছে, ঐ টাকাটা জমিয়ে তার সাথে আর’ও কিছু টাকা মিশিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনে নিজেই ঘরে টুকটাক কাজ করতে থাকে,,,তার হাতের নৈপুণ্য ছিলো দেখার মতোই। অসাধারণ কাজ করতো,,,,,একটা সময় রোডের ধারে দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের “কল‍্যাণী লেডিস টেলার্স ” নাম দিয়ে শুরু করে,আজ ঐ দোকানেই তিন জন মেয়ে কাজ করে।।

কল‍্যাণীর বাবা অমিতাভ বাবু এখন ” বিবেক দংশনে” ভুগছে,কারণ,–” যে ছেলের প্রতি বুক ভরা আশা ছিলো,ভরসা ছিলো, সেই ছেলেই কিনা এমন ভাবে চোখের সামনে নিমেষে পাল্টে গেলো!!!!!আর যেই মেয়ে’কে ভেবেছিলাম শুধুমাত্র অন‍্যের ঘরে একদিন চলে যাবে তাই বেশি দূর পড়াতে পারেনি ; ওর পিছনে খরচ করতে সেভাবে পারিনি,,,,আজ আমার রিটায়ারমেন্টের পর, সেই মেয়েই কিনা নিজের পা’য়ে দাঁড়িয়ে উপার্জন করে আমাদের দিনে-রাতের অন্ন জোগাচ্ছে,অসুস্থতার ঔষধ কিনে দিচ্ছে!! বাঃ রে পৃথিবী, এই বৃদ্ধবয়সে আর কতো রূপ আমায় দেখাবি “?!

আজ কল‍্যাণী খুব খুশি,যে তার আন্ডারে তিনজন মহিলাকর্মী কাজ করছে,ওদিকে বৃদ্ধ বাবা-মা কে দেখছে,,,,সমস্ত দিক সামলে নিয়েছে একা হাতে,কিন্তু বিয়ে করেনি এখনো। নিজের রূপ নিয়ে এখন আর মনের ভিতর কোনো “হীনমন‍্যতা” নেই তার আর। কারণ এই সমাজে এখনো যে কিছু,কিছু মানুষ আছে যারা মানুষকে “রঙ”-টা দিয়েই বিচার করে,এখনো তাঁর একটাকেও চোখে পড়েনি যে “রূপ” না, মন দিয়ে বিচার করে “গুণ” টাকে খুঁজে নেবে, এমন কারোর আসার অপেক্ষায় আজও কল‍্যাণী কুমারী হয়েই আছে,আর যদি কেউ নাই আসে, সে মা-বাবার কাছে থেকেই পুরো দায়িত্ব যেমন সামলাচ্ছে আগামী দিনগুলিতেও সামলে নেবে ঠিক,আর কোনো কিছুতেই ভয় পায় না সে,অসম্ভব পজেটিভ এনার্জি তে ভরপুর কল‍্যাণীর আর’ও ইচ্ছে নিজের একটা সম্পূর্ণ ম‍্যানুফ‍্যাকচারিং কোম্পানি গড়ে তোলা পোষাক শিল্পে,এ উদ্দেশে জোরকদমে কাজ ইতিমধ‍্যেই শুরু ‘ও করে দিয়েছে, হয়তো কয়েক বছরের মধ‍্যেই সেই স্বপ্ন সত‍্যি হয়ে যাবে।। এবং তখন দেখিয়ে দেবে সবাই কে চোখে আঙুল দিয়ে, যে ছেলে হয়ে জন্মালেই মা-বাবাকে সেবা করবে,দেখভাল করবে তা না,বরং একটা মেয়েও পারে অনুরূপ কার্য একা হাতেই সম্পাদন করতে।।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত