সেদিন তরকারীতে লবন কম হওয়ার কারনে আমার স্বামী খাবারসহ প্লেট আমার মাথায় মেরেছে। প্রচন্ড আঘাতে কপাল থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। তাতেই ক্ষ্যান্ত হয়নি খাওয়া থেকে উঠে লাথি আর কিল-ঘুষী মারলো। কিছুই বলতে পারিনি। শুধু কান্না করেছি আর আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পাশের ঘরের প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসলো। খাটে শোয়ায়ে মাথায় পানি দিলো। একসময় জ্ঞান ফিরে আসে।
সেদিন রাতে আর আমার স্বামী বাসায় ফিরেনি। পরেরদিন সকাল ১০ টায় ফিরলো একটা মদের বোতল নিয়ে। এ আর নতুন কিছু নয়! আমার স্বামীর অত্যাচার আমি একা ভোগ করিনা, ভোগ করতে হয় নিরীহ প্রতিবেশীদেরও। ওইতো সেদিন দল-বল নিয়ে মালেক চাচার ছাগলটি জবাই দিয়ে বুনা করে খেলো। কেউ কিছু বলতে পারেনি। মালেক চাচা শুধু নিরবে অশ্রু ছাড়লেন আর আল্লাহর দরবারে বিচার দিলেন।
কিছুদিন পর পর যৌতুকের টাকার জন্যে আমাকে মারে। টাকা এনে দিলে কয়েকদিন ভালো থাকে। জুয়া খেলে যখন টাকা শেষ হয়ে যায়, তখন আবার আমার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু আমার মা-বাবা তো খুবই অসহায়। কোনোরকমে দিন পার করে। কিছুদিন পর পর এতো টাকা তারাও কিভাবে দিবে? বিয়ের আগে আমার স্বামী এমন ছিলোনা।
কয়েকদিন হলো গ্রামে তাবলীগের লোক এসেছে। তাকে দাওয়াত দেয়াতে তাদের উপরেও নাকি অনেক ক্ষ্যাপেছে। কিন্তু যখন তারা বেহেশতের অসীম নিয়ামতের কথা বর্ণনা করলেন তখন নাকি আমার স্বামীর মুখমন্ডল ফুটে উঠলো। বাদ মাগরিব যখন বিস্তারিতভাবে বললো তখন আমার স্বামী নিজেকে দুরস্ত করতে নিয়ত করলো।
তাবলীগে ১০ দিন থাকার পর আমার স্বামীর খিদমতের ফালা এসেছে। তার সাথে পুরনো একজন সাথিও আছে। বাজার-সদাই শেষে দু’জন লেগে গেলো রান্নার কাজে। আমার স্বামীকে বলা হলো চুলোয় আগুন জ্বালানোর জন্য। আমার স্বামী চুলোয় আগুন জ্বালানোর জন্য কয়েকবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। সাথীকে বলে চুলোয় আগুন জ্বালালো। ওই সাথী আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে বললো।
আমার স্বামী চুলোর পাশেই বসা ছিলেন। কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে থাকার জন্য চুলোটি নিভে যায়। আগুন জ্বালানোর জন্য আবারও চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবার কালো কালো ধোয়ার মুন্ডলীগুলো তাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। অসহ্য জ্বালায় চোখ জ্বলতে লাগলো। বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগলো চোখের অশ্রুবারি। ওই সাথী তাকে চোখ মুখ ধুতে বললেন। এবং ওনি নিজেই চুলো জ্বালিয়ে দিলেন।
চোখ মুখ ধুয়ে এসে আমাকে দেয়া কষ্টগুলো স্বামীর চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। ভাবলো;- এতো কষ্ট করে আমার বৌ রান্না করে আনতো আর আমি সামান্য ত্রুটিতেই তার উপর চালাতাম অমানুষীক অত্যাচার নির্যাতন। আজ আমি শত চেষ্টা করেও কাজটি করতে পারলামনা। আমার কষ্ট দেখে অন্য সাথী ভাই সাহায্যের হাত বাড়ালেন। আর আমার বৌ? “তার কষ্টে তো কেউ তাকে সাহায্যের হাত বাড়ায় না! যত কষ্টই হোক তার কাজ তাকেই শেষ করতে হয়।” আমার স্বামীর হৃদয়টা কেঁদে উঠলো! চোখ দিয়ে বইতে লাগলো শোকবারি। এক চিল্লা শেষ করে গ্রামে ফিরছে স্বামী। “আসসালামু আলাইকুম ” রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া সবাইকে সালাম দিচ্ছে। এতোটা পরিবর্তন দেখে অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেদিনই মালেক চাচার সাথে দেখা;-
-“আসসালামু আলাইকুম।
চাচা আমাকে চিনছেন আমি সোহাগ। সেই পাপী যে কিছুদিন আগে যে আপনার ছাগল চুরি করে খেয়েছে। চাচা আমি আপনার ছাগলের সবটাকা পরিশোধ করে দেবো। আপনি মন থেকে আমাকে ক্ষমা করু চাচা”! বলেই মালেক চাচার হাত ধরে আমার স্বামী কাঁদতে থাকলো।
চাচা ভাবতে থাকলেন;- এই কি আমাদের সেই সোহাগ? কী সুন্দর মাথায় টুপি, গায়ে সুন্নতী পাঞ্জাবি, মুখে দাড়ি। যেই চেহারায় বিরাজ করতো হিংস্র জানোয়ারদের চাপ, আজ সেই চেহারায় ফুটে উঠেছে আল্লাহওয়ালাদের নূর! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। এক পর্যায়ে আনন্দে কেঁদেই ফেললেন; আর বললেন;-
-তুমি যদি সেই সোহাগ হও, তাহলে আমি তোমায় ক্ষমা করে দিলাম।
বাড়িতে এসে দরজায় টোকা দিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। দরজা খোলার সাথে সাথে আমাকে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, ইনিই আমার সেই অত্যাচারী স্বামী। রাতে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেতে বসলো। তবে আগের মত টেবিলে নয়, মেঝোতে দস্তরখানায় খেতে বসলো। এতো কিছুর পরেও বুকে সেই পুরনো ভয় নিয়ে খাবার গুছিয়ে দিলাম। স্বামী বললো;-
-তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো একসাথে খাই! ওর মুখে এমন ব্যাতিক্রমি কিছু শুনে অবাক হই।
-না আপনি খান! আমি না হয় পরে খেয়ে নেবো!
-“যতো হাত তত বরকত” কথাটি বলেই আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলো।
“বিসমিল্লাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ” বলে মুখে লোকমা নিয়ে বললো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ খাবারে অনেক স্বাদ হয়েছে। ওর মুখে এমন প্রশংসা শুনে খুব অবাকই হলাম। আমিও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাবার মুখে তুললাম। কিন্তু একি? তরকারিতে মোটেই লবন দেয়া হয়নি। ভয়ে ভয়ে হৃদপিণ্ড বের হওয়ার উপক্রম হলো। কাঁপতে লাগলো পুরো শরীর।
এসময় স্বামী মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো;-
-তুমি ভয় পেয়োনা। তোমার কোনো দোষ নেই। আল্লাহ পাক আজ আমাদের রিজিকে লবন রাখেননি, তাই এ অবস্থা হয়েছে। সুতরাং আমাদের তাকদীরের এ ফয়সালা মেনে নিতে হবে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকর আদায় করতে হবে।
চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করতে লাগলাম। হে মালিক! লাখো শুকরিয়া তোমার দরবারে। আধার জগতের মানুষটিকে তুমি দিয়েছো দ্বীনের জ্যোতি। বদলে দিয়েছো তার অন্ধকারের অভিশপ্ত জীবনকে দিয়েছো তোমার নূরানী জীবন।