“আচ্ছা, আমি যদি কোনোদিন ভালবেসে ফেলি তোমায়? কী করবে?”
“পালাবো! পালিয়ে বেড়াবো তোমার চোখের আড়ালে।”
“জীবনের আড়ালে তো নয়, তাতেই হবে।”
হৃদিতা কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে খুব শব্দ করে একটা চড় কষে দিলো মুখে। আমি উল্টে পড়ি এমন অবস্থা। এরপর থেকে হৃদিতার সাথে দেখা হলেও কথা বলি না। কথা বলি স্নিগ্ধার সাথে। আমার প্রতি যার দুর্বলতা আছে। স্নিগ্ধার থেকেই শিখি কী করে ভালবাসার মানুষের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। তবে বিশ্বাস করুন আপনারা আমার ভালবাসাটা হৃদিতার ওপরেই। কেন জানি না চড় খাবার পর থেকেই ওর প্রতি ফিলিংসটা বেড়ে গেছে।
আমার ব্যাপারে হৃদিতা কতটা ইতিবাচক জানি না। কিন্তু স্নিগ্ধার সাথে যখনই কথা বলি তখনই সে কেমন মায়া মায়া চোখে তাকায়। আর আমিও মায়ায় পড়ে যাই। ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, “এই পাগলি.. আমি তো তোকেই ভালবাসি শুধু।” কিছুই বলা হয় না। মানুষ হয়ে জন্মালে অনেক না বলা আক্ষেপই রয়ে যায় ভেতরে।
প্রস্তাবনা এটুকুই। এবারে আমাদের পরিচয় দিয়ে মূল কাহিনীতে যাব। স্নিগ্ধা আমার বাড়ির পাশেই থাকে, ছোটবেলা থেকেই আমরা একে-অপরকে চিনি। তবে কে কাকে কতটা জানি সেটা আমি নিজেও জানি না, সেটা অপ্রকাশিত। আর হৃদিতা আমার ক্লাসমেট। শুরুতে খুব ভাল বন্ধু ছিল। আমার প্রতি যত্নশীলও ছিল, কারণ বন্ধুত্বের মর্যাদা সে জানতো। কিন্তু ভালবাসার মর্যাদা তার কাছে কতখানি সেটা আমি জানি না। সকাল সাতটা নাগাদ কখনই ঘুম ভাঙে না আমার। সেখানে আজ আমি স্নিগ্ধার সাথে রাস্তায় হেঁটে চলছি পাশাপাশি। স্নিগ্ধার রূপ আগের থেকেও বেড়েছে। তবুও বুঝতে পারছি আমাকে ইমপ্রেসড করতে সে একটু বেশিই সেজেছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা?” স্নিগ্ধা বলে, “কবর জিয়ারত করতে।”
“কার?”
“বাবার।”
আমি আর কিছু বললাম না। তবে মনে পড়লো আজ শুক্রবার। এই দিনে স্নিগ্ধা প্রতিদিন ভোরে তার বাবার কবর জিয়ারত করে থাকে। তবে সঙ্গী হিসেবে আমি আজই প্রথম। কবর জিয়ারত করে ফিরছি দুজন। এমন সময় লম্বা সুদর্শন এক ছেলে এসে স্নিগ্ধাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে, গেছিলা কই? কেন?” (স্নিগ্ধাকে একটু রাগত মনে হয়)
“জানতে চাইলাম জাস্ট!”
“বাবার কবরে গিয়েছিলাম।”
“আমায় বলতা। আমিও যেতাম সাথে।”
“আমি কবর জিয়ারতের সময় একমাত্র বাপ্পিকে ছাড়া কারও সান্নিধ্য আশা করি না।”
এটা বলে স্নিগ্ধা আমার হাত ধরলো। আর আমি রিয়ালাইজ করতে পারলাম সেদিন আমি কতটা আপন স্নিগ্ধার। আমি জিজ্ঞেস করি, “ছেলেটি কে ছিল?” “আমার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড। দু’বছর আগে আমাদের ব্রেক-আপ হয়েছে।” আমি আর কিছু বলি না।
এর মাঝেও কিন্তু থাকে। এতকিছুর পরেও হৃদিতার থেকে এক বিন্দুও মন সরেনি আমার। মনটা সারাক্ষণ হৃদিতার জন্য বেবাগী, নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেঁচে থাকি। কারণ স্নিগ্ধা আমায় ভালবাসে। তার ভালবাসা ও বিশ্বাসকে অসম্মান করি কী করে? এতদসত্ত্বেও দূর্ঘটনা একদিন ঘটেই গেল। সেদিন বিকালে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছি। বন্ধুদের আড্ডায় আচমকা ফাহিম বলে, “বাপ্পি, ঐটা হৃদিতা না?” চেয়ে দেখি আসলেই তাই। পেছনের কর্ণারে বসে হৃদিতা। আমি যাব না যাব না করেও ওর টেবিলে ছুটে যায়। কারণ অপ্রত্যাশিতভাবে হৃদিতার সাথে একটি ছেলে বসে আছে। আমি মেঘস্বরে বলি, “কে ছেলেটি?”
হৃদিতা অবাক হয়ে বলে, “আমার বন্ধু।”
“তুমি আমার সাথে এসো।”
“কেন?”
“আমি তোমায় ভালবাসি, তাই।”
“আজব! এসব কথা এখানে কেন? বললাম তো ও আমার বন্ধু।”
ছেলেটি বলে, “ভাই, মাথা ঠিক আছে আপনার?” আমিও তৎক্ষণাৎ ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে বলি, “কথা বললে জিভ ছিঁড়ে ফেলব!” হৃদিতা তখন আমার হাত ধরে পরিস্থিতির দায়ে বাইরে আসতে বাধ্য হয়। তারপর বলে, “আমায় ভালবাসো?”
“হ্যা!”
“কতটা?”
“দুই ইঞ্চি।”
“এত কম?”
“এক ইঞ্চি বললে খুশি হতে?”
“পাগল একটা।”
হৃদিতা জড়িয়ে ধরে আমায়। ঠিক সেসময় আচমকা স্নিগ্ধা এসে আমায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। বলে, “এই মেয়েটি কে?” আমিও বলি, “সে আমার গার্লফ্রেন্ড! “আর আমি?” “তুমি? কে তুমি?” স্নিগ্ধা অবাক চোখে তাকায়। “আরে বলেই ফেলো কে তুমি? কী সম্পর্ক তোমার সাথে আমার? কে ভালবাসতে আসছে তোমায়? একতরফা ভালবাসা কোনো ভালবাসা নয়।” স্নিগ্ধা নীরবে কাঁদতে থাকে। ওর ফর্সা গাল দুটি লজ্জায় লাল হতে থাকে। তবু আমার মন গলে না। আমি বলি, “অন্যের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলাবে না। যাও এখন।” স্নিগ্ধা যেন পালিয়ে বাঁচলো। দৌড়ে ছুটে গেল। সেটাই কাল হল ওর জন্য। রাস্তার মাঝ বরাবর দৌড়ে যেতেই এক ট্রাক এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।
স্নিগ্ধার কবরের পাশে বসে আমি। একাকী! অনেক প্রার্থনার পর বলি আনমনে, “ভালবাসার সম্মান যে দিতে পারে তাকেই আমি হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে। জানো স্নিগ্ধা.. একমাত্র তুমিই জানতে ভালবাসা কতটা পবিত্র। হৃদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। ও নিজের ইচ্ছায় বিয়েটা করেছে। না, আমার কষ্ট হচ্ছে না। ঘৃণা হচ্ছে ওর প্রতি। যে ঘৃণার বিপরীতে অশেষ ভালবাসা হয়ে আছো তুমি। শুধু তুমি!” কবর ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। কারণ নিজেকে ক্ষমা করবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি যে আজও!