মেয়েটা বন্ধ দোকানটার চালার নিচে দাড়িয়েছে অন্তত দুইঘন্টার কম হবেনা।সকালে কোচিং এ যাওয়ার সময় যেভাবে দেখেছিলাম এখনো ঠিক সেভাবেই দাড়িয়ে অাছে।চেহারায় ভীতি আর বিরক্তিভাব দুটোই সমানে কাজ করছে।চিপচিপে শ্যামলা গায়ের গড়ন, ঠোটে হালকা খয়েরি রংয়ের লিপস্টিকের প্রলেপ অাঁকা, কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো সবমিলিয়ে দেখতে অনন্য সাধারন মেয়েটা।
দেখে তো মনে হচ্ছে গ্রামেরই মেয়ে।কিন্তু এখানে এতসময় ধরে একাকি দাড়িয়ে কেন।পথ ভুলে যায়নি তো! নাকি কেউ অাসার অপেক্ষা করছে।নিশ্চয় দুটোর যেকোন একটা হবে। অাপনি ব্যস্ততা দেখতে চাইলে একবার শহরে অাসুন। হাজার হাজার মানুষের এতটা ব্যস্তসমস্ত অবস্হা দেখবেন যেটা অাপনি গ্রামে বসে কখনও কল্পনা করতে পারবেন না।এদের দেখতে মানুষের মত মনে হলেও এরা অাসলে একেকটা যন্ত্রমানব।যার নিয়ন্ত্রক সংস্থা হল টাকা।
এ শহরে বোধই অামিই একজন যার অবসরযাপনের শেষ নেই।শুধু খায় ধায় অার ঘুরি,টাকা রোজগারের চিন্তা নাহি করি।অামি মেয়েটার সোজাসুজি রাস্তার অপরপাশে দাঁড়িয়েছি।দূরত্ব বেশি হলে বিশ হাত, এর বেশি হবে না।এরমধ্যে দুইবার মেয়েটার সাথে অামার চোখাচোখি হয়েছে।চোখ বিনাবাক্যে কথা বলতে পারে। চোখ প্রচন্ড অাঘাতে জল ঝড়াতে পারে।চোখ পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন করাতে পারে।সেইহিসেবে চোখের একটা অালাদা অস্তিত্ব অাছে।যা মানবদেহের অন্যসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গর মাঝে নেই। পেটে কৃমিগুলো ক্ষুদার্থ হয়ে ক্রমশ উঠানামা করছে।এখুনি কিছু খাওয়া উচিত।কয়েক গজ দূরেই ভাতের হোটেল।উপরে সুন্দর করে সুদক্ষ হাতে সুনিপুণভাবে লিখা অাছে-
” অাল- জিলানী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট”।
এখানে ঘরোয়া ও মনোরম পরিবেশে খাবার পরিবেশন করা হয়।” অামি এক পা দুপা করে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম।হোটেল কারিগর রান্নায় মহাব্যস্ত।অার্থিক ব্যবস্হাপক টাকা গুনতে ব্যস্ত।বয় ছেলেগুলোরও ব্যস্ততা কোন অংশে কম যায় না।অামি বসার জন্য এমন সিট চয়েজ করলাম যেখান থেকে মেয়েটাকে দেখা যায়।বয় এসে অর্ডার নিয়ে গেল।কতক্ষণ পর এসে খাবারও দিয়ে গেল।অামি ধীরে ধীরে খাচ্ছি অার মেয়েটাকে দেখছি।অামার কেমন জানি অপরিচিত মেয়েটার শেষ গন্তব্য দেখার ইচ্ছে হল।তাই যতটা সম্ভব সময় পার করার চেষ্টা করতে লাগলাম। গ্রামের মেয়েরা অসম্ভব মায়াবি টাইপসের হয়।তাদের হাঁটা, চলা, কথা বলায় একটা গম্ভীরভাবমূর্তি ধারন করে।তাদের নম্রতা ভদ্রতা শালীনতা শহরের মেয়েদের তুলনায় হাজারগুন বেশি।বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই অামি গ্রামের মেয়েদের প্রতি অনুরক্ত।
মনে মনে একটা গোপন সিদ্বান্তও অাছে যে প্রেম করলে গ্রামের মেয়ের সাথেই করব।অার বিয়ে করলে তাও গ্রামের মেয়েকেই করব।ভাবনার এক পর্যায়ে গিয়ে দেখলাম মেয়েটার হাত ধরে অাছে একটা ছেলে।মেয়েটা অাপ্রাণ চেষ্টা করছে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে।কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলেটা কিছুতেই মেয়েটার হাত ছাড়ছে না।ছেলেটার বয়স বড়জোর ৮বছর হবে।টোকাই ছেলে পোশাকে ময়লাভর্তি।জন বুঝে ভিক্ষুকের কাজটা সেরে নেই।মেয়েটা একটা সিকি বের করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে ধরল।সম্ভবত দুই টাকা নয়ত পাঁচ টাকার সিকি হবে।কিন্তু টোকাই ছেলেটার দাবি অারো বেশি।তাই সে সিকি পয়সাটা নিতে চাইলনা।মেয়েটা পড়ল মহা মুশকিলে।একে তো মানুষজন অাড়চোখে তাকে দেখছে তার উপর মেয়ে মানুষ।মেয়েটা লজ্জায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। না।এভাবে বসে থাকলে চলবেনা।মেয়েটার কাছে টাকা নাও থাকতে পারে।আমি বিল মিটিয়ে ওখানে গেলাম।
– ওই টাকা কি তুই লাগাই রাখছিস নাকি।যেটা দিচ্ছে ওটা নিলে নে, না নিলে যা এখান থেকে।”
অামার ঝাটকি শুনে রীতিমত ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল।তারপর মেয়েটার হাত থেকে সিকিটা নিয়ে সামনে হাঁটা ধরল।মেয়েটা অামাকে ধন্যবাদ দিয়ে চুপ করে রইল।বুঝায় যাচ্ছে চাপা স্বভাবের, কম কথা বলতে ভালোবাসে।কি জানি হয়ত অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে চায় না।এখন যদি অাগ বাড়িয়ে অামি কিছু বলতে যায় তাহলে অামাকে খারাপ ভেবে বসবে।আমি সেখান থেকে চলে অাসার সময় মেয়েটা ডাক দিল।
– এই যে শুনছেন?
– জি বলুন।
– ওয়াসা যাওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে বলতে পারেন?
– সেটা তো অাপনি অনেক অাগেই ফেলে এসেছেন…
-এখান থেকে কতদূর হবে?
– দূর কম না।দুটো গাড়ি বদলাতে হবে।(অামি)
– অামাকে একটু চিনিয়ে দিন না প্লিজ।(মেয়েটা)
– পুরো শহরে আমাকেই খুঁজে নিলেন….!
– মানে?
– না মানে অাপনি পথ হারিয়েছেন অনেক অাগে।অথছ এতসময়ে কাউকে একবারও জিজ্ঞাস করেননি তাই বললাম।
– তাহলে আপনি অামাকে ফলো করতেছেন এতক্ষন ধরে?
– এখনো করছি।( অামি)
– বাহ! বেশ মজা করতে পারেন তো দেখি অাপনি।
– মজা না।সিরিয়াসলি…
– তাই?
– হুম।অাচ্ছা চলেন আপনাকে গাড়ির ছাড়ার পথটা দেখিয়ে দিই…
– হ্যাঁ চলুন।( মেয়েটা)
দুজনেই পাশাপাশি হাটছি।একটু পিছিয়ে পড়লেই শহরের কোন অলিগলিতে আমাকে হারিয়ে ফেলতে পারে।সেই ভয়ে মেয়েটা একপ্রকার দৌড়ে দৌড়েই হাঁটছে।আমিও স্বাভাবিক গতিতে হাঁটার চেষ্টা করলাম।যাতে ওর কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়।
– তা যেখানে যাচ্ছেন ওখানে কে থাকে অাপনার?( অামি)
– অামার মাসি।( মেয়েটা)
– প্রথমবার যাচ্ছেন বুঝি?
– না।দুইবার, ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার এসেছিলাম।
– নিশ্চয় কোন অনুষ্ঠান নামছে…
– হ্যাঁ। ঠিক ধরছেন।মাসিত বোনের বিয়ে।
কতক্ষণ চুপচাপ দুজনেই।মেয়েটা ইতস্তত করছে।হয়ত কিছু একটা বলতে চাইছে।কিন্তু লজ্জা ভয় কিংবা অন্য কোন কারনে কথাটা বলতে পারছেনা।ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অামি বললাম-
– কিছু বলবেন?
