পাপের ফল

পাপের ফল

বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফিরেই বন্ধুর দেয়া একটি সংবাদে কিছুটা থামকে গেলাম। পিতার পরিচয়হীন আরো একটি নবজাতকের জন্ম দিলো এই প্রবাসী নারী ম্যালিনা। হয়ত তার এই অপরাধের জ্বলন্ত প্রমানের দৃশ্য আমাদের না দেখানোর জন্যই তাড়াহুড়ো করে এয়ার টিকিট কিনেছিলো, তার আপন দেশে ফিরে যাবার জন্য।
শরীর সুস্থতার অস্বাভাবিক বিপর্যয়ের কারণেই তার সেই চেষ্টায় সফল হয়নি। সেদিন আমি তার শরীরের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, তোর পেটে কি বেবী আছে নাকি! আমার উপরে ক্ষেপে ১ সের থেকে ৫ সের হয়েছিলো। আমি সরি বলে ক্ষমা চেয়েছিলাম। ভিনদেশী নারী, যদিও সহকর্মী, ইয়ার্কি বুঝেনা তা প্রথম জানলাম। ম্যালিনার কথাবার্তা চলাফেরায় কেউ বুঝতে পারবেনা যে এ নারী এমন নিকৃষ্ট কাজে জড়াতে পারে। গতবছর যখন গর্ভবতী হয়েছিলো, তখন দেশে গিয়ে বাচ্চা প্রসব করে বিক্রি করে এসেছে। বাচ্চা বিক্রির খবর ছড়িয়েছে তাদের প্রতিবেশী এক সহকর্মীর মাধ্যমে। ম্যানিলা আগে সৌদিআরব ছিলো ৫ বছর। সেখানে গিয়েও একই কাজ করেছে, প্রতিবেশী তাকে হারাম টাকার কুমির বলে।
প্রবাসে হালাল কাজের আড়ালে দেহব্যবসা করে নিজ দেশে টাকার পাহার গড়েছে ম্যানিলা। পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান প্রসবের ব্যপারে আমরা যতটাই লজ্জিত অনুভব করি ম্যানিলা ব্যাপারটা হয়ত ততোটাই স্বাভাবিক মনে করে। যাই হোক, বন্ধুর দেয়া সংবাদে আমার মাঝে ভালো বা মন্দ কোনো অনুভূতি জাগলো না। আমি বন্ধুকে শুধু বললাম,
এটা তার বার্ষিক বোনাস হিসেবেই গণ্য হলো।
বন্ধু বিস্তারিত জানার আগ্রহে বললো,
কিভাবে হলো বার্ষিক বোনাস!
ম্যানিলা তার দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে এসেছে একবছর হয়েছে? – প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম বন্ধুর কানে।
কতক্ষণ ভেবে বললো,
না, এখনো একবছর হয়নি।
একটা সন্তান জন্ম দিলো এক বছর না যেতেই আর এক সন্তানের মা হলো। এই সন্তানের পিতা কে জানিস?
কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো।
এখানের কেউ হবে,
ধরে নিতে পারো আমরা সকলেই এই সন্তানের পিতা, যতক্ষণ না ম্যানিলা বলে এই সন্তানের শরীরে কার রক্ত বয়ে চলছে, কার রক্ত এটা কতটুকু লজ্জার হতে পারে।
তা ঠিক বলেছিস, অনেকের সাথেই তার গভীর ভাব,
হু, টাকার লোভ যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে এভাবেই বছরে বছরে বোনাস দেন আল্লাহ্‌। আগের বেবীটা বিক্রি করেছে শুনেছিস?
হ্যাঁ, শুনেছি।
টাকার লোভের কাছে রক্তের কোনো মূল্য নাই। মনে কর এমন একটি ঘটনা বাংলাদেশের কোনো গ্রামে ঘটলো, তখন পরিস্থিতি কেমন হবে?
গ্রাম থেকে তাদের তাড়িয়ে দেবে সমাজের মানুষ।
এখানে?
এখানে তো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিচ্ছে সকলে।
ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর তাই এমন কুকর্মে লিপ্ত হচ্ছে মানুষ। আর এসবকে অতি স্বাভাবিক ভাবেই সকলে মেনে নিচ্ছে। – আমার কথা শেষ না হতেই বন্ধু কথার মাঝেই বললো।
এসকলের জন্য আমরা প্রবাসী ছেলেরাই দায়ী, আমরা যদি ওদের কাছে না যাই, তাহলে ওরা এমন খারাপ কাজে লিপ্ত হতে পারতোনা।
আমি আস্তে হেসে বললাম। কেউ কেউ দায়ী। গড়ে সকলকে বলা ঠিক নয়। এখানে অনেকেই আছে মেয়েদের ধারে কাছেও যায়না। তারা সব সময় চিন্তা করে দেশে তাদের সন্তান পিতামাতা রয়েছে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। তাদের স্ত্রীরা কত ধৈর্য ধরে আছে স্বামীর পথপানে, যেসব স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের কথা মনে করবে, তাদের স্ত্রীকে ভালোবাসবে, তারা কখনো এমন ম্যালিনাদের সাথে টাকার বিনিময়ে বা এমনিতে তাদের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবেনা।
এই একটা মহিলাই পুরো কম্পানির কলঙ্ক।
সে টাকার জন্য এখানে এসেছে, তার টাকা চাই, তা হালাল উপায়ে হোক বা হারাম উপায়ে হোক। শুনেছি তার দেশের বাড়িতে যে ঘর তুলেছে তা আমাদের দেশের মন্ত্রীর বাড়ির থেকেও বেশী দামী।
হ্যাঁ আমিও শুনেছি।
দুই দিন পরে বন্ধু সিরাজ এসে গল্পের এক পর্যায়ে বললো।
জানিস দোস্তো; ম্যালিনার একটি আনকমন বেবী হয়েছে।
আনকমন মানে?
বাচ্চাটার চোখ হয়েছে চায়নাদের চোখের মতো, হাত পাকিস্তানীদের মতো ঘনো লোমে ভর্তি। মুখের গঠন, নেপালীদের মতো।
বাঙালীর মতো কি হয়েছে! হাসির মাত্রা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গায়ের রঙ আমাদের মতো।
ইন্ডিয়ার লোকের গায়ের রং তো আমাদের মতো।
তাহলে বড় হয়ে এই বেবীটা বাংলায় কথা বলবে– গল্পে গল্পে দুজনেই হেসে দিলাম।
বাঙালীরা যে সবাই সাধু, আমি তা বলছিনা। পাকিস্তানী এক সহকর্মীর সাথে ম্যানিলার গভীর ভাব ভালোবাসা ছিলো, এটা এখানের সকলেই জানে। পরে শুনেছি এই পাকিস্তানী সহকর্মী কমিশনের বিনিময় সে গ্রাহক যোগার করতো। এই পাকিস্তানীকে কখনো দেশে টাকা পাঠাতে দেখিনি। তা স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। কথায় আছে, পিঠের জ্বালা সয়, পেটের জ্বালা সয়না।
কম্পানির সহযোগিতায় ম্যানিলার বাচ্চার পাসপোর্ট করা হলো, পাসপোর্টে নবজাতকের নাম রাখা হলো আবদুল্লাহ, পাসপোর্টে শিশুর নাম দেখে কিছুটা অবাক হলাম, পরে জানলাম যেসকল মহিলারা এমন অবৈধ শিশুর জন্ম দেয়, তাদের সন্তানের পিতার কোনো পরিচয় থাকেনা, সেসব শিশুর নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ। মালয়েশিয়াতে এমন ধারা রয়েছে, আমাদের বাংলায় এমন আছে কি না আমার জানা নেই। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ, শিশুরা যেহেতু নিষ্পাপ সে দিক দিয়ে আমিও একমত ম্যালিনার শিশুর নাম আবদুল্লাহ রাখাতে।
১৫ দিন বাদে ম্যালিনা আব্দুল্লাহকে নিয়ে তার আপন দেশে চলে গেলো, আমরা সকলেই ভেবেছিলাম লজ্জায় হয়ত আর ম্যালিনা এখানে ফিরে আসবেনা। ম্যালিনা চলে যাবার পরে বেশ কিছুদিন সকলে ম্যালিনার আলোচনায় ব্যস্ত থাকতো, তারপর সব আগের মতো শান্ত নিরব হয়ে গেলো।
তিনমাস না যেতেই আবারো ম্যালিনা বাচ্চা রেখে মালয়েশিয়া চলে এলো, কেউ কেউ বলছিলো, এই মহিলার লাজ লজ্জা বলতে কিছু নাই, যদি লজ্জা শরম থাকতো, তাহলে আর সে এখানে আসতো না। আমি মনে করি লজ্জা আমাদের পুরুষ সমাজের হওয়া দরকার।
প্রায় ছয়মাস বাদে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা এলো, সকল প্রবাসী কর্মীদের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। সরকারি ক্লিনিক থেকে ডাক্তার এসে এক এক করে নারী পুরুষ সকলের রক্ত নিয়ে গেলেন পরীক্ষার জন্য। একসপ্তাহ বাদে ম্যালিনা সহ চারজন সহকর্মীকে অফিসে ডাকা হলো, ডেকে অফিসের ইনচার্জ জানিয়ে দিলেন, এই চারজনের রক্তে HIV ধরা পরেছে ম্যালিনার শরীরে
HIV সহ তার উদরে আরো এক শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। ম্যালিনার চোখে এই প্রথমবার সকলে অশ্রু গড়িয়ে পরতে দেখেছে। অন্য তিনজনের শরীরেও ম্যালিনার সাথে দৈহিক মেলামেশার কারণেই এমন মরণ রোগ ছড়িয়েছে।
তাদের টিকিট কাটা হয়েছে তিনদিন বাদেই তাদের যারযার দেশে পাঠানো হবে। ম্যানেজারের কথায় তারা তেমন গুরুত্ব দিলোনা। ম্যালিনা বাদে বাকি তিনজনেই নিজেরা গিয়ে পার্সোনাল ডাক্তার দিয়ে তাদের রক্ত পরীক্ষা করালো, সেখানেও একই ফলাফল, তাদের রক্তে HIV ভাইরাস তাদের জীবন কেড়ে নেয়ার জন্য ধমনীতে দ্রুত তাদের বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। চারজনেই দরজা বন্ধ করে যে যার কক্ষে নিজেকে বন্দি করে রাখলো। অন্য কেউ তাদের দিকে এখন ফিরেও তাকায় না। সকলেই এই চারজন ব্যাক্তির নিকট থেকে দূরে থাকে। কেউ এদের সংস্পর্শে যায়না। একজন বাঙ্গালী সহকর্মী, আর দু’জন নেপালি সহকর্মী HIV তে আক্রান্ত। শুক্রবার রাতেই ম্যালিনা ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহনন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। তার পায়ের কাছেই রেখে যায় একটি ছোট্ট চিরকুট তাতে লেখা ছিলো।
“ওরা তিনজন HIV তে আক্রান্ত হবার জন্য আমি ম্যালিনা দায়ী। আজ আমি যে মরণ রোগে আক্রান্ত হয়েছি এ রোগ আমার পাপের ফল। আমি বেঁচে থাকলে হয়ত আরো অনেকেই এমন মরণ পথের পথিক হবে, তাই ভেবে আমি নিজেকে ঐ পথ থেকে চিরতরে মুক্তি দিলাম।” ইতি ম্যালিনা

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত