প্রতিশোধের কষ্ট

প্রতিশোধের কষ্ট

এইযে শুনছেন? চাপুন, বসতে দিন। এএএএএইইইইইইইযে চাপুন। কাহারো ডাকে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।আধা চোখ খোলা অবস্থায় কোন মতে চেপে বসলাম। সেই আওয়াজটা আবারো কানে এলো।

— আচ্ছা মানুষতো আপনি!!!! বাসে বসে ঘুমাচ্ছেন কেন? বাসে ঘুমাতে নেই। আর ব্যাগটা চাপান।

বই খুলে ঘুমাচ্ছেন কেন?? মানুষকে দেখান নাকি আপনি বই পড়েন!? এবার মেজাজটা পুরো বিগ্রে গেল, কিছু একটা বলবো বলে মাথা তুলে দেখি, পাশে একটা হিজাব করা মেয়ে বসা। মেয়েটার চেহারা দেখে রাগ ঘুম দু’টাই উধাও! কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না, একে তো অচেনা কোন মেয়েদের সাথে কথা না বলার অভিজ্ঞতা তার উপর আবার এইটাইপের একটা রাগী মেয়ে!! চুপ থাকাই ভালো মনে হলো।

মেয়েটির কথাগুলো মনে উঠতেই মেজাজটা আবার গরম হয়ে গেল। মনে মনে বললাম, বসতে আসছেন বসেন, আমি মানুষকে দেখাই না কি করি আপনার কি! এত কথা বলার কি আছে। কোন অজানা কারনে চুপ মেরে রইলাম। কিন্তু ভিতরে রাগটা এত বেশি ছিলো যে, কালো চেহারা আরো কালো হয়ে গেল, মেয়েটা মনে হয় বুঝতে পারলো বিষয়টা, একটা অজানা ছেলেকে এভাবে ক্ষ্যাপাতে পেরে মনে হয় খুশিই হলো। মেয়েটার মুচকি হাসি “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” এর মত তখন রাগটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। আব্দুর রাহিম সাহেবের “বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব” বইটাটা পড়ছিলাম। একটা লাইনও সামনে এগোচ্ছেনা। বইটা পড়ার মত যে মনযোগ দরকার তার কিছুই নেই । বইটা ব্যাগে ভরে হুমায়ূন আহমেদের “তিথীর নীল তোয়ালে” বইটা নিলাম। উৎসর্গে সূবর্ণা মুস্তফাকে নিয়ে ঐ ছোট্ট লেখাটা পড়তেই অনেক সময় লেগে গেল।তারপরও কি পড়লাম কিছুই মনে নেই।

মেয়েটির এই শরীর জ্বালানো হাসি না থামালে আমার পড়া হবেনা। তাই কিছু একটা বলার জন্যে আবার ফিরলাম, হাসিটার দিকে নজর পড়তেই চুপ মেরে গেলাম। কেন জানি মনে হলো, কিছু বলে এই হাসিটা নষ্ট করা ঠিক হবেনা। কিন্তু চুপ করে বসে থাকাটাও আমার জন্যে কষ্টকর ছিলো, যেকোন অঘটন ঘটে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। মেয়েটির কথাগুলোর প্রতি রাগ, আর হাসির প্রতি হঠাৎ এই ভালো লাগা! কি থেকে কি হয়ে যায়। রাগের বশত কিছু বলে ফেলি, না হাসির প্রতি অজানা টানের কারনে বলে ফেলি, তা নিয়ন্ত্রন করা আমার জন্যে কষ্টকর।

এই রাগ আর ভালো লাগার ভিতরই চলতে থাকলো আমার সফর, এর ভিতরই ঘটলো ঘটনাটা। “মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি” র মত অবস্থা।শেষ কবে এত খুশি হয়েছে তা বলতে পারবো না। এত্ত সুন্দর একটা প্রতিশোধের সুযোগ, এত্ত দ্রুত আসবে তা ভাবিনি। আর তা এভাবে নিতে পারবো তা কল্পনাও করতে পারিনি। “মেয়েটাও বাসে বসে ঝিমুচ্ছে” লজ্জাটা দেয়ার জন্যে গলাটা একটু কেশে তাতিয়ে নিলাম।

— এইযে বাসে বসে ঘুমাচ্ছেনন কেন? বাস কি ঘুমানোর জায়গা?

আকস্মিক এভাবে জাগ্রত করায় মেয়েটা একদম ভয় পেয়ে গেল। আমার একটু জোরে বলাতে আশ-পাশের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে, আচমকা এইরকম ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া, তার উপর আবার সবাই তার দিকে হাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা , পুরো অসস্তিতে পড়ে গেল মেয়েটি।লজ্জায় একদম মুছড়ে গেল। লালছে গালজোড়ায় কেউ মনে হলো জবা ফুলের রস ছিঁটিয়ে দিয়েছে।

আমিতো বিজয়ের আনন্দে মহা খুশি। কোন অচেনা মেয়ের সাথে এইপ্রথম কথা বললাম, সঙ্গে এইভাবে একটা ভেটুও দিলাম। বিজয়ের খুশি তাও আবার ততক্ষনিক বিজয়। তখন আমি ভেটু দেয়ার খুশিতে আত্মহারা।উপস্থিত এভাবে একটা ভেটু খেয়ে চেহারার কি অবস্থা হয়েছে দেখার জন্যে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি,কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে।হরিনীর মত চোখ গুলো আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হলো, প্রতিশোধ নেয়ার এক পৈশাচিক আনন্দে এভাবে কাউকে কষ্ট দিবো! তা চিন্তাও করিনি।

কাজটা না করলেও পারতাম, বা চাইলে আরো আস্তেও করা যেত। নিজেকেই মনে মনে শাসাতে লাগলাম,বোকামিটা না করলেও তো পারতাম। কি করবো এখন! মাফ চেয়ে নিবো? কিভাবে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এক তো মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস নাই, তারউপর বাস ভর্তি মানুষের সামনে!! সরি বললে হবে কিনা, যদি আবার সবার আমায় ধমক বা অন্য কিছু বলে উঠে! এদিক ঐদিক ভাবতেছি, হঠাৎ মেয়েটা খুবিই নীচু স্বরে বললো আপনাকে ঐ কথাটা বলার জন্যে সরি! আসলে খুবই দ্রুত ঢাকা যেতে হবে, তার উপর আবার বাস লেইট, এসে আমার সিটে আপনার ব্যাগ দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেল।

মেয়েটার কথাগুলো শুনে নিজেকে খুবই নিম্নপ্রজাতির এক জিব মনে হলো, মেয়েটা কান্না থামানোর জন্যে যখন হেসকি দিচ্ছিলো, আমার মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবো। এমন সময় কন্ট্রাক্টরের আওয়াজ শুনলাম “পোস্তগোলা পোস্তগোলা” পাথরের মত সিট থেকে উঠে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম, না সরি বলতে পারলাম, না সরি বলার মত কিছু নিয়ে আসতে পারলাম। শুধু কিছু অজানা কষ্ট আর এক ভিন্ন সফরের অভিজ্ঞতা ছাড়া।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত