শহরটা যেন আজ বন্দী।ঘরের ভেতর থেকে জানালাটাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে।শহরটা যেন এর লোহার শিকের মধ্যে আটকা পরে গেছে। রাস্তা দিয়ে অসংখ্য গাড়ি চলছে।সাইকেল,রিক্সা,ভ্যান আরও কতো গাড়ি।
রিক্সা টিং টুং শব্দ করে চলছে অন্য দিকে রিম ঝিম শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে।রাস্তায় খুব অল্পই মানুষ দেখা যাচ্ছে।একেকজনের কাছে একেক রঙের ছাতা।সবাই খুব তারাতারি হাঁটছে।এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে থাকা যায়না যে। আম্মুকে বললাম,
-“একটু নিচে যাবো।বৃষ্টির মধ্যে হাতার ইচ্ছা হচ্ছে।“ আম্মু রাজী হলো না।মন খারাপ করে জানালার পাশে গিয়ে বসলাম।
আমার মনে হয় সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে রিক্সা চালকদের জীবনে।তাদের কোন ছাতার প্রয়োজন হয়না।বৃষ্টির মধ্যে ভিজেই তারা যাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছে।আর যাত্রীরা কি শান্তিতে রয়েছে।নীল অথবা সাদা পলিথিন দিয়ে তারা ঢাকা।বৃষ্টির কতো কাছে রয়েছে কিন্তু বৃষ্টি তাদের ধরতে পারছে না।অন্যরকম একটি আনন্দ।
এক বয়স্ক দাদুকে দেখলাম ধীরে ধীরে হেটে যাচ্ছে।তাঁর মাথার ওপর একটি ছাতা রয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটাকে ছাতা বলে চেনা যাচ্ছে না।ছাতার শিক গুলো ভেঙে কাপড় ওলট পালট হয়ে গিয়েছে।বৃষ্টি তাতে আটকাচ্ছে খুব সামান্যই।দাদুর মুখে বৃষ্টির পানি এসে লাগছে।
_”একী দাদু কি কান্না করছে?”
কেন আমার কাছে এমন মনে হলো?বৃষ্টির পানিও তো হতে পারে যা আমার কাছে চোখের পানির মতো লাগছে। দাদু গুটি গুটি পায়ে কোথায় যেন চলে গেলো।তখনই একদল মেয়েকে দেখলাম লাফালাফি করে যাচ্ছে।তাদের কাছে কোন ছাতা নেই,গায়ে নেই কোন রেইনকোট।ছয়জন তরুণী,সকলের পরনে লালপেড়ে সাদা শাড়ি।
_”আজকে তো বৈশাখ,বসন্ত কোনটিই নয়?তাহলে তারা এই ধরনের শাড়ি পড়েছে কেন?” যাই হোক অসাধারণ মানিয়েছে মেয়েগুলোকে। আম্মুর কাছে গিয়ে সোহাগমাখা গলায় বললাম,
_”আম্মু না আমার কতো ভালো।আমার শোনা আম্মু আমায় যেতে দাও না নিচে।ছাতা নিয়ে যাবো তো” আম্মু আমাকে নিচে যেতে দিতে রাজী হয়ে গেলো।
এলাকার রাস্তা থেকে বেড়িয়ে এসেছি।আমি হয়তো একমাত্র প্রাণী যে বিশ্ব রোডের মাঝখানে ছাতা হাতে এই বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে রয়েছি।এলাকার রাস্তায় তাও দুই একজনকে দেখা যাচ্ছিলো কিন্তু এখানে একজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।কি বিশাল রাস্তা কিন্তু জনোমানবহীন। হঠাৎ হঠাৎ এক দুইটি গাড়ি ঝরের বেগে আসছে আবার ঝরের বেগে চলে যাচ্ছে।মন চাইছে রাস্তার মাঝে বসে পড়ি।
যদি দেখতাম আমার বয়সী কোন মেয়ে আকাশী রঙের শাড়ি পরে ছাতা হাতে রাস্তায় ঘুরতে বেড়িয়েছে,অবাক চোখে বৃষ্টির ফোটা গোনার চেষ্টা করছে।কতোই না ভালো হতো।দুজনে মিলে এই জনোমানবহীন এই বিশাল রাস্তা ধরে হাঁটতাম। নিশ্চয়ই মেয়েটি আমার সাথে হাটতে রাজী হতো।কেনই বা হবে না?দুজন মানুষের মনের মিল যদি থাকে এতো তাহলে নিশ্চয়ই রাজী হতো।
এমন সময় সেই দাদুকে দেখলাম এক হাতে বাজারের ব্যাগ এবং অন্য হাতে ভাঙা ছাতা নিয়ে ফিরছে।দাদুতো পুরো ভিজে গিয়েছে।তাঁর ছাতা ধরার ধরন দেখে মনে হচ্ছে ছাতাটি ধরে রাখার জন্য ধরে রেখেছে শুধু।বৃষ্টির হাত থেকে বাচার জন্য নয়। আমি দাদুর দিকে এগিয়ে গেলাম।দাদু আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো।দাদুর পুরো মুখে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে।হয়তো তাঁর মন চাইছে বিশ্রাম নিতে কিন্তু তাঁর কোন উপায় নেই।
_”আচ্ছা এই বৃষ্টির মধ্যে কোন দোকান খোলা থাকে?নিশ্চয়ই থাকে টা নাহলে দাদু বাজার করে আনলো কোথা থেকে।“ দাদুকে বললাম,
_”দাদু আপনাকে আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই?”
দাদু আমার দিকে মমতামাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি দাদুর হাতে আমার ছাতাটি ধরিয়ে দিয়ে দাদুর ব্যাগ এবং তাঁর ভাঙা ছাতাটি নিলাম।ভাঙা ছাতাটি বন্ধ করার চেষ্টা করছি কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না।এবার আমি বুঝতে আপ্রছি কেন দাদু ছাতাটি অনিচ্ছা সত্যেও মাথার ওপর ধরে ছিল।কারন ছাতাটি তো বন্ধ হয় না।ছাতাটি পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম।
দাদুর ব্যাগটি নিয়ে তাঁর সাথে এগিয়ে যাচ্ছি।বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগছে।দাদু আমাকে ছাতার নিচে নেয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আমি যাচ্ছি না। দাদুর বাড়ির সামনে চলে এসেছি।দাদু আমাকে ছাতাটি ফিরিয়ে দিতে চাইলে আমি নেইনা। দাদু আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
_”দাদুভাই কোনোদিন বাবা মাকে কষ্ট দিয়ো না।ভালো থেকো” দাদুর কথার মধ্যে কতোটা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে সেটি বুঝতে আমার কোন সমস্যা হলো না।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছি।এখন এই বৃষ্টি আগের মতো ভালো লাগছে না।মেয়েগুলোকে দেখছি এখনো লাফালাফি করছে কিন্তু সেগুলো আমার কাছে অসাধারণ লাগছে না। বাড়িতে গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করে শুয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে,বৃষ্টি এখনো থামেনি।এতো ঠাণ্ডা লাগছে কেন আমার? আম্মুকে দেখছি আমার মাথায় পানি ঢালছে।ঠিক মতো কথা বলতে পারছি না।কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে।ঘোরের মধ্যে শুধু একটি কথাই বলে যাচ্ছি,
_”আম্মু আব্বু তোমাদের আমি খুব ভালোবাসি।কোনোদিনও তোমাদের কষ্ট দিবো না।“