– না।
– কিন্তুু অাপনার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আপনি কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন।
– হ্যাঁ। অাসলে অামার ভীষন….. বলতে পারবোনা অামি।
– বলতে হবেনা।অামি বুঝতে পেরেছি।অাসেন অামার সাথে।( অামি)
অামাদের পাশেই একটা প্রাইভেট ওয়াশিং সেন্টার ছিল।অামি দেখিয়ে দিলাম।অার ওখানেই মেয়েটা তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নিল।টানা পাঁচ-ছয় ঘন্টায় প্রচন্ড জোড়ে অাসতেই পারে।চেপে রাখলে যত অসুবিধা। মেয়েটা আরো একবার অামাকে ধন্যবাদ জানায়।মেয়েটাকে দুইবারই ছোটখাটো বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি অামি।সেই জের ধরে ধন্যবাদ অামার প্রাপ্যই।ফুরফুরে লাগছে সবকিছু।উত্তপ্ত রোধ ধুলোমাখা শহর তীব্র যানজট অাজ অামার মাথা ব্যাথার কারন হচ্ছেনা।বরং ভালোই লাগছে শহরটা।ইচ্ছে করছে থাকি অনেকক্ষণ পাশে প্রিয় মানুষটি অাছে যতক্ষণ।খানিক্ষন পর মেয়েটা মুখ থেকে একটা কথা বের করল-
– অামরা তো ১০-১৫ মিনিট ধরে শুধু হাঁটতেই অাছি।গাড়ি ছাড়ার পথ বুঝি এখনো এলো না…
– অাসবে।অাসবে।ভরসা রাখুননা অামার উপর।নাকি রাখতে পারবেন না? ( অামি)
– কেন পারবনা।এতটা পথ যখন রাখতে পেরেছি।বাকিটা ঠিকই পারব।(মেয়েটা)
– অাপনি অনেক ভালো একটা ছেলে।
– কিভাবে বুঝলেন?
– চোখ দেখে।মেয়েরা ছেলেদের চোখ দেখে বুঝতে পারে ছেলেটা কেমন।
– তাই।তাহলে সেদিন পটিয়ায় রিমা নামের একটা মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের হাতে খুন হল কেমনে।চোখ দেখে বুঝা উচিত ছিল মেয়েটার…
– সেটা অন্য কথা।তবে অাপনি ভালো ছেলে সেটা চেহারা দেখেই বুঝা যায়।
– তাহলে কি কোনদিন অামার কপালে গার্লফ্রেন্ড জুটবেনা? (অামি)
– সেরা সুন্দরি অাপনার গার্লফ্রেন্ড হবে।
– কিন্তু ভালো ছেলেদের যে গার্লফ্রেন্ড থাকেনা। (আমি)
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল।এইপ্রথম কোন মেয়ের হাসি এতটা সুন্দর লাগল।অামিও মেয়েটার দেখাদেখি হাসার বৃথা চেষ্টা করলাম।
– অামরা এসে পড়েছি অামাদের গন্তব্যে।( অামি)
– মেয়েটা অবিশ্বাসের স্বরে ” কী “বলে তারপর এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করল।
সত্যি বলতে তার বিশ্বাসই হচ্ছেনা।যেখানে দুটো গাড়ি বদল করে আসার কথা ছিল সেখানে মাত্র পনের-বিশ মিনিট হেঁটে অাসা যাবে এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
– কিন্তু অাপনি তো বলেছিলেন দুটো গাড়ি বদল করা লাগবে।(মেয়েটা)
– মিথ্যে বলেছিলাম।
– কি কারনে?
– অন্য কোন একদিন উত্তরটা বলি…
– যদি দেখা না হয় অার? (মেয়েটা)
– পৃথিবীটা তো গোল।দ্বিতীয়বার দেখা হতেই পারে।(আমি)
মেয়েটা আর বেশিকিছু বলেনি।শুধু “ভালো থাকবেন ” বলে বাসায় ঢুকে গেল। কতদিন পর স্বপ্নরাজ্যের প্রিয়তমার খোঁজ পেয়েছি, ঠিকানা জেনেছি।এখন অার অামাকে অাটকায় কে।