দক্ষিণ পাড়ায় সিংহরায়দের সাতপুরুষের বাস। তারাচরণ সিংহরায় পরিবারের বর্তমান কর্তা। তারাচরণের তিন ছেলেই করিৎকর্মা। বড়োটি সিমেন্টের ডিলার, মেজটির পেট্রোল পাম্প আছে, তার ছোটো ছেলে তারই মতন দেওয়ানি কোর্টের উকিল। পসার বেশ ভালো। পাড়ায় বড়োলোক বলে সিংহরায়দের বেশ নামডাক আছে। লোকজন খাতিরও করে। যদিও আড়ালে আবডালে কেউ কেউ নিন্দে করতেও ছাড়ে না। বলে, সিংহরায়দের টাকা আছে কিন্তু কালচার নেই।।
তারাচরণ মনে করে জীবনে টাকাটাই হল আসল। অর্থ রোজগার করা ছাড়া জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। সিংহরায় বাড়ির ছেলেরা প্রায় সকলেই লক্ষ্মীর সাধনাই সদাই ব্যস্ত। যারা রোজগার ছেড়ে অন্য কাজে সময় নষ্ট করে তারা ক্ষমার অযোগ্য বলে তারাচরণের বিশ্বাস। তবে একটি ব্যতিক্রম আছে। তারাচরণের বড়ো ছেলের একমাত্র পুত্র রূপক। ঠাকুরদাদার সঙ্গে তার কোনোকালেই মতের মিল হয় না। রূপক সে-কথা প্রকাশ্যে বলেও বেড়ায়। এ-কারণে তারাচরণ তার নাতিটিকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁর মতে রূপক বংশের কুলাঙ্গার।
রূপক এ-বাড়ির অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। অর্থ উপার্জনকে সে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করে না। তার মন যা চায় সে তার পিছনে ছুটে বেড়ায়। এই তো কদিন গিটার নিয়ে পিরিং পারাং করল খুব। কী একটা গান না স্লোগান নিয়ে সম্পূর্ণ বেসুরে চিল্লাত
সারাদিন থাকি আমি অনলাইন খবরে,
রাত্রিতে ঘুমোতে যাই ঠান্ডা এক কবরে,
এসেছে সময় জবাব দিতে হবে,
এবার বন্ধু হিসাব নিতে হবে।
তার আগে কিছুদিন ছিল ছবি তোলার বাতিক। আর এখন ধরেছে পুরোনো ও দামি জিনিস খোঁজার নেশায়।
তারাচরণের ছোটো কাকা মতিলাল ছিল অনেকটাই রূপকের মতো। বাউন্ডুলে, ভবঘুরে। তিনতলার ছাদে ছোটো ঘরটাতে সারাদিন কীসব পড়াশোনা করেই কাটাত মতিলাল। হুটহাট করে বাড়ি থেকে কোথায় যেন উধাও হয়ে যেত। মাস-দুয়েক পর ফিরে এসে বলত গঙ্গোত্রী ঘুরে এলাম। আবার কখনো মেদিনীপুরের আদিবাসীদের গ্রামে মাসখানেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরত। একবার তো সুন্দরবন থেকে দু-খানা কচ্ছপের বাচ্চা ধরে এনেছিল। এ-বাড়ির কেউ তাকে ভাল চোখে দেখত না। তারাচরণও তার ছোটো কাকাকে কোনোদিনই পছন্দ করত না। কাজে-কর্মে মন নেই, হঠাৎ করে যেখানে সেখানে চলে যাওয়া এসব তারাচরণ মেনে নিতে পারত না। শুধু তারাচরণ কেন সিংহরায়-দের বাড়িতে বড়োরা এখনো যখন ছোটোদের শাসন করে তখন বলে, লেখাপড়ায় মন নেই, কাজে-কর্মে চেষ্টা নেই শেষ কালে কি মতিলাল হবি? মতিলালের জীবনটা যেন একেবারেই বৃথা, কোনো কাজেই লাগল না।
সকালবেলা সেরেস্তায় যাওয়ার সময় তারাচরণ দেখল ছোটো কাকার ছাদের ঘরটাতে রূপক একগাদা কাগজ আর আদ্যিকালের পুরোনো জিনিস-পত্র ছড়িয়ে কী যেন খুঁজছে।আজ কদিন হল সারাবাড়ি খুঁজে ছেলেটা যত রাজ্যের বাতিল পুরোনো সব জিনিস জড়ো করেছে। বেলজিয়াম কাচের ঝাড়বাতি, ইটালিয়ান মার্বেলের মূর্তি, ফরাসি আতরদানি, আরও কত কী। দুপুরে খাওয়ার পরে সেরেস্তায় যাওয়ার পথে তারাচরণ একবার ছাদে উঠে দেখে এসেছে। ছেলেটা ছোটো কাকার পুরোনো ছবি, বই-খাতা, কাগজপত্রের জঙ্গলের মধ্যে কী যেন খুঁজছে। তারাচরণ মনে মনে ভাবল ছেলেটার মাথায় গণ্ডগোল আছে।
সন্ধ্যাবেলায় ছাদে হাওয়া খাওয়া তারাচরণের বহুদিনের অভ্যাস। আজ ছাদে এসে তারাচরণ অবাক হয়ে গেল। মতিলাল চলে যাওয়ার পর আর তার ঘরে কোনওদিন আলো জ্বলেনি। আজ আলো জ্বলছে। মতিলাল শেষবার বাড়ি ছেড়েছিল উনিশশো ছেচল্লিশ সালে। মাসখানেক ধরে পাখি সংক্রান্ত বই পড়ে, হঠাৎ তিনি চললেন অসমের জঙ্গলে পাখি দেখতে। চারিদিকে তখন দাঙ্গা, গণ্ডগোল। সবাই বারণ করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
মতিলাল আর বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেল লোকটা? কী হল তার? কেউ জানে না। এর ঠিক একবছর পর মতিলালের নামে সিংহরায় বাড়িতে একটা বাক্স আসে, ডাক-এ। তাতে না ছিল টাকা-পয়সা, না ছিল কোনও দামি জিনিস। কতগুলি চিঠি, কখানা বই আর কী-সব আজে বাজে জিনিসপত্র। এসবে সিংহরায়দের কোনও আগ্রহ ছিল না। তাই বাক্সটা ছোটোকাকার ঘরেই পড়ে আছে আজও।
তারাচরণ মতিলালের ঘরটার কাছে গেল। আঙুল দিয়ে আলতো চাপ দিতেই দরজার পাল্লা দুটো সরে গেল দুদিকে। ঘরের থেকে খানিকটা আলো ছিটকে এসে ছাদের অন্ধকার কমিয়ে দিল বেশ কিছুটা। বিস্মিত তারাচরণ দেখল ছোটোকাকার ঘরটা ঝকঝক করে পরিষ্কার করা। মেঝেতে আলপনা দেওয়া হয়েছে যত্ন করে। টেবিলের ওপর মতিলালের বই-খাতা পরিপাটি করে সাজানো। টেবিলের কাচের তলায় কাকার ক-খানা চিঠি। চেয়ারের ওপর সাদা কাপড় পেতে মতিলালের একটা বাঁধানো ছবি রাখা। তাতে আবার রজনীগন্ধার মালা পরানো।
নিতান্ত অবজ্ঞার অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরটার এই হঠাৎ পরিবর্তনে তারাচরণ অবাক না হয়ে পারল না। ঘরের দরজায় শিকল তুলে হাতটা নামাতেই দেখল, পাশের দেওয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা পোস্টার, লেখার ছিরি দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হল না যে এ-লেখা রূপকের ছাড়া আর কারও হতে পারে না। পোস্টারে লেখা আছে, মতিলাল সিংহরায় কক্ষ। উনিশশো ছেচল্লিশ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচারের প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন বিপ্লবী মতিলাল সিংহরায়।