পানিতে জীবন্ত লাশ

পানিতে জীবন্ত লাশ

আমরা তখন মীরপুরে থাকি। আমাদের ফ্ল্যাটের আট তলায় থাকতেন এ্যাডভোকেট সাহেব। উনার স্ত্রী আর তিন ছেলে- মেয়ে নিয়ে সাজানো সুখের সংসার ছিলো। দু’ ছেলের একজন সবেমাত্র বিবিএ পাশ করেছিলো, অন্য ছেলে মনিপুর স্কুলে ক্লাশ টেনে পড়তো। মেয়েটা ক্লাশ সেভেনে। উনাদের দু’ ছেলে ছিলো রত্নের মত। কি কারণে রত্ন সেটা বলি। তারা দু’ ভাইই লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিলো, তেমনি ছিলো তাদের আদব কায়দা, ভদ্রতা। স্কুল/ ভার্সিটি যে কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতায় হোক তাদের ঘরে পুরস্কার আসতোই। কেবল তাই নয়, গল্প বলা প্রতিযোগিতা, খেলাধূলা সেখানেও পুরস্কার তাদের জন্য নির্ধারিত ছিলো!

এসবের পর আরো বেশি ভালো লাগতো যখন দেখতাম ( লিফট কিংবা নিচে) সব সময় তারা তাদের বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে বাজারের বড় বড় ব্যাগ বহন করছে। বাবা- মায়ের প্রতি তাদের ভক্তি, দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। তাদের মাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া, তাদের নানীর বাড়ি খিলগাঁও নেওয়া,কিংবা বাবার সঙ্গে ছায়ার মত থাকা – এসবই দু’ ভাই মিলে চমৎকার পালন করতো। আমার সঙ্গে লিফটে দেখা হলেই হাসি মুখে সালাম দিতো। তারা দু’ ভাইই ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। ওদের পুরো পরিবারটাই ছিলো ভীষণ ধার্মিক। ভাবীকে আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ কখনো উনার মুখ দেখেননি। এমনকি ফ্ল্যাটের ক্লিনারের বউ গিয়ে ময়লা আনতে গেলেও কখনো উনার চেহারা দেখতে পারেনি। কি কারণে জানিনা ভাবী আমাকে খুব পছন্দ করতেন। অথচ আমি তেমন কখনো উনার বাসায় যাইনি। ফ্ল্যাটে কারো বাসাতেই আমার তেমন যাওয়া আসা হতোনা। তবে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে, অথবা কারো অসুখের খবর জানলে কিংবা মৃত্যুর সংবাদে সব সময়ই যেতাম। এটা এখনো করি। যাইহোক যেটা বলছিলাম, হঠাৎ একদিন নিচে লিফটের সামনে ভাবীর সঙ্গে দেখা। ( উনার সঙ্গে কোথাও যাওয়া- আসার পথে ফ্ল্যাটের নিচে দেখা হলে আমি ১০/১৫ মিনিট মাঝে মাঝেই গল্প করতাম।) তখন ভাবী বললেন, আমরা ১০ বছর পর এবার ঈদ করতে শ্বশুরবাড়ি বরিশাল যাচ্ছি । আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

আমি বললাম, কি মজা গ্রামে গিয়ে ঈদ করবেন। উনি বললেন, শ্বশুর- শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই তো তাই এত বছর যাওয়া হয়নি। এবার গ্রামে গিয়ে গ্রামের ৩০০/৪০০ মানুষকে গরু জবাই দিয়ে খাওয়ানোর চিন্তা করেছে আপনার ভাই। আমার শ্বশুর – শাশুড়ি, দাদা শ্বশুর – দাদী শাশুড়ির জন্য। আমিও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম।….

এরপর উনারাও কখন গেলেন জানিনা, আমিও ব্যস্ততায় কাটালাম। হঠাৎ একদিন আমার বাচ্চাদের আরবী শিক্ষিকা ফোন দিয়ে বললেন, আপা, জানেন নাকি আপনাদের উপর তলার দু’ ছেলে বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে ডুবে গতকাল মারা গেছে? আমি খবরটা শুনেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে আর একজনকে ফোন দিয়ে জানলাম ঘটনা সত্যি না মিথ্যা! উনিও বললেন, একটু আগেই তিনিও খবরটা পেয়েছেন। আমি কি বলবো, এখনো লিখতে গিয়ে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে । আমি কাঁদতে লাগলাম ফোন হাতে নিয়ে। বাসার সবাই দৌঁড়ে এলো ব্যাপার কি জানতে। পুরো ঘটনা শুনে সবাই স্তব্ধ! এরপর ৪/৫ দিন পর ওরা ঢাকাতে এলো। গার্ডদের আগেই বলে রেখেছিলাম ওরা এলে যেনো আমাকে জানায়। গার্ড জানালো, ওরা এসেছে।

সন্ধ্যায় উনাদের বাসায় যাওয়ার পর দেখি বেডরুমে অনেক আত্মীয় স্বজন। আমাকে দেখেই ভাবী জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেন। আমি নিজেও কাঁদতে লাগলাম। একসাথে দুটো রত্নের মত ছেলে হারানোর শোক আমার বুকের ভেতরটাও ভেঙ্গে চুরে শেষ করে দিচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে উনি সব ঘটনা বর্ননা করতে লাগলেন।

গ্রামের প্রায় সব মানুষকেই দাওয়াত করা হয়েছিলো। ওরা দু’ ভাই অন্য আত্নীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে সবার খাওয়া দাওয়া তদারকি করছিলো। সবার খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই তারা না খেয়ে মাকে বলেছিলো, খুব গরম লাগছে, কাছেই সন্ধ্যা নদীতে গোসল করে এসে ভাত খাবে। ভাবীও ছেলেদের জন্য বসে ছিলেন। ওদের সঙ্গে অন্য আত্মীয় স্বজনও ছিলো। দু’ ভাই এর বড় জন সাঁতার পারতো, ছোটজন পারতো না। তাই নদীর কিনারায় দাঁড়িয়েই দু’ ভাই গোসল করছিলো। হঠাৎ মাঝখানে একটা ঘূর্ণির মত এসে ছোট ভাইটিকে টান দিয়ে অনেকটা দূরে নিয়ে যেতে দেখে বড় ভাই ছোট জনকে বাঁচাতে দৌঁড়ে যায় পানির ভেতর। কিন্তু ততক্ষণে দু’ ভাইকেই পানির স্রোত বহুদূরে নিয়ে চলে গেছে।

চারিদিকে মানুষের চিৎকার, হৈ চৈ এ ততক্ষণে বহু মানুষ এসে গেছে। তাদের অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে খুঁজতে। কেউ পায়নি। অনেক নৌকা, ডুবুরি, সব রকমের ব্যবস্হা করে খোঁজা হয়েছে। পরদিন নদীতেই বহুদূরে দু’ ভাই এর লাশ পাওয়া যায়।
তাদের দু’ ভাইকে তাদের দাদা দাদীর কবরের পাশেই পারিবারিক গোরস্তানে কবর দেওয়া হয়।….

জীবনের কিছু কিছু পরিস্থিতি এমনই যন্ত্রণার হয় – যেগুলো মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। কিন্তু কিছু করার নেই। মানতেই হয়। দু’ছেলে মারা যাবার পর থেকে ভাই ভাবী জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছেন। বিশেষ করে ভাবী। তিনি বলতে গেলে সারা মাসই রোজা রাখেন, নামাজ, কালাম পড়ে আর চোখের পানিতে দিন পার করেন। জাগতিক দুনিয়া তিনি পুরোপুরিই বর্জন করেছেন। কোথাও যান না, কিছু কেনেন না, তেমন খানও না। কেবল জানটা বাঁচাতে যা না খেলেই নয় ততটুকুই খান। বেঁচে থেকেও মানুষ কিভাবে মৃতের মত জীবন কাটাতে পারেন আমি ভাবীকে দেখে বুঝেছিলাম ।

এই ঘটনাটা ঘটার পর বহু রাত আমি ভালোভাবে ঘুমাতে পারতাম না। কেবল দু’টো চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতো আর নিজের অজান্তেই কখন যে চোখ ভিজে যেতো জানিনা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত