ছক্কা নয় নক্কা!

ছক্কা নয় নক্কা!

ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই তিনি ‘বড়াব্বা’। সৈয়দ মুহম্মদ তাছির উদ্দিন তালুকদার নামে কেউ তাঁকে চেনে না।

পুলিশের বড় কর্তা হিসেবে অবসর নেওয়া রাগী এই মানুষটি কখন কিভাবে সবার কাছে ‘বড়াব্বা’ হয়ে উঠলেন সে খবর অনেকের অজানা। শহরের এক প্রান্তে বিঘা দুয়েক জমির ওপর ছোট্ট দোতলা এক বাড়ি। সেখানেই তাঁর সারা জীবনের সংসার। স্ত্রী নেই। সন্তান নেই। এক কেয়ারটেকার ছেলে পলকই তাঁর এখন সব। ষাটোর্ধ্ব এই বুড়ো মানুষটাকে ফেলে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই পলকের। মানুষটা রাগী হলে কী হবে, ভেতরটা দয়ার সাগর। সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছ থেকে কেউ ফিরে গেছে—এমন নজির নেই। মা-বাবাহীন পলকও তাই বড়াব্বাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে সেই ছোট্ট বেলা থেকে। বিকেলে ক্রিকেটের আসর বসে বড়াব্বার বাড়ির ঠিক পাশেই। পলকের খুব ইচ্ছা করে ওদের সঙ্গে খেলতে। লুকিয়ে লুকিয়ে যে খেলেনি তা নয়। বড়াব্বা তা জেনেও কিছু বলেননি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পলক আর সেখানে খেলতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না।

বড়াব্বা ক্রিকেটের ভালোমন্দ নিয়ে কখনো কিছু বলেন না। সেদিনও হয়তো বলতেন না, যদি কাঠের বলটা ছক্কা হয়ে বিশাল আঙিনা টপকে তাঁর মাথা ছুঁয়ে না পড়ত। বড়াব্বা আঙিনার মাঝখানে বসে শীতের মিঠে রোদ পোহাচ্ছিলেন। তিনি আবার কথায় কথায় কথাও বলেন নিজস্ব খিচুড়ি ভাষায়। এ নিয়ে কে কী বলল, তা তিনি গায়েও মাখেন না। তো বলটা কপাল ছুঁয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার চেয়ে বড়াব্বার ভয়টাই ছিল বেশি। রেগেমেগে মাঠে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘কেডা মারছে বলডা? কেডা? বলডা মাথার মইধ্যে পড়লে আমি জিন্দা থাকতে পারতাম? পালাইছ ক্যান্ সোনার চান্দেরা, পালাইয়া বাঁচবা না। চেন আমারে? খাড়াও, দেখাইতাছি মজাডা!’ কে দেবে উত্তর? ভয়ে ততক্ষণে সবাই হাওয়া। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢোকেন বড়াব্বা। মোটরসাইকেল নিয়ে ছোটেন থানায়। জিডি করলেন এই বলে যে আবারও বল এভাবে আঙিনায় পড়লে সব খেলোয়াড়কে যেন পাকড়াও করা হয়। সেই সঙ্গে মাঠের দিকের দেয়ালটিও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এমন উঁচু করলেন, যাতে ছক্কার বল কিছুতেই উঠোনে পড়তে না পারে। এ জন্য ছক্কা মারতে আর ভয়ও থাকে না মাঠের ছেলেদের।

মাসখানেক পরের ঘটনা। বড়াব্বা সেদিন বিকেলে উঠানে বসেননি। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে ছিলেন ঘরে। পলক ভেবেছিল, বড়াব্বা ঘুমাচ্ছেন। মাঠে খেলা জমে ওঠার শব্দে পলক আর থাকতে পারেনি। পায়ে পায়ে বেরিয়ে গিয়ে বদলি ব্যাটসম্যানের জায়গা করে নেয়। কিছুক্ষণ পর ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে বড়াব্বা উঠে বসেন। বারান্দায় গিয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তাঁর ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা ছিঁড়ে কাঠের সেই বলটা উঠানে। দেয়ালের বেড়ার দিকে তাকিয়ে বড়াব্বা নিশ্চিত হলেন, না, বলটা বেড়া ছিঁড়ে আসেনি। মুখটা গম্ভীর করে মাঠে গিয়ে দেখেন, মাঠটা ফাঁকা। পলকটাও নেই। ভাবলেন, গেল কই ওরা? রাস্তায় পুলিশ ছিল কি? ভেবে ভেবে গেলেন তিনি সোজা থানায়। থানার বড় কর্তা দৌড়ে এসে বললেন, ‘নো প্রবলেম স্যার। খবর পেয়েই সব কটাকে পাকড়াও করে ফটকে ভরেছি। ব্যাটাদের অ্যাত্তো সাহস যে স্যারের…’। তাঁকে ধমক দিয়ে বড়াব্বা বললেন, ‘লেকচার রাখো। ধরার আগে আমারে একটু জানাতেও পারলা না? নিয়ে আসো সবাইরে আমার সামনে। ’ ছেলেরা কাঁচুমাচু মুখে বড়াব্বার সামনে এসে দাঁড়ায়। বড়াব্বা প্রশ্ন করেন, ‘মাইরডা দিল কেডা?’ সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ক্যাপ্টেন আসিফ জোড় হাত করে বলে, ‘ভুল হয়ে গেছে বড়াব্বা। মাফ করে দেন। আর এ রকম হবে না। ’ বড়াব্বা খেপে যান। ‘আর হইবে না মানে? ১০০ বার হইবে। মাইরডা কি ভূতে মারছেনি?’ পলক এবার সাহস করে এগিয়ে এসে বলে, ‘আমিই মেরেছি বড়াব্বা ছক্কাটা। একটু বেশি জোরে হয়ে গেছে। ’ ‘ছক্কা? এইডারে কয় ছক্কা?’ চেঁচিয়ে উঠলেন বড়াব্বা। পলকের চোখ তো ছানাবড়া। বড়াব্বা বলতে থাকেন, ‘বান্দর, এইডা ছক্কা? ৫৮ ফুট উঁচা টপকাইয়া বল গেলে ছক্কা হয় ক্যামনে? এই মাইরডারে নক্কা কওন যাইব না ক্যান্, আমারে বোঝা!’ ব্যাপারটা এবার মাথায় ঢোকে সবার। বড়াব্বার খুশি খুশি মনটাকে যেন দেখতে পায় সবাই। আনন্দে জড়িয়ে ধরে বড়াব্বাকে। বড়াব্বা বলেন, ‘আরে ছাড় ছাড় পাগলের দল। এই রহম আসমান ফাটা মাইররে নক্কা না কইলে কইব কোন মাইরডারে? ক্রিকেটের বড় ব্যাডারা এইডা দ্যাহে না? নিয়ে আয় দশ কেজি মিষ্টি। আমার সামনে বইসা খা। ’

‘হুররে’ বলে আনন্দে নেচে ওঠে সবাই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত