এবার ঈদে বাড়িতে গিয়ে আব্বু – আম্মুর উপর দারুণ প্রতিশোধ নিলাম! কি? নিশ্চয়ই চোখের ভ্রু কুঁচকে গেছে আপনাদের? অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে? একজন সন্তান হয়ে বাবা-মায়ের উপর কিসের প্রতিশোধ?
আমি যখন ইন্টার পড়ুয়া ছাত্র। তখন আমি সম্পূর্ণ বেকার এক যুবক। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন বেকার থাকা মানে আস্ত একটি পাথর দূর্বাঘাসের উপর পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একই কথা। ঘাস যেমন আস্ত পাথরের নিচে অক্সিজেন ছাড়া কোনোমতে বেঁচে থাকে ঠিক তেমনই একটি পরিবার একজন বেকার যুবকের স্পর্শে অক্সিজেনবিহীন দিনানিতিপাত করে। ঠিক ঐ সময় উপলব্ধি করতাম,বাবা- মা আমার উপর ভীষণ বিরক্ত। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ানো,ঘুম আর খাওয়া-দাওয়া। এ নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে অনেক কথা শুনতে হতো।
বাস্তবিক অর্থে এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। একটি শক্ত সামর্থ্য যুবক বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে কিংবা আধুনিক সমাজে থাকলে সবক্ষেত্রেই অবহেলিত হয়। ঐ সময় বাড়িতে দুধ,ডিম, মিষ্টিজাতীয় খাবার প্রায়ই আয়োজন করা হতো। তখন দেখতাম, আমার আম্মু আব্বুর জন্য একটু বেশি পরিমাণে রেখে দিতেন। একদিন এক দুপুরের ঘটনা, বাড়ির মুরগিতে তিনটে ডিম পেড়েছে। আমার আম্মা তিনটি ডিম সেদ্ধ করে দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছেন। খাওয়া – দাওয়া শেষে দেখলাম,আমার আম্মা, সবচেয়ে বড়ো ডিমটি আব্বুকে দিলেন। বাকি সেদ্ধ ডিম দুটি ছোট দুইবোনকে দিলেন। বাকি আমি আর আম্মা। ছোট দুইবোন আবার তাদের ডিমের অর্ধেক অংশ করে আম্মাকে দিলেন। আমি বুঝতে পারছি, আমাকে ডিম দেয়ার মতো এখানে আর কেউ নেই। জিভে হালকা জল এলেও চুপ করে রইলাম।
এ দেখে ছোটবোন নুসরাত বললো, আম্মু,ভাইয়ার জন্য ডিম কৈ? আম্মু উত্তর দেয়ার আগেই আব্বু উত্তর দিলেন, ” ডিম তাদের খেতে দেয়া হয় যারা নিয়মিত পড়ালেখা কিংবা শরীর খাটিয়ে কাজ করে। তোর ভাই আবার কি করে”। আমি এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম, হয়তো আম্মা আরেকটি ডিম সেদ্ধ করে আমাকে দেবে। আব্বুর কথা শোনার পর আর বসে থাকা গেলো না খাবার টেবিলে। আমি উঠতে যাবো ঐ সময় আম্মু ছোটবোনকে বললো,” দুপুর থেকে একটি মুরগি ডাক পাড়ছে। হয়তো বিকালে ডিম পাড়বে। তখন ঐ ডিম তোর ভাইয়াকে সন্ধ্যায় সেদ্ধ করে দেবো”। বুঝতে পারলাম,আম্মু স্বান্তনার বাণী উচ্চারণ করলেন। কেননা আমার দেখামতে বাড়িতে কোনো মুরগি কক কক করে নাই। সোজা রুমে গিয়ে দরজা ধপাস করে লাগিয়ে দিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই দিনটার প্রতিশোধ আমি নেবোই। এমন একদিন আসবে, মুরগির সকল ডিম আমাকে আদর করে খাওয়ানো হবে।
দীর্ঘদিন পার হবে হলো। পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় ভালো বেতনের একটি চাকরী পেয়েছি। বলতে গেলে পুরো পরিবার আমি সামলায়। আব্বুর বয়স হয়েছে। আগের মতো খুব একটা কাজ করতে পারে না। আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। এ নিয়ে আব্বু আম্মুর চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ফোন দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরেই আমার বিয়ের কথা বলে। আমি এটা এড়িয়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয়। মনে মনে বলি, ডিম খাওয়ার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত কোনো বিয়ে আমি করছি না। অতো বোকা আমি নই। মন তৃপ্তি করে অতি আদরের সহিত ঘরের সকল খাবার না খাওয়া পর্যন্ত কোনো বিয়েটিয়ে নয়। তাছাড়া ছোটদুইবোন পড়ালেখা করছে। তাদের একটি ভালো অবস্থান না করে দেয়া পর্যন্ত বিয়ে আমি করছিনা।
সামনে ঈদ। এবার বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়ের উপর প্রতিশোধ নেবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ঈদের আগেরদিন বাড়িতে পৌঁছে আব্বুকে বললাম, আব্বু ঢাকার খাবার খেতে খেতে জীবন শেষ হয়ে গেলো আমার। জানেনই তো, ঢাকার খাবারগুলো ম্যাক্সিম্যাম ফরমালিন যুক্ত। এ কথা শোনার পর আম্মু আব্বুকে বললো, “হ্যাঁ গো শুনছো, ছেলেটা আমার সত্যি ঢাকা গিয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। আগে কত্ত নাদুসনুদুস ছিলো আমার বাবুটা। তুমি এখন বাজারে যাও। বাজারে গিয়ে সবচেয়ে বড়ো মাছটা কিনে আনবে। আমার সোনাবাবুকে আমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো। ও আসবে বলে আমি চারটা মুরগির ডিম যত্নে তুলে রেখেছি। রাতে দুটো ভেজে দেবো আর দুটো সেদ্ধ সেদ্ধ করে দেবো। তুমি আর মোটেও দেরি করোনা,এখনি যাও।
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,লাভিউ আম্মু। জানো আম্মু, ঢাকায় লবণহীন তরকারী খেতে আমার আলসার হয়ে গেছে। এ কথা শুনে ছোটবোন ফিক করে হেসে আম্মুকে বলে, হ্যাঁ এখন আপনি আপনার ছেলেকে পেয়ে গেছেন,দুনিয়ার সব খাবার খাইয়ে গরুর মতো মোটাতাজা করেন। ছেলেকে পেয়ে এখনতো আমাকে চোখে দেখেন না। আম্মু বলে, চুপ অলক্ষুণে মেয়ে। ছেলেটা আমার ঢাকায় থাকে, সারাদিন কি খায় না খায়,কিছুই জানিনা। ওকে ছাড়া আমার আঁচলটা একদম ছিঁড়তে বসেছে। যা তুই চোখের সামনে থেকে। আমিও হাসতে হাসতে রুমে চলে গেলাম। এবার দরজা কিন্তু ধপাস করে লাগায়নি। আস্তে করে লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে বালিশটা মুখে চাপা দিলাম। আমার হাসি কিছুতেই থামছে না। অবশেষে আমার প্রতিজ্ঞা সফল হতে যাচ্ছে ভেবে মনে মনে দারুন নাচছি। রাতে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
আম্মু মাছের বড়ো মাথাটা আব্বুর প্লেটে দিতে যাবে ঐ মুহুর্তে আব্বু আম্মুকে আটকিয়ে দিলেন। আব্বু বললো, আরে কি করছো, মাছের মাথাটা তোমার ছেলেকে দাও। আর ডিম ভাজা কৈ? দুর্জয় তো ডিম ভাজা খেতে খুব পছন্দ করে। আব্বুর কথা শুনে আম্মু মাছের বড়ো মাথাটা আমার প্লেটে দিলো। আমি তো মনে মনে এটায় বলছিলাম, মাছের মাথা ওদিকে দাও ক্যান,আমারে দাও। আর ডিম ভাজা কৈ। আম্মু চিৎকার দিয়ে বলে, কৈ রে নুসরাত,মরেটরে গেলি নাকি। তোর ভাইয়ার ডিম ভাজাটা নিয়ে আয়। কতক্ষণ লাগে ডিম ভাজতে তোর। রান্নাঘর থেকে ছোটবোন নুসরাত উত্তর দেয়, হ্যাঁ আম্মু হয়ে গেছে। নিয়ে আসছি।
একেতো চুলার তাপ তার উপর আম্মুর বকুনি, সবমিলিয়ে নুসরাত ৪২০ হাই ভোল্টেজে আছে, ডিম এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও ডিম ভাজা। ছেলেকে পেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে। যখন ছেলে ঢাকায় চলে যাবে তখন দেখবো, আপনি কাকে এতো আদর করেন। হাজারবার ডাকলেও আমি শুনবো না। এই নিয়ে খাবার টেবিলে অনেকক্ষণ হাসাহাসি করলাম আমরা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে গেলাম। তৃপ্তির একটা ঢেঁকুর তুলে হাত পা টান করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অনেক ঝাক্কাস মুডে আছি। এতোদিনে আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হলো। জোরে হাঁক ছেড়ে নুসরাতকে ডাকলাম।
জ্বী ভাইয়া কিছু বলবেন? এদিকে আয় গুড্ডু। নুসরাত কাছে আসলে বললাম, কতদিন তোকে দেখিনা। আমার ঘুমও হয়নারে গুড্ডু। তুই বিছানায় বোস, তোর কোলে মাথা রেখে অনেকদিন ঘুমায়না। একথা শুনে নুসরাত হাসতে হাসতে বিছানায় বসে গেলো। আমি তার কোলে মাথা রেখে চোখটা বন্ধ করলাম। নুসরাত আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছে, ভাইয়া এবার একটা বিয়ে করে ফেলেন। আমার একটা সুইটিটুইটি ভাবি চাই। আর তাছাড়া আম্মুও চাচ্ছে তুমি বিয়ে করো। বয়স হয়েছে, এসময় তাদের নাতি নাতিন দরকার।
আমি শুনছি আর বলছি.. হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