বৃষ্টি আমার কোনদিনই ভাল লাগে না । বিশেষ করে বর্ষাকালের প্যাঁনপ্যানে বৃষ্টিতে বিরক্ত ধরে যায় । আর বৃষ্টির সাথে আমার অঘোষিত একটা শত্রুতা ছিল সব সময় । আমার যখন আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো কোন কাজে তখনই এই বদ বৃষ্টি এসে হাজির । আর একবার শুরু হলে আর শেষ হওয়ার নাম নেই ।
আজকেও টিউশনী থেকে বাসায় ফেরৎ যাওয়ার সময় সেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । বিকেল বেলা আকাশটা ছিল একদম পরিষ্কার । আকাশে একটু মেঘ দেখলেই আমি ছাতা নিয়ে বের হই । তখন অবশ্য বৃষ্টি হয় না । কিন্তু যেদিন আমি ছাতা ছাড়া বের হব ঠিক সেদিনই বৃষ্টি নামবে এবং আমাকে ভিজতে হবে ।
ঢাকার বাস গুলোতে বৃষ্টি হলেই ভীড় বেড়ে যায় । কোথায় বৃষ্টির দিকে সবাই বাসায় বসে থাকবে, তা না, বৃষ্টির দিনেই যেন সবাই আরও বেশি বেশি করে বাইরে বের হয় । আমার বিরক্তি আরও বাড়তে থাকে । আমি বিরক্তি নিয়ে বাসের ভীড়ের মধ্যে দাড়িয়ে আছি । মাঝে মাঝে বাস চলছে আবার থামছে । আমার বিরক্তি বাড়েই চলেছে ।
ঠিক সেই সময়েই আমার বিরক্তিটাকে আরও একটু বাড়িয়ে দিতে ফোনটা বেজে উঠলো । একবার মনে হল ফোনটা ধরবো না কিন্তু এই সময়ে বাসা থেকে ফোন আসে । না ধরলে মা হয়তো চিন্তা করবে । আমি ফোনটা বের করে দেখলাম ফোন মা করে নি । বৃষ্টি করেছে ।
আমি এই বর্ষার বৃষ্টিকে এতো অপছন্দ করি আর আমার জীবনে বৃষ্টির অভাব নেই । আমার ছাত্রীর নাম বৃষ্টি । দুজন ক্লাসমেটের নামও বৃষ্টি । ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে কতজন বৃষ্টি নামে আছে, হিসাব নেই । তার উপর এই এখন যে মেয়েটা ফোন দিয়েছে তার নামও বৃষ্টি । এই এতো বৃষ্টি নিয়ে আমি কোথায় যাবো !!
অন্য কারো ফোন হলে কেটে দিতাম হয়তো কিন্তু বৃষ্টি বলেই হয়তো দিলাম না ।
-কোথায় তুমি ?
-বাসের ভেতরে !
-বাসায় আসো !
-এখন ?
-হুম ! এখন !
-কিন্তু এখন ……
-কোন কিন্তু ফিন্তু না এখনই আসো !
আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বৃষ্টি ফোন রেখে দিল । মেয়েটা সব সময় এরকমই আচরন করে । কদিন হল মেয়েটাকে চিনি কিন্তু আচরনে মনে হয় কতদিনেরই না চেনা সে আমার । আমাদের এমন কোন সম্পর্কও তৈরি হয় নি । কথা হয়, মাঝে মাঝে দেখা হয় ব্যাস এই টুকুই ।
তারপর নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম আসলেই কি এই টুকু ?
জানি না ! আসলে বৃষ্টির সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে কোন কিছুই নিয়ম মাফিক হয় নি । মেয়েটার আচরন আমার কাছে সব সময় গোলমেলে লাগে । আমি মেয়েটাকে ঠিক মত আজও বুঝতে পারি নি । অবশ্য বুঝার খুব একটা চেষ্টাও করি নি ।
বৃষ্টি সাথে আমার পরিচয়ও এই বৃষ্টির ভেতরেই । তাও আবার খুব বেশিদিন আগেও না । সবে মাত্র বসন্ত কালটা পড়েছে । আকাশে টুকটাক মেঘ জমলেও বৃষ্টি হয় না । কেবল ভয় দেখিয়েই চলে যায় । সেদিনের কথা ভিন্ন । টিউশনে যাবো বলে বাইরে বের হয়েছি । তার আগে আট নাম্বারে একটা কাজ ছিল । কাজ শেষ করে বাসে উঠতে হবে । সে জন্য রাস্তার ওপাশে যাওয়া লাগবে ।
আকাশে তখন মেঘ জমে একাকার হয়ে গেছে । একবার মনেহল বাসায় গিয়ে ছাতাটা নিয়ে আসি । খুব বেশি দুরে না বাসাটা । কিন্তু পরে আবার মনে হল একবার বাসে উঠতে পারলে আর সমস্যা নেই । আর এখন বৃষ্টি শুরু হয় নি, নাও হতে পারে । আমি এক রাস্তা পার হয়ে মাঝের আইল্যান্ডের উপরে এসে দাড়ালাম । ঠিক তখনই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । আর আমার এমনই কপাল যে ঠিক তখনই দুধারে গাড়ি গুলোও তীব্র গতিতে চলা শুরু করলো । আমি রাস্তায় নামতেও পারছি না গাড়ির জন্য । বাধ্য হয়ে ভিজতে শুরু করলাম । আইল্যান্ডের উপর লাগানো গাছের ছায়ায় নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । বিরক্তিতে মন ভরে গেল ।
আমি যখন নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে ব্যস্ত তখন পাশে তাকিয়ে দেখি কালো রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরে একটা মেয়ে আমার পাশে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে । হাত দুটো আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া । মনে হল সে বৃষ্টিটাকে খুব ভাল ভাবেই উপভোগ করছে । আমার কি মনে হল বললাম
-খুব মজা লাগছে ?
মেয়েটি আমার কথা শুনে চোখে মেলে তাকালো । তারপর বলল
-কেন ? আপনার লাগছে না ?
-বিরক্ত লাগছে !
-আহ ! বৃষ্টিটাকে উপভোগ করতে শিখুন জনাব । দেখবেন কত চমৎকার একটা জিনিস !
-কোন দরকার নেই । ধন্যবাদ !
আমি তখনও সামনে তাকিয়ে আছি কখন গাড়ির চাপ একটু কমবে আর আমি রাস্তা পার হব । টিশনীতে যাওয়া লাগবে । একবার মনে হল আজকে টিউশনীতে না যাই, তারপর মনে হল নাহ, যেতে হবে । কামাই দেওয়া যাবে না । কালকে এমনিতেই যাই নি ।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোথায় যেতে চাচ্ছেন ? কোথায় ?
-টিউশনীতে যাবো । কিন্তু দেখেন কি অবস্থা ! আজকে না গেলে আমার খবরই আছে ।
-কখন যেতে হবে ?
-এই তো ৫টার দিকে । মগবাজার !
মেয়েটা কি মনে করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর হাত ইশারা করে কাকে যেন ডাকলো । আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে একটা কালো ফ্যারারী এসে থামলো আইল্যান্ডের পাশে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি গাড়িতে উঠুন । চলুন আপনাকে মগবাজার পৌছে দিয়ে আসি !
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । এই মেয়ে আমাকে মগবাজার পৌছে দিতে চাচ্ছে কেন হঠাৎ ! এই মেয়ের সমস্যা কি !
মেয়েটি মনে হচ্ছে আমার মনের কথা বুঝতে পারলো আমার দিকে তাকিয়েই । তারপর বলল
-আসলে বৃষ্টি আমার খুব বেশি পছন্দ । আমার মায়েরও খুব পছন্দ ছিল । তাই তো আমার নাম বৃষ্টি রেখেছে । যখন দেখি এই কেউ এই চমৎকার বৃষ্টির উপর বিরক্ত হয়ে আছে মনে হয় যেন আমার উপরেই সে বিরক্ত হয়ে আছে । আমি সারাটা সময় প্রার্থনা করি যেন বৃষ্টি হয়।
আমি কি বলবো ঠিক বুঝলাম না । বৃষ্টি বলল
-কই আসুন ! ভয় নেই । আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো না !
