শুশুনিয়ার বাংলোয়

শুশুনিয়ার বাংলোয়

শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকে এগােচ্ছিল তিন বন্ধু জোরকদমে।

হাঁটতে হাঁটতে মণিকুন্তলা গজগজ করে উঠল,ধুস, পুরাে প্ল্যানটাই মাটি। ভেবেছিলাম বিকেল বিকেল শুশুনিয়ায় পৌঁছে যেতে পারব। পারতামই তাে। ঝুলন বিরক্ত মুখে বলল,—বাসটা এমন ফাসিয়ে দিল।

স্রেফ ড্রাইভার কনডাক্টরদের বদমায়েসি। সুপর্ণা বেঁঝে উঠল,–হেলপারটা কেমন বেমালুম বলে দিল বাসের তেল ফুরিয়ে গেছে দিদি! বিষ্ণুপুর থেকে তেল নিতে ভুলে গেছিলাম। কাল সকালে ছাতনার মােড়ে যাবে তেল আনতে, তবে গাড়ি বড়বে! আশ্চর্য দ্যাখ, বাসের প্যাসেঞ্জারও কেউ কিছু বলল না। দিব্যি নেমে যে যার মতো সুড়সুড় করে চলে গেল! লাস্ট বাস ব্রেকডাউন, তাতেও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। এ সব বােধহয় এখানে প্রায়ই হয়। গা-সওয়া হয়ে গেছে।

ড্রাইভারটার কথার কায়দা দেখেছিলি? ঝুলন চুল ঝাঁকাল, তাড়াতাড়ি হাঁটা দিন দিদি…তিন জন মেয়ে পথেঘাটে একা একা বেরিয়েছেন, কোখেকে কী বিপদ আসে…! হাঃ, আমাদের ভয় দেখায় ! তিনজন নাকি একা একা। মণিকুন্তলা মুখ বেঁকাল, ওরে বুদ্ধ, আমরা কুংফু ক্যারাটে জানি। চোর-ডাকাত-গুণ্ডা বদমাশ যেই সামনে আসুক, দেব একখানা এইসান…

রাগ-বিরক্তি ভুলে হি হি করে হেসে উঠল তিন বন্ধু! হাসতে হাসতেই হাঁটছে। কাধে রুকস্যাক, পরনে জিনস টিশার্ট, পায়ে ট্রেকিং শু্।

তিন মূর্তি রওনা হয়েছে আজ সকালেই। কলকাতা থেকে ট্রেনে মেদিনীপুর, সেখান থেকে ট্রেনে বিষ্ণুপুর, তারপর বাস। তিনজনেরই এবার কলেজের থার্ড ইয়ার। ডাকাবুকো তিন সখীর হঠাৎ হঠাৎ এভাবে বেরিয়ে পড়াই বেশি পছন্দ। যাদের প্রাণে ভয়ডর নেই, তারা বেশি চিন্তাভাবনা করবেই বা কেন? মা-বাবারা অবশ্য আপত্তি করেন মাঝে মাঝে, তবে খুব একটা বাধাও দেন না! গত পুজোয় তারা গিয়েছিল পিণ্ডারি গ্লেসিয়ার, গরমে মণিমহেশ। তিন মেয়েরই প্রচণ্ড মনের জোর, বিপদ-আপদ তাদের কাছে ঘেঁষতে ভরসাই পায় না।

সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে আছে লাল আভা। শুশুনিয়া এখন অনেকটা কাছে। শেষ বেলার আলােয় ঝকঝক করছে শুশুনিয়া পাহাড়ের মাথা। দেখে মনে হয় যেন প্রকাণ্ড হাতি বসে আছে চুপটি করে শুড় ঝুলিয়ে।

সরু পিচের রাস্তার দুপাশে সােনালি ধানখেত। তার ওপারে গাছপালা, অনেক দূরে দূরে। একটা-দুটো গ্রামের বাড়িও বুঝি দেখা যায়, আবছা আবছা। এখন শরৎকাল। লক্ষ্মী পুজো গেছে ক’দিন আগে। ধানখেতের ওপরে এক মিহি কুয়াশার আস্তরণ। শীত নেই।

হাঁটতে হাঁটতে তিন মূর্তি এসে পৌঁছােল একটা গঞ্জ মতন জায়গায়। চারদিকে দোকানপাট রয়েছে বেশ কিছু, মানুষজনের ভিড়ও আছে মােটামুটি।

ঝুলন বলল,–একটু গলা ভিজিয়ে নিলে হত না?

সুপর্ণা বলল,–কিছু খেয়েও নেওয়া যায়। বেশ খিদে পাচ্ছে।

একটা চায়ের দোকানে এসে বেঞ্চিতে বসল তিনজন। ডিম পাউরুটির অর্ডার দিয়েছে।

দোকানদার এক বুড়ো মতাে লােক! ডিম গুলতে গুলতে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। এদিকে প্রায়ই ছেলেমেয়েরা ট্রেকিং, মাউন্টেনিয়ারিং করতে আসে, কিন্তু এই পড়বেলায় তিন মেয়ের হন্তদন্ত ভাব দেখে সে বেশ বিস্মিতই হয়েছে। জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, -শুশুনিয়া যাচ্ছেন নাকি দিদিমণিরা?

মণিকুন্তলা ঘাড় দোলাল, হা, আর কদূর ?

এ ধরেন এক ক্রোশ বটে।

শুনেই ফের খেপে গেল সুপর্ণা, -দেখেছিস, কনডাক্টরটা কী পাজি! বাস থেকে নামানাের জন্য বলল, শুশুনিয়া নাকি মাত্র আর এক ক্রোশ পথ, এতটা হাঁটার পরে আরও দু-মাইল বাকি থাকে কী করে?

মণিকুন্তলা চাপা স্বরে বলল,–একে বলে ডাকা ভাঙা ক্রোশ।

সেটা কী?

গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে হাঁটতে শুরু কর, যেখানে ডালটা শুকোবে সেখানে হবে এক ক্রোশ।

ঝুলন সভয়ে বলল,—এখনও অতটা পথ বাকি নাকি ?

দোকানদার শুনতে পেয়ে গেছে। বলল,–না দিদিমণি, অতটা বাকি নাই গাে। দু-মাইল-ই হবে জোর।

হলেই ভালাে।

তা আপনারা ভ্যানরিকশা নিয়ে নেন না কেন? অাঁধার ভালােমতাে নামার আগে পৌঁছে যেতে পারবেন?

তিন বন্ধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল একবার। ভাবটা এমন, ভ্যানরিকশা একটা নিলে হয়। তারপর সুপর্ণাই বলল,—নাঃ, থাক। বাস যখন আমাদের পরিত্যাগ করেছে, আমরা হেঁটেই যাব।

আঁধার নামলে কিন্তু অসুবিধে হবে গাে দিদিরা। শুশুনিয়ায় আজ তিন দিন হল কারেন্ট নাই বটে! সেই বুধবার জোর ঝড়বৃষ্টি হল, তখন তার ছিড়ে গেছে।

ও নিয়ে আমরা ভাবি না। দোকানদারের হাত থেকে চায়ের গ্লাস নিল ঝুলন, আমাদের কাছে বড় টর্চ আছে।

তা আপনাদের ঘর ঠিক আছে তাে দিদি?

কলকাতা থেকে চিঠি নিয়ে এসেছি। সরকারি বাংলােয় উঠব।

সে তাে পাহাড়ের ওদিকটায়! ফাঁকা জায়গায়।

ফাকাই তাে ভালাে। আমরা ভিড়ভাট্টা পছন্দ করি না।

দোকানদার আর কিছু বলল না। খাবার-দাবার এগিয়ে দিয়েছে তিন বন্ধুকে। খাওয়া শেষ করেই তিনজন উঠে পড়ল। আবার হাঁটা শুরু।

সূর্য অস্ত গেছে দিগন্তরেখার ওপারে। তবু দিনের একটা আভাস যেন আছে এখনও। আর একটা ছােট্ট লােকালয় পার হতে না হতেই ঝুপ করে কখন সন্ধে নেমে গেল। কদিন আগের বৃষ্টির জন্য ক্ষেতে এখনও জল আছে অল্প অল্প, দু-ধারের খানাখন্দ সব ভরা ভরা, ব্যাঙরা কোরাস গাইছে গাঙর গ্যাং। গাছের তলায় জোনাকি জ্বলছে নিভছে।

পথ অনেকটাই বাকি ছিল। দু-মাইলের বেশিই হবে। তিন বন্ধু শুশুনিয়ায় পৌছল প্রায় আটটায়। দোকানদার ঠিকই বলেছিল, কারেন্ট নেই। গোটা অঞ্চল জুড়ে একবারে ঘুরঘুষ্টি অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষ চলছে, এখনও চাপ ওঠেনি, এই যেন আরও বেশি গাঢ় লাগে আঁধারটা। শুশুনিয়া পাহাড়কেও আর হাতি টাতি কিছু বলে মনে হয় না। বরং পাহাড় যেন এখন ঘন কালাে স্তুপ। অন্ধকারে আরও গভীর অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে। এক্কেবারে সামনে। তাকালেই কেমন গা ছমছম করে।

তিন বন্ধুর তাতে ভুক্ষেপ নেই। তারা তাে ভয় পেতেই জানে না। ঝুপড়ি মতাে দোকানগুলাে ঝাপ বন্ধ করছে, সেখানে জিজ্ঞেস করে বাংলোর হদিস জেনে নিল। প্রথমে পঞ্চায়েত-বাংলাে, তারপর ইয়ুথ হস্টেল, তারপরও বেশ খানিকটা গেলে তবেই পড়বে বাড়িখানা।

বাংলােটা অবশ্য রাস্তার ধারেই। টর্চ জ্বালিয়ে তিন বন্ধু বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। পুরনাে ধরনের বাড়ি, দরজা-জানলা সব আষ্টে পৃষ্ঠে বন্ধ।

ঝুলন চারদিকে টর্চ ঘােরাল,—কী রে, আশপাশে তাে জনপ্রাণী নেই! মণিকুন্তলা বলল,-কেয়ারটেকার নিশ্চয়ই থাকবে। জোরে হাঁক মার না একটা। সঙ্গে সঙ্গে সুপর্ণা বিটকেল ডাক ছেড়েছে,—কেয়ারটেকার…?

কেয়ারটেকার, আপনি কোথায়…?

কোনও সাড়াশব্দ নেই। সুপর্ণার ডাকটাই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। হঠাৎ কুকুর ডেকে উঠল কয়েকটা! অন্ধকারে কোথায় যে কুকুরগুলাে আছে তাও বােঝা যায় না। ঝুলন বেজার মুখে বলল,–এ তাে মহা মুশকিল হল। রাত্রে কি তা হলে মাঠে ঘাটে কাটাতে হবে?

মণিকুন্তলা রাস্তায় বসে পড়েছে। বলল,—মন্দ কী, নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
কিন্তু হিম পড়ে যে এখন ! ঠান্ডা লেগে যাবে না?

–হাঃ, পিন্ডার মণিমহেশ পার করে এসে শুশুনিয়ায় ঠান্ডা লাগা ?

কথার মাঝেই আবার কুকুর ডেকে উঠেছে। কেমন যেন উদ্ভট সুরে । কান্নার মতাে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলাের পাশ থেকে একটা গলা শােনা গেল, আপনারা কোখেকে আসছেন?

একটু চমকে গিয়েই টর্চ মেরেছে সুপর্ণা । আশ্চর্য, আলােটা জ্বললো না! অন্ধকারে অনেকটা চোখ সয়ে এসেছে, সেই আলােতে তিন বন্ধু দেখতে পেল লােকটাকে। ঢ্যাঙা, রােগা, গায়ে চাদর মুড়ি দেওয়া।

ঝুলন গলা ঝেড়ে বলল,–আমরা কেয়ারটেকারকে খুঁজছিলাম।

আমাকে বলুন। আমিই কেয়ারটেকার বটে।

এখানে আমাদের বুকিং আছে।

চিঠি এনেছেন ?

এনেছি।

আসুন।

লােকটা ওই অন্ধকারেও ঝপ করে গেটের তালা খুলে ফেলল। বাংলাটা একতলা, সামনে টানা লম্বা বারান্দা। কোণের ঘরটা খুলে দিয়ে বলল,-“দুটো বিছানা আছে, তিনজনে একটু কষ্ট করে ঘুমােত পারবেন তাে?

ঘরের বন্দোবস্ত হতেই সুপর্ণা মহা খুশি। তাড়াতাড়ি বলল,-খুব পারব। আমাদের দিব্যি চলে যাবে।

পাশেই বাথরুম আছে। আপনারা আরাম করুন, আমি বাথরুমে জল তুলে দিচ্ছি।

ঝুলন ভদ্রতা করে জিগ্যেস করল,আপনি জল তুলবেন?

আজ্ঞে, আর তাে কেউ নেই। আপনারা বেড়াতে এসেছেন, আপনাদের সুবিধে- অসুবিধে দেখাই তাে আমার কাজ।

খুশি হল তিন সখী। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। বেড়াতে বেরােলে দেশলাই, মােমবাতি, সুপর্ণার সঙ্গেই থাকে, ফস করে কাঠি জ্বালিয়ে মােমবাতি ধরাল। ভালভাবে দেখল ঘরখানা। খাট দু-খানা আছে বটে, জোড়া লাগিয়ে চলে যাবে, তবে চাদর বালিশগুলাে বেশ নােংরা । যাকগে, রুকস্যাকে তাে যার যার চাদর আছেই, পেতে নিলেই হবে। টেবিলটাতেও বেশ ধুলাে পড়ে আছে, আলমারিটাও মনে হয় সাত জন্মে খােলা হয় না। সরকারি বাংলাে এত অপরিষ্কার কেন? কেউ কি ঝাড়পোঁছ করে না? ঘরের কোণায় একটা হারিকেন গড়াগড়ি খাচ্ছে। মরচে ধরা। মণিকুন্তলা গিয়ে তুলে দেখল হ্যারিকেনটা। তেল নেই।

ঝুলন জানলাগুলাে খুলে দিয়েছে। আলগা আলগা হাওয়া আসছে ভিতরে, ভ্যাপসা ভাবটা অনেকটা কেটে গেল। তবু একটা চিমসে গন্ধ যেন নাকে লেগেই থাকছে। সুপর্ণা খাটে বসেছে। বলল,– হ্যাঁ-রে, মশারি তাে দেখছি না? মশারি ছাড়া ঘুমালে কাল সকালে তাে ফুলে ওজন ডবল হয়ে যাবে! লােকটাকে বল।

মণিকুন্তলা অন্য খাটটায় গা ছড়াল,—আর হ্যা, চিঠিটাও দিয়ে আয়।

ঝুলন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল লােকটা চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। অবাক হয়ে বলল,—আপনার জল তােলা শেষ?

হুঁ দিদি।

কই, বাথরুমে আওয়াজ তাে পেলাম না।

কথাটা যেন শুনেও শুনল না লােকটা। বিনয়ী গলায় বলল,—দোকানপাট তাে সব বন্ধ হয়ে গেছে দিদি, আপনাদের রাতের খাওয়া কী হবে?

সত্যি তাে। ব্যবস্থা তাে একটা করতেই হয়। ঝুলন বলল,-কী করা যায় বলুন যদি আমার হাতের রান্না খান তো রেঁধে দিতে পারি।

আপনি রাঁধবেন ?

আপনারা অতিথি মানুষ আজ্ঞে। অতিথিকে খাওয়ানাে তাে পূণ্যের কাজ। কী খাবেন বলেন? চিকেন? মাটন? মাছ? ডিম? ভাত? রুটি?

চিকেন হলে মন্দ হয় না। সঙ্গে একটু ভাত। কিন্তু এত রাতে কি মুরগির বাবস্থা করতে পারবেন?

আজ্ঞে, আমার কোনও অসুবিধে নেই। লােকটা মৃদু হাসল,—তিনজনেরই তা হলে ভাত করি?

ঝুলন মনে মনে খুশিই হচ্ছিল। বলল, কিছু টাকা দিয়ে দেব কি?

দেবেনখন। আপনারা তাে আর পালিয়ে যাচ্ছেন না।

ঝুলন আরও বিগলিত হল,আপনি তাে খুব ভালাে লােক!

ও কথা বলবেন না আজ্ঞে। আপনাদের সেবা করা তাে আমার কর্তব্য।

তাই বুঝি ?…তা আপনার নামটা জানতে পারি?

আমি নীলকমল। নীলকমল মাল। বহুকাল এই বাংলােয় চাকরি করছি। সেই প্রায় শুরু থেকে।

ও। ঝুলন ঘরে যেতে গিয়েও দাঁড়াল, আমাদের চিঠিটা কিন্তু আপনি এখনও দেখেননি দাদা।

দরকার নেই দিদি। কোন মানুষ নকল, কোন মানুষ আসল, আমি দেখলেই টের পাই।…আপনি ঘরে যান দিদি, আমি আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা দেখি।

ঘরে এসে ঝুলন প্রশংসায় ফেটে পড়ল,—সত্যি, নীলকমল মালের তুলনা নেই। অন্দর থেকে মণিকুন্তলা আর সুপর্ণাও শুনেছে কিছু কিছু। প্রসন্নচিত্তে ব্যাগ থেকে নাইটি, হাউসকোট বার করে ফেলল তারা।

একে একে বাথরুমে যাচ্ছে। এক ফালি বাথরুমটা বেশ স্যাতসেঁতে, ঝুলও আছে প্রচুর। চৌবাচ্চার জলটা বেশ টাটকা। ছুঁয়েই বােঝা যায় একটু আগে তােলা হয়েছে। নীলকমল এত নিঃশব্দে কাজ করতে পারে?

হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে গুছিয়ে বসল তিন বান্ধবী। শরীর এখন অনেকটাই ঝরঝরে, পথ শ্রমের ক্লান্তি আর নেই। হাত-পা ছড়িয়ে ঠিক করছে কাল দিনভর কী কী করা হবে। ঝুলনের ইচ্ছে ভােরেই বেরিয়ে পড়বে ট্রেকিং-এ, পাহাড়টা তাকে টানছে। মণিকুন্তলার বাসনা একটু অন্যরকম। পাহাড়ের নীচের দিকে কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে, মণিকুন্তলা আগে সেগুলাে দেখতে চায়। তারপর একটা হেভি ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে পাহাড়। সুপর্ণার সাধ ভােরে আগে ঝরনা দেখতে যাওয়ার। সঙ্গে আশপাশের গ্রামও। তার মাসি বলেছে শুশুনিয়ার ঝরনাটা নাকি দেখার মতাে সুন্দর।

এমন একটা আলােচনার মাঝে বাইরে যেন কার একটা গলা! ভেজানাে দরজা খুলে বেরােল মণিকুন্তলা। পিছন পিছন সুপর্ণা, ঝুলন। গেটের কাছে একটা লােক দাঁড়িয়ে। বেঁটেখাটো, গাট্টাগােট্টা, গায়ে চাদর। শীত না পড়তেই এখানকার লােকরা এত চাদর জড়ায় কেন?

রুক্ষ গলায় লােকটা প্রশ্ন ছুঁড়ল,আপনারা কে বটে?

ঝুলন পালটা প্রশ্ন করল,—আপনি কে?

আমি এ বাংলাের কেয়ারটেকার।

চমকে উঠল তিন সখী। মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

বাইরে অন্ধকার একটু ফিকে এখন ? চাদ উঠেছে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। মরা-মরা জোৎস্না। ঝিঝি ডাকছে একটানা। কান্নার সুরে আবার কুকুর ডেকে উঠল কাছে পিঠে।

লােকটা এগােচ্ছে না। গেটে দাঁড়িয়েই বলল,আপনাদের ওই ঘর কে খুলে দিল?

নীলকমল বাবু। নীলকমল মাল। সুপর্ণা আমতা আমতা করে বলল,—উনি তাে বললেন উনিই এখনকার কেয়ারটেকার!

নীলকমলদা? নীলকমলদা এসেছিলেন ?

ঝুলন বলল,—আছেনও তাে এখনও। পিছনের রান্নাঘরে আমাদের জন্য রান্না করছেন।

নীলকমলদা আট বছর আগে মারা গিয়েছেন। আমার আগে উনিই ছিলেন এ বাংলাের কেয়ারটেকার। খুব ভালােমানুষ ছিলেন। অতিথি এলে প্রাণ দিয়ে যত্ন আত্তি করতেন। দু-দুটো ছেলে একসঙ্গে কলেরায় মারা যাওয়ায় মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একদিন ওই ঘরেই গলায় দড়ি দিয়ে…

মণিকুন্তলা সুপর্ণার হাত চেপে ধরল। প্রাণপণে গলায় জোর এনে বলল,বিশ্বাস
করি না।

আমি মিছে কথা বলছি না দিদি। উনি মারা যাওয়ার পর থেকে ওঘর আর খােলা হত না। একবারই শুধু আমি…

কেন ভয় দেখানাের চেষ্টা করছেন?

ঝুলন মণিকুন্তলার হাত খামচে ধরল। জিভ শুকিয়ে গেছে অজান্তেই, খরখর করছে তা।

বলছি তাে আমরা আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করছি না।

প্রমাণ পেলে বিশ্বাস হবে?

লােকটা আচমকা ফ্যাসফেসে গলায় হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই চাদরের ভেতর থেকে বার করল একটা হাত। হাতটা সটান লম্বা করে দিল। বাড়তে বাড়তে, বাড়তে বাড়তে হাতখানা মণিকুন্তলাদের পেরিয়ে চলে গেল। ঢুকে পড়েছে ঘরটায়। খাটের নীচ থেকে একটা মােটা দড়ি বার করল। দড়ি নিয়ে ফিরে আসছে হাতটা। নাড়ছে দড়ি। তিন বান্ধবীর মুখের সামনে। ফিসফিস করে বলল,—এই সেই দড়ি ।

আমিও এই দড়ির ফাস গলায় লাগিয়ে তিন বছর আগে…

এরপর তিন সাহসী কন্যের কী হল তা কি আর বলার দরকার আছে?

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত