সিংগাড়া-সমুছা

সিংগাড়া-সমুছা

রেস্টুরেন্টে বসে আপন মনে সিংগাড়া-সমুছা খাচ্ছি। দুটো সিংগাড়া আর দুটো সমুছা নিয়েছি আমি। একবার এক কামড় সিংগাড়ায় দিই আরেকটা দিই সমুছায়। তারপর একটা করে পেয়াজ আর কাঁচামরিচে কামড় দিই। আমার টেবিলে আমি একাই বসা আর কেউ নেই। কিছুক্ষণ পরই কেন যেন মনে হলো নেপালের ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। তাকিয়ে দিকে কলেজের ইউনিফর্ম পড়া একদল মেয়েলোক ঢুকতেছে। কলেজের নাম বলবনা চাকরী হারানোর ভয়ে। হুড়মুড় করেই ঢুকতে লাগলো ওরা।

ছোটখাটো একটা দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল কে কোন টেবিলের কোন চেয়ারটা দখল করবে বলে। কিছুক্ষণ যেতেই বুঝতে পারলাম চেয়ারের ঘাটতি হয়েছে। সবাইকে বসতে হলে তিনজনকে অবশ্যই আমার টেবিলে আসতে হবে। এরপরও একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শোনা যাচ্ছে ওদের মধ্যে আবার টিম লিডার ও অন্য বেশ কয়েকজনের কাছে এই রেস্টুরেন্টের খাবারই পছন্দ। তাই ওদের ডিসিশন, যেভাবেই হোক এখানেই খাবে।

আমি বাইরের দিকে থাকা চেয়ারটাতে বসেছিলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে আলতো করে ভেতেরর দিকে থাকা চেয়ারটায় নিজের পাছাকে ট্রান্সফার করে দিই। এমন ভাব নিয়েছি যেন আমি ওদেরকে দেখিইনি! আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম দুটো মেয়ে রেস্টুরেন্টে থাকা ছেলেটিকে কাছে ডেকে নিয়ে কি যেন বললো। বিষয়টা আমি কিছুটা টেরও পেলাম। ছেলেটি সোজা আমার কাছে এসে বললো,

-আর কিছু খাইবেন উস্তাদ?

-আরে বেটা খামুনা মানে! চারটে সিংগাড়া-সমুছায় কি এই পাগলার কোনদিন পেট ভরতে দেখছস?

এই বলে ওর হাতে চুপিসারে দশ টাকার একটা কড়কড়ে নোট ধরিয়ে দিলাম। সেও আমার মতো করে নাচতে শুরু করলো।

-আরে, কি যে কননা উস্তাদ, আপনের মতোন কি আর মানুষ ওয়! প্রতিদিনই তো আট-দশটা সিংগাড়া-সমুছা আর দু-তিনটা মোগলাই না খাইলে আপনের ওয়েই না। অবাক হলাম আমি। আমার টাকা দেয়ার কারণটা ও অদ্ভুতভাবে বুঝে ফেললো। পিঠ চেপে দিয়ে বললাম, ‘ফিউচারে তুই শাইন করবিই। সেটা যেকোন কাজই করিসনা কেন।’

অবশেষে বহু আলোচনার পর টিম লিডারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনজনকে আমার টেবিলে পাঠানো হলো। আরেকজনকে একটা টোল দেয়া হলো বসার জন্য। ওরা অর্ডার করলো দুটো করে সিংগাড়া আর একটা করে সমুছা। ততক্ষণে আমি চারটা খেয়ে সাবার করে দিয়ে আরো আনিয়ে নিলাম।

ওরা খেতে শুরু করলো। থুক্কু, খেতে নয় কথা বলতে শুরু করলো। খাওয়া থেকে যেহেতু কথা বলার পরিমাণটা বেশি ছিল তাই সেটাই বললাম। আমি আবার প্রচুর পরিমাণে সিংগাড়া-সমুছা খেতে পারি। আলোচনায় বুঝা যাচ্ছিল দু’একজন বাদে বাকি সব মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড আছে! প্রতিটি টেবিলেই একই খাবার নিয়ে জিহবার একতৃতীয়াংশ বের করে করে সেলফি তুলে সেগুলো তাদের কাছে মেসেঞ্জার যুগে পাঠানো হচ্ছিল। বুঝতামনা কিছুই যদি না তারা এসব করার সাথে সাথে না বলতো, ‘আমি না ওলরেডি আমার জানুকে পিক পাঠিয়ে দিয়েছি’, ‘এই রিতু, আমিও পাঠিয়েছি, তুই কি তোর বেবিকে পিক পাঠিয়ে দিয়েছিস?’ আরো কত রংঢংয়ের কথাবার্তা বলছিল ওরা।