এই বলেই মেয়েটা হাসলো । বৃষ্টির পানি মেয়েটার চুল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে । আমি কেবল অবাক হয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম বৃষ্টির দিকে । মনে হল এই মেয়ে যদি হয় কিডন্যাপার তাহলে আমি স্বানন্দে কিডন্যাপ হতে রাজি আছি ! আমি আর কিছু না ভেবে গাড়িতে উঠে পড়লাম । বৃষ্টিও ভেজা কাপড় নিয়ে আমার পাশেই উঠে পড়লো ।
মগবাজার নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-বৃষ্টি ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ না । একবার একটু মন দিয়ে দেখলেই হল । বৃষ্টিকে আর ঘৃণা করবেন না কেমন !
আমি কেবল একটু হাসার চেষ্টা করলাম । বৃষ্টিও প্রতি উত্তরে একটু হেসে গাড়ি নিয়ে চলে গেল । আমি দাড়িয়েই রইলাম আরও কিছুটা সময় ।
বৃষ্টিদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি । বলতে গেলে পুরোপরি ভিজে গেছি । বৃষ্টির বেগ যেন আরও বেশি বেড়েছে । অবশ্য একটু আগে যে পরিমান বিরক্ত লাগছিলো এখন অবশ্য তেমন লাগছে না । একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে অবশ্য ।
বৃষ্টিদের বাসাটা ধানমন্ডির সব থেকে অভিজাত এলাকাতে । এখানে উচু উচু বিল্ডিংয়ের মাঝে বেশ কয়েকটা দুতলা আর তিন তলা বাসা আছে । বৃষ্টিদের বাসাটাও ঠিক তেমন একটা ।
আমি এর আগেও কয়েকবার এই বাসায় এসেছি । বাড়ির দাড়োয়ান আমাকে ভাল করেই চেনে । তবুও আমি গেটের সামনেই দাড়িয়ে রইলাম কিছুটা সময় । আজকে কেন জানি হঠাৎ করেই বৃষ্টিতে ভিজতে খারাপ লাগছে না । বিরক্তও লাগছে না ।
গেট খুলে গেল । ছাতা হাতে দাড়োয়ানকে দেখতে পেলাম
-আফা মনি আপানরে ভেতরে যাইতে কইছে !
-ভিজে গেছি তো !
-অসুবিধা নাই । আসেন !
ঐদিনের ঘটনার পরে আমি ভেবেছিলাম বৃষ্টির সাথে মনে হয় আর কোন দেখা হবে না । তবে এটা নিশ্চিৎ ছিলাম যে মেয়েটাকে আমার মনে থাকবে । মেয়েটারও হয়তো আমার কথা মনে থাকবে ।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে আবারও বৃষ্টির সাথে দেখা হয়ে গেল । এবং ওদের বাসার সামনেই । ক্যাম্পাস থেকে একটা সার্ভের কাজ করছিলাম । আমার বাসা যেহেতু এদিকে আমার দায়িত্ব পড়ে ছিলো এই এলাকায় খোজ নেও । সেই কাজই করছিলাম তখনই বৃষ্টি আমার পেছনে এসে দাড়িয়ে পড়লো ।
-আরে আপনার নামই তো ঐদিন জানতে চাই নি !
আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি !
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম । বললাম
-বলা হয় নি আর কি !
