বিছানার এক কোণে বালিশে মুখ গুঁজে এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে ঝিনুক। পাশের ঘর থেকে তার মা রান্না করতে করতে বলছে, “ইমরানের বাড়ির লোক খুব ভালো, দেখবি তোর মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে না। তোর আব্বা আর আমি নিজে গিয়ে ওদের ঘর-পরিবার দেখে এসেছি। ওদের সঙ্গে আমাদের বহুদিন আগে থেকে চেনাশোনা আছে, তুই শুধু শুধু কেঁদে চলেছিস।”
-“আমার ওই পরিবার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, তবে বিয়েটা কলেজের পড়া শেষ করেও তো করা যেত। একটি মেয়ের এই সময়ে শিক্ষিত হওয়া কতটা জরুরি, সেটা যদি তোমরা একটু বুঝতে!”
গেট দিয়ে আব্দুল মিঞা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঝিনুকের কথোপকথন কানে যেতেই গম্ভীর গলায় বললেন, “তোমার আম্মি আমাকে বিশ্বাস করে সংসার করতে এসেছিলেন, এখানে এসে দেখো ভালোই আছেন। তবে তোমার বিয়েতে আপত্তি কেন? আমরা ঘর-পরিবার দেখেই তো বিয়ে ঠিক করেছি।” ঝিনুক তার আব্বার কথা শুনে কোন উত্তর দিল না, মনে মনে ভাবল, এখন আর কিছু করার নেই …, দেখা যাক আগামীতে নিজে কিছু করতে পারি কিনা…।
পাত্র পক্ষের উপর রাগ যে হচ্ছে না সেটাও নয়। আম্মির মুখে বহুবার সে শুনেছে, ইমরান সরকারি অফিসে উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, আর ভীষণ মেধাবী। তবে তার কখনো মনে হল না, আমার ভবিষ্যতের কথা…! তা অবশ্য কেনই বা হবে, যখন তার পরিবারেরই মনে হল না! বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ঝিনুক, ঘরের বাইরে বেরিয়ে গ্রামটাকে প্রাণ ভরে দেখতে ইচ্ছে করল। বাতাবি ফুলের মন-মাতানো সুবাস, চৈত্র শেষে ঝোড়ো হাওয়া, শুকনো পাতায় পা পড়লে খসখস শব্দ, বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত দুপুরের রোদ, এইসব তার বড় ভালো লাগে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর এইসব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে ভেবে রেখেছিল, কিন্তু সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে সেই শুভক্ষণ চলে এল, বাড়ি ভরে গেছে আত্মীয় পরিজনে, কাল মেহেন্দি। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়েছে, ঝিনুক প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। খুব ঘটা করে আব্বা মিষ্টি নিয়ে পাত্রপক্ষের বাড়িতে জানিয়ে এসেছে সে খবর। ঝিনুকের এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল, তবে সাহস করে আব্বাকে জানাতে পারে নি। ছোটবেলা ঝিনুকের ভীষণ গর্ব হ’ত কারণ তার ভালো নাম রোকেয়া খাতুন। কিন্তু আজ তার এই নামটা নিয়ে গর্ব করার কিছু থাকল না। হঠাৎ তার গায়ে এক ধাক্কা লাগল, ঝিনুক চমকে পাশে তাকাতেই তার কিছু বোন এসে বলছে, “আপা তুই কি এতো ভাবছিস বল তো, কাল তোর মেহেন্দি আর পরশু নিকা! মন খারাপ লাগছে নাকি?” কি উত্তর দেবে না বুঝতে পেরে চুপ করে বোনেদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সে চলে গেল।
মেহেন্দি হয়ে গেছে গতকাল। আর কিছুক্ষনের মধ্যে পাত্র পক্ষের বাড়ির সবাই আসবে। কাজীসাহেব বারান্দায় বসে আছেন। খালা, ফুপু এরা সবাই ঝিনুককে সাজাতে ব্যস্ত… গ্রামের মুরুব্বিরাও উপস্থিত। হঠাৎ বোনেরা খবর দিল বরযাত্রী এসেছে, সবাই তাদের দেখতে ছুটে গেল। নিকার আগে কাজী সাহেব রীতি মেনে কবুল বলতে বলল, সেই সময় ইমরান হঠাৎ বলল, “আমি একটা কথা বলতে চাই রোকেয়াকে, আপনারা অনুমতি দিলে।” উপস্থিত সকলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তারপর অনুমতি নিয়ে বলল, “বিয়ের পর রোকেয়া পড়াশুনা করবে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আমি ওকে সবসময় সাহায্য করব, এটা আমার ইচ্ছে। আশাকরি দুই পরিবারের কোনো আপত্তি নেই।” শুনে ঝিনুক আবেগ ধরে রাখতে পারল না, তার অশ্রুধারা গাল বেয়ে নিচে নেমে এল, পর্দার আড়ালে কারোর তা নজরে এল না।