কামাল, মিনার সংসারে কাওছারে দেখার মানুষ নাই। কামাল তাই ভাড়া করা ভ্যানে এক কোনায় ছেলেকে বসিয়ে মানিক মহাজনের দোকান থেকে মালামাল খুচরা বাজারে বহন করে এক বেলা। বেলা দুপুর। ভ্যানে কাওছারের হাতের কাছে ফিডার।কাউছার নিজেই চুমুক দিয়া খেতে থাকে। আজ রোদের বড় তেজ বাপ-বেটায় সে রোদে পুড়তে পুড়তে মালামাল টানে। একসময় সেখানেই বস্তার উপর ঘুমিয়ে পড়ে কাওছার।
শক্ত বালিশের নিচে রাখা সস্তা মোবাইলটা বের করেই চমকে ধরমরিয়ে উঠে বসল মিনা। সর্বনাশ হইছে,আইজ আবার দেরি হইব!!
কি কইরা যে আইজ এত ঘুম আইছে,হায় হায় রে!! মিনা মনে মনে ভাবে। শেষ রাতে বৃষ্টিটা আইসাই বিপদ হইছে।আরামের ঘুম ঘুমাইছি বলতে বলতে তার লম্বা খোলা চুলে খোপাঁ গড়াতে গড়াতে বিছানা থেকে নামে। জামার একাংশ তার দেড় বছরের শিশুর হাতের মুঠোয় আটকানো।ছেলের হাত থেকে জামা ছাড়িয়ে উরুতে লুঙ্গি উঠিয়ে গভির ঘুমে থাকা জীর্ণ শরীরের স্বামী’র দিকে চোখ পড়ে মিনা’র বড় মায়া হয় মানুষটার জন্য।সারাটা দিন কত কষ্ট করে মানুষটা!! ছেলের কপালে চুমু দিয়ে মিনা হাড়ি হাতে ঘর থেকে বেরোয়। মেঝেয় খেতে বসে ভর্তা ভাত দেখে কালাম বলে, -আইজক্যা তোমার বেতন হইব না?’ -হইব মনে হয়..’ -তাইলে এক কেজি গরুর গোশত কিনমু’ মিনা শুকনা ভাত মুখে দিতে দিতে বলে, -কিনবা,কিন্তু আমি এ মাসে বাবু’র একজোড়া ভাল জুতা কিনমু কইছিলাম।এইজন্যে বেশি কইরা ওভার টাইম করছি।’ -হইব নে। টেকা পাইয়া দেখা যাইব নে!’ মিনা কথা বাড়ায় না।পেট ভইরা খাওনের আর রসের আলাপ পারনের সময় এহন না।
-এক নজর ছেলে কাউছারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,-
-বাবুরে এট্টু ভাল কইরা গোচল দিও,মাতার চুলগুলা আডা আডা লাগে।’ মিনা তড়িৎ বের হতে হতে বলে।
মিনা এখনও প্রডাকশন ম্যানেজার এর সামনে দাঁড়িয়ে।তাকে কাজ দেয়া হয় নাই। বস কর্কট চোখে তাকায় মিনার দিকে..বলে, -ওই,তর ডেলিদিন লেট হয় ক্যা?’ -গাড়িতে আসি দুর হয়।মাঝে মাঝে সময় মত গাড়ি পাইনা বস…’ -বাসা কাছে নিলেই পারস’ -এহানে বাসাভাড়া বেশি’ তাইলে করবি কি?আমার কাছে থাক,আমি একলা থাকি।’ মিনা মনে মনে গালি দেয়,’বুড়া শয়তান বেডা, বেজন্মার বেজন্মা। ‘ মুখে শুধু বলে -আমার জামাইরে পাঠামুনে স্যার…’ হে এতিম।আপনে তো আমাগো বাপের মতই।তাছাড়া হে না থাকলে আর দেরি ও হইবনা। পি.এম মিনার লোভনীয় কিশোরী কমল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আগুন চোখে। বিকালে বেতন হাতে পেয়ে মিনা কামালকে ফোন দেয় টয়লেটে গিয়ে -কাওছারের বাপ, আমি বেতন পাইছি।তিনশ টেকা এ মাসে বেশি।জুতা কিনমু যাবার সময়।’ -আকাশ তেমুন ভাল না।তাড়াতাড়ি আইয়া পরবা। বাবুর গাওত জ্বর আইছে। -কি কও??মাতায় এট্টু পানি দেও,ওষুধও কিনা আনমু নে। বেটারে এট্টু দেইখ্যা রাইখ।আমি আটটার দিকে আমু।মোবাইলে চাজ নাই কিন্তু। কতা আর হইব না মনে কয়।’
রাত আটটায় গামের্ন্টস ছুটি হল।মিনা বাস স্টপে রাস্তার পাশের জুতার দোকান থেকে জুতা কেনে। জুতা জোড়া কিনতে গিয়ে মিনার বেশ দেরি হয়ে গেল। আকাশ খারাপ করে এসেছে। জুতার দোকানের সামনে ফলের দোকান দেখে ছেলের জন্য আপেল ও কেনে সে ।মাস চলতে একটু কষ্ট হলে হোক,ছেলেটাকে ফলমূল খাওয়ানো হয়না।দেখলে কি খুশি হবে মিনা তাই ভাবে। ওষুধের দোকানে ঢোকার পর তুমুল এলোপাতাড়ি ঝড় বৃষ্টি শুরু হল।দোকানদার চাচা বলে,বৃষ্টিটা একটু থামলে যাও, এর মধ্যে যাইবা কেমনে?’
মিনা বলল,-না চাচা,বাচ্চাডার অসুখ!’ গাড়ি আসতেই মিনা ঝাপঁ দিয়ে উঠল। কন্টেকটার কেমন চোখে যেন তাকায়!! মিনা ভেজা ওড়না দিয়া ভালভাবে নিজেকে ঢাকে।
ভাড়া নিতে এসে হাতটা একটু স্পর্শ করল শয়তানটা। মিনা মনে মনে গালি দিল’ শয়তান বেডা’!!
পরের স্টপে সব যাত্রী নেমে গেল।মিনা গাড়ির খালি সিটগুলোর দিকে তাকায়।দুজন ছেলে যাত্রী আছে অবশ্য।
মিনার তবুও একটু অস্থির লাগতে থাকে।
একবার নেমে যাবার কথাও ভাবে। আবার ভাবে তার তাড়াতাড়ি যাওয়ার দরকার। এই বৃষ্টিতে গাড়ি যদি আর না ধরতে পারে?’ কন্টেকটার ড্রাইভারকে কি যেন বলল।উপরের গ্লসে দুবার ড্রাইভারের চোখে চোখ পড়ল মিনার। গাড়ি জোড়েই যাচ্ছে।জানালার গ্লাস দিয়ে বাহিরে কিছু দেখা যায়না।তুমুল বৃষ্টির পানি গ্লাসে বাড়ি খাচ্ছে।যেন সব ভেঙ্গেচুরে ফেলতে চায়।ড্রাইভারের ইশারায় হেলপার দরজা বন্ধ করল বৃষ্টি আসতেছে বলে।
মিনা এবার ঝাপঁ দিয়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে বলল, -আমি নামমু,আমারে নামাইয়া দেন।’ কন্টেকটার তার দিকে এগোতে থাকে পান মুখে।কি কুৎসিত তার হাসি!!মিনা দরজায় জোড়ে জোড়ে বাড়ি দেয় আর বলে, খুলেন আমি নামমু…’বদমাইশ লোকটা ওর হাত দুইটা শক্ত করে ধরে।হেলপার পিছন থেকে ওড়নাটা হ্যাচকাটানে খুলে ফেলে।মিনা ভড়কে যায়। সে তার প্রবল শক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানের চেষ্টা করে,পারেনা।আহত চোখে যাত্রী দুজনার দিকে তাকায়।ততক্ষনে যাত্রী দুজন হায়েনার মত তার দিকে আসতে থাকে। মিনা চিৎকার দেয় একটা ।কন্টেকটার তাকে এক ঝটকায় নিচে ফেলে দেয়।মিনা’ র হাতে শক্ত করে ধরে থাকা ব্যাগ ছিটকে পড়ে গিয়ে আপেলগুলো ছড়িয়ে যায়।পাশেই পড়ে থাকে লাল টুকটুকে বাশিঁওয়ালা ছোট্ট জুতা জোড়া ।ঔষধের বোতল গড়িয়ে ঢুকে সিটের নিচে।
মিনা করুন আর্তনাদ করতে থাকে, -আপনেরা আমারে যাইতে দেন,আল্লাহর দোহাই লাগে।’ শয়তানটার পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপনে আমার ধর্মের ভাই, ছাইরা দেন।’ চারপাশ থেকে দানবগুলোর আটটা হাত তার শরীরকে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে কুকুরের থাবার মত।আত্নচেষ্টায় ব্যার্থ মিনা চেয়ে থাকে জ্বরের ঔষধটার দিকে। দানবগুলো ছিঁড়ে ফেলছে তার বক্ষদ্বয়।যে বুকের দুধের আশায় চেয়ে আছে তার অসুস্থ শিশু। মিনা চিৎকার দেয় আবারও,”কাউছারের বাপ”…
কামাল ছটফট করে।আজ এত দেরি করছে।ছেলের জ্বর বাড়তেই থাকে।একবার সে জানালায় আসে ঝড়ের তান্ডব দেখে আবার কাপড়ে পেঁচানো ছেলের মাথায় পানি ঢালে… বন্ধ ফোনে বার বার ফোন দেয়। ছেলের মুখের উপর পড়ে বলে, -বাপ,বাপ,কথা ক বাপ..তর মা ওষুধ নিয়া আইতাছে বেটা।আর এটটু বাপ!’
ড্রাইভার মিনার কামড়ে দেয়া রক্তাত্ব উলঙ্গ শরীর থেকে উঠে বলে,”মাল একটা” শেষ কইরা দে বেটিরে….’ কুকুরগুলো খিলখিল করে হাসে মিনা আস্ফালন করে ওঠে আধমরা শরীরে… ‘আমারে অহন ছাইড়া দেন।ঘরে আমার বাবুডার খুব জ্বর। ওষুধটা না খাওয়াইলে পোলা আমার মইরা যাইব। আপনেগো দোহাই লাগে…’কন্টেকটার মিনার ওড়নাটা পেঁচিয়ে ওর দিকে এগোতে থাকে…মিনা সমানে জনে জনে দৌঁড়ায় উলঙ্গ শরীরে… ‘ও আল্লা গো…..কাউছারের বাপ….ও আমার কাওছার…আমার বেটা,বেটারে….’ মিনা‘র গলার আওয়াজ যত কমতে থাকে, ঝড়ের তান্ডব ততই প্রখর হয়। কাছেই কোথাও ভয়ঙ্কর শব্দে বাজ পড়ে। রাত বাড়তে থাকে। কাওছারের জ্বর ও বাড়ে।প্রকৃতি মহাউৎসবে মেতেছে আজ, প্রকৃতির সব ময়লা ধুয়ে যাবে এই ঝড়ে!!!!!!