বিরাট এক বটগাছ ছিল। গাছটি ছিল যেমন উদার, তেমনি পরোপকারী দানশীল। তার কাছে এলে কেউ খালি হাতে ফিরতো না। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পেতো। একেবারে যদি সে কোনো কিছু দিতে না পারতো, তাহলে অন্তত সান্ত¡না দিতো। ছায়া দিতো।
সে বটগাছের সঙ্গে একবার একটি বুড়ো শকুনের বন্ধুত্ব হলো। শকুন বটগাছের ঠিক মাঝামাঝি একটি শাখায় সুন্দর বাসা বাঁধলো। খড়কুটো, লতা-পাতার তৈরি বাসা। বাসায় থেকে সে সকাল-সন্ধ্যা গান করতো। তার গান শুনে ভোর হতো। রাত নামতো।
শকুনটি ছিল খুবই জ্ঞানী। তার জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতলান্ত। উদার বটগাছের সঙ্গে শকুন কুটকুট করে কথা বলতো।
গল্পগুজব করতো। জীবন জগতের গল্প। সুখ-দুঃখের গল্প। হাসি-আনন্দের গল্প।
শকুনের মজাদার গল্প শুনে বটগাছ মুগ্ধ হতো। সেও নিজের অভিজ্ঞতা মতো শকুনকে গল্প শোনাতো। এভাবে সুখে-দুঃখে ভালোই যাচ্ছিল দুবন্ধুর দিনকাল। অবসর সময়ে শকুন বটগাছের বিভিন্ন সেবা করতো। শুকনো পাতা, মরা ডালপালা ঠুকরিয়ে ফেলে দিতো। বটগাছকে সব সময় সুন্দর, পরিপাটি করে রাখতো। এতে বন্ধু শকুনের প্রতি বটগাছ ছিল খুবই প্রসন্ন।
একদিন আকাশে উড়তে গিয়ে শকুন লক্ষ করলো, একটি বাজপাখি একটি গোশালিককে আক্রমণ করেছে। গোশালিকরা গু-গোবর নিয়ে সব সময় ঘাঁটাঘাঁটি করে তো, তাই এমন নাম। বাজপাখির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য গোশালিকটি অত্যন্ত করুণ সুরে আর্তনাদ করতে লাগলো। ওর করুণ কান্না শুনে শকুনের মনটা গলে গেলো।
পরে রাজপাখিকে তাড়িয়ে দিয়ে সে ওকে বাঁচিয়ে দিলো। কিন্তু প্রাণে বাঁচলে কী হবে? গোশালিকের একটি ডানা ভেঙে গেছে।
ভাঙা ডানা নিয়েই সে বেশ কিছুদূর উড়ে গেলো। তারপর হঠাৎ তাল হারিয়ে নিচে পড়ে গেলো। গো-শালিকটি শকুনের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললো, তুমি কেন আমাকে বাঁচালে? বাঁচিয়ে তো আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছো। এখন আমি ভাঙা ডানা নিয়ে কিভাবে আকাশে উড়বো। এর চেয়ে তো আমার মরে যাওয়াই ভালো ছিল।
গোশালিকের এমন কথা শুনে তো শকুন একেবারে ‘থ’। বলে কী সে! আশ্চর্য পাখি দেখছি! এতো বড় বিপদ থেকে ওকে প্রাণে বাঁচালাম, কোথায় সে বিনীতভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। ধন্যবাদ দিবে। তা না করে উল্টো দোষারোপ শুরু করছে। তারপর বললো, ভয় নেই, আমার সঙ্গে চলো।
আমার বাসায় থেকে সুস্থ হলে ফিরে এসো।
শকুনের কথায় গোশালিক রাজি হলো। পরে শকুনকে পিঠে নিয়ে বটগাছে ফিরে গেলো। সন্ধ্যায় গোশালিক স্বভাবমতো কিচিরমিচির গান ধরলো। ওর গানে বিরক্ত হয়ে বটগাছ শকুনকে বললো, এ কাকে নিয়ে এলে ভাই? অসভ্য-নিচুজাত! কদিন পর দেখবে ঘুরে বসেছে। জলদি বিদায় করো।
শকুন বটগাছকে বুঝিয়ে বললো, ও এখন অসুস্থ। একটি ডানা ভাঙা। সুস্থ হলেই ফিরে যেতে বলবো। বন্ধুর কথার পর বটগাছ আর কোনো কিছু বলতে গেলো না। কিছুদিন পর গোশালিক পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলো।
সে এখন ইচ্ছেমতো ডানা মেলে উড়তে পারে। যেখানে খুশি যেতে পারে। বটগাছের ডালে ডালে, শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায় সে এখন উড়ে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায়। বেড়ায় আর ভাবে, জায়গাটা তো মন্দ না। গাছটাও চমৎকার! শকুনটাকে তাড়াতে পারলে ভালো হতো। পুরো গাছটাই দখলে চলে আসতো।
বটগাছের সঙ্গে মাঝেমধ্যে গোশালিকের কথা হতো। কথা হলেই সে শকুনের বিরুদ্ধে নানারূপ অভিযোগ করতো। শকুন একটা নোংরা পাখি। পচাগলা খায়। মরা গরু খায়। গাছটাকেও নোংরা দিয়ে ভরে রেখেছে। জলদি ব্যবস্থা নিন। কিন্তু গোশালিকের কথায় বটগাছ কান দিতো না।
বটগাছ খুব জ্ঞানী তো! সহজেই গোশালিকের মনোভাব ধরে ফেললো। বুঝলো, এ ব্যাটা সুবিধের লোক না। আস্ত একটা অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর। এমন অকৃতজ্ঞের সঙ্গে কথা বলায় আনন্দ নেই। তাই সে চুপ হয়ে থাকতো।
এরই মধ্যে শকুনের দুটো ছানা হলো। কদিন পর ছানারা কিছুটা বড় হলো। ছানারা সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে গান করতো। কিচিরমিচির ডাকতো। ছানাদের এ মধুর গান গোশালিকের মোটেও পছন্দ হতো না। ভাবতো সে, নালায়েক ছানা দুটো বড় হলে তো আর উপায় নেই।
এখনই কী দুষ্টু! বড় হলে পুরো গাছটাই দখলে নিয়ে যাবে। তাই ওরা বড় হওয়ার আগেই কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, ভাবতে লাগলো গোশালিক। শেষে ঠিক করলো, বাসা থেকে ওদের নিচে ফেলে দেবে। ফেরে দিয়ে মেরে ফেলবে। এখন কীভাবে ওদের নিচে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলা যায়, গোশালিক দিনরাত সে চিন্তাই করতে লাগলো।
এদিকে গোশালিকটির সব ষড়যন্ত্র শকুনটি কী করে যেন জেনে ফেললো। কিন্তু জেনে গেলেই কি? মুখ ফুটে সে তো আর গোশালিককে বলতে পারবে না, যে বিদায় হও তুমি। কারণ সে বিবেকবান সভ্য পাখি। এখন কী করা! পরে নিজের ছানাদেরকেই সে সাবধান করে দিলো। বললো, বাছারা শোন। গোশালিকের মধুর কথায় ভুলো না। সুযোগ পেলেই সে তোমাদের ক্ষতি করবে। ও আসলে পাখি না, বিষাক্ত প্রাণী। বিষাক্ত প্রাণীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। তোমরা সুযোগ দিও না।