“আম্মা একটা কথা বলবো। বলি?”
“হু, বল।”
“আমার ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবীরা সবাই ঘুরতে যাচ্ছে বান্দরবান, আমি কি যাব ওদের সাথে?” অনেকক্ষণ প্রস্তুতি নিয়ে তনু কথাটা বলেই ফেললো।
লতিফা বানু হাত থেকে চা নামিয়ে রেখে মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললেন,
“এখন কি যাওয়ার মোক্ষম সময় বলে তোমার মনে হয়?”
রেগে গেলে লতিফা বানু তুই থেকে তুমিতে নেমে আসেন। তনু বুঝতে পারলো অবস্থা সুবিধার না, তাই চুপ করে রইলো।
লতিফা বানু শুরু করলেন,
“এবার যাওয়া যাবে না। পৃথিবীর অবস্থা এমনিতেই বেশি ভালো না। ইসরায়েলে ইহুদিরা মুসলিমদের মেরে ফেলছে, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে কত বিগ্রহ, যেকোনো সময়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নেমে যাবে। কত মানুষ খাবার পাচ্ছে না, পানি পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় কি তোমার বান্দরবান যাওয়া উচিত?”
তনুর মনে হলো আসলেই তো কথা সত্যি! এ অবস্থায় কিভাবে কারো মাথায় আসতে পারে বান্দরবান ঘুরতে যাওয়ার কথা?
নিজের মনুষ্যত্বহীনতা দেখে খানিকটা ধিক্কার দিয়ে অন্যকাজে মনোযোগ দিলো।
এরপর অনেকদিন কেটে গেলো। ততদিনে ট্যুর, ট্রিপ ভুলে পরীক্ষায় মনোনিবেশ করেছে তনু। সেমিস্টার ফাইনালের পর
সবাই ঠিক করলো কক্সবাজার যাবে। তনু আবার গেলো আম্মার কাছে। ততদিনে ইহুদিদের মুসলিমহত্যা বন্ধ হয়ে গেছে,
কাশ্মীরের অবস্থা স্থিতিশীল, মানুষ খাবার পানি সবই পাচ্ছে।
“আম্মা একটা জিনিস….”
” হু, বল।”
“আমার বন্ধুরা এখন কক্সবাজার যাচ্ছে, তিনদিনের ট্যুরে। এবার আমি যাই?” খুব ইনিয়েবিনিয়ে তনু বললো।
লতিফা বানু টিভিতে সুলতান সুলেমান দেখছিলেন। মেয়ের কথা শুনে হাত থেকে রিমোট পড়ে গেলো।
” কক্সবাজার!! ওইখানে কয় কোটি রোহিঙ্গা আছে জানো? জানো তুমি? ওরা তোমার বয়সী মেয়ে দেখলেই ধরে ধরে রেখে দিচ্ছে। আমি চাইনা কোনো রোহিঙ্গা আমার মেয়ের জামাই হয়ে আসুক। পরে নাতি পুতি আটাশ গোষ্ঠী রোহিঙ্গায় ভরে যাবে। অসম্ভব!
তাছাড়া কক্সবাজারে দেখার মত কি এমন আছে ? এরচেয়ে তুমি বাথটাবে লবণ মিশিয়ে সেখানে শুয়ে থাকো। একই কথা।”
ক্ষণিকের মধ্যে একরাশ মুগ্ধতা ছেঁয়ে ফেললো তনুকে। মা’র সাথে কথা বললেই ও অবাক হয়ে যায়। এত বুদ্ধি মায়ের মাথায়! পরবর্তী তিনদিন তনু বাথটাবে সাবানের ফেনার সাথে লবণ আর বালু মিশিয়ে সেখানে শুয়ে থাকলো। আহ, কি যে শান্তি!সেই সাথে টাকাও তো বেঁচে গেলো।
তবে ফ্রেন্ডদের সাথে যাবার জন্য মনে মনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো তনু। একবার পিকনিকের জন্য ডিপার্টমেন্টের সবাই মিলে সিলেট যাওয়ার কথা হচ্ছিলো। তো তনু সেবার ঠিক করলো মায়ের কাছ থেকে পারমিশন না নিয়ে বাবার কাছে যাবে।
মেয়ের কথা শুনে আজমল হোসেন মেয়ের কথা শুনে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“তোমাদের গ্রুপে কয়জন ছেলে যাচ্ছে সাথে?”
“স্যার সহ উনিশ জন।”
“এই উনিশ জনের নাম, বাবা -মা, দাদা নানার নাম, বংশ, উচ্চতা, গায়ের রঙ, জন্মসাল, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং দুই কপি
পাসপোর্ট সাইজের ছবি আমাকে দিবে।
আর সাথে যে স্যার যাচ্ছেন তার এস.এস.সি, এইচ এস সি পরীক্ষার মার্কশীট, ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট, চাকুরির আবেদনপত্রের ফটোকপি, বৈবাহিক অবস্থা, লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, স্ত্রীর যাবতীয় তথ্যাদি আমাকে দিয়ে যাবে।”
তনুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মাত্র দুইদিন সময়ের মধ্যে এত তথ্য জোগাড় করা একদম অসম্ভব! এসব ভাবতে ভাবতে তনু যখন চোখ মুছছিলো, তখনই বাবা ঢুকলো রুমে।
“তোমার নাম্বারে ৬৩ টাকা দিচ্ছি। ২ জিবি কিনে ইউটিউব আর গুগল থেকে সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর ছবি, ভিডিও দেখে নিও৷ ”
ওয়াও! বাবা আসলেই চমৎকার একজন মানুষ। মাত্র ৬৩ টাকায় সিলেট ভ্রমন! এর চেয়ে ভালো মুহূর্ত আর কি হতে পারে? তনুর আসলেই মনে হলো এরকম রোদ বৃষ্টির মধ্যে দূর দুরান্ত ঘুরতে যাওয়ার কোন মানেই নেই।
অবশ্য মা সবসময় বলেছেন, “বিয়ের পরে জামাইয়ের সাথে ঘুরতে যাবি।” তনু ঠিক করে রেখেছে জামাইয়ের সাথে সম্পূর্ণ
বাংলাদেশ ঘুরে এরপর দেশের বাইরে ঘুরতে যাবে। তনুর চব্বিশ বছর বয়সে বিয়ে হলো রিফাতের সাথে। বিয়ের প্রথম রাতেই
তনু খাতা কলম নিয়ে বসলো কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে তার লিস্ট বানাতে।
এদিকে রিফাত আবার প্রচন্ড কৃপন;
ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াই করে না টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে দেখে, সেখানে ঘুরতে যাওয়া তো নিতান্তই বিলাসিতা!
অনেকদিন ধরে তনু ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেও রিফাত নানা অজুহাত দেখিয়ে তা ক্যান্সেল করেছে। একবার রিফাতের রাঙামাটি যাওয়ার কথা অফিসের কাজে। রিফাত ভাবলো তনুকে নিয়ে গেলে খারাপ হয় না। খরচও বেঁচে যাবে, আর মেয়ের ঘ্যানঘ্যানানিও
কমবে।
ওদিকে তনু তো খুব এক্সাইটেড ; এই প্রথম রিফাত ওকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এবারই প্রথম রিফাতের সাথে নাইট জার্নি করে অনেক দূরে কোথাও যাচ্ছে।
বাসে উঠার আগেই তনু কল্পনা করলো ওর চুল বাতাসে রিফাতের মুখে যেয়ে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, সে বৃষ্টির ফোঁটা দু’জনের মুখে এসে পড়ছে। ক্লান্ত তনু রিফাতের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমাচ্ছে! কি এক আবেগঘন ভ্রমন!
মা বুঝি এজন্যই বলতো, “বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে যাইস!”
রাত ৮ টায় নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বাস ছাড়লো। তনু প্রথম ত্রিশ মিনিট জানালার বাইরে তাকিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে অপেক্ষা করছিলো কখন রিফাত ওকে কাছে টেনে চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। কিন্তু অনেকক্ষন যাওয়ার পরও রিফাতের কোন খবর নেই।
কিছুক্ষন পর তনুর মনে হলো কাঁধে কি যেন ভেজা, যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে অার্দ্রতা। বাইরে কি বৃষ্টি হয়? না তো।
মুখ ফিরিয়ে দেখে রিফাত বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তনু’র কাঁধে।
আর মুখ থেকে গরুর মত অবিশ্রান্তভাবে নিঃসৃত হওয়া লালা ভিজিয়ে দিচ্ছে তনু’র কাঁধ, শাড়ি।
তনুর খুব ভালো লাগলো। রিফাত যতটা না আপন, তারচেয়েও বেশি আপন আপন লাগলো। কি সুন্দরভাবে লালা পড়ছে
রিফাতের মুখ থেকে! বেড়াতে না এলে কি তা তনু জানতো? বাস থেকে নামার পর তনু দেখলো রিফাতের হাতে এক্সট্রা একটা ব্যাগ।
“এই ব্যাগে কি রিফাত?”
“চাল, ডাল, আলু, শসা, ধুন্দল, পিঁয়াজ, মরিচ এসব। ”
“ঘুরতে এসে এসব কেনো?”
“আজকে তুমি আর আমি মিলে রান্না করবো। তাহলে বাইরে খাওয়ার খরচ টা বেঁচে যাবে, আর স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়াও হবে। তাছাড়া আজ থেকে কয়েকবছর পর তুমি প্রেগন্যান্ট হবে, আমাদের সন্তান আসবে। তার জন্য হলেও এসব অখাদ্য খাওয়া যাবেনা। ”
তনুর মন একধরনের নির্মল আনন্দে ভরে গেলো। এত কেয়ারিং স্বামী এই যুগে পাওয়া সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার।
রিফাতের মাথায় যে অন্তত এটা এসেছে তাতেই তনুর খুশিতে বাকবাকুম অবস্থা।
পাঁচদিনের ট্যুরে রিফাত সারাদিন অফিসের কাজ করলো, আর তনু বাসায় বসে রান্না করলো দু’জনের জন্য। আশেপাশের
বাসার দাড়োয়ান, বুয়াদের সাথে গল্প করে অনেক কিছু জানলো। তনুর মনে হলো রিফাতের সাথে না আসলে এসব মানুষের
সাথে পরিচয়ও হতো না, আর এত ভালোভাবে জানাও হতো না হয়তো! এসব কারনেই মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় তনুর। রাঙামাটির থেকে চলে আসার দিন রিফাতের হাতে এক বোতল পানি দেখে তনু জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কি?”
“তোমার জন্য নিজহাতে শুভলং ঝর্নার পানি এনেছি। তোমার যেতে অনেক কষ্ট হতো, তাছাড়া খরচাপাতির ও ব্যাপার
ছিলো। আমি থাকতে তোমাকে এমন কষ্ট কিভাবে দেই?”
তনুর চোখে আবেগে পানি চলে আসলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিফাতকে। এত ভালোবাসা সে সত্যিই আগে কখনো
দেখেনি।
এজন্যই বুঝি মা বলতো,
“বিয়ের পরে জামাইয়ের সাথে ঘুরিস!”