রাজামশাই ভারি চিন্তায় পড়েছেন। মুখচোখ গম্ভীর, থমথমে। সভায় এসেছেন ঠিকই, কিন্তু কারও সাথে বিশেষ কথা-টথা বলছেন না। মাঝে মাঝে রাজমুকুট খুলে টাকে হাত বোলাচ্ছেন আর জল খাচ্ছেন। ক’দিন থেকেই এমন চলছে। জরুরি কাজকর্ম সব ডকে উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী পড়েছেন মহাবিপদে। প্রথমে ভেবেছিলেন, পাশের দেশের রাজা হয়তো যুদ্ধ-টুদ্ধ পাকাবার মতলবে আছে। আর রাজা বুঝি সেই সংবাদ টের পেয়েছেন। রাজামশাই আবার যুদ্ধ-টুদ্ধ বিশেষ পছন্দ করেন না। নেহাত শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই হয়তো মুষড়ে পড়েছেন। অগত্যা মন্ত্রী গুপ্তচর পাঠালেন পাশের দেশে। চর খবর নিয়ে এল, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। যুদ্ধের কোনও সংবাদ নেই। বরং পাশের দেশের রাজা দুর্মুখ সিংহ এখন ভীমরুলের উৎপাত ও বাতের ব্যথায় নিজেই কুপকাত।
তাহলে হলটা কী! রানিমা মন্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে রাজবৈদ্য আরোগ্যাচার্যকে খবর দিলেন।
“ক’দিন থেকে মহারাজ কিছু খাচ্ছেন-টাচ্ছেন না। রাতবিরেতে উঠে কীসব বিড়বিড় করে বকছেন আর পায়চারি করছেন। কোনও কাজে মন নেই। সবসময় গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন।” বললেন মহারানি।
সব শুনে পাক্কা পাঁচ মিনিট নাড়ি দেখে আরোগ্যাচার্য মাথা নেড়ে বললেন, “বায়ু কুপিত হয়েছে। মাথায় মহাভৃঙ্গরাজ তেল লাগাতে হবে। খেতে হবে ব্রহ্মবটিকাচূর্ণ ছাগলের দুধে সেদ্ধ করে। সবরকম আমিষ আহার বন্ধ। তবে নিরামিষ আহারে কোনও বিধিনিষেধ নাই। রাবড়ি, ক্ষীর, পায়েস, গোকুল নাড়ু সবকিছুই খাওয়া যাবে।”
মহারাজ হাঁফ ছাড়লেন। যাক বাঁচা গেছে। বৈদ্যব্যাটা অন্তত মহাকালমেঘ বটিকা ও তৎসহ পঞ্চতিক্ত সেব্য বলেনি। তাছাড়া রাজভোগে রোজ রোজ মাছ-মাংস খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। তার চেয়ে নিরামিষ ঢের ভালো। রাবড়ি আর ক্ষীরের কথা মনে হতে নোলায় বান ডাকল। রাজামশাই ঢোঁক গিললেন।
ক’দিনের চিকিৎসায় একটু উন্নতি হয়েছে মহারাজের। এখন আর ততটা গোমড়া মুখে থাকছেন না। দু-একটা কথাও বলছেন। রাজসভাতেও নিয়মিত আসছেন। কাজটাজ করছেন। পরিস্থিতি অনুকূল বুঝে মন্ত্রীমশাই কথাটা পেড়েই ফেললেন, “মহারাজ, আপনার গভীর চিন্তার কারণ কী! কোনও অজানা আতঙ্ক কি ঘনীভূত হয়েছে?”
দুধপুলি, পাটিসাপটা সহযোগে প্রাতরাশটা শেষ করার পর থেকেই মহারাজের মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। তাই এতদিন যে কথাটা বলব বলব করেও লজ্জায় বলতে পারেননি সেই কথাটা বলেই ফেললেন, “বুঝলে মন্ত্রী, একটা প্রশ্ন নিয়ে আমি বড়ো সমস্যায় পড়েছি!”
“কী প্রশ্ন মহারাজ, বলুন যা আপনাকে এতদিন ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে! পারলে এক্ষুনি সমাধান করে দেব। আর যদি অতীব কূটপ্রশ্ন হয় তাহলে সভাপণ্ডিতদের খবর দেব।”
মহারাজ মাথা নেড়ে বললেন, “এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তোমার কিম্বা সভাপণ্ডিতদের কম্ম নয়। এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন। এতদিন ভেবেও আমি কোনও উত্তর পাইনি।”
মন্ত্রী ব্যাগ্রভাবে বলল, “তবুও বলুন, মহারাজ। সবাই মিলে ভেবে যদি কোনও সমাধান পাই।”
রাজামশাই এবার সব দ্বিধা ঝেড়ে প্রশ্নটা করেই ফেললেন, “বল দেখি, গঙ্গাফড়িংয়ের রং কেন সবুজ হল?”
প্রশ্ন শুনে মন্ত্রীর তো আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়। ভাবলেন, রাজার মাথাটা বোধহয় বিগড়েছে। না হলে বুড়ো বয়সে এমন ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করেন! এই প্রশ্নের জন্যই কিনা রাজা নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন! যাই হোক, মনের ভাব চেপে রেখে মন্ত্রী যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আজ্ঞে, ছেলেবেলা থেকেই তো দেখছি গঙ্গাফড়িংয়ের রং সবুজ। অন্য রং তো হয় না, মহারাজ।”
রাজামশাই মুচকি হেসে বললেন, “সেইটাই তো সমস্যা। সবুজ রং হল কেন? অন্য রংও তো হতে পারত!”
মন্ত্রী বা সভার অন্য কেউ অনেক ভেবেও উত্তর দিতে পারল না। সেদিনের মতো সভা ভঙ্গ হল।
বিকেলবেলা কাজু পেস্তার বরফি আর দইয়ের লস্যি খেতে খেতে রাজামশাই ভাবছিলেন রাজ-উদ্যানে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। আজ সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে গেলে কেমন হয়! হয় তো ভালোই। কিন্তু সেখানে কি তিষ্টোনোর জো আছে! কোন গাছের ফাঁকে ঘুটুং ঘাপটি মেরে থাকবে কিচ্ছু বলা যায় না। একবার সামনাসামনি হলেই তো হল। লজ্জার একশেষ এক্কেবারে।
ঘুটুং হল রাজ-উদ্যানপালকের ছেলে। ছোঁড়া যেমনি ফুটফুটে তেমনি বিচ্ছু। রাজা ভারি ভালোবাসেন এই বুদ্ধিমান ছেলেটিকে। সে মাঝে মাঝেই রাজ-উদ্যানে বেড়ানোর সময় রাজার সঙ্গী হয় আর সময়ে সময়ে এমন দুমদাম প্রশ্ন করে যে তার উত্তর যোগাতে রাজা হিমসিম খান। এই তো সেদিন রাজার সাথে বেড়াতে বেড়াতে একথা সেকথার পর ফস করে প্রশ্ন করেছিল, “আচ্ছা, তোমাকে রাজা বানাল কে বল দেখি?”
রাজা প্রশ্ন শুনে খুব ঘাবড়ে গেলেন। রাজার বাবাও রাজা ছিলেন, তাঁর বাবাও রাজা ছিলেন। রাজপদ বংশানুক্রমিক। কিন্তু একথা বললে ঘুটুং বলবে তাকে কে রাজা করল কিংবা তার বাবার বাবাকে কে রাজা করেছিল। এইভাবে প্রশ্নের স্রোত চলতেই থাকবে। তাই রাজা সেদিকে না গিয়ে বুদ্ধি করে উত্তর দিলেন, “প্রজারাই আমাকে রাজা করেছে।’’
ঘুটুং সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, “এত লোক থাকতে তারা তোমাকেই কেন রাজা করল?”
এবারেও রাজা দমলেন না। উত্তর দিলেন, “তারা আমাকেই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ভেবেছিল বোধহয়।’’
ঘুটুং বলল, “ও, তাহলে তুমি এ রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোক।” তারপর ছাড়ল তার সেই মোক্ষম প্রশ্ন, “আচ্ছা বল তো, গঙ্গাফড়িংয়ের রং কেন সবুজ?”
এবারে রাজা কুপোকাত। এমনিতে রাজা অঙ্কে ভালো হলে কী হবে, জীবনবিজ্ঞানে আর ইতিহাসে তিনি বরাবরই কাঁচা। খুব অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন রাজা। কিন্তু মুখে সে ভাব প্রকাশ করলেন না। বরং চালাক চালাক ভাব দেখিয়ে, “কাল বিকেলে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব,” বলে কোনওমতে কেটে পড়লেন। সেই থেকে একমাস ধরে ঘুটুংয়ের প্রশ্নের ভয়ে আর উদ্যানমুখো হননি রাজামশাই।
আজ সবে চালতাগাছটা পেরিয়েছেন আর কোত্থেকে পেয়ারা খেতে খেতে ঝুপ করে উদয় হল ঘুটুং।
“কী ব্যাপার রাজামশাই, তোমার কি শরীর-টরীর খারাপ হয়েছিল? একমাস ধরে বাগানে আসছ না যে!”
রাজামশাই আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, “তা একরকম বলতে পার। আসলে বুড়ো হয়েছি তো, শরীর সবসময় ঠিক থাকে না।”
একথা সেকথার পর রাজা ভাবলেন, ঘুটুং বোধহয় তার প্রশ্নের কথা ভুলে গেছে। ভালোই হল, ল্যাঠা চুকল।
কিন্তু নাহ্! ভবী ভুলবার নয়। ঘুটুং বলল, “তা না হয় হল। আমার প্রশ্নের উত্তর তো তুমি এখনও দিলে না, রাজামশাই।”
রাজা ভুলে যাওয়ার ভান করে বললেন, “কোন প্রশ্নটা বল তো?”
ঘুটুং বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “ধুর, তুমি বড্ড ভুলে যাও। সেই যে বললাম না গঙ্গাফড়িংয়ের রং কেন সবুজ হল?”
এবার আর এড়ানোর উপায় নেই। রাজাকে হার মানতে হল। তিনি বললেন, “উত্তরটা ঠিক কী হবে বুঝতে পারছি না।”
“ঘুটুং বলল, “অ্যাঁ! এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি রাজাগিরি কর! যাক, মন দিয়ে শোনো, গঙ্গাফড়িংরা তো সব সবুজ ঘাস আর লতাপাতার জঙ্গলে থাকে তাই ওরা পাখিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের গায়ের রংও ঘাস-জঙ্গলের মতো সবুজ করে রাখে ফলে পাখিরা ওদের চট করে ধরতে পারে না। এবার বুঝলে তো?”
রাজার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। তবুও ঘুটুংকে একটু মুশকিলে ফেলার জন্য বেয়াড়া প্রশ্ন করলেন, “ওর গায়ের রংটা সবুজ হল কী করে?”
ঘুটুং বলল, “সেটা তো আরও সোজা। গঙ্গাফড়িং সবসময় সবুজ ঘাসপাতা খায়, তাই ওর গায়ের রং সবুজ হবে না তো কি তোমার মতো ফর্সা হবে?”
রাজা আবার একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, গরুছাগলও তো সবুজ ঘাসপাতা খায় কিন্তু ওদের গায়ের রং তো কই সবুজ হয় না। কিন্তু ঘুটুংকে আর না ঘাঁটানোই ভালো মনে করে থেমে গেলেন। বলা তো যায় না, শেষমেশ আবার একটা বিদঘুটে প্রশ্ন করে প্যাঁচে ফেলুক আর কি! অগত্যা রাজামশাই প্রচণ্ড খুশি হয়ে ঘুটুংকে পরদিন সকালে তাঁর সাথে রাবড়ি ও ক্ষীরের মালপোয়া সহযোগে প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ জানিয়ে প্রাসাদের পথ ধরলেন।