আমার স্ত্রী রিনা, ভালবেসে ওর নাম তিলোত্তমা দিয়েছিলাম আমি। ক’দিন আগেই রাগারাগি করে বাপের বাড়ি চলে যায়৷ অনেক অনুনয়- বিনয় করে ওকে আজ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি৷
বাবার বাড়ি থেকে এসে আজকাল তেমন একটা কথা বলেনা ও। দু- এক কথায় উত্তর করে, না দিলে বয়েই গেল ভাব। কৈফিয়ত চাইলে কেমন যেন একটা চিবিয়ে খাবার উপক্রম। চিরকাল বক বক করে মাথা খারাপ করে দেওয়া মানুষটা হঠাৎ চুপ করে থাকলে মানায় না। এসব মানুষ চুপ হয়ে যাওয়াটা গুলিয়ে দেয় সবকিছু। সব সময় কেমন যেন একটা হাহাকার মত মনে হয়। তিলোত্তমা চুপ করে যাওয়ার কারনে আমারও এখন ঠিক সেরকম হাহাকারই লাগছে। বুক ভর্তি যন্ত্রনা। সে কথা না বললে এ যন্ত্রনা কমবে না এতটুকুও। আমাকে তাই এখন কথা বলতে হবে ওর সাথে। শোয়ার ঘরে যেতে হবে,
-ভেতরে আসবো তিলোত্তমা…!
-কেউ না করেনি, আপনার ঘর আপনার বাড়ি.. আপনার ইচ্ছা।
-ধন্যবাদ।
-কাজের কথা কিছু থাকলে বলেন।
-আর যদি না থাকে.?
-কি না থাকে.?
-কাজের কথা।
-তাহলে এখন আসুন। আমার হাতে অনেক কাজ আছে।
-কি কাজ আছে শুনি?
-আপনাকে বলবার প্রয়োজন মনে করছি না।
-বাব্বাহ!! ফিল্মি ডায়লগ।
-আমি কার সাথে কেমন কথা বলবো সেটা একান্তই আমার নিজের ব্যপার মহাশয়।
-চিরকাল সব কিছুই কি নিজের থাকতে পারে?
-পারে। কিছু কথা বলতে গেলে প্রয়োজনীয় মানুষ লাগে।
-আমি কি তোমার প্রয়োজনীয় মানুষ নই.?
-না নন। প্রয়োজনীয় মানুষ হতে গেলে নিজের মানুষ হতে হয়। একমাত্র নিজের মানুষদের কাছেই মানুষ তার সকল প্রয়োজন শেয়ার করে।
-কথাটা ভাল ভাবে নিলাম না। কষ্ট পেলাম।
-পান। আমাকে আর ওসব ছুঁতে পারেনা।
-রাগ ও না.?
-রাগ পারে।
-কেন রেগে আছো বলবে.?
-বলবো না। আমি বলিনা সবাইকে সব কিছু।
-একটা কথা বলি.?
-বলুন।
-রাগ জিনিসটাও সকলের সাথে মানায়না।
কারো উপর রাগ করতে হলে সেই মানুষটার উপর অধিকার থাকতে হয়। অধিকার নেই এমন মানুষের সাথে রাগের মতো সুন্দর শব্দটা কোন দিক থেকেই যায়না। অধিকার নেই মানুষ গুলোর সাথে যে শব্দ গুলো যায় তার নাম হলো ঘৃনা, তার নাম হলো আক্রোশ, প্রতিহিংসা। ভালবাসার মানুষকে মানুষ ঘৃনা করতে পারেনা। তার উপর আক্রোশ মেটাতে পারেনা। তবে তার উপরে রাগ করতে পারে।
-আমি আপনাকে মোটেও ভালোবাসিনা বুঝলেন! ক্লিয়ার..
কথাটা শেষ হতেই তিলোত্তমা আমাকে বের করে দেয় তার ঘর থেকে। দরজা লক করে দেয়। আমার জায়গায় আর কেউ হলে হয়তো রাগ করতো কিংবা আবার দরজায় ডাকতো । অথবা উল্টে অপমান করতো তিলোত্তমাকে। কিন্তু আমি তেমনটা করবো না। কারণ, আমি জানি ও এখন দরজা দিয়ে বর্ষার মতো কাঁদবে। তারপর একসময় সমস্ত অভিমান গুলো চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। আমি তখন কতটুকু অপরাধ করেছি কি না, তা ভুলে গিয়ে ও আমাকে ক্ষমা করে দেবে। একটা সম্পর্কে সুখী হতে গেলে “স্যরি” বলাটা দরকার। আমি তাই আজ স্যরি বলবো। বলবো
-তিলোত্তমা সেদিন সত্যিই আমার অমন জোরে কথা বলা উচিৎ হয় নি।
জানি, তারপর ও হাসবে। নয়তো এমনও হতে পারে… ও হুট করে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। আমি কাঁদবো না, কারণ পুরুষরা কাঁদতে পারেনা সহজে। তবে মেয়েদের ওসব বালাই নেই। তারা কাঁদতে পারে মন খুলে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, মেয়েদের কান্নার দাম নেই। মেয়েদের কান্নার দাম আছে। কোন মেয়ে সাধারনত একটা কারণে কাঁদেনা। তাদের কাঁদতে গেলে অনেক কারণ দরকার হয়।
একটা কারণের সাথে আর একটা কারণ যখন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, তখন মেয়েরা ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে। মেয়েরা চুপ করে থাকার অর্থ আসলেই চুপ থাকা নয়, তাদের চুপ থাকার অর্থ হচ্ছে, তারা সব বৈপরীত্য মিটিয়ে ফেলার জন্য সময় ও ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। আর তিলোত্তমারা কথায় কথায় কাঁদে বলেই পুরুষের প্রতিনিয়ত করা অসংখ্য ভুল-ত্রুটি অটোমেটিক ক্ষমা হয়ে গিয়ে এই পৃথিবীতে আজও টিকিয়ে রেখেছে মানব সভ্যতাকে, আজও টিকে আছে সংসারকে।