তারপরই টুকটাক কথা শুরু । বললাম কেন এখানে এসেছি । আমি ঐ এলাকাতে উদ্বাস্তু মানুষ গুলোর ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলাম । ঐদিন বৃষ্টি পুরোটা সময় আমার সাথেই ছিল । ওর নাকি মজাই লাগছিলো । তারপর থেকেই আমার যোগাযোগ শুরু । কথা বার্তা শুরু .. আপনি থেকে তুমিতে আসা ।
বৃষ্টির আজকে মন খারাপ । এই জন্যই ও আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছে । মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে বুঝতে পারলাম । এর আগেও এমনটা হয়েছে । বৃষ্টি মন খারাপ কিংবা ভাল থাকলেও ও আমাকে ডেকে নিয়ে আসে । আমার সাথে কথা বলে আড্ডা মারে ।
আমি ওদের বাসার ছাদের দাড়িয়ে আছে । তখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে । বৃষ্টি দাড়িয়ে আছে ছাদের মাঝেই । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেখানে বৃষ্টির চেহারাটা আরো ভাল করে ফুটে উঠছে । আমি দাড়িয়ে রইলাম দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজতেছি । কারো মুখে কোন কথা নেই । আমি আগ বাড়িয়ে কোন কথা জানতে চাইলাম না । কেন জানি মনে হল মেয়েটা নিজ থেকেই বলবে !
বৃষ্টি হঠাৎ বলল
-আজকে আমার জন্মদিন !
-আরে তাই নাকি ? আগে বল নাই তো !
আমি বৃষ্টির আরও কাছে এগিয়ে এলাম । মেয়েটার মুখটা আসলেই বিসন্ন মনে হচ্ছে । নিজের জন্মদিনের দিন কোন মেয়ের মন খারাপ থাকতে পারে আমার জানা ছিল না । বৃষ্টি এমনিতেও চুমচাপ স্বভাবের মেয়ে হলেও মুখটা সব সময় হাসি হাসি থাকে । সুখী সুখী একটা চেহারা লাগে । আজকে এমন মন খারাপের চেহারা কেন ?
-আজকে আমার মায়ের মৃত্যুদিনও ! প্রতি বছর এই দিনে তুমুল বৃষ্টি হয় । শুনেছি আমি যেদিন সেদিনও নাকি তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো । আম্মুর পছন্দের বৃষ্টির দিনে তার মেয়ের জন্য । আম্মুর কিছুক্ষনের জন্য জ্ঞান এসেছিলো । সেই সময়ে বাবাকে বলেছিলো যে তার মেয়ের নাম যেন বৃষ্টি রাখা হয় !
বৃষ্টির কথা বলতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছিলো । কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো । আমার তখনই মনে হল মেয়েটা আসলে কতটা দুঃখী । এতো দিন আমি মেয়েটা একটা সুখী মেয়েই মনে করতাম । বড় লোকদের আবার দুঃখ থাকে নাকি । আমি আরেকটু কাছে গিয়ে বৃষ্টিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম । কেবল মনে হল মেয়েটার কেবল এখন কাছে থাকা দরকার ।
একটু যে ভয় ছিল না তা কিন্তু না ! কিন্তু মেয়েটা অন্য কোন প্রতিক্রিয়া করলো না বরং আমার মনে হল মাথার রাখার জন্য মেয়েটা এমন কাউকে খুজছিলো । বুকের ভেতরেই মুখ গুজে বৃষ্টি বলল
-এই দিনে বাবা দরজা বন্ধ করে থাকেন সারাটা সময় । রাত ভর ডিংঙ্কস করে । আমার বড় একা একা লাগে । নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয় । মনে হয় আমি জানি না আসতাম পৃথিবীতে তাহলে হয়তো আম্মা আজকে বেঁচে থাকতো !
অনুভব করলো বৃষ্টির কান্নার বেগ প্রাকৃতিক বৃষ্টির বেগের মতই বৃদ্ধি পেয়েছে । আমাকে যেন আরও একটু জোরেই জড়িয়ে ধরেছে । আমি কিছু বললাম না । বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরেই দাড়িয়ে রইলাম । মেয়েটা একটু কাঁদুর । আকাশ যেন বৃষ্টি দিয়ে তার বুক হালকা করে নিচের এই বৃষ্টিও একটুকান্না করুক ।
আজকে দুই বৃষ্টির জল মিলে মিশে একাকার হোক !