আমাদের মেনি যে মানুষ হিসেবে মোটেই সুবিধের নয়, সেটা বোঝা গেল বাচ্চা হওয়ার পর। তখন থেকেই সে তাদের কাছে কেরামতি দেখাবার জন্য ভীষণ শিকার করা আরম্ভ করে দিল। একদিন ছুঁচো মারে, তো পরেরদিন ঘুঘুপাখি। একদিন তো কাঠবেড়ালির ছানাটাকে আরেকটু হলে মেরেই ফেলছিল। নেহাত ছাতারে পাখিগুলো কিচমিচ করে ওকে সাবধান করে দেওয়ায় ও পোঁ-পাঁ দৌড়ে পেয়ারাগাছের কোটরে সোজা মায়ের কাছে চলে গেল। পরের দিন মরল একটা ছাতারে। কে না জানে এটাও মেনির কীর্তি। আর সেগুলো সে আমাদের বারান্দাতে সাজিয়ে সাজিয়ে রেখে যেতে লাগল।
বাবা বলল, “ওগুলো আসলে আমাদের ও উপহার দিচ্ছে। আমরা খেতে দিই বলে আমাদের ওপর খুশি হয়েছে, তাই।”
মা বলল, “তাহলে তো দেখছি আর খেতে না দেওয়াই ভালো। অমন ছিরির উপহারের দরকার নেই। বেচারা পাখিগুলো কী দোষ করেছে যে ওদের খামোখা ধরে ধরে মারছে?”
মা রেগে গিয়ে খাবার পর এঁটোগুলো বারান্দায় মেনির বাটিতে না দিয়ে বাইরে কুকুরদের দিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
ওরা মানে মেনি আর তার তিনটে ছানাপোনা। আমি তাই দেখে দয়া দেখিয়ে বাটিতে করে দুধ ঢেলে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় ওদের খেতে দিলাম। মেনিটা অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সবটুকু দুধ সাবাড় করে দিল। বেচারা বাচ্চাগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আমি আবার বাটি ভরে দুধ নিয়ে এলাম। কিন্তু নিচে দিলেই মেনি খেয়ে নেবে বলে হাতে নিয়ে ছানাদের ডাকতে লাগলাম চুক চুক করে। ছানাগুলো কিন্তু টবের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল, এমনই লজ্জা তাদের। এদিকে মা বেড়ালটা নির্লজ্জের মত ম্যাও ম্যাও করেই চলেছে ওপর দিকে তাকিয়ে। পারলে হাত থেকে কেড়ে খায়। আমিও ওকে দেব না কিছুতেই ঠিক করেছি। বেড়াল ছানাগুলোকে টেনে টেনে আনা আর একই সঙ্গে মেনিকে ঠেকিয়ে রাখা কি সোজা কাজ? যাই হোক, দুটো ছানাকে এইভাবে খাওয়ানো গেলেও সবচেয়ে যে লাজুক, তাকে খাওয়ানো গেল না কিছুতেই। তাকে ধরতে যেতেই সে চোখ-কান বুজে ঝুপ করে বাগানে লাফ দিল। এই প্রথম সে বোধহয় নিজে এক লাফে বাগানে ল্যান্ড করল।
আমিও ছাড়ার পাত্র নই। ওকে ধরবার জন্য আমিও বাগানে নামলাম, হাতে দুধের বাটি। তাতে আবারও দুধ ভরে নিয়েছি। আমি বদ্ধপরিকর, একে আজ দুধ খাইয়েই ছাড়ব। এর মা-টা অপদার্থ, নিজে সব দুধ খেয়ে নেয়, ছানাগুলোকে খাওয়ার সুযোগই দেয় না। বাগানে লাজবন্তী বেড়ালছানা ছুটছে, তার পেছনে আমি ছুটছি, আর আমার পেছনে মেনি ছুটছে। আমার হাত থেকে চলকে পড়ে যাওয়া দুধগুলো চেটে চেটে খাচ্ছে বেহায়ার মতন।
ছানাটা পিটুনিয়ার ঝাড়ের মধ্যে ফুলের তলা দিয়ে অদৃশ্য অবস্থায় খানিকটা গিয়ে হেজের বেড়ায় ঢুকে পড়ল। তারপর আমি নিচু হয়ে তাকে দেখতে যেতেই তিরবেগে বেরিয়ে লেবুগাছ পার হয়ে দেবদারুগাছের সারির আড়ালে সেঁধিয়ে গেল। আমি যত ওকে বোঝাতে চেষ্টা করি, আরে বাপু, তোর ভালোর জন্যই আমি বাটি হাতে ছুটে বেড়াচ্ছি, কে কার কথা শোনে। অবিশ্যি আমিও মাঝে মাঝে খাওয়ার ভয়ে মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু সে তো আমার মা আমাকে বেশি বেশি খাওয়ায় বলে। আর মেনি মোটেই ছানাদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে অত ভাবে না। হুলো তো নয়ই। ফলে এদের পেরেন্টাল কেয়ারটা কম। এরকমভাবে চললে এরা ক’দিন বাঁচবে? ওই তো টিপ-বোতামের মতন চেহারা।
গেটের সামনে এসে প্রায় ওকে ধরে ফেলেছি, এমন সময় ও তড়াং করে পাঁচিলের ওপর চড়ে পড়ল। ও যে এতটা লাফাতে পারে সেটা বোধহয় নিজেও জানত না। পাঁচিলের ওপারেই রাস্তা। আকচার গাড়ি যাচ্ছে। ওপাশে লাফিয়ে পড়লে বিপদ। আমি তাড়াতাড়ি গেট খুলে বাইরে গেলাম। ওদিক থেকে তাড়া দিলে বাগানের মধ্যেই লাফাবে। মেনিও স্বর পালটে ওকে সাবধান করে দিল। ফলে ও বাধ্য ছানার মতো কিছুক্ষণ পাঁচিলে বসে থেকে এপারে নেমে মেনির কাছে গেল। আমি গেটের সামনে দুধের বাটিটা রেখে একটু তফাতে গেলাম। গিয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়। যথারীতি মেনি হামলে পড়ল। তবে এবার দেখলাম লাজুকলতাটিও মেনির সঙ্গে সঙ্গে আসছে বাটির দিকে। আহা, একটু দুধও যদি ওর পেটে যায়, তাহলেই আমার এতক্ষণের ছোটাছুটি সার্থক হয়। কিন্তু মেনির অতবড় মুখে বাটির সবটুকু ঢেকে রয়েছে। ও বেচারা বাটিতে মুখ দিতে না পেরে মেনির দুধই খেতে লাগল।
আরে, এটা তো খেয়াল করিনি! মেনি আমার আনা আমুল গোল্ড খেল, আর মেনির দুধ খেল ছানাটা। কাজেই পরোক্ষে মেনির খাওয়া মানেই ছানাটারও খাওয়া। এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? এমন সময় দেখি মেনি বাটি থেকে মুখ তুলল। বলল, নে খা। ছানাটা শুঁকে-টুকে নিয়ে আবার মেনির দুধই খেতে লাগল। ওটাই ওর কাছে সুবিধেজনক। মা থাকতে কে আর বাটি থেকে দুধ খায়। অগত্যা মেনি চেটেপুটে সবটুকু দুধ খেয়ে রোদে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল আর বড়ো সেফটিপিনে যেমন ছোটো ছোটো সেফটিপিন লাগানো থাকে, সেরকম ছানাগুলো তার কোলের কাছটিতে শুয়ে দুধ খেতে লাগল।
এ তো গেল দু’সপ্তাহ আগেকার কথা। আজকাল সেই লাজুক ছানাটা লায়েক হয়েছে। আমাদের জানালার একটা জালের ছেঁড়া ফোঁকর গলে ঘরে ঢোকা শুরু করেছে। সেটা দিয়ে ওর মা ঢুকতে পারে না। আমাদের ঠিক খেতে বসার সময় ও ওখান গলে ঢুকে আসে বাড়ির মধ্যে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সে বীরদর্পে সোফার পেছনে টিকটিকি শিকার করছে। লজ্জা-শরমের বালাই নেই। আমায় দেখেই খুশি হয়ে টিকটিকির লেজটা এনে আমার সামনে রেখে দিল। সেই যে সেদিন দুধ খাইয়েছিলাম তার ফল। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে সেদিনও যেমন ও আমার দেওয়া দুধ খায়নি, আমিও ওর অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ওর দেওয়া টিকটিকির লেজটা খেলাম না।