লামিয়ার হাত ধরে টান দিতেই বেঞ্চিটার ছোট্ট একটা আলপিনে বেজে জামার সামনের দিকের কিছুটা অংশ ছিড়ে গেলো। এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত এমন ঘটনা ঘটলো। এর আগেও ঠিক এই বেঞ্চিটাতেই ছিড়ে গিয়েছিলো লামিয়ার আরও একটি জামা। আজ আবারও একই ঘটনা ঘটলো। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে। লামিয়া কিছুই বলে নি। আর বলবেও না।
ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আলামিনের কাছে গেলাম। যদি কিছু টাকা ধার পেতাম লামিয়াকে একটা নতুন জামা কিনে দেবার জন্য। জানি লামিয়া আর এটা নিয়ে আমায় কিছুই বলবে না। কারণ ও জানে যে আমি টিউশনিতে যা টাকা পাই সব এনে আম্মুর হাতে তুলে দেই। আলামিনেরও নাকি হাত খালি। এরপরে শুভকে ফোন করলাম। শুভও একই কথা বললো। আসলে প্রয়োজনের সময় এমনটাই ঘটে।
বাসায় গিয়ে নিজের রুমে বসে ভাবতেছি-কী করা যায়! গতবার যখন জামা ছিড়ে গিয়েছিলো, তখন তো আম্মুর কাছে থেকে না বলে টাকা নিয়েছিলাম। তারপরে ও যেন কীভাবে টের পেয়ে আমাকে দিয়ে শপথ করিয়েছিলো যে আর কখনো যাতে ওর জন্যে মায়ের কাছে থেকে না বলে টাকা আনি। আর আমিও তো ওকে কথা দিয়েছি। কী যে করবো কিছু বুঝতেছি না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে লামিয়াকে বললাম যে আজ যেন ও আমার সাথে দেখা করে।
একই ভার্সিটিতে পড়তাম আমি আর লামিয়া। মাস্টার্স করার পরে কোন চাকরি না পেয়ে বেকার বসে আছি। কয়েকটা টিউশনি করিয়ে ছোট্ট একটা পরিবারকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। লামিয়া এবার মাস্টার্সের প্রথম বর্ষে। ওদের পারিবারিক অবস্থাও তত একটা ভালো নয়। লামিয়াই একমাত্র মেয়ে ঘরের। দুয়েকটা টিউশনি করিয়ে ভালোভাবেই চলে।
বিকেলে ঘুম ভাঙলো আযানের শব্দে। নামাজ পড়েই বের হয়ে পড়লাম। একটা টিউশনি আছে। দেখি সেখানে কিছু পাওয়া যায় কিনা অগ্রীম। কিন্তু না এখানেও ফলাফল জিরো। রাস্তায় বের হয়ে হাঁটছি। এর মধ্যেই লামিয়া ফোন করে ওকে ওর বাসা থেকে নিয়ে আসতে বললো। আমি রবিনের সাথে দেখা করেই লামিয়াকে নিয়ে প্রথমে কোন একটা কফিশপে গিয়ে কিছুটা ক্ষণ গল্প করে মার্কেটে নিয়ে ওকে একটা জামা কিনে দেবো। কিছু টাকা যোগাড় হয়েছে। কফি খেতে খেতে হুট করে লামিয়া আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ
— তোমার হাতের ঘড়িটা কোথায়?
— ওহ্! ঘড়িটা বাসায় রেখে আসছি ভুলে।
কথাটা বলেই আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম। লামিয়া কেমন যেন চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আমি বুঝতে পারছি। কফি শেষ করে লামিয়াকে বললামঃ
— চলো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নইলে মার্কেট বন্ধ করে দেবে।
— আমরা মার্কেটে কেন যাবো? (অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো লামিয়া)
— তোমায় একটা জামা কিনে দেবো। ওঠো, ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো।
— তুমি টাকা পেলে কোথায়?
— আজকে রবিনের বাসায় গিয়েছিলাম। ও কিছু টাকা দিয়েছে।
— টাকা দিয়েছে কেন?
— বন্ধুকে দিতেই পারে।
— রবিন ভাইয়া তো টাকা দেবার মানুষ নয়। কাউকে ধারই দেয় না।
— আজকে দিয়েছে আমায়।
কথাটা বলেই নিচের দিকে তাকালাম। লামিয়া আমার হাত ধরে বললোঃ ‘তিতাস, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো তুমি ঘড়িটা বিক্রি করে দাও নি তো?’ আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে আছি। লামিয়া আবার বলতে লাগলোঃ’তোমার শখের ঘড়িটা আমার জন্যে বিক্রি করে দিলে? আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?’ বোকাসোকা বাচ্চা ছেলের মত জবাব দিলামঃ ‘হু!’
— আচ্ছা, ওঠো তাহলে মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে তো। তোমায় একটা ঘড়ি কিনে দেবো। (লামিয়া)
— তুমি টাকা পেলে কোথায়? (অবাক নয়নে জিজ্ঞেস করলাম)
— আজকে টিউশনি থেকে বেতন পেয়েছি। তার উপরে আবার গত মাসের কিছু টাকা বাকি ছিলো। সেটাও দিয়েছে।
— না, আমার ঘড়ি লাগবে না। আমার কাছে যা আছে তা দিয়েই একটা কিনে নেবো।
— সবসময় তো তুমিই দাও আমাকে। আজ না হয় তোমার প্রেমিকা হিসেবে কিছু দিলাম।
— তাহলে ওই টাকা কী করবো?
— ওটা আম্মুর হতে তুলে দিও।
আমি ‘আচ্ছা’ বলেই বুকের মধ্যিখানে ওকে জড়িয়ে নিলাম। সেও যেন আর ছুটতে চাইছে না এখান থেকে। তারপরে বুকটায় আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বললোঃ ‘এই জায়গাটাতে আমার জন্যে একটা ঘর বানিয়ে দিও।’