বিয়ের আগে যে পাত্রীকে দেখিয়েছিলো। সে মেয়েকে তাঁরা বিয়ে দেয়নি! দিয়েছে তাঁর বড় বোনকে!
যে রাতটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত হওয়ার কথা ছিলো সে রাতটা হলো শ্রেষ্ঠ বেদনাদায়ক রাত!
পাত্রীর ঘোমটা খোলার পর থেকে আমি একদম নিশ্চুপ। কোনো কথা বলিনি।
তাঁর ছোট বোনের ধারেকাছেও এই মেয়ে নেই! না চুলে, না নাকে না গায়ের রঙে! স্বাভাবিকভাবে কথাটা আমার পরিবারকে জানানোর পর একটা হট্টগোল লেগে গেলো!
এই মেয়ের নাকি ভালো জায়গায় বিয়ে হচ্ছিলো না। তাই এই বেঈমানীটা করেছে! শুনেছি এর পর কত টাকা যৌতুকে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিয়েছে দুপরিবার!
কতই সহজ না? যে মানুষকে আপনি চাননি সে মানুষকে নিয়ে সারাজীবন পার করে দেওয়া? চাইলেই পারা যায়?
আমি পরেরদিন সকালেই নরসিংদী চলে যায়। ফজরের নামাজটা পড়েই। নামাজের পরে উপর ওয়ালার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
জীবনে কোন পাপের জন্য এত বড় একটা শাস্তি আমাকে তিনি দিয়েছেন?
ছোটবেলায় মা মারা যান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অবশ্য সৎ মা যে অবহেলায় আমাকে মানুষ করেছে তা না। কিন্তু কোনোদিন কাছে রাখেননি!
নরসিংদীতেই জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়ে দিচ্ছি বলতে গেলে। মামার সাথে থাকছি। উনার ব্যবসা আছে।
মামা মামী আর আমি। একটা মেয়ে আছে। চার বছর হলো বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
এখানে ভালোই আছি! তবুও দিনশেষে ঘুমাতে পারি না! বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখি না। বিয়ে করা মেয়েটার নাম মিথিলা !
ওর সাথে তো কথা হয়নি পুরো এক বছর। রোজা ঈদের দিনের রাতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। সে রাতে কোনো কথা হয়নি আমাদের।
সকালে উঠে দেখি বাড়ির সব বাচ্চাকাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। সবাই বেশ খুশিতে আছে শুধু মিথিলা শোবার ঘরের কোণে আঁচলটা ঢেকে কাঁদছে!
কোনো ইচ্ছা ছিলো না কথা বলার। তবুও জিজ্ঞেস করলাম।
“ কাঁদছেন কেন? ”
সে কোনো জবাব দিলো না!
ভাবলাম এক বছর পর এসেও আপনি করে বলছি দেখে বোধহয় কথার উত্তর দিচ্ছে না। তারপর তুমি ডেকে সুন্দর করে জানতে চাইলাম কী হয়েছে?
তাও জবাব দিলো না! সবাই মজা করছে একজন কোনো কথা বলছে না! মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম।
“ মিথিলা কাঁদছে কেন? ”
মা আমার কথাটা এড়িয়ে গেলো! আমার ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগলো! আজকে তো কমপক্ষে ঈদের দিন!
বড় ভাবীর কাছে গেলাম। একই প্রশ্ন করার সাথে সাথে উনি জবাব দিলেন।
“ এই মেয়ের তো কাঁদা’ই উচিৎ। বিয়েটা দিলো ছেলেখেলা করে। বিয়ের এক বছর ধরে বরের মুখটা পর্যন্ত দেখেনি! অথচ যে সবসময় পাশে থাকার কথা। ঈদে তাঁর জন্য একটা ওড়না আনলেও বোধহয় অপরাধ হতো তাঁর বরের। তার উপর যে মেয়ে কথা বলতে পারে না সে তো সুখ দুঃখ প্রকাশ করবে কান্নার মাধ্যমেই তাই না? ”
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম! বাকরুদ্ধ অবস্থা।
“ কথা বলতে পারে না মানে? বোবা নাকি? ”
“ পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিলি না? সে টাকা খাইয়ে কথা বলিয়ে নে। এমন ভাব করছিস মনে হয় কিছুই জানিস না! ”
মাথায় হাত দেয়া ছাড়া উপায় থাকলো না আমার!
“ কী বলো ভাবী? আমি এসবের কিছুই জানি না। বিশ্বাস করো টাকা পয়সার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এমনকি কথা বলতে পারে না আজকেই শুনলাম! এতোদিন তো কেউ এটাও বলেনি! ”
“ ঢং করিস না। ঢং মেয়েদের মানায়। পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা করবি বলে সকাল হওয়ার আগেই নরসিংদী গিয়েছিলি। এরপর তো যোগাযোগ করারও প্রয়োজন মনে করিসনি একটা বছর! এখন বৌ বোবা কিনা সেটাও জানিস না!ডং করিস? সবার লাথি-উষ্টা খেয়ে খেয়ে বেঁচে আছে মেয়েটা এটাই কম কী? ”
ভাবীর কথা শুনে থমকে গেলাম। নিজের পরিবারের প্রতি ঘেন্না জন্মালো! এত বড় একটা ঘটনা কীভাবে আমার কাছ থেকে লুকাতে পারলো?
ভাবীর কথা অবিশ্বাস করার উপায় নেই। আমাদের বাড়িতে মাটির মানুষ থাকলে এই একজনই আছেন!
দৌড়ে এসে আর মিথিলা কে জিজ্ঞেস করিনি। কাঁদছো কেন?
কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিলাম।
আমি এখন থেকে তোমার পাশেই থাকবো। আর তুমি এই বাড়িতেই থাকবে। আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। কিছু করতে পারবে না।
সেদিন আমার কাছে ঈদ বলতে মিথিলা’র ঠোঁটের কোণে অশ্রুসিক্ত হাসিটাই ছিলো!
বিয়ের পরে একদিনও নাকি বাপের বাড়ি যায়নি! শুনে বেশ চমকে গেলাম! সে কাগজে লিখে যা বললো তাতে আমার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো!
এই বোবা মেয়েকে আবার যেকোনো ভাবে ঘরে নিলে নাকি ছোট মেয়ের বিয়ে হবে না!
এজন্য কেউ আর নিতে আসেনি! একরকম পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য! যেন ঘরের কোনো দামী অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রটা বিক্রি করে দিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে!
মিথিলা আমাকে উজাড় করে ভালবেসেছে। আমার হাসিটাই নাকি তাঁর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ!
বোবা মেয়ে কী কারো মন জয় করতে পারে? দিনরাত কাজের বেটীর মতো সবার সেবা করেও কারো মন পায় না! উল্টো আরো তুচ্ছতাচ্ছিল্য!
অনেকবার বলেছি নরসিংদী চলো। মামার কাছে অনেক ভালো থাকবো আমরা। মিথিলা শুনেনি। এখানেই মরে পঁচে গলতেও নাকি তাঁর আপত্তি নেই!
এই বোবা মেয়ের পোড়া কপালটায় যে একদিন অনেক বড় একটা চমক লেখা ছিলো কে জানে? মাত্র বিশ টাকার একটা লটারি ধরেছিলো! প্রথম পুরস্কারটা তাঁর ভাগ্যেই ছিলো!
কত কত টাকা!
মিথিলা বড় ভাবীকে খুব পছন্দ করতো। তাই সব টাকা উনাকেই দিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু ভাবী এক পয়সাও নেবে না। যারা এতদিন দূরদূর করেছে তাঁরাও এখন মাথায় করে রাখছে মিথিলা কে!
চোখের পানিতে ভেজা কাগজে কোনোরকম লিখে মিথিলা বলতো। এসব আমার ভালো লাগে না। আমি এসব চাইও না। আমি মায়ের কাছে যাব। ছোট বোনটাকে একবার দেখবো।
আমি নিয়ে যাইনি।
অলক্ষুণে মেয়ে এখানেই মরে পঁচে যাক! কদিন পর মিথিলা চোখেমুখে রাজ্যের সুখের হাসি। দুষ্টুদুষ্টু চাহনি জানান দিয়েছিলো আমাকে। আমাদের নতুন অতিথি আসতে যাচ্ছে!
সেদিন থেকেই মিথিলা খুবই খুশি। সারাক্ষণই হাসিমুখ। আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়তো না।
তারপর কোনোদিন ভুলতে না পারার মতো কত স্মৃতি পেরিয়ে একদিন মিথিলা পেটে ব্যথা! হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি।
হ্যাঁ সেদিন বাড়ির সবাই গিয়েছিলো! আমার মা সহ! যিনি তাঁকে দুচোখে, এক চক্ষুতেই দেখতে পারতেন না। সহ্য করতেন না ওর ছায়াটাও!
ভাগ্যের কী নির্মম খেলা! অলক্ষ্মী অভাগা বোবা মেয়েটা তাঁর রক্তের ধন। তাঁর পৃথিবী, তাঁর ভালবাসার টুকরা মেয়েটাকে এক নজর না দেখেই মারা যায়! ডাক্তার মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে মিথিলা কে বাঁচাতে পারেনি!
মৃত্যুর সময় ওর মুখটা নাকি হাসি হাসি ছিলো! মৃত্যুর পরেও তাই দেখেছিলাম! মুচকি একটা হাসি দিয়ে যেন ঘুমিয়ে আছে মিথিলা !
এই ঘুম থেকে মিথিলা কোনোদিন উঠেবে না। এটাই মানতে কষ্ট হচ্ছিলো! অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।
মিথিলা’র মৃত্যুর একটা দিনও পার হয়নি। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে মিথিলা’র ছোট বোনের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে!
আমি রাজি থাকলে তাঁরা নাকি খুব তাড়াতাড়িই কাজটা সেরে ফেলতে চান। বাচ্চাটাকে লালনপালন করতে একটা মেয়ে ছাড়া নাকি হবেই না! আমি খিলখিলিয়ে হাসছি। এ হাসি, কীসের হাসি? জানি না। হাইরে টাকা! টাকার কারণে অলক্ষ্মীর জামাইটাও এখন মঙ্গলের লক্ষ্মী ”
সমাপ্ত