কিছুক্ষণ পর আমার টেবিলে বসা মেয়েগুলো এগিয়ে গেল গ্রুপ ছবি তোলার জন্য। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো আমার। কেমন হয় যদি প্রত্যেকের প্লেট থেকে একটি করে সিংগাড়া হাওয়া করে দিই। যেই ভাবা সেই কাজ। কে আর আমাকে আটকায়। হাওয়া করে দিলাম তিনটে সিংগাড়া। ওরা ফিরে এসেই দেখে প্রত্যেকের প্লেট থেকে একটি করে সিংগাড়া উধাও! শুরু হয়ে গেল একে-অপরকে দোষারোপ করা। পরিস্থিতি ক্রমশই ভারি হতে লাগলো। একবার ভাবলাম স্বীকার করে ফেলবো পরে ভাবলাম চুরি যেহেতু করেই ফেলেছি স্বীকার আর করছিনা। এমন সময় টিম লিডার এগিয়ে এসে বিষয়টার রফাদফা করলো। ওদেরকে আবারো একটা করে অতিরিক্ত সিংগাড়া দেয়া হলো। কথা বলার জন্য খেতে খেতে পাশে বসা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম,

-আপনারা কোন কলেজে পড়েন?

-এইতো পাশের ‘ক (ক= কলেজের নাম)’ কলেজেই।

-ওহ আচ্ছা। কোন ক্লাসে পড়েন?

-ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।

-ওহ আচ্ছা।

দেখতে আমি বেশ ছোট মানুষ হওয়ায় কোন মেয়েই আমাকে তেমন পাত্তাই দিলোনা। ওরা ওদের মতো করে দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট সময় ধরে রেস্টুরেন্টিতে হৈ-হুল্লোড়ের সাথে এই তিন কামড়ের সিংগাড়া-সমুছা খেলো। ফটোসেশন করলো। সেলফি তুললো, গ্রুপ ছবি তুললো, পেয়াজে কামড় দিয়ে, কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে এভাবে-সেভাবে আরো কত কিভাবে যে ছবি তুললো বলে শেষ করবার নয়। সেই সাথে যাদের বয়ফ্রেন্ড আছে তাদের অনেককেই ভিডিও কল দিলো। নিজেদের মধ্যে বয়ফ্রেন্ডদের নাম ধরে ধরে হরেকরকম কথাবার্তা বললো। আমি বেচারা শুধু শুনেই গেলাম আর মস্তিষ্ক একটু ভালো হওয়ায় সবকটার নামের সাথে সাথে তাদের বয়ফ্রেন্ডের নামও মুখস্থ করে ফেললাম।

সদ্য নিয়োগ পেয়ে এই কলেজে আসলাম আমি। ক্লাস শুরু করার আগের দিন এসে বাসা নিই। ইংরেজি পড়াবো। আনুষ্ঠানিকভাবে সকলের সাথে পরিচিত হবারও তেমন পরিবেশ বা সুযোগ হয়নি। আর এসবের জন্য অপেক্ষাও করিনি আমি। দিনের প্রথম ক্লাসটাই আমার। ক্লাসে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গুডমর্নিং বলে উইশ করলো। আমিও করলাম। সবাইকে বসিয়ে প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে ওদেরও পরিচয় নিতে লাগলাম। পৃথিবীটা খুব ছোট। একজন মানুষের সাথে দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বার বা তারও বেশি বার দেখা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে আমার সাথে ওদের একদিনের ব্যবধানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটা হয়ত কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি ওরা। সেদিন থেকেই আমার জানামতে বয়ফ্রেন্ড থাকা মেয়েগুলোকে ওদের নিজেদের নাম ধরে না ডেকে ওদের বয়ফ্রেন্ডের নাম ধরেই ডাকতাম। ওরাও আমাকে প্রায় সময় সিংগাড়া-সমুছা এনে দিতো। আমিও খেতাম। তবে চুরি করে খাওয়া তিনটে সিংগাড়ার কথা ওদেরকে এখনো বলিনি!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত