সাত রঙের পাখি

সাত রঙের পাখি

সাতরঙা এক পাখি। পাখিটার রঙ সবুজ, লাল, হলুদ, বেগনি, নীল, কমলা, খয়েরি……, সব মেশান। এমন পাখি চোখে পড়ে না বড় একটা।

বনমালি সাধু পাখিটাকে দেখছে ক’দিন ধরে। দুপুরে এসে তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে বড় নিমের ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। আবার বিকেলের একটু আগে উড়ান দেয়। পাখিটা খুব বড় নয়। কিন্তু ছোটও বলা যায় না। বকের মতো হবে প্রায়।

বনমালি সাধু এখন বুড়ো হয়েছে। বাড়িতে বসে বসে খায়। তার দুই ছেলে গঞ্জে ব্যবসা করে। মাঝে মাঝে টাকা পাঠায় বাবাকে। বনমালি ছিল ফরেস্ট গার্ড। বনে বনে ঘুরত। কত পাখি চেনে, কত প্রাণী দেখেছে সে বনের ভিতর, মেটে খরগোস থেকে মস্ত হাতি পর্যন্ত। হেলে সাপ থেকে অজগর পর্যন্ত। জঙ্গলের ভিতরে বয়ে যাওয়া নদীর স্বচ্ছ আয়নার মতো জলে চকচকে রূপোর মতো মাছ, হাতি আর বাঘের জল খেতে আসা। নুন খেতে আসত হাতি। এই সব নিয়েই জীবন কেটেছে বনমালি সাধুর। এখন যে গ্রামে তার বাড়ি সেই কুসুমগ্রাম, কুসমা থেকে জঙ্গল বেশি দূরে নয়। অন্য জনা পাঁচ বনরক্ষী আছে। বনমালির কাছে তারা আসে মাঝে মধ্যে। সেদিন বনমালি সাধুর ঘরে বেশি করে রান্না চাপে।

হ্যাঁ, বনমালি সাধু একা থাকে। তার বউ বছর দুই আগে মারা গেছে এক মানুষখেকো বাঘের কামড়ে। এমন কেন হয়েছিল তা বনমালি আজও বুঝে পায় না। আর সেই ঘটনার পর তার দুই ছেলে গঞ্জে পাকাপাকি চলে যায়। গঞ্জে থেকেই ব্যবসা করতে থাকে। তারা আর আসবে না বলেছে এই গ্রামে। খুব চেষ্টা করেছিল বাবাকে হলদিগঞ্জে নিয়ে যেতে। বনমালি যায়নি। চাকরি ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু জঙ্গল ছেড়ে যেতে চায়নি যেমন, তেমনি কোন বাঘ তার বউকে মেরে দিল ঠিক দুপুরে এসে, তা খুঁজে বের করবে। কিন্তু কী করে খুঁজবে? বনের জন্তু বনে চলে গেছে। তার খোঁজ কে দেবে? বনমালির দুই ছেলে, যদু আর মধু বলেছে, তাদের বাবা যতই বলুক, বনের প্রাণীরা সব অহিংস, দরকার ছাড়া জীব হত্যা করে না, তা মোটেই সত্যি না। তাহলে তাদের মা মরল কেন?

বনমালির সঙ্গে তো বনের প্রাণীদের বিরোধ ছিল না কোনো। তাহলে সেই প্রাণীটা এল কেন বনের বাইরে বনমালির বাড়ি? বনমালি তারই জন্য এই বাড়ি ছেড়ে গঞ্জে যায়নি। তার মনে হিংসা নেই। কিন্তু সে বসে আছে

প্রাণীটির জন্য, শুধু জিজ্ঞেস করবে তার ছেলে মেয়ের মা কী করেছিল যে তাকে মেরে দিয়েছিল সে? বনমালির মনে হয় সে আসবে। আসবেই। হত্যাকারী একবার ফিরে আসে অকুস্থলে, কথাটা তাঁকে বলেছিল রেঞ্জার সায়েব। সে আবার আসবে বনমালি, তুমি সাবধান থেক, না হয় তুমি গঞ্জে চলে যাও। বনমালি সাধু যায়নি।

নিজে রেঁধে খায়। ভাত, আলু করলা সেদ্ধ, ডাল। এই তার খাদ্য। মাছ যদি পায়, তবে খায়। গ্রামের মানুষ যদি পুকুরে জাল ফেলে, বনমালিকে মাছ দিয়ে যায়। বন মুর্গি বা মেটে খরগোশ বনমালি খায় না। বনরক্ষীর কাজ করতে করতে সে ওই সব ত্যাগ করেছে। ছেলেরা তাকে ত্যাগ করেছে, অথচ বনমালি জানে সে কোনোদিন হিংসা করেনি। এই বনের বাঘ মানুষখেকো হয় না, তবু কেন হলো? তার বউ সুধাময়ীকে মেরে দিল। দুঃখে বনমালি কাজ ছেড়ে দেয়। কাজ ছেড়ে দেওয়ার দু’মাস বাদে বনের ভিতরে আবার দুটি লোক মরেছিল বাঘের থাবায়। সেই খবর পেয়েছিল বনমালি। ইস, জঙ্গল কি হিংসায় ভরে যাবে! আগে তো এমন হত না।

বনমালি দেখছে পাখিটা বসে আছে নিমডালে। গাছটি অনেক বড়। এই বসন্তের সময় ফুল ফুটিয়েছে। সন্ধেবেলায় নিম ফুলের গন্ধ ছেয়ে থাকে এই বাড়ি। বাড়ির ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে আর টালির চাল। বনমালি সাধু বারান্দা থেকে উঠে উঠনের দক্ষিণ কোণে গেল। পাখিটাকে দেখবে ভাল করে। বনের কাজ সে দু’বছর ছেড়েছে মাত্র। সে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁ করে পাখিটাকে দেখতে থাকে। এমন পাখি তো বনের ভিতর দ্যাখেনি কখনো। অদ্ভুত। সে যেন বনমালিকে চেনে। জানে বনমালি কেমন মানুষ। তাই ভয় পাচ্ছে না। উড়ে যাচ্ছে না। বনের পাখিদের সঙ্গে তার এমনি ভাব ছিল। কিন্তু বনে কত রকম কত পাখি। সবাই কি তাকে চিনত? কেউ কেউ তো উড়াল দিত বনরক্ষী বনমালি সাধুকে দেখে। হাজার হলেও মানুষ তো। মানুষকে কি বিশ্বাস করা যায়। কত রকমে পাখি ধরে, পাখি মারে। ফাঁদ আছে, গুলতি আছে, জাল আছে। বনমালি পাখিদের এসব কথা জানত। পাখিদের অনেক কথা ধরতে পারত। জঙ্গলে ঘুরত বলে এমন পারত সে। এখন ভুলে যাচ্ছে।

বনমালি বলল, হুস হুস।

অন্য পাখি হলে উড়ে যেত। কিন্তু এই পাখি ঘাড় নামিয়ে তাকে দেখল। তারপর আবার দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বনমালি তখন ঘরে যায়। মুড়ি আর বিস্কুটভাঙা এনে ছড়িয়ে দিল উঠনে। পাখি আবার দেখল, কিন্তু নেমে এল না। বনমালি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। তার উঠনে এই একটিই বড় গাছ। বাড়ির পিছনে বাগান। জামরুল, পেয়ারা, আম, আতা, নোনা, করমচা। কিন্তু কোনো ফলই বনমালির জন্য নয়। আগে যদিও খেত সিজিনের আম, পেয়ারা, জামরুল বা করমচা, এখন খায়ই না। পাখিদের জন্য দিয়ে দিয়েছে। পাখিরাই খায়। আরো নানা রকম ফল আছে। বনমালির বাড়ির পিছনে তাই পাখিদের কলকাকলি লেগেই থাকে। কোনো পাখি শিস দেয়, কোনো পাখি গান গায়, কোনো পাখি ডানায় তালি দিয়ে দিয়ে নাচে। এসব বনমালি বুঝতে পারে। এই পাখি কিন্তু ফলের বাগানে না গিয়ে এই গাছে এসে বসে। নিমফল এখনো জন্মাতে দেরি আছে। সবে ফুল ফুটেছে। বনমালির কী মনে হলো, পাখিটার কোনো উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য না হলে সব দিন ঠিক পথ চিনে তার বাড়ির নিম গাছে এসে বসে? অবশ্য পাখিরা এমন। আকাশে ওড়ে দিক ঠিক করে। তাদের পথ চিনতে অসুবিধে হয় না। বনমালি চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই পাখি, তুমি এখানে এসে বস কেন প্রত্যেকদিন?

পাখি মাথা নিচু করে বনমালিকে দেখল। মনে হলো যেন হাসল তার লম্বা গোলাপি চঞ্চু ঘুরিয়ে। উত্তর দিল না। কিন্তু বনমালি বোঝে পাখি তার কথা বুঝেছে। না বুঝলে মাথা নিচু করে হাসত না। বনমালি বলল, আমি বসে আছি সেই খুনিটার জন্য, যে আঁচড়ে কামড়ে আমার বউ সুধাময়ীকে মেরে গিয়েছিল। সুধাময়ী কত ভালবাসত জঙ্গল আর তার প্রাণীদের। কীট পতঙ্গকেও ভালবাসত।

পাখিটা আচমকা গম্ভীর গলায় কী যেন বলে উঠল, বনমালি শুনল, “আমিও বসে।”

“তুমি কে?” বনমালি জিজ্ঞেস করে।

পাখি আর উত্তর দেয় না। বনমালি জিজ্ঞেস করল, “বুঝলাম না।”

পাখি গম্ভীর গলায় বলল যা, তা আন্দাজ করে বনমালি, বুঝল, পাখি বলছে, তারা আসুক।

“কারা তারা?” বনমালি জিজ্ঞেস করল।

“তারা আসবে।” পাখি বলল।

“কিন্তু তুমি কে বলো দেখি সত্যি করে?” বনমালি আবার জিজ্ঞেস করে।

পাখি বলল, “আমি তাদের চিনি।”

অবাক হয়ে গেল বনমালি। কী শুনল সে। সুধাময়ীর হত্যাকারীর জন্য পাখিটা তার মতো বসে আছে। “পাখি পাখি, তুমি কে?”

পাখি বলল, “আমি পাখি, আমার নাম সাতরঙা চন্দনা। তুমি আমাকে চন্দনা বলো।”

“চন্দনা কি এত বড় হয়? আমি তোমাকে তো বনের ভিতর দেখিনি।”

পাখি বলল, “আমি পাহাড়ি চন্দনা, সেই উত্তরের পাহাড়ে থাকি, হিমগিরি, সেখেনে সব বরফে ঢাকা, বরফের উপর সূর্য কিরণ পড়ে শাদা রঙ বিচ্ছুরিত হয়ে সাতরঙ আমার গায়ে লেগে এমনি হয়ে গেছে, আগে আমি বরফের মতো শাদা ছিলাম, শ্বেত চন্দনা, সেদিন উড়ে যাচ্ছিলাম আকাশ দিয়ে, দেখি একজন আমাকে ডাকছে, ‘এই পাখি, এই পাখি, আয় আয়, আয় নারে পাখি।’ ”

কিছুই জানে না বনমালি। সুধাময়ীর সঙ্গে এই পাখির খুব ভাব হয়েছিল। তখন কার্তিক মাস। মাঠে পাকা ধান। উত্তরের হিমালয়ে খুব শীত। উপর থেকে পাখিরা তখন নেমে আসে সমতলে। তেমনই এসেছিল সে। উড়ে যাচ্ছিল দূর দক্ষিণে, যে দেশে শীত কম। বড় বড় জলাভূমি, সরোবর। সরোবরে গা ডুবিয়ে ভেসে থাকায় খুব আরাম। সেই দিকেই উড়ে যাচ্ছিল সে। যেতে যেতে মাঠের হলুদ ধান দেখে ইচ্ছে হয়েছিল একটু খেয়ে আবার উড়ে যায়। তখন এই বাড়ি থেকে ডাক এসেছিল, “ও পাখি, সাতরঙা পাখি, আয় না রে পাখি আয় না, আমায় দেখে যাও না।”

চন্দনা তখন তার সাতরঙ নিয়ে নেমে এসেছিল ঠিক দুপুরে। সে নামতেই এই উঠোন সাত রঙে আলো হয়ে গেল। সুধাময়ী কী খুশি! কিন্তু তা যদি হয়, এখন তো সাতরঙের আলো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না ? পাখি বলল, রঙ সে লুকিয়ে রাখে। রঙের বিচ্ছূরণ হতে দেয় না। রঙের আলো দেখে সে এসেছিল তাকে ধরতে। তারা কারা?

পাখি বলল, “গুহি আর দহি, দুই স্যাঙ্যাত।”

“গুহি দহি, চিনি না তো?” বনমালি অবাক।

“তারা হাতির দাঁত, হরিণের চামড়া, আর রঙিন পাখি–এই নিয়ে ব্যাবসা করে।” পাখি বলল।

“আমি কি সত্যিই চিনিনে তাদের, বনের ভিতরে তো ঢুকতে হবে তাদের, না হলে হাতির দাঁত পাবে কোথায়, হরিণের চামড়াই বা আসবে কোথা থেকে?” বনমালি বলল। একটু ভেবে দেখল। তার এলাকায় হরিণ মেরেছিল কেউ? মনে পড়ে না। হরিণ না মারলে তার চামড়া পাবে কোথা থেকে? হাতি মরেছিল। হাতি মরে গেলে তবে না তার দাঁত কেটে নেয় পোচাররা। তবে হাতি তো নির্জনে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। কেউ জানে না জঙ্গলের কোন গভীরে গিয়ে সে শুয়ে পড়ে আকাশের নিচে। অপেক্ষা করে কখন মৃত্যু আসবে। খোঁজ রাখে পোচাররা। মানে যারা হাতির দাঁত মরা হাতির মুখ থেকে কেটে নেয়, তারাই খোঁজ রাখে দলছাড়া হাতি কোথায় গিয়ে শুয়ে পড়ছে মৃত্যুর জন্য।

পাখি বলল, সেদিন সাত রঙের আলোয় ভরে গিয়েছিল এই উঠন। তার জন্য ভাত আর বারোমেসে পাকা পেয়ারা, পাকা টম্যাটো খেতে দিয়েছিল বনমালির বউ সুধাময়ী। সে যখন খাচ্ছে তখন গুহি দহি দুই শয়তান যাচ্ছিল বনের দিকে। তাদের হাতে পাখি ধরার জাল ছিল। তারা দেখল বনমালি সাধুর বাড়ির উঠনে সাতরঙের আলো। আলো দিন দুপুরেই ঝলমল করছে। তারা বনমালিকে খুব ভয় করে। পাখি ধরার জাল হাতে ধরতে পারলে কোমরে দড়ি বেঁধে চালান করে দেবে। তারা দেখল বনমালি নেই। তবু গুহি নামের রোগা টিংটিঙে লোকটা এসে জিজ্ঞেস করল, “বনমালিভাই আছে গো সুধাদিদি ?”

“সুধাদিদি বলল?” অবাক হয়ে যায় বনমালি।

“হ্যাঁ, তাই বলল, তখন সুধা মা বলল, তিনি তো বনে গেছেন।”

সুধা মা কথাটা বলা মাত্তর জাল নিয়ে ছুটে এল আর একটা দুর্জন দহি। “আরিব্বাস, কী সুন্দর পাখি। লাখ টাকায় বিক্রি হবে। বলতে বলতে জাল ছুঁড়ে দিল আমার উপর। আমি আটকা পড়ে গেলাম। তারা আমাকে ধরে ফেলেছে। জাল গুটিয়ে নিতে লাগল। আর তাই দেখে সুধা মা ছুটে ঘরে গিয়ে কাটারি নিয়ে এল, ‘তোরা ওরে ধরলি শয়তান!’ তিনি জাল কেটে দিতে লাগলেন। তখন দহি আর গুহি দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর উপর। তাদের হাতে লম্বা বাঁকানো নখ। নখে থাবা মারল জন্তুর মতো। লম্বা আর বাঁকানো নখ দিয়ে তারা মেরেছিল সুধা মাকে। আমি আবার এসেছি তার জন্য। ঠুকরে মেরে ফেলব দুই শয়তানকে।”

বনমালি সাধু মনে করতে চাইল কে দহি কে গুহি। মনে তো পড়ে না। লম্বা নখ! নখ নয় বাঘনখ। বাঘের থাবায় যেমনি থাকে তেমনি ধারাল নখ। কামার জানে। কামারের বাড়ি গেলে জানা যাবে কে তৈরি করেছিল অমন। কামারের নাম গণেশ। গণেশকে জিজ্ঞেস করবে সে। তাহলে বনের জন্তু নয়, বনের বাইরে বাস করা এই গ্রাম সেই গ্রামের জন্তু। খুব রোগা? খুব রোগা কি কেউ আছে এই গ্রামে?

পাখি উড়ে গেল বনের দিকে। বনের ভিতরে এক নদী আছে, সেই নদীতে ভেসে থাকে সে। সে চলে যেতে বনমালি ঘরে তালা দিয়ে গণেশ কামারের ঘরে গেল, সে তখন হাপর টানছে চুল্লির। লোহা লাল টকটকে করে বাঁকিয়ে দা কুড়োল তৈরি করছে। বনমালিকে দেখে তার মুখ অন্ধকার, বলল, “এস সাধুভাই, কী লাগবে বলো।”

বনমালি বলল, “কিছু লাগবে না, আমি গাছ কাটি না মানুষ মারি, হ্যাঁ কামারভাই, তুমি বাঘের মতো নখ তৈরি জানো, বাঁকানো নখ?”

গণেশ জিজ্ঞেস করল, “কেন গো?”

“যা জিজ্ঞেস করছি বলো।” বনমালি বলে।

গণেশ বলল, সে জানত না, দুটো লোক ছবি এঁকে নিয়ে এসেছিল, তারা জানে, ছবি দেখে লোহা নখের মতো বাঁকিয়ে বাঘনখ করে দিয়েছিল।

“দুটো লোক কারা?”

গণেশ বলল, “আমি জানিনে ভাই, তারা দামও দেয়নি।”

“সত্যি বলছ?” বনমালি জিজ্ঞেস করে।

“সত্যি সত্যি সত্যি।” গণেশ বলল, “পরে দিয়ে যাবে বলেছিল, কিন্তু আর আসেনি।”

“তাদের খোঁজ চাই আমার,” বনমালি বলে।

গণেশ বলল, “তুমি গঞ্জে যাও, সুরেন সামন্ত আমার মাসতুতো ভাই হয়, তাকে জিজ্ঞেস করো, তার পরিচয়েই এসেছিল।”

পরদিন সকালে বনমালি গেল গঞ্জে। ছেলেরা থাকে। তারা সব শুনে বলল, “বাবা, আর কী হবে, মা আমাদের গেছে, পাখিটা না এলে এমন হত না।”

“পাখির কী দোষ!” বনমালি রাগ করল।

দুই ভাই বলল, “পাখি না এলে কি এমন হতো?”

বনমালি কোনো কথা বলল না। গেল সুরেন সামন্তর বাড়ি। সুরেন শুনে বলল, তাদের তো সে চেনে না, তারা এসেছিল জিতেন কুন্ডুর কাছ থেকে। কুন্ডুর মুখোসের ব্যবসা, কুন্ডুর কাছ থেকে মুখোস কিনত তারা, কুন্ডুর কাছে গিয়ে খোঁজ করতে হবে তারা কারা।

জিতেন কুন্ডুর কাছে গেল বনমালি। জিতেন লোকটা বেঁটে আর কালো। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে। নিজে নিজে মুখোস বানায়। বাঘ, সিংহ, হাতি, রাক্ষস, গণেশ ঠাকুর এমনি কত। কতরকম মানুষের মুখ। সে সব শুনে বলল, হ্যাঁ, দুটি লোককে সে পাঠিয়েছিল বটে সুরেন সামন্তর কাছে, তার কাছে এসেছিল তারা মুখোস কিনতে। কী মুখোস? না মানুষের মুখোস। বাঘের মুখোস। সিংহের মুখোস। তারা তখন জিজ্ঞেস করেছিল কামারের কথা। সে জানত সুরেন সামন্তর মাসতুতো ভাই কামারের কাজ করে। দুবছর রথের মেলায় তার কাছ থেকে সে ছুরি কিনেছিল মুখোসের শোলা কাটার জন্য।

বনমালি জিজ্ঞেস করল, “তারা কি এমনি এসেছিল?”

“না, তাদের পাঠিয়েছিল যাদব আর মাধব সাধু, তারা বিদেশে মুখোস পাঠায় তার কাছ থেকে কিনে।”

“যাদব মাধব, যদু, মধু?”

“হ্যাঁ, এখনো নেয় তারা দুইজন, আমেরিকা ইংল্যান্ড কত দূরের দেশে মুখোস পাঠায়।”

বনমালি ছেলেদের বাসায় এসে জিজ্ঞেস করল, “ওদের তোরা চিনলি কী করে যদু মধু?”

যদু মধু চুপ। তারপর যদু বলল, সে চিনত গুহিরামকে, সঙ্গে এসেছিল দহিরাম, তারা সাহায্য নিতে এসেছিল। কিসের সাহায্য, না একজনের খুব অসুখ তাই টাকা তুলে বেড়াচ্ছে। পরে জেনেছিল সব মিথ্যে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুখোস কোথায় পাওয়া যায়।

বুঝল সব বনমালি। ছেলেরা কিছুই জানত না, কিন্তু অজান্তে সাহায্য করেছে দুই খুনিকে। তারা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুখোস আর বাঘনখ কিনে বনে যাওয়া শুরু করেছিল। চোখে জল এসে গেল বনমালি সাধুর। তার দুই ছেলে খুব ভালো। তারা জানে না তাদের মায়ের মৃত্যুর জন্য তারাও দায়ী। সেই দুজনকে না সাহায্য করলে, মুখোস কিনতে না পাঠিয়ে এসব কিছুই হত না। এখন খুঁজে বের করতে হবে দুজনকে। যদু মধু বলল, “বাবা, তুমি কী করে জানবে, তারা দুজন কেউ বেঁচে নেই।”

“কী করে?” বনমালি জিজ্ঞেস করে, “তোদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল।”

“না বাবা, কিন্তু তারা দুজনেই তো বাঘনখ কিনেছিল, সেই নখ দুজনে দুজনের গায়ে বসিয়ে দিয়েছিল বাবা, আমরা বুঝলাম।”

“তাই?” বনমালি বলল, “বনের ভিতরে ঝিমি নদীর তীরে?”

“হ্যাঁ বাবা, বাঘ দুটো লোককে মেরে গিয়েছিল, তুমি জান না?”

“জানি তো, তোর মায়ের মৃত্যুর দুমাস পর, আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসতেই হয়েছিল।”

যদু বলল, “বাবা সেই গুহি আর দহি, বাঘ মারেনি, হাতির দাঁতের ভাগ নিয়ে গোলমাল লাগতে ওই হয়েছিল বাবা।”

“তোরা বুঝেছিলি?” বনমালি জিজ্ঞেস করে।

“ না, এখন বুঝলাম, তারা বনে গিয়েছিল হাতির দাঁত আনতে,” মধু বলল, “তারপর একে অন্যকে ফাঁকি দিতে গেল লোভে পড়ে, তাই বাঘনখ নিয়ে অন্ধকার রাতে দুজনে দুজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিষ মাখানো বাঘনখ ! বনমালি সাধু মন খারাপ করে ফিরে এসেছিল পরদিন। সারাদিন উঠনে নিম গাছের নিচে বসে ছিল পাখিটার জন্য।

কিন্তু সেই সাতরঙা পাখি আর ফিরে আসেনি। আসেনি বটে। বনমালি জানে বসন্তকালের পর গ্রীষ্ম এলে, পাতা ঝরার পর জঙ্গলের গাছে গাছে কচি পাতা জন্মালে পাখি হিমগিরির দিকে যাত্রা করবে। ফিরে যাওয়ার পথে নিশ্চয় তার সঙ্গে দেখা করে যাবে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত