হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। মাথা থেকে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। শার্ট-প্যান্ট দুইটাই ভিজে একাকার। মনে হচ্ছে, এইমাত্র পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠে এলাম। ফ্যানের সুইচটা অন করে ক্লান্ত অবশ দেহটাকে এলিয়ে দিলাম খাটে। ফ্যানটা সম্পূর্ণ স্পিডে ঘুরছে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে মোটে ও ঘুরছে না। এরকম হাজারটা ফ্যান চালালে ও হয়তো আমি শান্তি পাব না।
পুরো পাঁচ মিনিট নীরবতার সহিত শুয়ে থাকলাম। ততক্ষণে পরিস্থিতি ঠান্ডা। শরীরের সমস্ত ঘাম শুকিয়ে একাকার। গরমটা আর নেই। শীত লাগছে। উঠে ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিলাম। আচ্ছা! হুট করে এত গরম। আবার এত ঠান্ডা। এসব কেমনে? ভাবতে লাগলাম। ভাবতেছি এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। নিশির ফোন। মাথাটা আবারো গরম হয়ে গেল। ওর জন্যই আজ দৌড়ানি খেলাম। কি যেন একটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে, প্রথম দিনেই মা-মেয়ে মিলে দৌড়ানি দিল। ফোনটা রিসিভ করেই বললামঃ ‘ওই মুরগির বাচ্চাটাকে আমি আর পড়াব না।’
– ‘তুমি কি আজকাল মুরগির বাচ্চা পড়াও নাকি? শুনো, আমাদের বাসার মুরগিটা নতুন বাচ্চা দিয়েছে। ভাবছি, তোমাকে দিয়েই ওদের পড়াশোনাটা শেষ করাব।’ ‘ইয়ার্কি করবা না একদম।’
– ‘কি হয়েছে? কোন মুরগির বাচ্চার কথা বলছ তুমি?’ জানো না? নাকি না জানার ভান?’
– ‘সত্যিই তো জানি না। বলো দেখি।’ ‘হুঁ। শুনো তাহলে।’
– ‘বলো।’ ‘তুমি যে টিউশনিটা ঠিক করে দিয়েছিলে ওইটাতে তো আজকে যাওয়ার কথা ছিল। তাই না?’
– ‘হুম। যাওনি?’ ‘গিয়েছিলাম।’
– ‘তো!’
‘গিয়ে দেখি তোমার সেই বান্ধবীর ছোট বোন সেজেগুজে বসে আছে। জানোই তো, পিচ্চি বাচ্চাদের আমি খুব আদর করি।’
– ‘হ্যাঁ। তা তো জানি।’
‘যথারীতি পড়ানো শুরু করলাম। মেয়েটা বেশ করেই পড়ছিল। সবগুলো ব্যঞ্জনবর্ণ এক নিঃশ্বাসেই হাজিরা দিল।’
– ‘তাহলে তো ভালোই।’
‘রাখ তোমার ভালো। তারপর, ওর মা এল নাস্তা নিয়ে। দিয়েই চলে গেল। আমি ও, লোভ সামলাতে পারলাম না। খাওয়া শুরু করে দিলাম। আসলে, বিরিয়ানি ছিল তো।’
– ‘তারপর?’
‘খাওয়া শেষ পর্যায়ে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মেয়ের মাথায় আমার হাতের গুঁতো লাগল। দেখি, মেয়েটা গ্লাসভর্তী পানি আমার মাথার উপর ঢেলে দিল।’
– ‘হি হি হি। তারপর বলো।’
‘রাগে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই ভেজা শার্টে কেমনে বাড়ি যাব? রাগ কমানোর উদ্দেশ্যে মেয়েটাকে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম। মশা মারার মতো। কিন্তু, মেয়ে করল কি? আকাশ-পাতাল ভাঙ্গিয়ে কান্না জুড়িয়ে দিল। তারপর, ভিতর থেকে তার মা এল। হাতে একটা বাঁশ। আমার পিঠে বসিয়ে দিল এক ঘা। কে দেখে কার দৌড়? আমি তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে নেমে এলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়ের মা আমার পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে।’ ফোনের ওইপাশে শুনা যাচ্ছে নিশির হাঁসি। সে হাঁসছে। তার হাঁসিটা আমার একদমই ভালো লাগছে না। কোনোভাবেই না। সে পুণরায় জিজ্ঞেস করলঃ ‘তুমি ওকে মুরগির বাচ্চা বললা কেন?’
– ‘এর উত্তর শুনবা?’ ‘অবশ্যই।’
– ‘ছোটবেলায় আমাদের বাসায় কয়েকটা মুরগি ছিল। আম্মা আর বড় আপা মুরগি গুলো লালন-পালন করত। একদিন আম্মা অসুস্থ হওয়ায় আমাকে বলল মুরগিগুলোকে কিছু খাবার দিতে। আমি ও গেলাম। ছোট্ট একটা বাচ্চা আমার খুব ভাল লাগল। তাকে আদর করব ভেবে ধরলাম। আমার ধরতে দেরি হলে ও, মা মুরগির আমাকে ঠোকর দিতে দেরী হল না। ঠোকর দিয়ে শান্ত হলো না, আমার পিছু ধাওয়া শুরু করল।’ ‘তাই বলে, মেয়েটা মুরগির বাচ্চা?’
– ‘হিসাব করে দেখ, মেয়ের মা আর মুরগির মা আর মেয়ে আর মুরগির বাচ্চার মধ্যে সব কিছুই মিল।’ ‘তাই নাকি?’
– ‘হ্যাঁ। তাই।’ ‘কাল থেকে আর যাবে ওই টিউশনে?’
– ‘ভুলে ও না।’
‘আচ্ছা, রাখি।’ নিশি ফোন কেঁটে দিল। বিদ্যুৎ উধাও। ফ্যানটা বন্ধ হয়ে গেল। আবারো শুরু হলো গরমের ঝাপটা। ঘাম জমছে আবারো। বন্ধু অভ্রের বাসায় এসি আছে। ওর বাসায় যেতে পারলেই সমাধান। সিটের উছিলায় ওর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
গেইটের বাইরে বের হতেই দেখি দুইটা মা মুরগি তার বাচ্চাসহ আপনমনে খাবার খাচ্ছে। আমি ওইদিকে না দেখেই হাঁটতে শুরু করলাম। যার কপাল খারা, তার কপাল ভালো করার উপায় কি? ভাগ্য আমার সহায় হল না। একটা মুরগির বাচ্চা আমার পায়ের কাছে পড়ল। তারপর যা হবার তা-ই হলো। এক দৌড়ে আবারো উপরে উঠে গেলাম। মুরগির দৌড়ানির চেয়ে গরমটাই যেন বেশি শান্তির।