১ম অংশঃ
“অরে খা…, ..গী’রা..
তোরা আর আসার টাইম পাস নাই, দিলি তো আমার অযু ভাংগিয়ে, দুনিয়ার বেটা ছেলে সব দেখে দেখে মাগতে আসছিস, তোদের গায়ে গতরে বাইরের বেটাদের ছায়া লেগে গেছে না? দূর থেকে হাঁকডাক করে আসতে পারিসনি ? কথাবার্তা ছাড়া সোজা ঘরের দরজায় এসে হাজির!
তোদের দেখা আর বাইরের বেটা দেখা একই কথা ।
ধুর, আবার অযু বানাতে হবে…”
ভিক্ষা করতে আসা দুই ভিখারীকে দেখে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা খাতুনের মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
চাল দিতে দিতে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে গালি পাড়েন৷
ওরা নিত্যদিনের এই গালি গায়ে না মেখে হাসিমুখে থলিতে চাল ভরে।
ছোট ছেলের ঘরের নাতি বলে উঠে,
“অ দাদী, তুমি পঁচা পঁচা গালি দিচ্ছো, এমনিতেও তোমার অযু ভাংবে।”
“আহ, আমার অযু অতো সস্তা না, দুই তিনটা গালি পাড়লে ধপাস করে পড়ে ভেঙে চার খান হবে। কুত্তা, এদিকে আয়, কল চেপে দে।”
“দেবোনা, গালি দিছো কেনো?”
এই বলে এগারো বছর বয়সী নাতি ফারুক এক দৌড়ে পগারপার।
“হারামজাদা” বলে তিনি নিজেই কল চেপে অযু করেন৷ বাথরুমে রোদে গরম হয়ে যাওয়া ট্যাংকের পানি দিয়ে অযু করে শান্তি পাননা বলেই কল চেপে করতে চান।
এরপর উনার রুমে শীতল পাটি’র জায়নামাজ পেতে নামাজে বসেন।
জ্যৈষ্ঠ মাসের অতি গরমে অতীষ্ঠ খাতুন জানালা সামান্য ফাঁক রাখেন। ফ্যানের সুইচও দিয়ে রাখেন, বিদ্যুৎ আসলে যাতে পাকা ঘুরে।
নামাজ পড়তে পড়তে তেল চুপচুপে সামান্য একগোছা বেশী সাদা, সামান্য কালো চুল আছে তার; এর ভেতর থেকে ঘাম ঝরতে থাকলে, শাড়িতে ঢাকা গা থেকে কাপড় তুলে কাঁধে রাখেন৷ পেট পিঠে একটু আরাম লাগে তাতে। কিন্তু মাথার কাপড় ঘোমটা হয়ে নাক পর্যন্ত ঢাকা, মাথা থেকে কাপড় একটু সরলেই যে অযু আবার ভেংগে যাবে!
তিন বছরের সেজ বউয়ের ছোট কন্যা, নাতনিটা এসে নামাজরত দাদীর মুখ দেখবে বলে মাথার কাপড় সরিয়ে দেয়!
খাতুন মাথায় কাপড়টা তুলে সালাম ফিরিয়ে আবার গালি পাড়েন।
“শুওরের বাচ্চা আর কাজ পাস নাই, আমার ঘোমটা ফেলে নামাজ ভাংতে আসছিস!” তোদের মা’রা কি করে, শান্তিতে নামাজ পড়তেও দেয়না।
নাতনি ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলে। কোত্থেকে ফারুক এসে বলে,
” অ দাদী, তুমি এতো মূর্খ কেনো? ক্লাস ফোরের বইতেও তো আছে, পেশাব, পায়খানা, বায়ু বের হলে, ঘুম এসে গেলে, মুর্চা গেলে তবেই না অযু ভাংগে, নামাজ হয়না। তুমি তো কথায় কথায় ভেঙে যাবে বলো। বায়ু কি বুঝো তো, পাত, পাত!
আর অযু কি অতো সস্তা যে ধপাস করে পড়ে ভেঙে চার খান হবে!”
“ওরে শুওর, আমার কথা আমাকে ফেরত দিস! আর তুই দুই পয়সার বিদ্যা নিয়ে আমাকে শেখাতে আসিস, এ্যাঁ? আমি কিছুই জানিনা, আমি মূর্খ, আমি বানে ভেসে আসছি ? আমি পাত দেয়াও চিনিনা, না?
তোর বাপ দাদা শেখাতে সাহস করেনি, ভুল ধরেনি কোনদিন, আমার দেওর (দেবর) আসছে শেখাতে..!”
হাংগামা শুনে এক বউ দেখতে আসে।
“কি হয়েছে আম্মা”, জানতে চায় সে।
” কিছু হয় নাই৷ তোমার ছেলে আমাকে পড়া শেখাচ্ছে, আমি কিচ্ছু জানিনা তো, মূর্খ মানুষ। তাই চিল্লাইতে চিল্লাইতে পড়া শিখি।”
বউ বাঁকা জবাব পেয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে যায়, সাথে জা’য়ের মেয়েকেও।
যাবার সময় বলে যায়, “আপনাকে ভাত দিয়ে দিবো?”
“কেনো, আমি কি ভুখা আছি বলছি? নাকি তোমাদের সাথে একত্রে খেতে অসুবিধা আছে? ”
বউ জবাব না দিয়েই চলে যায়। কি দরকার কথা বাড়িয়ে!
আরাম করে শান্তিতে নামাজ আদায় করতে না পেরে খাতুনের মন অত্যাধিক খারাপ হয়েছে।
বিদ্যুৎ আসলে, সে মাথার কাপড় হালকা সরিয়ে তসবীহ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। পাশে রাখেন ছেঁড়া কিছু পুরনো কাপড়ের ডিব্বা। একশো তসবীহ পড়া শেষ হলে একটা গিঁট দেন কাপড়ের রশি বানিয়ে। তাতে করে, গিঁট দেখে গুনতে সুবিধা।
তাও কি তিনি অতো গুনতে পারেন! এই নাতি, ঐ নাতিন নইলে ছেলের বউদের হাত পা ধরে গুনান। ছোট বউ অবশ্য মাঝেমধ্যে নিজে থেকে এসে গুনে একটা কাগজে হিসাব লিখে রাখে।
তাহলিল পড়ে শেষ করতে হবে তার। অবশ্য বেশ কয়েকবার শেষ করেছেন সোয়া লাখ খতমে তাহলীল। এখন মা বাপজান, শশুর, শাশুড়ির জন্যই পড়া।
তিনি তার মৃত্যুর পর, কাউকে এই খতম পড়ার কষ্ট দিতে চাননা। এমনকি এখনো এই বয়সেও তিনি নিজেই নিজের কাপড় ধুয়ে ফেলেন।
ছেলের বউয়েরা ধুয়ে দেবার জন্য টানাটানি করলে বলেন,
” আর বেশিদিন নাই, দুইদিন পর বিছানায় হাগামুতের সময় আসবে, তখন ধুয়ে দিও, যতদিন শক্তি আছে, নিজের কাজ নিজে করে নিই। সারাজীবন করতে থাকলে বিরক্তি এসে যাবে তোমাদের। তখন বলবে, বুড়ি মরেনা কেনো!”
তাই তিনি নিজেই চুল আচড়ান, বিছানা ঝাড়েন, অনেক সময় ঘরও ঝাড়ু দিয়ে ফেলেন।
ছেলেরা বাজার করে আনলে, শাক, কচুর লতি, ছোট মাছ, চিংড়ি সব কুটে বেছে দেন৷ বউরা এইসব লম্বা সময়ের কাজ গুলো নিয়ে বসে থাকলে রাঁধবে বাড়বে কবে, গোসল নামাজ আছেনা তাদেরও, বাচ্চাকাচ্চাদের ঝামেলাও কি কম?
তাই তিনি এই কাজগুলো খুশী মনে করে দেন।
বউরাও মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়।
জোয়ান কালে এক বৈঠকে এক সপ্তাহের রান্না করেছেন সারারাত জেগে। ফ্রিজ ছিলোনা যে সব জমিয়ে রাখবেন। ধানের কাজ করেছেন বান্দি (কাজের মেয়েদের) সাথে নিয়ে, তাদের জন্য ৭/৮ কেজি চালের ডেকচি বসিয়েছেন চুলাতে।
ঘর লেপন করছেন, মরিচ মসল্লা সব পাটায় বেটেছেন, কোন কাজটা করেননি? সাথে বছর বছর বাচ্চাও জন্ম দিয়েছেন।
গরুও পেলেছেন।
কত্তো কাজ যে করেছেন এই দুই হাতে। তাই তো এখনো সুস্থ আছেন। একটু পানি ঘাটলে ঠান্ডা লেগে যায়না আজকালকার মেয়েদের মতো।
তারা কেনা গুড়া মসল্লা’র তরকারি খায়, কাজের মেয়ে ডেকে ধান শুকায়। ধানও কি আর আছে, সব বর্গা চাষাদের দিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা বউদের দিয়ে কাজ করাতে রাজি না। না আছে গরু, না আছে চাষ, না আছে মরিচ বাটাবাটির কাজ।
মরিচ বেটে, জ্বলা হাত পানিতে ভিজিয়ে আরাম দিবেন, সেই সময়ও পান নি।
মাটির চুলায় বর্ষাকালে ভেজা লাকড়ি দিয়ে চোখের পানি, নাকের পানি এক করে ধোঁয়ার মধ্যে বসে রেঁধেছেন।
সে রান্না আংগুল চুষতে চুষতে পেট পুরে খেয়েছেনও, তারপর সারারাত মরার মতো পড়ে ঘুমাতেও পারেননি কখনো ।
এই ছেলের অসুখ তো, ঐ মেয়ের খিদে, তো আরেকজন বিছানা ভিজিয়ে চিল্লিয়েছে।
আহারে, কি কষ্টের দিন ছিলো!
এখন তো বাচ্চাদের কিসব প্যান্ট পরিয়ে সারারাত মায়েরা আরামে ঘুমায়! দুনিয়ার সব ওষুধ কিনে বাক্স ভরে রাখে। তিনি নাত নাতনিদের কান্নার আওয়াজ শুনেননা কতো রাত।
খাতুন এখন তো বৃদ্ধ হয়েছেন, এরপরও রাতে তার চোখে ঘুম আসেনা, ইচ্ছে করে সারারাত জেগে কারো সাথে গল্প করেন। তার এই রাত জাগা রোগের জন্য কোনো নাত নাতনি তার সাথে ঘুমাতে রাজি হয় না। পরদিন নাকি তাদের স্কুল কলেজে ঘুম পায়! ননীর পুতুল সব!
এখন কেনা গুড়া মসলার তরকারি’র স্বাদ যেমন নাই, পেট পুরেও খেতে পারেন না। সাদা পাতা আর জর্দা দিয়ে পান খাওয়া মুখে সবকিছুই পানসে লাগে তার।
কিছুক্ষণ তাহলীল পড়া শেষ করতে করতে চোখ লেগে আসে তার। চোখ মেলে উঠে বসে তিনি এবার কোরান শরীফটা নিয়ে বসেন। পবিত্র কোরান তিনি তেলোয়াত করতে জানেন না। কিন্তু তেলোয়াত করার তার বড় শখ। তাই আত্মীয় এক হুজুরকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেছে,
“চাচী, তোমার তো আর শেখার বয়স নাই, তুমি অযু করে নাহয় কোরানের হরফগুলো আংগুল দিয়ে নিশানা করে লাইন বাই লাইন পড়ার মতো করে হাতড়ে যেও। তাহলেও কিছু সওয়াব পাবে।”
তিনি তারপর থেকে তাই করে আসছেন গত দুই এক বছর ধরে।
কিন্তু নাত নাতনি কেউ এসেই তার মেজাজ খারাপ করে দিয়ে যাবে। সব নাত নাতনি যেনো তার পেছনে পড়ে থাকে।
ঐদিন সুরভী, সে এসেই বলে,
“অ দাদী, তুমি তো কোরান পড়তে পারো না, কি করো ওটা নিয়ে? পড়া পড়া খেলো?”
“অ মানু, পড়তে পারিনা বলে বড় আফসোস আমার। তুই শেখাবি?” নরম সুরেই তিনি জবাব দেন।
“আমার আর খেয়ে পড়ে কাজ নেই, তোমাকে শেখাবো!
ছোট কালে শেখো নাই কেনো? তুমি শেখো নাই, নাকি তোমার বাপ ছেলে মেয়েদের পড়াবার সময় পায় নাই, বিয়ে করার ধান্দায়। আর শোন, আমাকে মানু ডাকবেনা, কি পঁচা নাম!”
“তুই আবার আমার বাপের পেছন লাগছিস কেনো আবার? পড়াতে পারবিনা, অতো মুরোদ নাই তোর, সেটা বল। আমার বাপের অঢেল ছিলো তাই চার পাঁচটা বিয়ে করেছে, তোর জ্বলে কেনো?
আর সুরভী! এটা কেমন হিন্দুয়ানী নাম রাখছে! আমার কথা শুনছে কেউ? খাতিজা, আয়েশা কতো সুন্দর সুন্দর পবিত্র নাম আছে, তা না, রাখছে সুরভী! মানু খারাপ কি এ্যাঁ? মানোয়ারা রাখতে চাইছিলাম, সেখান থেকেই মানু।”
” মানোয়ারা, মানু একটাও পছন্দ না আমার।
আর আমার দাদারও তো কম ছিলো না, কই দাদা তো বিয়ে করেননি? অবশ্য তোমার যা মেজাজ, বেচারা দাদা মনে হয়, ভয়েই আধমরা হয়ে থাকতো, বিয়ে তো পরের কথা। ”
” পুরা কপালী, তোর দাদা’র এক হাত লম্বা জিহ্বা ছিলো, দশ পদের খানা বানাতে বানাতে আমার দিন রাত শেষ হতো, আর সে কিনা আমার ভয়ে থাকতো আধমরা! ”
“তাহলে তো তোমার উপর অনেক অত্যাচার করেছেন, দুই চারটা বউ থাকলে তোমার এতো কাজ করতে হতো না। দাদা’র বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে আরেকটা বিয়ে করাতে পারতাম।”
” সতীন কোথাকার, আসছে আমার সতীন আনতে, যা কবর থেকে নিয়ে এনে বিয়ে করিয়ে দে আরেকখানা, নইলে নিজে বিয়ে বঅ।”
এভাবে খুনসুঁটি লেগে থাকে কোনো না কোনো নাত নাতনি’র সাথে খাতুনের।
রান্না, গোসল, নামাজ সেরে, বউরা পাটি পেতে খেতে ডাকেন শাশুড়ি খাতুনকে।
শাশুড়ির পাতে মুরগীর বড় টুকরোটা তুলে দেন৷ তিনি হায় হায় করে উঠেন।
“আমাকে মেহমান পাইছো, এ্যাঁ? এতো বড় টুকরো কোন আক্কেলে দিলে, সব একদিনে খেয়ে শেষ করে ফেলবো নাকি? অর্ধেক ছিঁড়ে দাও, বাকিটা নাতি’র পাতে দাও। আমাকে শেখাতে শেখাতে তার শক্তি শেষ।”
“তোমার এঁটো খাবোনা।” ফারুক জবাব দেয়।
“অ শয়তান, আমি কি হেগে হাত ধুই না? নাকি থুতু মেখে দিছি?”
“তুমি এমনিতেও এক বদনা পানি দিয়ে পানি খরচ করো, আর সাবান দিয়ে হাত ধুতেও দেখি নাই।”
” অ মোর খোদা, তোর থেকে পানি খরচ করাও শিখতে হবে আমার! আর আমি এক বদনা খরচ করি নাকি আধা বদনা, তুই জানিস কেম্নে? তুই কি টাট্টিতে বসে গু খাস?”
“পড়ার টেবিলের পাশেই তো বাথরুম, আমি আওয়াজ শুনি।”
বউরা ফারুককে ধমক দেয়,
“বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই, এটা বেয়াদবী। তোমাকে এঁটো মুরগী খেতে হবেনা, এতো কথাও বলতে হবেনা। আমরা খাবো, তুমি চুপচাপ খেয়ে বিদায় হও।”
মুখের ভেতর করে ফারুক বলে,
” সত্যি বললেই বেয়াদব! দাদীর ভুল কেউ দেখেনা। ”
২য় অংশঃ
রোজার মাস, প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ রোজা শেষ। আজ একুশ রোজা। খাতুন এতেকাফ নিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরেই নিচ্ছেন।
আর তিনি এতেকাফ নিলেই, ঘরের সবার মুখ টিপে হাসাহাসির ধুম পড়ে। কেউ কিচ্ছু বলার সাহস তেমন পায়না, শুধু ঠোঁট কাটা ফারুক এসে ভুল ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাতুন তাকে গালি পাড়েন, “সতীনের ঘরের নাতি” বলে।
বউ কিংবা নাতনি যদি রুমে ইফতারি নিয়ে আসেন, তিনি হায় হায় করে উঠেন।
“সবার সাথে খাবো, কষ্ট করে এখানে আনার দরকার কি!”
নাতনি বলে উঠে,
“এখানেই খেতে হবে দশদিন পর্যন্ত, এতেকাফ, এতেকাফের মতো হওয়া চাই, আর চুপচাপ থাকবে, বেশী কথা বলবেনা দাদী।”
“কেনো বলবো না, বাইরের লোকের সাথে বলছি, নাকি বাইরের লোকের পাশে বসে খাবো বলছি, বল?”
“এতোকিছু বুঝিনা, এই কয়দিন তুমি প্রয়োজন ছাড়া এই রুমের বাইরে আসবে না।”
“তুই বললেই হলো, হুমম, আসছে আমাকে শেখাতে! সবাই আমাকে মূর্খ পাইছে..”
উনি সারাঘর ঘুরে বেড়ান, তবে বাইরে যাননা। জানালা খুলে বাইরে কে হাঁটে দেখেন। কখনো জিজ্ঞেস করেন, “কই যাস?”
মেহমান কেউ আসলে রুমে ডেকে কথা বলেন।
কি আর করবেন, এতো বড় দিন, শুয়ে, বসে, নামাজ পড়ে আর ঘুমিয়ে কাটতেই চায়না। বউগুলোও বজ্জাত, বাজার আনলে তরকারি কুটতে ডাকছেওনা এই কয়দিন, তার কাছে দিয়েও যায়না।
সেহেরী’র সময় আসলে খাতুনের বুক ধরফর করে উঠে। বউরা কেউ ভাত দিতে আসলেই তার এমন হয়, তাদের শুকনো মাথা আর বাসি শাড়ি দেখলে। জামাইর পাশে থাকা বউ গুলো এতো শুকনা শরীরে কিভাবে থাকে! বাথরুমে গোসলের পানি পড়ার আওয়াজও তো শুনেননি।
এরা তার রুম অপবিত্র করে দেবে বলে, বড় ভয়ে ভয়ে থাকেন তিনি। একবার তো বলেই ফেলেছেন,
“কষ্ট করে তোমরা খাবার আনিওনা, মেয়েদের দিয়েই পাঠিও।
খাতুন’দের সময় কতো কষ্টই না গেছে এই গোসল নিয়ে! ভোর রাতে, আলো ফোটার অনেক আগে হারিকেন জ্বালিয়ে চুপিসারে গোসল সেরে এসেছেন। আর রমজানের সময় তো গভীর রাতে, সেহেরী রাঁধা বাড়ার আগেই গোসল সেরে আসতে হয়েছে, কি শীত, কি গরম পুকুরের ঠান্ডা পানিতে মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাবার যোগাড় হতো।
আর আজকাল গ্যাসের চুলা, ঘরে বাথরুম তাও নোংরা অপবিত্র গায়ে চলাফেরা করে( খাতুনের তাই মনে হয়)।
তখনকার দিনে এমন অবস্থায় কখনো কেউ থাকলে তাদের বাচ্চাদের অসুখ বিসুখ লেগেই থাকতো! এসব নোংরা অপবিত্রতার জন্যই এমন হতো বলতো।
একদিন ছোট বউকে বলতে শুনেছেন, রোদ পড়ে গেছে, ধানগুলো ঢুকানো হয়নি। ঐ বাড়ির ফিরু হাত লাগাবে বলে আসবে বলেও আসেনি, অন্যান্য বউরা ইফতার তৈরিতে বসে গেছে।
এই সুযোগ, তিনি রুম থেকে বেরিয়ে, ঝাঁটা হাতে নিয়ে বলেন,
“চলো!”
“কি বলেন মা, আপনার এতেকাফ ভেংগে যাবে তো!”
“ধুর, তোমরা তো ঘরের মানুষ, ছাদটাও আমাদের ঘরের। যাও থলে আর বাটি নিয়ে চুপিচুপি চলো, আমার সতীন গুলো এসে গেলে আবার আমাকে শেখাতে বসবে। এতো শিখে আমার কাজ নাই । ”
বউ শাশুড়ি মিলে ধান ভরে সিঁড়ি ঘরে রেখে আসে।
ফারুক চিল্লাতে চিল্লাতে ঘরে আসে,
“আমার বল কোথায়, কে লুকিয়েছে আমার বল?”
খাতুন আসরের নামাজ আদায় করতে বসছে, নাতি’র চিল্লানী তার কানেও পৌঁছে। নামাজরত সে গলা খাকারী দিতে থাকে, “এহেম এহেম” করে।
ফারুক ভাবে, কোনো কারণে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন এতেকাফরত দাদী।
“কিছু বলবে দাদী, কিছু লাগবে?” জানতে চেয়ে রুমে ঢুকে দেখে, নামাজ থেকেই দাদী ইশারায় তার খাটের তলা দেখিয়ে দিচ্ছেন।
“ধুর দাদী, নামাজ থেকে কেউ কথা বলে, নাকি ইশারা করে? কিচ্ছু জানোনা তুমি।”
সালাম ফিরিয়ে দাদী জবাব দেন,
“কুত্তার মতো চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছিস তাতে কিছু না, আমি ইশারা করলেই যতো দোষ। যা বল নিয়ে বিদায় হ। নামাজ রোজা নাই নাকি তোদের, এতো বল খেলা কেনো? ”
রাতে কেউ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে বুঝতে পারেন খাতুন। রুম থেকে চেঁচিয়ে উঠেন তিনি,
“ভাগ্য লক্ষি কি সব বাইরে ফেলে দিবে নাকি? কি অলক্ষুণে কাজ, রাতে কেউ ঘর ঝাড়ু দেয়? ঝাড়ু রাখো এক্ষুণি।”
“মা, বাচ্চারা ঘর বেশী ময়লা করে ফেলেছে। ” জবাব আসে।
“যতই ময়লা করুক, রাতে বাইরে ময়লা ফেলা মানে ভাগ্য ফেলে দেয়া।”
রাত প্রায় নয়টা বাজে খাতুনের এক কন্যা ফলমূল আর মায়ের জন্য শাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়। তিনি মেয়ের সাথে সুখ দুঃখের কথা’র ঢালি সাজিয়ে বসেন।
গাড়ি করে যেতে আবার ঘন্টা খানিক সময় লাগবে, মেয়ে দুইঘন্টা মতো বসে চা নাস্তা খেয়ে আবার ফেরত যায়, তারও ঘর সংসার আছে।
সেহেরী শেষে মেয়ের আনা আংগুর ভাগ করে নাত নাতনিদের ডাকে খাতুন।
“চারটা বাটি নিয়ে আয়” বলেন তিনি।
“অ দাদী ফ্রিজে রেখে দুই চারদিন করে তুমিই খেয়ে নাওনা। চার, পাঁচ ভাগ করলে কার ভাগে আর কতোটা পড়ে, তুমি নিজেও তো খেতে পাওনা।” এক নাতনি বলে।
“আমার অতো পেট হয়নি, সব নিজে বসে খাবো। সবসময় বেশী কথা বলিসনা। তোরা, আমার ছেলেরা না খেলে, আমার গলা দিয়ে কি নামবে ?”
আরেকদিন সকালে কেউ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছেনা অথচ বাচ্চাদের খেলতে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। কি অশুভ লক্ষণ!
খাতুন আবারো চিল্লিয়ে ডাকে বউদের।
“ঘর ঝাড়ু না দিয়েই বাচ্চাদের বাইরে পাঠিয়ে দিলে, এটা কেমন কথা? আমি রুমে বন্দী বলে কি কিছুই জানবোনা ভেবেছো?”
“আম্মা, ঘর পরিস্কার আছে তাই।”
“পরিস্কার থাকলেও, ঝাড়ু হাতে অন্তত রান্নাঘরে হলেও দুই একটা পোছা দেবে, ঠিক আছে? এসব হলো নিয়ম নীতির কথা। আমরা আমাদের মা দাদীদের থেকে শিখে আসছি। তোমারা তো দেখি কিছুই মানোনা নাকি জানোইনা! ”
ছেলেরা এসে মায়ের পাশে বসে। সাথে নতুন কয়েকটা শাড়ি, চামড়ার সেন্ডেল।
“মা, দেখো তো পছন্দ হয় কিনা, সেন্ডেল পায়ে লাগে কিনা দেখো, নইলে ফেরত দিয়ে আরেকজোড়া আনবো। ”
“কে বলছে তোদের এসব আনতে? আলমারী ভরা এতো এতো শাড়ি আমি গায়ে পড়বো নাকি পা মুছবো? তোদের বোনেরাও আনছে, মানা করলেও কেউ শুনিসনা… কয়দিন বাঁচবো আর?”
“প্রয়োজনে পাপোশ বানিয়ে ভেজা পা মুছবে, ঠিক আছে? এবার দেখি সেন্ডেল পায়ে দিয়ে দেখো।”
সুরভী বলে উঠে,
” দাদা মাত্র একটা বউ রেখে গেছে, পরাতে সমস্যা কি! দুই চারটা রেখে গেলে, তোমার ছেলেদের কষ্ট হতো আর কি। কি বলো চাচ্চু?”
“যা, এই শাড়ি তুই পরিস, তুই তো আমার আরেক সতীন!” খাতুন বলে।
ঈদের চাঁদ উঠে।
কলেজ পড়ুয়া বড় ছেলের ঘরের নাতনি আসে রুমে।
“দাদী, এই কয়দিন তো বের হতে পারো নাই, আসো তোমাকে চাঁদ দেখায় আনি। উঠান থেকেই দেখা যাচ্ছে।”
তিনি নাতনি’র মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, সামনে কাটা চুল মুঠো ভরে ধরে বলেন,
“অ হারামি, এটা কি করলি তুই, চুল কাটছিস কি জন্য, তোকে লাগছে কেমন? ”
“তুমি বেশী করো দাদী, কাল ঈদ, চুল কাটবো না?” আনন্দ না করলে ঈদের মজা কি?”
“তাই বলে চুল কাটবি? মনে আনন্দ আসলে রুম বন্ধ করে খেমটা নাচ দিতি। দুনিয়ার সব শয়তানি কাজ কারবার। ”
“যাও, তোমাকে চাঁদ দেখতে হবেনা। ”
নাতনি রাগ করে চলে যায়।
আজ তো তারাবীহ’র নামাজও নাই। অলসভাবে শুয়ে শুয়ে খাতুন তার শাশুড়ির কথা ভাবেন আর দোয়া করেন,
“আল্লাহ, আমার শরীরে শক্তি থাকতেই তুমি তুলে নিয়ে যেও তোমার কাছে।”
খাতুনের শাশুড়ি শেষ বয়সে বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বিছানায় পেশাব পায়খানা করতেন। চোখেও কম দেখতেন বলে, ময়লা আবর্জনা সব হাত দিয়ে ধরে ফেলতেন। শেষের দিকে শরীর শুকিয়েও কাঠ হয়ে গিয়েছিলো।
খাতুন তখন তাকে পাজা কোলে করে পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গাছ ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে , পুকুর থেকে বালতি ভরে পানি এনে ঢলে ঢলে ময়লা পরিস্কার করতেন।
খাতুন অতো হায়াত পেতে চায়না।
শক্তিহীন শরীরটা তখন হয়তো, চার পাঁচ বউয়ের চার পাঁচ ঠ্যালা সহ্য করতে হতে পারে। তিনি একা ছিলেন, সব তার উপর দিয়ে গেছে।
আর তিনি শাশুড়িকে মায়ের মতো জেনেছেন। যতই বুড়ো হয়েছিলেন, শাশুড়ি যেন তার আরেক বাচ্চা হয়ে গিয়েছিলো।
এখনও খাতুনকে সবাই ভয়, শ্রদ্ধা করে, মান্য করে। কিন্তু শক্তিহীন হয়ে গেলে, তখন?
খাতুনের ছেলে মেয়ে, নাত নাতনি সবার মুখ দেখা হয়ে গেছে। এবার তিনি শান্তিতে বুড়োর পাশে যাবার অপেক্ষা করেন।
#ফারহানা_বহ্নি_শিখা
২৯.১২.১৮