ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রুমমেটের ফোন থেকে গার্লফ্রেন্ডরে কল দিলাম। তার এই নাম্বার চিনার কথা না। ভাবলাম একটু মশকরা করি…
-হ্যালো রূপা
-শালার পো..আমি রূপা না, হিমি।
-ওহ্
-তোমার হিমুগিরি আর আহ্ ওহ্ রেখে আগে বলো চাকুরি হইছে?
-উঁহু..
-আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে। এসে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যেও। ফোন রাখলাম, বাই।
আশ্চর্য মেয়েটা রেগে গেল কেন! আর আমার তো আগামী সপ্তাহে খেলে হবে না। আজকে খেতে হবে। পাঁচশ টাকা দরকার। তাই তাকে ফোন দিয়েছিলাম।
আমার হিমুর মতো ঢাকা শহরে কোনো মাজেদা খালা নেই। তবে দূরসম্পর্কের এক ফুপু আছে, পাতানো ফুপু। দেখি সেখানে গিয়ে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
রাত বারোটার দিকে পাতানো ফুপুর বাসার সামনে হাজির হলাম। কিন্তু দারোয়ান বেটা কোনোভাবেই এতরাতে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। ফুপুকে যে একটা ফোন দিব সেই অবস্থাও নেই।
দেখি দারোয়ান বেটারে কোনোভাবে বিব্রত করা যায় কিনা। বিভিন্ন টেকনিক এপ্লাই করলাম। কিন্তু বেটা কোনোভাবেই টলে না। শেষে আমার উপর এক প্রকার বিরক্ত হয়েই বেটা বলল, “দেহেন রাহাত ভাই, আমার সাথে হিমুগিরি দেখাইতে আইবেন না। এমন কত হিমু এই হাতের তল দিয়া গেল-আইল।”
-জি..
-আর শুনেন, আপনার ফুপুই আপনারে ঢুকতে দিতে মানা করছে। শুনলাম আপনি নাকি তার কাছ থিকা এত টাকা ধার করছেন যে আপনারে নিয়া কাওরান বাজার বেচলেও সেই টাকা শোধ হইব না।
-কথা সত্য..
এইখানে থাকা মানে টাইম নষ্ট। অন্য কোথাও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন মজিদ মিয়ার দোকানই ভরসা। দেখি সেখানে গিয়ে কোনো টালটি-বালটি করা যায় কিনা।
মজিদ মিয়া দোকান বন্ধ করে দিবে। গোছগাছ করছে। মজিদ মিয়ারে একটু চমকে দেওয়া দরকার।
-আসসালামু আলাইকুম মজিদ ভাই…
-ওয়ালাইকুম..
-মজিদ ভাইয়ের মনডা বোধহয় খারাপ?
-খারাপ তো থাকবই, আপনারা টাকা-পয়সা দেন না। তা আমার খাতাডা কবে কিলিয়ার করবেন?
-করব, করব…তার আগে আপনারে একটা খুশির সংবাদ দেই।
-কী..আপনের চাকরি হইছে?
-আরেহ নাহ্..খুশির সংবাদটা আপনার, আমার না।
-ওহ্..বলেন, শুনি।
-আপনি এবার বাবা হবেন, মজিদ ভাই।
-কী?
-কী আবার, অবাক হওয়ার কী আছে! আপনি বাবা হবেন, বাবা।
-মিয়া, ফাইজলামি করেন আমার লগে! হলুদ পাঞ্জাবি পইরা কী নিজেরে হইলদা সাধু ভাবেন?
-কী হইছে ভাই রাগেন ক্যান?
-ফাজিল রাগি ক্যান, না। গাল বরাবর একটা দিলেই বুঝবা ক্যান রাগি! আর কাইলকা রাইতের মধ্যে তুমি আমার দোকানের সব ধার শোধ করবা। এরপর তোমারে যেন আমার দোকানের আশেপাশে আর না দেখি। দেখলে ঠেঙের নলীডি এক্কেরে ভাইঙা দিমু।
অবস্থা বেগতিক। এখানে আর থাকা যাবে না। তবে মজিদ ভাইয়ের দোকানের কর্মচারীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যা শুনলাম, তাতে মনে হলো অবস্থা এর থেকে ভয়াবহ হলেও কিছু করার ছিল না। কিছুদিন আগে ডাক্তার বলেছে মজিদ ভাই কোনোদিন আর বাবা হতে পারবেন না। আর গতকাল মজিদ ভাইয়ের স্ত্রী নাকি তার সাথে এইগুলা নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
আমার হিমুগিরি করা আর হলো না। আর কোনো অপশন নেই। মেসে ফিরাই এখন একমাত্র ভরসা।
রাত তিনটা বাজে। মেসের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণ যাবৎ ঠকঠক করছি। কারো খোলার নামগন্ধ নেই। আরো জোরে ধাক্কাতে লাগলাম। ঠক্ ঠক্ ঠকঠক…
আমার গেইট ধাক্কানোর শব্দে মেসের কেউ না আসলেও আশেপাশের এলাকার সব কুকুর ঠিকই চলে এসেছে। তারা এখন আমার চারপাশে এসে ঘেউঘেউ করছে। ঘেউ ঘেউ ঘেউঘেউ…
কুকুরগুলোর ইনটেনশন সুবিধার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় কামড়ে দিবে। এখান থেকে সড়ে দাঁড়ানো দরকার।
আমি হাঁটা শুরু করলাম। কুকুরগুলোও পিছু পিছু হাঁটছে। আমি গতি বাড়ালাম, কুকুরগুলোও বাড়াল। আমি এক প্রকার দৌঁড়ানো শুরু করলাম, কুকুরগুলোও দৌড়াচ্ছে।
আমি জানপ্রাণ দিয়ে দৌড়াচ্ছি। আর আমার পিছনে দশ-বারোটা পাগলা কুকুর। এলাকার গলি পেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে এসে এরা শান্ত হলো।
আমি একটা বন্ধ চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে হাঁপাচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় যেন পায়ের সেন্ডেল ফেলে রেখে এসেছি খেয়াল নেই।
জিরানো শেষে এবার হাঁটা শুরু করলাম। খালি পা, কালো পেন্ট, হলুদ পাঞ্জাবি, শূন্য পকেট। শরীরে একটা হিমু হিমু ভাব চলে এসেছে। কিন্তু খিদায় তো পেট চুচু করছে, খাবো কী? জোছনা খাওয়া যেতে পারে। ধূর ছাই! জোছনা পাবো কই? আজকে তো আমাবস্যা রাত।